কোন পথে যাবে জামায়াত

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 13 May 2016, 06:15 AM
Updated : 13 May 2016, 06:15 AM

জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিজামীর প্রাণদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন নিজামী। আপিল বিভাগও তার প্রাণদণ্ডের আদেশ বহাল রাখেন। সব আইনি প্রত্রিুয়া শেষে গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টা ১০ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে নিজামীর মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে।

একাত্তরে নিজামী ছিলেন আলবদর বাহিনীর প্রধান। এই আলবদর বাহিনী দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় প্রধান ভুমিকা পালন করেছিল। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত না থাকলেও বাহিনী-প্রধান হিসেবে নিজামী যে নেতৃত্ব ও নির্দেশনা দিয়েছিলেন, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিল এদেশীয় রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনীর সদস্যরা।

জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েই এই সব বাহিনী গঠনে সত্রিুয় ভূমিকা পালন করেছিল। গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনেও নেতৃত্ব দিয়েছিল জামায়াতে ইসলামীসহ পাকিস্তানমনা আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল। স্বাধীনতার পর এই দলগুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তখন গোলাম আযমসহ জামায়াতের কয়েকজন শীর্যনেতা দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন এবং বিদেশে বসে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতায় শামিল হয়েছিলেন। আর বাকিরা দেশের মধ্যেই আত্মগোপনে থেকে, পরিচয় লুকিয়ে সুদিনের অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটলে জামায়াত তথা গোপনে থাকা পাকিস্তানপন্থীদের সুদিন ফিরে আসে। জিয়াউর রহমানের বদান্যতায় এরা রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ পায়। বিএনপির হাত ধরে জামায়াত এক সময় দেশের একটি অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের পরিচিত করতে সক্ষম হয়। যে দল স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের বিরুদ্ধে ছিল, যারা পাকিস্তানিদের পক্ষ নিয়ে বাঙালি নিধনযজ্ঞে মেতে উঠেছিল, তারা যখন লাখো শহীদের রক্তে ভেজা দেশের মাটিতে সদর্পে রাজনীতি করার সুযোগ লাভ করে, তখন আমরা লজ্জা ও গ্লানিবোধ করলেও প্রতিকার করার সুযোগ পাইনি।

আমাদের সামনে সেই সুযোগ এনে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছিলেন। জাতিকে করেছিলেন কলঙ্কিত। আর শেখ হাসিনা সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে শাস্তি দিয়ে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছেন। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে, শাস্তি হবে এটা কেউই আশা করেননি। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী না হলে এটা হতও না।

২০০৮ সালের নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠন করার পরও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে অনেকের মনেই সংশয় ছিল। অনেককেই বলতে শোনা গেছে, নির্বাচনে জেতার জন্য আওয়ামী লীগ স্টান্টবাজি করেছে, এটা একটা 'রাজনীতি'। শেষ পর্যন্ত কারও বিচার হবে না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যত্রুম শুরু হওয়ার পরও অনেকের মন থেকে দ্বিধা-সংশয় দূর হয়নি। বলা হয়েছে, এ সব আইওয়াশ। রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধ ইস্যু নিয়ে খেলছে।

জামায়াত নেতারাও তখন নানা ধরনের ঔদ্ধত্যপুর্ণ মন্তব্য করেছেন। ২০১০ সালের ২৫ এপ্রিল মতিউর রহমান নিজামী এক বক্তৃতায় বলেছিলেন:

''যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যু নিয়ে মাতামাতি করেন, তারা দেশের সমস্যা সমস্যা বলে মনে করেন না। সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা তাদের নেই বলেই এই বিষয় সামনে নিয়ে এসেছেন। আমার পূর্ণ আস্থা আছে, দুরবীন দিয়ে তালাশ করলেও মানবতাবিরোধী কোনো অপরাধের সঙ্গে আমাদের দলের কারও সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যাবে না।''

জামায়াত নেতার এই দম্ভোক্তি মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে। আদালতের রায়ে তাদের নেতাদের অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। আদালত জামায়াতে ইসলামীকে একটি অপরাধী (ক্রিমিনাল) সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। একাত্তরে এই দল এবং দলের নেতাকর্মীরা বাঙালির স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। আদালতের রায়ে এর মধ্যেই নিজামীসহ জামায়াতের চার শীর্ষনেতার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এরা হলেন, দুই সহকারি সেত্রেুটারী জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা (১২ ডিসেম্বর, ২০১৩) ও মুহাম্মদ কামারুজামান (১১ এপ্রিল, ২০১৫) এবং সেত্রেুটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মোজাহিদ (২১ নভেম্বর, ২০১৫)।

জামায়াতের বাইরে বিএনপির প্রভাবশালী নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে (২১ নভেম্বর, ২০১৫)। সবশেষ গত ১১ মে নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রত্রিুয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে পৌঁছুল বলে অনেকেই মনে করছেন। জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযম মানবতাবিরোধী দণ্ড মাথায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন (২৩ অক্টোবর, ২০১৪)। আর এক জামায়াত নেতা এ কে এম ইউসুফও কারাগারে মারা গেছেন (৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪)।

জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মীর কাসেম আলী এবং এটিএম আজাহার উদ্দিনের মামলাও আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। এদের সবার যদি মৃত্যুদণ্ড না-ও হয়, আমৃত্যু দণ্ড যে বহাল থাকবে তাতে সন্দেহ নেই। বিএনপি নেতা আবদুল আলিমও দণ্ড হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হবে না বলে যাদের মনে শংকা ছিল তারা এতদিনে এটা বুঝে নিয়েছেন যে, শেখ হাসিনা যা বলেন সেটা তিনি করেনও। এই বিচারপ্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য, ভণ্ডুল করার জন্য দেশে-বিদেশে কম চক্রান্ত ও যড়যন্ত্র হয়নি। বিচার ঠেকাতে দেশের ভেতর জামায়াত চরম সহিংতার পথ বেছে নিয়েছিল। দেশের বাইরে মোটা টাকা দিয়ে লবিস্ট নিয়োগ করেছিল। সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য কোনো চেষ্টা বাদ রাখা হয়নি। সরকার পরিবর্তন হলে নেতারা মুক্তি পাবেন এমন বিশ্বাস জামায়াতের ছিল।

দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিও জামায়াতকে এই ইস্যুতে সহযোগিতাই করেছে। বিচারপ্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য বিএনপি সরাসরি বিচারের বিরোধিতা না করে বিচারের স্বচ্ছতা ও আন্তর্জাতিক মান নিয়ে বিতর্ক তুলেছে।

জামায়াত এমনও মনে করত যে, বিদেশের চাপে সরকার শেষ পর্যন্ত বিচারকাজ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হবে। কিন্তু এর কোনোটাই হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও দৃঢ়তার কাছে কোনো বাধাই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। জামায়াত এখন পিছু হটেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় থেকে নেতাদের রক্ষার কোনো উপায় তাদের সামনে নেই, এটা বুঝে এখন তারা কৌশল বদল করছে। আত্মরাক্ষার উপায় খুঁজছে।

শীর্য অপরাধীদের বিচার ও দণ্ড বাস্তবায়নের কারণে এখন জামায়াতের রাজনৈতিক ভবিয্যৎ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন মহল থেকেই জামায়াতকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করে নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও জামায়াত নিষিদ্ধের পক্ষেই বলছেন।

নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও প্রভাবশালী মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা সময়ের ব্যাপার বলে মন্তব্য করেছেন। জামায়াত নিষিদ্ধের একটি আইনের খসড়া শিগগিরই মন্ত্রিসভার বৈঠকে উত্থাপিত হবে বলে আইনমন্ত্রীও জানিয়েছেন। জামায়াত নিষিদ্ধ হলে তারা আত্মগোপনে গিয়ে সন্ত্রাসের পথ বেছে নেবে বলে মনে করে কেউ কেউ জামায়াত নিষিদ্ধের বিরোধিতাও করছেন।

তবে জামায়াত নিষিদ্ধ না হয়েও এখনও কার্যত সন্ত্রাসী কার্যকলাপই চালিয়ে যাচ্ছে। জামায়াতের সামনে এখন চারটি বিকল্প খোলা রয়েছে। প্রথমত, তারা দেখবে সরকার শেষ পর্যন্ত তাদের নিষিদ্ধ করে কি না। দ্বিতীয়ত, তারা অন্য দলে ঢুকে তাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। তৃতীয়ত, তারা আত্মগোপনে গিয়ে দলের কার্যক্রম চালাতে চাইবে। চতুর্থত, তারা নতুন নামে, নতুন পরিচয়ে রাজনীতিতে নামতে পারে।

কোনো কোনো রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক অবশ্য মনে করেন, জামায়াত কোনো একটি আলাদা কৌশল নিয়ে অগ্রসর হবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। ওরা একই সঙ্গে হয়তো চারটি বিকল্প পথই ব্যবহার করবে। ইতোমধ্যেই তারা তা ব্যবহার করতে শুরুও করেছে। প্রতিষ্ঠার পর জামায়াত তিন বার নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু তারা বিলীন বা বিলুপ্ত হয়নি। বিপদের সময় কীভাবে আত্মরক্ষা করতে হয়, গা বাঁচাতে হয় সেটা ওরা ভালো করেই জানে।

এবারও বিপদ মোকাবেলায় সব প্রস্তুতি ওরা নিতে শুরু করেছে। তারা আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে যেমন ঢুকতে শুরু করেছে তেমনি বিভিন্ন নামে দেশে যেসব জঙ্গি সংগঠন গড়ে উঠছে সেগুলোতেও তাদের কর্মীরা যোগ দিচ্ছে। নিষিদ্ধ হলে নতুন নামে রাজনীতিতে নামার চেষ্টা করবে তারা।

তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যতদিন সরকার থাকবে ততদিন জামায়াত যত কৌশলই নিক না কেন খুব বেশি সুফল পাবে বলে মনে হয় না। একাত্তর-পরবর্তী সময়ে ওরা যেভাবে রাজনীতিতে জায়গা করে নিতে পেরেছিল, এখন তাদের সহায়-সম্পদ এবং সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেক বেশি হলেও সেভাবে পারবে না।

ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার প্রবণতা যেমন এখন বেড়েছে তেমনি ধর্মভিত্তিক জঙ্গি রাজনীতির বিরুদ্ধেও বৈশ্বিক জনমত প্রবল হয়ে উঠছে। জামায়াতের বড় সমস্যা হল, তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের এত বেশি জড়িয়েছে যে, তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা একেবারেই তলানিতে এসে ঠেকেছে। ওদের পক্ষে উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতি করা সম্ভব বলে কেউ মনে করেন না।

জামায়াত এখন খারাপ সময় অতিক্রম করছে। সরকারের বিরুদ্ধে অসম লড়াইয়ে নেমে তারা এত শক্তি ক্ষয় করেছে যে, এখন সামান্য প্রতিবাদ জানানোর ক্ষমতাও তাদের নেই। দলের গুরুত্বপুর্ণ নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর হরতালের কর্মসূচি যোষণা করা হলেও মাঠে দেখা যায় না জামায়াতের নেতাকর্মীদের। যে জামায়াত সাঈদীর রায় ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব শুরু করেছিল, সেই জামায়াত দলের আমীরের ফাঁসি হওয়ার পরও রাস্তায় বের হল না, এটা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য বলেই মনে হচ্ছে।

কেউ কেউ মনে করছেন, জামায়াতের উপর থেকে বিএনপি কৌশলগত কারণেই সাময়িকভাবে আশীর্বাদের ছাতা সরিয়ে নেওয়ায় জামায়াত বিপাকে পড়েছে। তাদের ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পরই তারা পথ ঠিক করবে। এখন অনুকূল পরিবেশের জন্য অপেক্ষা করছে কেবল। তবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থেকে নয়।

ওদিকে বিএনপিও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তারা রাজনৈতিক খেলায় আওয়ামী লীগের কাছে হেরে গিয়ে এখন কানাগলির মধ্যে পথ খুঁজছে। আশা করছে, সরকারই হয়তো তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেবে।

শেখ হাসিনার বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। কাজেই জামায়াত-বিএনপির জন্য অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই।