মেধার আগে জিপিএ দৌড় কেন

নাদিম মাহমুদনাদিম মাহমুদ
Published : 12 June 2016, 04:55 PM
Updated : 12 June 2016, 04:55 PM

১.

''উচ্চ ফলনশীল ফলাফলের তো বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। এই নিরীক্ষামূলক সৃজনশীলদের আমরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে পাচ্ছি। ইনাদের শিক্ষার্থী বলা মুশকিল, ইনারা আসলে সারা বছরই পরীক্ষার্থী। ইনারা পরীক্ষা দেওয়ার জন্য সদাউদগ্রীব। উনারা এখন পারলে পরীক্ষা আগানোর আন্দোলন করেন। যদিও পরীক্ষার খাতা দেখতে বসলে নিজের চুল নিজেরই ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। শেখার বিষয়টা উনাদের অপারেটিং সিস্টেমেই নাই। উনাদের দোষ না, মাধ্যমিক শিক্ষার চিরস্থায়ী বরবাদি তো নিজেই দেখতেছি।''

কথাগুলো ১১ মে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর নিজের ফেইসবুক ওয়ালে তুলেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বখতিয়ার আহমেদ। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের পর উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জায়গা নেওয়া বর্তমান জিপিএ প্রজন্মের সুষ্পষ্ট মূল্যায়ন উঠে এসেছে এই শিক্ষকের ক্লেদময় বাক্যে।

বখতিয়ার আহমেদ এই অভিযোগ তুললেও তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া সিজিপিএ দৌড়ে এগিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের বেলায় কথাগুলো সমভাবে প্রযোজ্য হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা পাশ করার পর চাকরির বাজারে নিজেদের সনদ বিক্রি করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। সিস্টেমবাজি কিংবা রাজনীতিক সুবিধাভোগীরা ব্যতীত দেশের মেধাবী বলে সনদে দাবি করা এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক ধরনের হতাশা থেকে যায়। বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনার কথা বাদ দিলে আমাদের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার ধীরে ধীরে নূুয়ে পড়তে শুরু করার বিষয়টি উদ্বেগজনক।

তাহলে ফলাফলে এগিয়ে থাকা দেশের 'শিক্ষা কাঠামো' কি মেধার দ্যুতি ছড়াতে ব্যর্থ হচ্ছে? জিপিএ প্রজন্মের ফলাফলে আলোর বেগ থাকলেও উচ্চ শিক্ষালয়ে আমাদের মস্তিস্কের কসরত বেপথু হওয়ার রহস্যটা কী?

পাঠক, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমরা খুঁজব। তার আগে চলুন দেখা যাক সদ্যপ্রকাশিত মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল কী বলে।

ঘোষিত ফলাফল দেখা যাচ্ছে, চলতি বছর আটটি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ১৬ লাখ ৫১ হাজার ৫২৩ জন শিক্ষার্থী অংশ নেন যেখানে কৃতকার্যের হার ৮৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। আর এই ফলাফলের মধ্যে জিপিএ ৫ দৌড় ছিল ১ লাখ ৯ হাজার ৭৬১ জনের।

দারিদ্রের বোঝা মাথায় নিয়ে বেড়ে ওঠা স্বাধীন একটি দেশে এ ধরনের ফলাফল সত্যি ঈর্ষাজাগানিয়া। শিক্ষার প্রতি সমাজের সব শ্রেণির মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতি বছর পরীক্ষার্থী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ফলাফলের স্কোর বোর্ড দফায় দফায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন একজন রিকশাচালক কী দিনমজুরের সন্তান স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, পড়াশোনা করছে, আবার কমবেশি ভালো জিপিএ-ও পাচ্ছে।

২.

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন সেই কথা বলছে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ১৯৯০ সালের এসএসসি সমমান পরীক্ষায় পরীক্ষার্থী ছিল চার লাখ ৩৫ হাজার ৯১৮ জন। আর ছাব্বিশ বছর পর সে সংখ্যা তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়ে চলতি বছর পরীক্ষার্থী সংখ্যা ১৩ লাখ ছাড়িয়েছে। ১৯৯০ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় যেখানে ৩১ দশমিক ৭৩ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করেছিল, সেখানে চলতি বছর পাস করেছে ৮৮ দশমিক ২৯ শতাংশ পরীক্ষার্থী। এ হিসেবে ২৬ বছরে এসএসসিতে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে তিন গুণের বেশি।

এক সময় পুরো গ্রামে ৬০ ভাগ নম্বর পেয়ে একজন প্রথম বিভাগে পাস করা পরীক্ষার্থীরও দেখা মিলত না, সেখানে আমরা আজ ঘরে ঘরে শতকরা ৮০ ভাগ নম্বরপ্রাপ্ত জিপিএ ৫ পাওয়া ছেলেমেয়ের দেখা পাই। এখন ফেল করাই বরং কঠিন হয়ে পড়েছে।

আমরা দেখছি ২০০১ সালের পর দেশে জিপিএ পদ্ধতিতে ফলাফল দেওয়ার রীতি চালুর পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি জিপিএধারী পেতে পাল্লা দিচ্ছে পরস্পরের সঙ্গে। বর্তমানে বিষয়টা এমন হয়ে গেছে যে, জিপিএ ৫ বা গোল্ডেন জিপিএ না পেলে সেটা যেন কোনো ফলাফলই নয়!

গত ষোল বছরের মাধ্যমিকে জিপিএ ৫ প্রাপ্তির পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিলে আমরা এমন চিত্র দেখতে পাই:

৭৬ জন (২০০১), ৩২৭ জন (২০০২), ১ হাজার ৩৮৯ জন (২০০৩), ৮ হাজার ৫৯৭ জন (২০০৪), ১৫ হাজার ৬৩১ জন (২০০৫), ২৪ হাজার ৩৮৪ জন (২০০৬), ২৫ হাজার ৭৩২ জন (২০০৭), ৪১ হাজার ৯১৭ জন (২০০৮), ৪৫ হাজার ৯৩৪ জন (২০০৯), ৬২ হাজার ১৩৪ জন (২০১০), ৬২ হাজার ২৮৮ জন (২০১১), ৮২ হাজার ২০১২ জন (২০১২) এবং ৯১ হাজার ২২৬ জন (২০১৩), ১ লাখ ১১ হাজার ৯০১ (২০১৫), ১ লাখ ৯ হাজার ৭৬১ (২০১৬)।

দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ও উচ্চতর ফলাফলধারীর সংখ্যা বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। উচ্চ মাধ্যমিকেও একই ধরনের চিত্র পরিলক্ষিত হলেও বিপত্তি বেঁধেছে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। তুখোড় ফলাফল করা এইসব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পা দেওয়ার পর তেল ফুরিয়ে যাওয়া মোটর বাইকের মতো ধপাস করে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিচ্ছে। অনেকে আবার হাঁটু গেঁড়ে পাশ করলেও চাকরির বাজারে এসে খাচ্ছেন ধরা।

তাহলে কি আমাদের এই হাজার হাজার জিপিএ ৫ পাওয়া ক্রমেই অন্ধকারের তীরে ভাসিয়ে দিচ্ছে শিক্ষার ভেলা?

এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলব, না। আমাদের মেধাবীরা ঠিক আছে। ওদের অপার শক্তিও ভরপুর। তাহলে সমস্যটা কোথায়?

সমস্যার মূলে আছে আমাদের 'নৈতিকতা আর প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা'। বর্তমানে বিষয়টা এমন হয়ে গেছে ভালো জিপিএ অর্জন করা ডাল-ভাত হয়ে গেছে। নৈতিকতার স্খলন এমন পর্যায়ে গেছে যে, আমাদের ভবিষৎ 'মেধার অস্তিত্ব' নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে।

৩.

গত চার বছরের রেওয়াজ অনুযায়ী, প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। পরীক্ষার আগের রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ফাঁসকৃত প্রশ্নের সরব উপস্থিতিই বলে দিচ্ছে আমাকের শিক্ষা ব্যবস্থার হাল-হকিকত। বিষয়টা এমন হয়ে গেছে যে, ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ছাড়া পরীক্ষা দেওয়া মানে লবণ ছাড়া তরকারি খাওয়া!

আজকে যারা এসএসসি পাশ করেছে তাদের সিংহভাগই পিএসসি, জেএসসির ফাঁসকৃত প্রশ্নে পাশ করেছে। গোঁড়াতে নৈতিকতা হারিয়ে ফেলা এইসব শিক্ষার্থী যখন দেশের শীর্ষ স্থানগুলোতে আসবে তখন কী হবে একটু ভাবুন তো? আমাদের এই কোমলমতি শিশুদের ভয়ানক ভুল পথে দেওয়ার সারথী কারা?

এক কথার উত্তর, শিক্ষা মন্ত্রণালয়। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের এই নিয়ামক শক্তি আমাদের যে কয়েকটি ভবিষৎ প্রজন্ম উপহার দিয়েছেন, তা মনে রাখার মতো। অনেকে উপহাস করে বলেন, 'নূরুলের সময় পাস মানে বায়াত্তরের অটো'। স্বাধীনতার দ্বিতীয় বছর ১৯৭২ সালে যুদ্ধাবস্থার কারণে সবাইকে (অটো) তৎকালিন মাট্রিক পাস করিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ আছে।

ঠিক বর্তমান সময়ের ফলাফল ঝাঁজহীন হয়ে পড়ছে। অনেক শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়ে হাসতে পারছে না। তাদের বাবা-মাও আত্মীয়দের কাছে সন্তানের এই ফলাফল বলতে দ্বিধা করছেন। কারণ তারা জানেন, তাদের সন্তানের যোগ্যতা কতটুকু। অনেক বাবা-মাকে দেখেছি, জিপিএ ৪ কিংবা ৪ দশমিক ৫ পেয়েছে, তাদের উচ্ছ্বাস যেন বাঁধভাঙ্গার মতো। এই বাবা-মা তাদের সন্তানদের ভুল পথে পা দিতে দেননি। ফাঁসকৃত প্রশ্নের সন্ধানও করেননি।

নূরুল ইসলাম নাহিদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমন জিপিএ-খাদক হয়ে গেছে যে, যে কোনো মূল্যে পাস বাড়াতে হবে। প্রশ্ন ফাঁস দেখেও না দেখার ভান করে মন্ত্রণালয়। সরকারপ্রধানও একদিন প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে কথা বলেননি। বিপুল উৎসাহ আর উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে প্রতি বছর ফাঁস প্রশ্নে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ যেন মূল এজেন্ডা হয়ে গেছে সরকারের। জিপিএ বাড়া মানে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হওয়া এমন রীতিতে বুঁদ শিক্ষা মন্ত্রাণালয়ের এমন ঘুম অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালরা ভাঙাতে পারেননি। শহীদ মিনারের বৃষ্টিতে ভেজেও শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি কাড়তে পারেননি তারা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় শুধু প্রশ্নফাঁসে উদাসীনতা দেখায়নি, এর আওতায় শিক্ষা বোর্ডগুলো থেকে পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নকারী শিক্ষকদের কাছে বিশেষ নির্দেশনা পাঠানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।শিক্ষকরা যেন অধিক নম্বর পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা সচল রাখেন এমন নীতিও চালু করেছে আমাদের এই শিক্ষা ব্যবস্থায়। আমার কাছে সবচেয়ে ভয়ানক তথ্য এটি।

আমাদের দেশের অধিকাংশ আমলা আর রাজনীতিবিদের সন্তান বিদেশি শিক্ষা ব্যবস্থায় ('এ' এবং 'ও' লেভেল) পড়াশুনা করে। অনেকের সন্তানই দেশের বাইরে পড়ছে। কারণ একটাই, মেধার চর্চা ও প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ। এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমাদের মতো প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দেয় না।

আমলা আর রাজনীতিবিদরা যদি মনে করেন, এই দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেবল মধ্যবিত্ত আর দারিদ্র শ্রেণির সন্তানরা পড়াশোনা করে, যেমন তেমন একটি শিক্ষা হলেই তো হয়, আর এ জন্য প্রশ্নফাঁসের ঘটনার তদন্তে বছরের পর বছর অনীহা প্রকাশ করে চলেছেন।

তাই আমাদের মতো তরুণরা শিক্ষা নিয়ে ভাবতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে বারবার। আমাদের এত এত মেধাবীর শরীরে 'সায়ানাইড' প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছি আমরা। ফ্যাশনে পরিণত করছি জিপিএ ফলাফলকে।

উন্নত বিশ্বের কোনো দেশই স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল নিয়ে এ রকম মাতামাতি করে না। এমনকি আমাদের মতো পত্রিকায় ব্যানার ক্যাপশনের সংবাদও করে না। এদের জিপিএ মানে হল, এক বর্ষ থেকে অন্য বর্ষে পা দেওয়ার সুযোগ। তারা কখনও জিপিএকে মূল ধরে একজন শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করে না। এমনকি চূড়ান্ত পরীক্ষার পর সনদ কিংবা নম্বরপত্রে মোট জিপিএ উল্লেখ করে না। আর এটাই হচ্ছে সার্থকতা।

আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছি সেই ওসাকা বিম্ববিদ্যালয় স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে যে, এই জিপিএ কখনও একাডেমিক কাজে লাগবে না। সবচেয়ে মজার বিষয় হল, নম্বরপত্রে বিষয়ের পাশে জিপিএ থাকলেও মোট জিপিএ কত তার উল্লেখ থাকে না। কারণ একটাই, জিপিএ প্রসঙ্গে নিরুৎসাহিত করা। জিপিএর পিছনে না ছুটে পড়াশোনার প্রতি শিক্ষার্থীরা মনেোযাগী হবে এটাই্ এই দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূলমন্ত্র। পুরো জাপানে একক নিয়মে পাঠচর্চা হয়। জিপিএ পদ্ধতিতে শিক্ষা হলেও, এরা এই জিপিএকে কখনও মূল্যায়নের মাপকাঠি মনে করে না। যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটগুলোও একই কথা বলছে।

৪.

আমাদের দেশে ২০১০ সাল থেকে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু রয়েছে। নকল থেকে মুক্তির জন্য এটি চালুর উদ্দেশ্যে হলেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের মিছিলে তা নিছক স্বপ্ন থেকে গেছে। আমাদের সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থা কতটা সৃজনশীল তা বুঝতে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরছি।

আমি যে বিম্ববিদ্যালয়ে পড়ছি তা জাপানের তৃতীয় বৃহত্তম আর বিশ্বের পঞ্চাশটি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি। এখানে ক্লাসে শিক্ষকরা পড়ানোর চেয়ে শিক্ষার্থীদের দিয়ে বেশি পড়িয়ে নেন। একটি ব্যাচে ৩০টি ক্লাস যদি হয়ে থাকে তার ১৫টি থাকে শিক্ষার্থীদের দিয়ে। শিক্ষকরা একেকটা টপিক গ্রুপভিত্তিক হাতে ধরিয়ে দেন। ছাত্ররা সেই টপিক নিয়ে বই ও ইন্টারনেট থেকে ঘেঁটে উপস্থাপনার জন্য স্লাইড তৈরি করে। এরপর তা সবার সামনে পাওয়ার পয়েন্টে উপস্থাপন করা হয়। দেড় ঘণ্টার ক্লাসে তাদের উপস্থাপনের পর চলে প্রশ্নোত্তর পর্ব।

কোনো শিক্ষার্থী যদি একটা বিষয় না বুঝে, তাহলে সে ওই প্রেজেন্টশন গ্রুপকে জিজ্ঞাসা করতে পারে। ফলে তা জানার জন্য প্রতিটি গ্রুপ সদস্যকে অধিক পড়াশোনা করতে হয়। বুঝতে হয়। তবে মুখস্ত করার তো দরকারই হয় না। শিক্ষকরা ক্লাস নেওয়ার মাঝে প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের হাতে একটা সাদা কাগজ ধরিয়ে দেন। এই কাগজে লেকচার শেষে শিক্ষকদের দেওয়া কয়েকটি প্রশ্ন করা হয়। যে প্রশ্নগুলো আসে তার সবগুলো করা হয় সদ্যপ্রদত্ত লেকচার থেকে। তাই একজন শিক্ষার্থীর ক্লাসে মনোযোগী না হয়ে উপায় থাকে না।

এই হল সৃজনশীল শিক্ষা। নিজের মস্তিস্ক কাজে না লাগিয়ে কেউ সনদ পেতে পারে না। প্রতিটি ক্লাসে উপস্থিতি আর ক্লাস পারফর্মের জন্য থাকে ৭০ ভাগ নম্বর। আর বাকিটা রাখা হয় মূল পরীক্ষায়। তাই এদের জিপিএর পিছনে দৌড়াতে হয় না। এগুলো স্বশিক্ষা আর এরই নাম হল সৃজনশীলতা।

৫.

আমাদের শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য তো সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা। তাহলে আমরা কেনই-বা জিপিএর পিছনে ছুটছি? এর প্রয়োজনীতা কি কেবল সরকারের ক্ষমতা পোক্ত করার জন্য নাকি পত্রিকায় ছেলেমেয়েদের ভি-চিহৃ প্রদর্শনের সুযোগ করে দিতে? আমরা অনুকরণে ভাসছি। আমাদের শিক্ষা পদ্ধতির শতকরা ৯২ ভাগই ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে মিল রেখে করা। গ্রেডিং সিস্টেম ভারতের আটটি হলেও বাংলাদেশের সাতটি। তবে মূল শিক্ষার ধাঁচ একই।

আমরা হয়তো দারিদ্রের অজুহাতে ভারতকেই আঁকড়ে ধরেছি। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কেন স্ট্যান্ডার্ড শিক্ষা পদ্ধতি পাচ্ছি না? পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর গ্রেডিং পদ্ধতিতে কোনো 'এ প্লাস' নেই। অধিকাংশ দেশে পাঁচটি গ্রেড (এ- ৯০ থেকে ১০০, বি- ৮০ থেকে ৮৯, সি- ৭০ থেকে ৭৯, ডি- ৬০ থেকে ৬৯ আর এফ- ৫৯ কম)। কিন্তু আমরা জিপিএ ৫ কিংবা এ প্লাসের যে ঐতিহ্য তুলে ধরছি তা মূলত খুশি করার জন্য।

তাই জিপিএ ৫ আর গোল্ডেনের প্রবণতা থেকে বের হওয়া জরুরি। আমাদের জিপিএ ভালো করার পিছনে নয়, মেধার সঠিক চর্চার পথে হাঁটতে হবে। প্রয়োজনে উপরের আর্দশিক জিপিএ পদ্ধতি গ্রহণ করে আমাদের প্রচলিত পদ্ধতির কিছুটা রদবদল এনে শিক্ষার্থীদের জিপিএ ৫ পাওয়ার লোভ থেকে বের করে আনতে হবে। কারণ আমাদের দরকার মেধার বিকাশ আর শিক্ষিত জনগোষ্ঠী।

একটি দেশকে সক্রিয় আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে এই শিক্ষিত জনগোষ্ঠী দেশের অর্থনীতির খুঁটি হিসেবে কাজ করবে। তারা স্ব-উদ্ভাবন শক্তিতে দৃঢ় হলে বাংলাদেশ একটি স্বাবলম্বী দেশে পরিণত হবে। সে জন্য মেধার চর্চা ব্যতীত আমাদের অন্য উপায় নেই।

জানি, আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়েছে। প্রতি বছর পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস একটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দারিদ্র আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। আর তা ঘোচানোর জন্য প্রয়োজন স্ব-শিক্ষা। এখনই সময় আমাদের ভবিষৎ অনুসন্ধানে শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা। স্ব-শিক্ষার প্রতিটি উপাদান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছড়িয়ে দেওয়া। ধর্মীয় উগ্রবাদ যেখানে একটা বড় সমস্যা সেখানে স্ব-শিক্ষায় মস্তিষ্কের আর বিবেকের সঠিক দ্বার উম্মোচন আমাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে।

আমরা হয়তো একবারে তা অর্জন করতে পারব না, তবে এখনই পরিকল্পনা হাতে নেওয়া প্রয়োজন। আজ থেকে দশ কিংবা কুড়ি বছর পর আমরা ঠিকই আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারব। ক্ষুদ্র সম্পদের সঠিক ব্যবহার কীভাবে করতে হয় তা স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী পারে আলো ধরতে। বেকার সমস্যা রোধ করতে, এই ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি অতীব জরুরি বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। তাই আমার বিশ্বাস, সরকার কিংবা রাষ্ট্র বিষয়গুলো নিয়ে ভাববে।

বিশ্বের দরবারে আমরাও এক সময় সামনের কাতারে যাব, সে প্রত্যয় প্রত্যেক বাঙালির মনে বাস করুক তেমন প্রত্যাশা রইল।