যেখানে রাষ্ট্রই অনন্তদের চুপ করিয়ে দিতে চায়

বন্যা আহমেদ
Published : 12 May 2016, 06:21 AM
Updated : 12 May 2016, 06:21 AM

গত বছর যতবার ভেবেছি আমি সুস্থ হতে শুরু করেছি, ততবারই তা যেন ভেঙে পড়েছে প্রতিটা হত্যার ঘটনায়।

মনে আছে টুটুলের হত্যাচেষ্টা আর দীপনের হত্যার দিন আমি ১৪ ঘণ্টা একটানা একটা চেয়ারে বসে থেকেছি, কী যে অদ্ভুত এক ক্ষুব্ধতা নিয়ে বসে থেকেছি তা ভাবলেও গা শিউরে ওঠে। সেদিনই দীপনের বাবার কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলেছিলাম, 'আমিও চাই না অভিজিতের হত্যার বিচার, আমাদের উপর নৃশংস মধ্যযুগীয় আক্রমণের'। জানতাম এসব হত্যার বিচার করার সদিচ্ছা এ সরকারের থাকার কথাও নয়।

আর গত বছর এই দিনে?

২৬ ফেব্রুয়ারি আমাদের উপর আক্রমণের পর অনন্ত প্রমিজ করেছিল, আমি পড়ি কি না পড়ি সে আমাকে প্রতিদিন একটা করে ইমেইল করবেই। আমাদের উপর আক্রমণের পরে আমার ব্যক্তিগত আইফোন আর পাওয়া যায়নি, কিন্তু আমার অফিসের ব্ল্যাকবেরিটা ছিল তখনও। কাজের ইমেইলেই প্রতিদিন একটা করে ইমেইল করত অনন্ত। স্কয়ারের আইসিউতে ওই চারদিন তো ইমেইল দেখার মতো অবস্থা ছিল না; কিন্তু তারপর আমেরিকায় মেয়ো ক্লিনিকের আইসিউতে থাকার সময় প্রতিদিন 'দিদি কেমন আছ' বলে ইমেইল করত অনন্ত। চোখে এখনও ভাসে সেই ইমেইলগুলো।

শুনেছিলাম, আক্রমণের কথা শুনে তখনই সিলেট থেকে ঢাকায় চলে এসেছিল, কিন্তু ডাক্তাররা দেখা করতে দেয়নি বলে স্কয়ারের দরজাতেই বসে ছিল সে। ওকে অনেক বার বলেছিলাম, "তুমি তো টার্গেট হবেই, কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাক, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।'' শোনেনি। বলেছিল, চাকরি ছেড়ে, অসুস্থ বাবাকে ছেড়ে কীভাবে যাবে সে।

গত বছর এই দিনে, ভাইবারে এক বন্ধু আমাকে খবরটা দিয়েছিল। আমি এক ফোঁটা চোখের পানিও ফেলিনি, আবারও স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম অনেকক্ষণ। চোখে জল আমার এমনিতেই কম আসে, গত বছরের পর যেন তা হারিয়েই গেছে।

সেই কোন ছোট্টবেলা থেকে মুক্তমনায় লেখালেখি করত অনন্ত; আমাকে দিদি ডাকত– ইউনিভার্সিটিতে পড়ার শুরু থেকেই মনে হয়। দেশে গেলে সিলেট থেকে দেখা করতে চলে আসত ঢাকায়। আমি জোর করে ওর পকেটে বাসের ভাড়াটা গুঁজে দিতাম; বলতাম, ''পড়ালেখা শেষ করে চাকরি পেলে শোধ করে দিও।''

'বিবর্তনের পথ ধরে' বইটা লিখতে লিখতে তিতিবিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, ''পারব না আর ইনডেক্স তৈরি করতে।''

অনন্ত ঢাকায় এসে, কদিন সেখানে থেকে ইনডেক্সটা তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিল নিজ থেকেই।

কিছু কিছু সম্পর্ক আছে ব্যাখ্যা করা যায় না। জীবনে মাত্র কয়েকবার দেখা হয়েছে অনন্তের সঙ্গে। কিন্তু ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা সে রকমই ছিল। কী দেব এর নাম? বন্ধু, ভাই, কমরেড? জানি না। দরকারও নেই বোধহয়।

অনেকেই ব্লগে লেখালেখি করে, অনেকেই ফেসবুকে অনেক কিছু লেখে। কিন্তু মৌলিক চিন্তার অধিকারী খুব কম লেখকই হয়ে উঠতে পারে। ওর সঙ্গে আমার চিন্তার পার্থক্য ছিল অনেক কিছুতেই, কিন্তু ওর অমায়িকতা এবং স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারার ক্ষমতায় মুগ্ধ হতাম সব সময়। এই বয়সেই সে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতার ছোট কাগজ 'যুক্তি' বের করত। 'পার্থিব', 'ডারউইন: একুশ শতকে প্রাসঙ্গিকতা এবং ভাবনা', 'জীববিবর্তন: সাধারণ পাঠ'সহ বেশ কয়েকটা বইও প্রকাশ করেছিল।

দেশে এখন যা হচ্ছে তা তথাকথিত 'নাস্তিক ব্লগার' মারার পরিধি ছাড়িয়ে গেছে কবেই। নাস্তিক মারা দিয়ে ওরা হাত পাকিয়েছে, এখন সেই পাকা খুনি-হাতের থাবা বিস্তৃত হয়েছে আরও বহুদূর। এই ব্লগাররা ওদের জন্য খুব সোজা টার্গেট ছিল।

একটু খেয়াল করলেই দেখবেন যে, এখন সব ধরনের সংখ্যালঘুতা (মাইনরিটি) এবং বহুত্বটাই (ডিভারসিটি) টার্গেট করা হচ্ছে। শিয়া, হিন্দু, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ, পুরোহিত, পাদ্রি, সমকামী জনগোষ্ঠী, সেকুলার অ্যাকটিভিস্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষক– কেউ বাদ নেই। এই ইসলামি সন্ত্রাসীরা শুধুমাত্র তাদের দ্বারা অনুমোদিত চরমপন্থী ওয়াহাবী ইসলাম ছাড়া আর কোনো গোষ্ঠীকেই সমাজে টিকে থাকতে দিতে রাজি নয়। শুধুমাত্র তাদের মত ছাড়া আর কোনো মত তারা প্রকাশ করতে দেবে না। চিরপরিবর্তনশীল সমাজ এবং সংস্কৃতিকে তারা বদ্ধ পঙ্কিল জলাশয়ের মতোই আটকে ফেলতে চায়– প্রতিক্রিয়াশীলেরা যেটা সব সময় চেয়েছে।

প্রগতিশীলতা আর প্রতিক্রিয়াশীলতার এই দ্বন্দ্ব সমাজে নিরন্তর চলতেই থাকে। তবে যখন প্রতিক্রিয়াশীলেরা ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে তখনই সেটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।

১৮০০ শতাব্দীতে ওয়াহাবী মতাদর্শের প্রতিষ্ঠাতা আবদ-আল-ওয়াহাব এবং সৌদ বংশের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ-বিন-সৌদের মধ্যে ঐক্য স্থাপিত হওয়ার পর পৃথিবীব্যাপী ওয়াহাবী ইসলাম বিস্তৃতির কাজে এতটা সাফল্য তারা আর কখনও পায়নি। সেই পুরনো ধর্ম এবং রাজনীতির মেলবন্ধন। এর পিছনে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন, সৌদ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, তেল আবিষ্কার এবং এই তেলের রাজনীতি ঘিরে ব্রিটেন এবং আমেরিকার সরাসরি সহযোগিতায় সৌদি আরব এবং সংশ্লিষ্ট আরব দেশগুলোর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির বিস্তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। খুব অল্প সময়েই তারা কোরানের আক্ষরিক ব্যাখ্যাসমৃদ্ধ ওয়াহাবী মতবাদের ইসলামকে অন্যান্য মুসলিম দেশ এবং সংস্কৃতিতে দ্রুত প্রসারিত করতে সক্ষম হয়েছে।

তারা এতটাই সফল হয়েছে এই কাজে যে, পৃথিবীর বেশ বড় এক মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে এটাই এখন ইসলামের একমাত্র রূপ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। অথচ ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় কত দেশে কত ধরনের কত রূপের ইসলামেরই না অস্তিত্ব আছে এবং ছিল পৃথিবীতে– এবং সে কথা সব বড় বড় বৈশ্বিক ধর্ম সম্পর্কেই প্রযোজ্য।

ধর্ম বরাবরই ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে রাজনীতির হাত ধরে এবং এই পারস্পরিক মিথোজীবীতার সম্পর্কটার নাম দেওয়া যায় 'আনহোলি অ্যালায়েন্স'। ধর্ম রাজনীতির বৈধতা দেয়, আর বিনিময়ে সম্পদ, ক্ষমতা ও যা কিছু ইহকালে ভোগ্য, সে সবের পরিপাটি ভাগ পায়। একটা উইন-উইন সিচুয়েশন।

সেই যিশুর জন্মের অন্তত তিন সহস্রাব্দেরও বেশি আগে মহেঞ্জোদারোর সভ্যতা, বা তিন সহস্রাব্দ আগের সুমেরীয় সভ্যতা, কিংবা আড়াই হাজার খ্রিস্টপূর্বেরও বেশি পুরনো মিশরীয় সভ্যতা থেকে আধুনিক সব সেমেটিক ধর্মেও একই সুর বহমান। রোমে খ্রিস্টান ধর্মের পত্তন থেকে শুরু করে ওয়াহাব-সৌদ ঐক্যের কাহিনি, ক্রুসেড বা আধুনিক যুগের আমেরিকা-বিন লাদেন ঐক্য এবং আমাদের সরকার আর হেফাজতের ভালোবাসার কাহিনিও কম-বেশি একই সুরে বাঁধা।

উপনিবেশ-পরবর্তী যুগের সাম্রাজ্যবাদী পলিসি, আমেরিকান এবং রাশিয়ান ব্লকের মধ্যে তেল এবং বিশ্ব-সম্পদের কর্তৃত্ব নিয়ে হানাহানি, বিভিন্ন মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐতিহাসিক বিবাদ, স্থানীয় স্বৈরশাসক এবং অগণতান্ত্রিক সরকারের সাম্রাজ্যবাদের লেজুড়বৃত্তি এবং ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে এখন যেন এই মধ্যযুগীয় ইসলামিক স্টেট বা আল কায়দা ভার্সনের ইসলামি আদর্শ হয়ে উঠেছে একমাত্র ত্রাণকর্তা। হতাশাগ্রস্ত, অবিরত সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এবং ভিতরের ও বাইরের যুদ্ধ-বিগ্রহে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মধ্যপ্রাচীয় সুন্নি মুসলমানদের একটা অংশের কাছে যেন এটাই একমাত্র মুক্তির উপায় হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে আজ।

এদিকে, বাংলাদেশের বাঙালির ইতিহাস পড়লে বা আঞ্চলিক শিল্প-সাহিত্য দেখলে মনে হয়, সাম্প্রদায়িকতার রেশ এখানে সব সময় অল্পবিস্তর ছিল, বড় দাগে ইসলামি এবং হিন্দু মৌলবাদের শেকড় এখানে অনেক আগে থেকেই প্রোথিত ছিল। তবে সমাজে সেটা কতখানি শক্তভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল সেটা হয়তো গবেষণার বিষয়।

গত কয়েক দশকে, বাইরে থেকে ওয়াহাবিজমের সরাসরি ইঞ্জেকশান, ইসলামভিত্তিক রাজনীতি এবং ব্যাপক মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতিষ্ঠা, সামাজিক এবং সাংষ্কৃতিকভাবে (অর্থনৈতিকভাবেও বাদ পড়েনি অবশ্য) ইসলামিকরণের ব্যাপক উদ্যোগ ইত্যাদি যেন দেশে আরেক প্যারাডাইমের জন্ম দিয়েছে। প্রযুক্তির সুতোয় বাঁধা আজকের পৃথিবীতে এক ধরনের বিশ্ব ইসলামি উম্মা তৈরি হতেও বেশি সময় লাগেনি। আর সব ধর্মের মতোই ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরীন কিছু হিংস্র মতাদর্শগত অবস্থান এবং মৌলবাদও পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।

ইউরোপে পুঁজিবাদী বিকাশের অংশ হিসেবে অন্যান্য আব্রাহামিক ধর্মগুলো, বিশেষত খ্রিস্টান ধর্ম যে রিফরমেশনের মধ্য দিয়ে গেছে সেটা ইসলাম ধর্মে এখনও না ঘটায় ধর্মগ্রন্থের আক্ষরিক ব্যাখ্যা বা ওয়াহাবী ইসলাম বিশাল এক জনগোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পেরেছে এত সহজে।

ওদিকে দেশের ভিতরে সাম্রাজ্যবাদী কর্পোরেট পুঁজি এবং কনজিউমারিজমের অনিবার্য আগ্রাসন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দারিদ্র্য, ব্যাপক আয়বৈষম্য, দুর্নীতি ইত্যাদির মতো প্রধান কারণগুলো তো ইতোমধ্যে বিদ্যমান ছিল। সেই সঙ্গে এবার যোগ হল মধ্যপ্রাচ্যব্যাপী অস্থিরতা এবং সুচিন্তিতভাবে গত কয়েক দশক ধরে ওয়াহাবী ইসলাম বিস্তারের প্রভাব।

তাই অবাক হই যখন দেখি এত জটিল এই বৈশ্বিক সমস্যাটাকে একদম শুধুই 'ইসলামের সমস্যা' আর আরেক দল শুধুই 'সাম্রাজ্যবাদের সমস্যা' বলে মুখে খই ফোটানোর চেষ্টা করেন। আজকে পৃথিবীব্যাপী যে হিংস্র এবং নড়বড়ে এক ভয়াবহতার সৃষ্টি হয়েছে তার ভিত্তি অনেক গভীরে প্রোথিত। সেই আলোচনা এই অল্প পরিসরে করা ঔদ্ধত্যেরই শামিল। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়া, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সে সময় উপনিবেশিক শক্তিগুলোর স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্য মাথায় রেখে পৃথিবীর বিশাল এলাকা জুড়ে যথেচ্ছ রাষ্ট্রসীমানা টানা, ইসরাইল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্ব, কোল্ড ওয়ার এবং কোল্ড ওয়ার-পরবর্তী সাম্রাজ্যবাদী কামড়া-কামড়ি, তেলের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জটিল লড়াই, আরব ন্যাশনালিজমের উদ্ভব এবং সেখানে নির্লজ্জ সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ ইত্যাদির মতো জটিল সব বিষয় গোণায় ধরে এই আলোচনায় নামতে হবে।

সেই সঙ্গে ইসলামের ভিতরের হিংস্রতা এবং মৌলবাদের সমালোচনাও করতে পারতে হবে। আজকের প্রগতিশীল এবং সচেতন বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞদের একই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ এবং ইসলামি মৌলবাদের সমালোচনা করার ক্ষমতা থাকা অতীব প্রয়োজন হয়ে পড়েছে এই মুহূর্তে।

এ রকম একটা জটিল পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের মতো একটা দারিদ্রপীড়িত দেশের সরকার এবং জনগণের দায়িত্ব আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর সেকুলার কন্সটিটিউশানসহ একটা আধুনিক রাষ্ট্রের সরকার যখন রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য নিজেই সংখ্যালঘু, বহুত্ব এবং স্বাধীন মতের টুঁটি চেপে ধরে, তখন বিচারহীনতার সংস্কৃতি আস্কারা পেতে বাধ্য।

বাংলাদেশের সরকার এখন রাজনৈতিক কারণে হেফাজতের মতো প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় মৌলবাদীদের সঙ্গে আঁতাত করে, সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার না করে, হত্যার জন্য তাদের বিচার না করে বরং নাস্তিক ব্লগারদের মৃত্যুর জন্য লজ্জাজনকভাবে তাদের লেখালেখিকেই দায়ী করে। সমকামিতা 'সমাজবহির্ভূত' আখ্যা দিয়ে সমকামীদের হত্যা জায়েজ করে। অথচ ধর্মহীন এবং সমকামীদের সংখ্যা হিসাব করলে তা পৃথিবীতে মোট জনগোষ্ঠীর ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। পৃথিবীর সব পশচাদপদ উৎপীড়নকারী সরকারের কাছেই জানতে ইচ্ছে করে, এত মানুষকে আপনারা শাস্তি দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারবেন?

কদিন আগের রিপোর্টে দেখা গেল, গ্রেফতারকৃত সন্ত্রাসীদের বেশিরভাগই নাকি জামিনে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। অনন্তের কেইসে ধরা ব্যক্তিটিও বোধহয় জামিন পেয়ে গেছে। দীপন, অভিজিৎ এবং আমার উপর হামলাকারীরা নাকি কেউ কেউ দেশ ছেড়ে চলে গেছে! প্রশ্ন হল, তারা সেটা জানলেন কীভাবে, জানলে ঠেকালেন না কেন, কিংবা তাদের গ্রেপ্তার করলেন না কেন!

ওহহো, আমি বোধহয় খুব ভুলভাল প্রশ্ন করে ফেললাম, যার উত্তর সবাই জানেন। ডিলানের ভাষায়, 'দ্য অ্যানসার ইজ ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড'।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সরকার আজ যে বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে লাই দিয়ে যাচ্ছে এবং মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারে সহায়তা করছে তার ফলাফল ভয়াবহ হতে বাধ্য। এ রকম অবস্থায় সমাজ-জুড়ে ধর্মীয় সন্ত্রাসের থাবা আরও বিস্তৃত হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। তাই এখন হত্যাকাণ্ড ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে শুরু করে প্রগতিশীল অ্যাকটিভিস্ট বা সাহিত্যমনা ইউনিভার্সিটির শিক্ষক পর্যন্ত। দেশে কেউ আজ আর নিরাপদ বোধ করছেন না।

কিছুক্ষণ আগে এক সংখ্যালঘু লেখক বন্ধু জানাল, তাকে নাকি নিয়মিতভাবে জীবনের হুমকি দিয়ে ফোন করা হচ্ছে বিভিন্ন জায়গা থেকে, প্রস্তুত থাকতে বলা হচ্ছে। দেশে মোহাম্মদ জাফর ইকবালের মতো সম্মানিত একজন লেখক এবং শিক্ষককেও যখন পুলিশি নিরাপত্তা নিয়ে চলাফেরা করতে হয়, তখন কী করে সে দেশের সরকার সব কিছু সুস্থ এবং স্বাভাবিক আছে বলে দাবি করে তা আমাদের ধর্তব্য নয়।

যে দেশে এক মাসে ছয়জন নাগরিক ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয় সে দেশের সরকার কী করে এগুলোর দায় নেবে না বলে সেটাও বোঝা কঠিন। তবে দায় তারা নিক আর না নিক, ভারতীয় উপমহাদেশের আল কায়দা আর আইসিস কিন্তু একের পর এক হত্যাগুলোর দায় স্বীকার করেই যাচ্ছে।

আমাদের সরকার বোধহয় বুঝতে পারছে না যে, যে কোনো প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় মৌলবাদীর সঙ্গে আঁতাত কখনও সুফল বয়ে আনতে পারে না, ইতিহাস জুড়েই এর ভুরি ভুরি সাক্ষ্য ছড়িয়ে আছে। বিন লাদেনের সঙ্গে আমেরিকার বন্ধুত্বের ফলাফল তো আমরা দেখেছি। ইরানে কমিউনিস্টদের সঙ্গে ইসলামিস্টদের আঁতাতের ফলাফলও দেখেছিলাম। ইরাক এবং সিরিয়ায় আইসিসকে অন্ধভাবে বাড়তে দিয়ে পৃথিবীব্যাপী আজ যে ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হয়েছে তার উদাহরণও চোখের সামনেই রয়েছে।

এ রকম পরিস্থিতিতে দেশের প্রগতিশীল অংশটি এগিয়ে না এলে অবস্থা আরও খারাপের দিকেই যেতে বাধ্য। আতঙ্ক ছড়িয়ে থাকা সমাজেও খুব কম হলেও কেউ কেউ যে এগিয়ে আসছেন, প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, সেটা অবশ্যই সুলক্ষণ।

প্রায়ই ভাবি অভিজিৎ, অনন্তরা থাকলে এখন কী বলত, কী ভাবত। ওদের জ্ঞানের গভীরতাটা যেহেতু জানি, তাই বুঝি আজকের পরিস্থিতির জটিল ডায়নামিক্স এবং বুৎপত্তিটা বোঝার চেষ্টা করত। আর নিজের ক্ষুদ্র পরিসরে যতটুকু কাজ করা সম্ভব, অদম্যভাবে তাই করে যাওয়ার চেষ্টা করত।

চলুন আমরাও তাই করার চেষ্টা করি।