যৌন-সন্ত্রাস রোধে নীতিমালা নয়, আইন চাই

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 6 Sept 2011, 07:10 PM
Updated : 22 August 2016, 05:15 AM

ঘরে-বাইরে নিপীড়ন-বৈষম্যের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রত্যেক নারীকে কমবেশি জীবন পার করতে হয়। বখাটেদের হয়রানি-হামলার শিকার হতে হয়নি– এমন নারী খুঁজে পাওয়া কঠিন। উৎসব-সমাবেশে নারীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মোবাইল ফোনে ভিডিওচিত্র ধারণ– এগুলো কি কেবলই শ্লীলতাহানি? শক্তভাবে বলতে চাই, এগুলো শ্লীলতাহানি নয়; এগুলো যৌন-হয়রানি, যৌন-সন্ত্রাস।

বর্তমান সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও নিরাপদ নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ ধরনের নির্যাতনের খবর দেখে বিস্মিত হতে হয়। ২০১৫ সালে টিএসসিতে পহেলা বৈশাখে ঘটে সবচেয়ে অপ্রীতিকর ঘটনাটি। বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে বখাটের দল নারীদের উত্যক্ত করে, হয়রানি করে, তাদের জামাকাপড় ধরে টানাটানি করে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে জেনেছি, সেখানে নাকি টানাহেঁচড়া করে কয়েকজন নারীকে বিবস্ত্র করার ঘটনাও ঘটেছে এবং সেই সংঘবদ্ধ চক্র তখন মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ভিডিওচিত্র ধারণ করছিল। সংবাদটি পড়তে গিয়ে শিউরে উঠেছি!

লক্ষণীয়, কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নয়, একই ধরনের ঘটনা একই দিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ আরও একাধিক স্থানে সংঘটিত হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ।

এসব ঘটনা বিচ্ছিন্নভাবে চলে আসছে বহু আগে থেকেই। তবে টিএসসি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে ঘিরে সংঘবদ্ধ এই দলের সক্রিয়তা শুরু হয়েছে কয়েক বছর ধরে। এদের উপদ্রব ভয়ানক মাত্রায় বাড়ছে। অথচ এই দিকটিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি আলাদাভাবে।

বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন মাত্রায় সংঘটিত হলেও যৌন-নিপীড়নের সংবাদ ও প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা থেকে কয়েকটি সাধারণ দিক চোখে পড়ে। এই যৌন-সহিংসতা জনপরিসরে ঘটছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘটছে, বছরের অন্যান্য সময় কমবেশি হলেও উৎসব-সমাবেশের দিনগুলোতে বেশি করে ঘটছে। বইমেলা চলাকালীন সময়ে, পহেলা বৈশাখ বা পহেলা ফালগুন, ভালোবাসা দিবস বা থার্টিফার্স্ট নাইট উদ্‌যাপনসহ ছুটির দিনগুলোতে দিনে-রাতে প্রতিবছর কিছু না কিছু মাত্রায় নারী নিপীড়নের শিকার হন। এ ধরনের ঘটনা প্রকাশ হলে নিপীড়িত নারী আরও বেশি করে 'সামাজিক কলঙ্কের' ভাগীদার হন এবং দোষটি প্রকারান্তরে তাঁর পোশাক বা আচরণের ওপরে পড়ে বলে অনেক সময়ই এই ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় না।

শ্লীলতাহানি (ইনডিসেন্সি) আর সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট (যৌন-হয়রানি) এক করে দেখলে হবে না। শ্লীলতাহানি আর সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট এক জিনিস নয়। হয়রানি, হেনস্তা, লাঞ্ছনা– এগুলোর মানে ঘটনার গুরুত্ব, ভয়াবহতা, আর অপরাধের চরিত্র সম্পর্কে আমাদের ভুল একটা ধারণা দেয়। এ শব্দগুলো উদ্দেশ্যপূর্ণভাবেই ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলো তৈরি হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক ধারণা আর অভিসন্ধির যোগফলে।

পুরুষশাসিত সমাজ আমাদের এমন চিন্তা করতে বাধ্য করে যে নারী বাইরে বেরিয়ে ধর্ষণের শিকার হলে তিনি তো ধর্ষিতা, আর তা যদি না হয় বাকি সব ঘটনাকে যৌন-হয়রানি বা হেনস্তা ইত্যাদি শব্দ দিয়েই সারা যায়। এর মধ্যে যেন মনোদৈহিক নির্যাতনের বালাই নেই, নিপীড়নের ব্যাপার নেই; এর মধ্যে নারীর প্রতি বিদ্বেষ আর নারী-পুরুষের বিবিধ বৈষম্যের প্রশ্রয় যেন নেই।

এক যুগ আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন-নিপীড়নবিরোধী দুটি বিরাট আন্দোলন প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার বিষয়টি আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে। সে আন্দোলনের মশালটি এখনও জ্বলছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখনও সেই দাবির পক্ষে জোরালো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি।

তবে এখন রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এ বিষয়ের চেতনা আগের চেয়ে প্রখর। প্রচলিত নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আইনের ভাষা ও বিধি তার বড় প্রমাণ। কিন্তু সবক্ষেত্রে বিষয়গুলো নিয়ে আদালত পর্যন্ত দৌড়ানো সবার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না।

গত চার বছরে যৌন-হয়রানির শিকার হয়ে ৯৯ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। যৌন-হয়রানিতে বাধা দেয়ায় লাঞ্ছিত হয়েছেন দুই হাজারের অধিক নারী ও ৪৮৯ জন পুরুষ। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ব্র্যাক স্কুল অব ল' আয়োজিত 'সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট অ্যান্ড রাইটস অব উইমেন ইন পাবলিক প্লেসেস' শীর্ষক সেমিনারে মানবাধিকার সংগঠন 'অধিকার' এ তথ্য জানায়। দেশের প্রধান ১২টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ পর্যালোচনা করে তারা এ তথ্য পেয়েছে।

প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আরও বলা হয়, গত চার বছরে ১১ থেকে ১৫ বছরের মেয়েরা সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হয়েছে। যৌন-নিপীড়কেরা মেয়েদের হাত বা ওড়না ধরে টানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তারা ধর্ষণ ও অপহরণের হুমকিও দিয়েছে।

যৌন-হয়রানি আসলে কী?

যৌন-হয়রানি রোধে একটি নীতিমালা করে দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। সেখানে আদালত রায় দেন, মেয়েদের উত্যক্ত করা, তাকিয়ে থাকা, ই-মেইল বা ফোনে বিরক্ত করা, এমনকী রাস্তায় অচেনা কাউকে 'সুন্দরী' বলা– এসবই যৌন-হয়রানির মধ্যে পড়বে।

যৌন-হয়রানি বা নিপীড়ন অনেকভাবে ঘটে থাকে। কথা, শারীরিক স্পর্শ, মানসিক বা শারীরিক আঘাত এমনকী পরোক্ষভাবেও ঘটতে পারে। কাউকে যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারা দেওয়া, বিদ্বেষমূলক অঙ্গভঙ্গি করা, কটুক্তি, টিটকিরি, ব্যঙ্গবিদ্রুপ করা যৌন-হয়রানি। আমরা যখন দেখি, দলবদ্ধভাবে নারীদের উপর হামলে পড়ে তাঁদের জামাকাপড় ছিড়ে ফেলা হচ্ছে, প্রতিবাদ করলে আঘাত করা হচ্ছে– সেসব ঘটনা শ্লীলতাহানি বলে হালকা করার কোনো উপায় নেই।

হাইকোর্টের জারি করা নীতিমালায় বলা হয়েছিল, যতদিন পর্যন্ত যৌন-হয়রানির কোনো আইন পাস না হবে ততদিন পর্যন্ত হাইকোর্টের এই নীতিমালা অনুসরণ করা হবে। 'নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০' সংশোধনসহ, 'যৌন-হয়রানি প্রতিরোধ খসড়া আইন ২০১০' তৈরি করা হয়। এগিয়ে যাওয়া বলতে এই এতটুকুই।

এই খসড়ায় কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে হয়রানির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু জনসমাগম স্থলে নারী যৌন-হয়রানির শিকার হয় সবচেয়ে বেশি।শিক্ষাঙ্গনে যৌন নিপীড়ন-সহিংসতা রোধে উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনা ২০১০ সালে প্রণীত হয়েছে। সেখানে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন-নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন, কমিটি গঠন এবং এসব তথ্য সব শিক্ষার্থীকে জানানোর বিধান আছে।

রাষ্ট্রকেও যৌন-নিপীড়নবিরোধী আইন প্রণয়ন করতে বলা হয়েছে। তবে রাষ্ট্র যতদিন আইন প্রণয়ন না করছে, ততদিন উচ্চ আদালত প্রদত্ত নির্দেশনাটি সবার পালনের জন্য প্রযোজ্য হবে বলে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রায় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এই নির্দেশনা অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে একদিকে যেমন শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানতে পারেন না যে কোন কোন আচরণ যৌন-নিপীড়নমূলক অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে বা এমন কিছু ঘটলে কী পদক্ষেপ নিতে হবে। এ কারণে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে একধরনের অসচেতনতা থেকে যায়, যা আচরণ নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।

আদালতের নির্দেশাবলীর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলো হল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে নারীর ওপর যৌন-হয়রানি আইনের চোখে অপরাধ হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। যৌন-হয়রানির আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা নির্দিষ্ট করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ভারতের 'বিশাখা বনাম রাজস্থান সরকার' মামলাটি স্মরণ করা যেতে পারে। ১৯৯২ সালে বিশাখা নামের এক নারী তাঁর সহকর্মীর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে তাৎক্ষণিকভাবে এ নিয়ে কোনো মামলা হয়নি। পরবর্তী সময়ে স্থানীয় জনগণ ও নারী আন্দোলনকারীরা বিশাখার পক্ষে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলা কোর্টে ওঠার পর বিচারক সিডও সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে ব্যর্থতার জন্য সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। এ জন্য বিশাখাকে ক্ষতিপূরণ ও যৌন-হয়রানি প্রতিরোধে আইন প্রণয়নের জন্য রাষ্ট্রকে আদেশ প্রদান করা হয়।

বিচারের ক্ষেত্রে হয়রানি বা নিপীড়নকারীর উদ্দেশ্য-মানসিকতার বদলে নারীর মানসিক যন্ত্রণা ও নির্যাতনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই নির্দেশাবলী বা রায় পালন করা সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অর্থাৎ আইনের নিরিখে বাধ্যতামূলক। এগুলো প্রয়োগের লক্ষ্যে পদক্ষেপ না নিলে তা আদালত অবমাননার অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এগুলো অনেকটা যৌন-হয়রানি প্রতিরোধে ও শাস্তির লক্ষ্যে ন্যূনতম ব্যবস্থা। দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনও সেই নীতিমালা কার্যকর করা হয়নি এবং তার আলোকে সংসদ কোনো আইনও তৈরি করেনি।

২০১০ সালের ২৫ আগস্ট আইন কমিশন একটি খসড়া আইন তৈরি করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন-হয়রানি প্রতিরোধ আইন, ২০১০ (প্রস্তাবিত) নামের আইনটিতে মোট ২১টি ধারা রয়েছে। এ ছাড়া লঘু ও গুরুতর অপরাধ আলাদাভাবে চিহ্নিত করে একটি তফসিল সংযুক্ত রয়েছে। কিন্তু সেটি এখনও আলোর মুখ দেখেনি।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন থাকার পরও নারী নির্যাতন কমেনি, সেখানে সাবস্ট্যানশিয়াল কোনো আইনের পরিবর্তে কেবল নীতিমালা নারীকে যৌন-হয়রানি ও যৌন-সন্ত্রাস থেকে কতটা রক্ষা করবে সে সন্দেহ থেকেই যায়।