বন্ধ হোক হিল-খাটানোর বর্ণবাদী চিন্তা ও অপচর্চা

প্রশান্ত ত্রিপুরা
Published : 4 June 2016, 04:13 AM
Updated : 4 June 2016, 04:13 AM

অনেকটা জেল-খাটার মতো অর্থে ব্যবহৃত 'হিল-খাটা' কথাটা আমি প্রথম শুনেছিলাম পনের বছর আগে। রাঙামাটি থেকে বান্দরবান বা সেরকম কোথাও যাচ্ছিলাম গাড়িতে করে, একজন বিদেশি নাগরিকসহ, যে কারণে নিয়ম মোতাবেক দুই জন পুলিশ কনস্টেবলও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তাদের একজন অসুস্থ হয়ে পড়াতে আমরা রাস্তায় বিরতি নিয়ে ও পানি দিয়ে সহায়তা করেছিলাম। এরপর তাদের সঙ্গে বিভিন্ন আলাপের ফাঁকে একজন খুব সরল ভঙ্গীতে আমাকে জানিয়েছিলেন, তাঁর 'হিল-খাটা' প্রায় শেষ। কথোপকথনের প্রেক্ষাপট থেকে বুঝেছিলাম, 'হিল-খাটা' কথাটা তিনি ব্যবহার করছিলেন 'পার্বত্য অঞ্চলে চাকরি করা' অর্থে, যা নিশ্চেই তাঁর বাহিনীতে এবং সম্ভবত আরও একাধিক সরকারি বিভাগে, সাধারণভাবে প্রচলিত ছিল।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, একটা সময় পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলার অধিকাংশ এলাকা ছিল খুবই দুর্গম, যেমন খোদ খাগড়াছড়ি জেলা সদরের সঙ্গে ১৯৮০এর দশকের আগে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ছিল না। এমন দুর্গমতার সঙ্গে ম্যালেরিয়া ও 'শান্তি বাহিনী'র ভীতি যুক্ত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পোস্টিং পাওয়া সরকারি চাকুরিজীবীদের অনেকের কাছে জেল-খাটার মতো ব্যাপারই ছিল। সেই সূত্রেই নিশ্চয়ই 'হিল-খাটা' কথাটা চালু হয়ে গিয়েছিল। সে সঙ্গে সরকারি চাকুরিজীবীদের উপর ছড়ি ঘোরানোর একটি পন্থা হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল খাগড়াছড়ি বা বান্দরবানের মতো জায়গায় বদলি করে দেওয়ার হুমকি।

তবে এসব বিষয় শুধুমাত্র ভাষিক চর্চার মধ্যে সীমিত থাকলে কথা ছিল না, বরং সেগুলির বাস্তব প্রয়োগ বাংলাদেশের জনপ্রশাসন সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছিল, যার আলামত এখনও দেখা যায়। যেমন, গত এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে একাধিক পত্রিকায় এই মর্মে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে, চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নির্মাণাধীন একটি ভবনে রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করার ঘটনা ধরা পড়েছিল। আর সে কারণে, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, সরকার "সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের পরিচালককে খাগড়াছড়িতে বদলি [করেছিল], যা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে জনপ্রশাসনে দেখা হয়ে থাকে।"

এদিকে অতি সম্প্রতি, কয়েকটি অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুসারে, বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস উপলক্ষে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, কোনো ডাক্তার হাসপাতালে ধূমপান করলে তাঁকে বান্দরবান পাঠিয়ে দেওয়া হবে! সরকারি কোনো হাসপাতালে বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো স্থাপনায় ধূমপান করা যাবে না, এই নিয়ম আসলে বিদ্যমান আইন ও সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সবার পালন করার কথা। তথাপি অনেকে তা মানেন না।

এই প্রেক্ষাপটে হাসপাতালের ভেতর ধূমপানের মতো কুচর্চা রোধ করার লক্ষ্যে প্রচলিত বিধিবিধানের কঠোর প্রয়োগের ঘোষণা একজন মন্ত্রী দিতেই পারেন, সেটা কাম্যও বটে। কিন্তু তা করতে গিয়ে তিনি অন্য একটি অপচর্চা মহিমান্বিত করবেন, তা নিশ্চয়ই প্রত্যাশিত নয়। স্রেফ শাস্তি হিসেবে সরকারি কর্মচারীকে পার্বত্য অঞ্চলে বদলি করা একটা অপচর্চা বই আর কিছু নয়।

বাংলাদেশের সংবিধান থেকে শুরু করে বিভিন্ন জাতীয় নীতি ও প্রচলিত আইন, কোথাও লেখা নেই, লেখা থাকতে পারে না যে, সরকারি কোনো চাকুরিজীবী কোনো অনিয়ম বা অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে কোনো দুর্গম অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে তাই হচ্ছে এবং এই প্রেক্ষাপটে বান্দরবান বা খাগড়াছড়ির মতো পার্বত্য জেলাকে এক ধরনের 'জনপ্রশাসনিক আস্তাকুঁড়' হিসেবে দেখার রেওয়াজ চালু রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে।

ক্ষমতার দম্ভে আচ্ছন্ন আমলা-মন্ত্রীদের কাছে এই অপচর্চা স্বাভাবিক মনে হতে পারে, কিন্তু বিদ্যমান বিভিন্ন জাতীয় নীতিমালা অনুসারেই তাদের দায়িত্ব হওয়ার কথা দেশের সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলগুলিতে সবচাইতে নিবেদিত সেবাদানকারীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা। সেটা ভুলে গিয়ে বিদ্যমান অপচর্চাকে প্রশ্ন করার বদলে যখন তাঁরাই সেটিকে মহিমান্বিত করে তোলেন, হোক তা পরোক্ষভাবে ব্যক্ত কোনো উক্তির মাধ্যমে, ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়ায় প্রত্যন্ত এলাকার মানুষদের বঞ্চনার ঘায়ে অপমানের ছিটা দেওয়ার মতো একটি কাজ।

তাই ধূমপায়ী ডাক্তারদের বান্দরবানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, এই মর্মে উচ্চারিত স্বাস্থ্যমন্ত্রীর হুমকির খবর চোখে পড়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে ফেসবুকে আমার প্রতিক্রিয়া ব্যক্তি করেছিলাম।

মন্ত্রীর উল্লিখিত বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে ফেসবুকে প্রকাশিত আমার সংক্ষিপ্ত নিন্দা ও প্রতিবাদের সঙ্গে অনেকেই সংহতি প্রকাশ করেছেন। তবে দুএকজন প্রশ্ন তুলেছেন, আলোচ্য অপচর্চার পেছনে আমি কোথায় 'বর্ণবাদী ও ঔপনিবেশিক মানসিকতা' খুঁজে পেলাম। উত্তরটা অনেকের জন্যই হয়তো-বা সহজ ও স্পষ্ট। তবু প্রশ্নটা যেহেতু উঠলই, এ প্রসঙ্গে সংক্ষেপে দুটি কথা যোগ করছি।

রেইস-ভিত্তিক বৈষম্য অর্থে বর্ণবাদের যে সংজ্ঞা জাতিসংঘের পরিসরে প্রচলিত আছে, সে অনুযায়ী জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বংশপরিচয় ইত্যাদির তারতম্যের কারণে আরোপিত যে কোনো বৈষম্যমূলক কর্মকাণ্ড, যা কোনো জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার, মর্যাদা ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার খর্ব করে, সেটাকেই বর্ণবাদী বলা যায়। বান্দরবানের অধিকাংশ এলাকার মানুষ এমনিতেই নানাভাবে সুবিধাবঞ্চিত। তার উপর সেখানকার অধিবাসীদের উল্লেখযোগ্য অংশের আদিবাসী স্বীকৃতির দাবি উপেক্ষা করে তাদেরকে সরকারিভাবে যে ধরনের আখ্যায় ভূষিত করা হয়, যেমন 'উপজাতি' বা 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী', এ নিয়ে অনেকের রয়েছে ক্ষোভ।

এই অবস্থায় তাদের এলাকাকে এক ধরনের 'জনপ্রশাসনিক আস্তাকুঁড়' হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গী বর্ণবাদী নয়তো কী?

উল্লেখ্য, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যে অনেক এলাকাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল 'পেনাল কলোনি' হিসেবে, যেমন উপমহাদেশের সাজাপ্রাপ্ত অনেক ব্যক্তিকে আগে আন্দামানে পাঠানো হত। একইভাবে খোদ অস্ট্রেলিয়া একদা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের 'পেনাল কলোনি', যেখানে দণ্ডপ্রাপ্ত লোকদেরকে ব্যবহার করা হয়েছিল উপনিবেশ গড়ার কাজে।

প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি আদিবাসীদের প্রতি অতীতে বিভিন্ন সরকারের অনুসৃত নীতিসমূহের মধ্যে কি ঔপনিবেশিক প্রবণতা কিছুটা হলেও ছিল না? সেসব প্রবণতা যে পুরোপুরি অতীতের ব্যাপার নয়, বরং এখনও নানা আকারে বিদ্যমান, তারই একটা প্রমাণ হচ্ছে বিভিন্ন বিভিন্ন অনিয়মের দায়ে অভিযুক্ত অথবা স্রেফ উপরওয়ালাদের রোষানলে পড়া সরকারি কর্মচারীদের খাগড়াছড়ি বা বান্দরবানে পাঠিয়ে দেওয়ার, বা সেভাবে হুমকি দেওয়ার, অপচর্চা।

বাংলাদেশে দারিদ্র্যের যে মানচিত্র রয়েছে, তাতে চৌষট্টি জেলার মধ্যে একাধিক মাপকাঠিতে বান্দরবানের অবস্থান হল একেবারে নিচে বা তার কাছাকাছি। কিন্তু একটি দিক থেকে এই পার্বত্য জেলা রয়েছে সবার উপরে– জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমাহারের দিক থেকে এমন ঐশ্বর্যশালী অঞ্চল আর দ্বিতীয়টি নেই দেশে।

এই প্রেক্ষাপটে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধান নীতি হওয়ার কথা ছিল স্থানীয় জনগণের জ্ঞান ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে এবং তাদের অংশীদারিত্ব ও সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে উল্লিখিত ঐশ্বর্য সুরক্ষিত রাখা। কিন্তু বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারের অনুসৃত নানান ভ্রান্ত নীতি বান্দরবানসহ পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামকে পরিণত করেছে একটি ক্ষতবিক্ষত অঞ্চলে, যেখানে বিভিন্ন পাহাড়ি জনপদে ভূমি হারানোর ক্ষোভ ও বেদনা প্রশমিত তো হয়ইনি, বরং ভূমি-হারানোদের দলে স্থানীয়দের একটা ক্রমবর্ধমান অংশ যুক্ত হচ্ছে প্রতি বছর।

সে সঙ্গে সর্বত্র চলছে অসম উন্নয়নের নানান অশ্লীল প্রদর্শনী। যেমন, দেশের ক্ষমতাধর শ্রেণির একটা অংশ যখন বান্দরবানের থানচি উপজেলায় অবস্থিত নীলগিরির মতো একটি ব্যয়বহুল ও সংরক্ষিত পর্যটন কেন্দ্রে অবকাশ কাটাতে যায়, সেই উপজেলাতেই নানান কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়া অনেক প্রান্তিক জুমিয়া পরিবার এখন প্রায় প্রতি বছর চরম খাদ্যাভাবের শিকার হয়।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর জানা থাকার কথা ছিল, বান্দরবান জেলায় অনেক মানুষ ক্ষুধা, অপুষ্টি ও বিভিন্ন রোগব্যাধির শিকার হচ্ছে যেসব কারণে, সেগুলির মধ্যে রয়েছে সেখানে বিভিন্ন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের অবহেলা বা অদক্ষতা, ভূমিদস্যুতার কারণে বনভূমি সংকুচিত হয়ে আসা, পানির উৎস শুকিয়ে আসা এবং সেখানে নির্বিচারে তামাকচাষের প্রসার। এসব মৌলিক বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে তিনি কি না বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসে ঘোষণা দিয়ে বসলেন, ধূমপায়ী ডাক্তারদের পাঠিয়ে দেওয়া হবে বান্দরবানে!

এমন বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গী এবং সংশ্লিষ্ট সকল সরকারি অপচর্চা বন্ধ হোক, শুধু বান্দরবান বা পার্বত্য জেলাগুলির বেলাতেই নয়, বরং সমগ্র বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও সরব ও তৎপর হতে হবে, প্রচলিত ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে, যেমনটা স্থানীয় জনগণের দাবির প্রতি সাড়া দিয়ে করে দেখিয়েছে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ। রডের বদলে বাঁশ ব্যবহারের কারণে শাস্তি হিসেবে খাগড়াছড়িতে বদলি করা কর্মকর্তার যোগদানপত্র গ্রহণে তাঁরা প্রকাশ্য আপত্তি জানান। এমন দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে পড়ুক।

সে সঙ্গে প্রত্যন্ত এলাকায় দায়িত্ব পালনকে 'হিল-খাটা'র মতো করে দেখেন, এমন লোকজনের বদলে সেখানে জনগণের সেবক হিসেবে নিজেদের দেখেন, এমন উদ্যমী, আগ্রহী ও নিবেদিত কর্মীদের নিয়োগ দেওয়ার জনপ্রশাসন সংস্কৃতি চালু হোক।