নতুন ব্যাংক: অর্থমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ

আবদুর রহিম হারমাছি
Published : 11 Sept 2011, 04:09 PM
Updated : 11 Sept 2011, 04:09 PM

'বাংলাদেশের মতো ছোটো অর্থনীতির দেশে এতো বেশি ব্যাংকের শাখার প্রয়োজন নেই'- এ যুক্তি দেখিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের (সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক) লোকসানী শাখাগুলো বন্ধ করতে বলেছিল বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ। সে সময়কার সরকার দাতাদের কথামতো কাজও করেছিল।

সময় অনেক গড়িয়েছে। দেশের অর্থনীতিও বড় হয়েছে। এখন ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানি আয় দেশে আসছে। আমদানি ব্যয় ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এরই মধ্যে বেসরকারি খাতে একটার পর একটা ব্যাংক গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন সরকারের সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া হয়েছে এ সব ব্যাংকের লাইসেন্স। বার বার প্রশ্ন উঠেছে দেশে এতো ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। কিন্তু কে শুনেছে কার কথা। যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে নিজের দলের প্রভাবশালীদের জোর তদবিরের কাজে নতি স্বীকার করে ব্যাংক ব্যবসার অনুমতি দিয়েছে।

বর্তমান মহাজোট সরকারের সময়েও তার ব্যত্যয় ঘটছে না। নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। জাতীয় সংসদে প্রথম তিনি এ ঘোষণা দেন। গত ২৮ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটের উপর সমাপনী বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, 'আরও কয়েকটি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হবে।' তখন অবশ্য বিষয়টি নিয়ে তেমন আলোচনা হয় নি। আগস্টের প্রথম দিকে ইকনোমিক রিপোর্টার্স ফোরামের এক আলোচনায় অর্থমন্ত্রী বলেন,'বেসরকারি খাতে নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার বিষয়টি সরকারের একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।'

অর্থমন্ত্রীর ঐ মন্তব্যের পর থেকেই আলোচনার ঝড় ওঠে। সরকারের অন্য কোনো মন্ত্রী অবশ্য এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করেন নি। তবে অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী নেতা ও ব্যাংকাররা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। কেউ বলছেন, দেশে আর কোনো ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। আবার কেউ বলেন, সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার জন্য নতুন ব্যাংকের অবশ্যই প্রয়োজন আছে। এখানে কয়েক জনের কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করছি। বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করা মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, 'নতুন ব্যাংকের অবশ্যই প্রয়োজন আছে।' আর বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'প্রয়োজন নেই।' ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই-এর সভাপতি এ কে আজাদ নতুন ব্যাংকের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন। সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেস্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম নতুন ব্যাংকের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। আরও অনেকে পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য দিয়ে চলেছেন।

এদিকে নতুন ব্যাংক নিয়ে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। লাইসেন্স বা নিবন্ধন পাওয়া তো দূরের কথা বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য আবেদনপত্রই চায়নি। কিন্তু কার্যালয় খুলে, সাইনবোর্ড টাঙিয়ে নিয়োগ-প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে 'দি ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেড'। প্রস্তাবিত এ ব্যাংকটির মূল উদ্যোক্তা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সাংসদ সরকারি হিসাব-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মহীউদ্দিন খান আলমগীর। ২৪ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে এ খবর প্রকাশিত হয়। ঐ দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় নতুন ব্যাংক অনুমোদনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক ওঠায় শেষ পর্যন্ত নতুন ব্যাংকের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়।

দেশে বর্তমানে তফসিলি ব্যাংকের সংখ্যা ৪৭। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চারটি বাণিজ্যিক, ৩০টি বেসরকারি, নয়টি বিদেশী ও চারটি বিশেষায়িত ব্যাংক রয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করে জানায় যে, দেশে এখন নতুন ব্যাংকের আর প্রয়োজন নেই। কারণ হিসেবে পর্ষদ আমাদের অর্থনীতির আকার, প্রতিযোগী ও দক্ষিণ এশীয়ার দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে তফসিলি ব্যাংক বেশি বলে অর্থমন্ত্রীকে অবহিত করে। তারপরও কেবলমাত্র রাজনৈতিক চাপে দেয়া হচ্ছে নতুন ব্যাংক। অর্থমন্ত্রী তা অকপটে স্বীকারও করেছেন।

২০০১ সালের পর থেকে দেশে নতুন কোনো তফসিলি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয় নি। তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ৮২টি নতুন ব্যাংক স্থাপনের আবেদন জমা আছে। এর মধ্যে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নতুন করে ২০টি আবেদন জমা পড়েছে।

ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ অনুযায়ী বাংকের লাইসেন্স দেওয়ার একমাত্র ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২ অনুযায়ী এ বিষয়ে কিছু নির্দেশনা দেওয়ার ক্ষমতা আগে সরকারের ছিল। কিন্তু ২০০৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডারে সংশোধনী এনে সরকারের নির্দেশনা দেওয়ার ক্ষমতা তুলে নেয়া হয়।

বর্তমান সরকারের আমলে সংসদে বিশেষ আইন প্রণয়ন করে 'প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক' নামে একটি নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রবাসীদের মূলধনে 'এনআরবি' ব্যাংক নামে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠারও উদ্যোগ দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই এ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন।

স্বাধীনতার পর পাকিস্তান আমলের ব্যাংকগুলোকে রাষ্ট্রীয়করণ করা হলে ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়ায় ছয়টিতে। এরশাদের আমলে পূবালী ও উত্তরাকে বিরাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে বেসরকারি খাতে ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়। এরশাদ সরকারের সময়ে বেসরকারি খাতে মোট নয়টি ব্যাংক স্থাপন করা হয়। এরপর বিএনপি'র আমলে নতুন আরও আটটি এবং পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের আমলে (২০০১ সাল পর্যন্ত) আরও ১৩টি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয়।

অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তার কিছু কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা চোখে পড়ার মতো। মুখে যেটা বলেছেন সেটা করার চেস্টা করেছেন। বিশ্ব অর্থনীতিতে যখন মন্দা চলছে, সে সময় অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব নিয়েই ঘোষণা দেন, মন্দা মোকাবিলায় করণীয় ঠিক করতে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হবে। সরকারি, বিরোধীদল ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদের নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করেন । ঐ টাস্কফোর্সে বিএনপি নেতা এম কে আনোয়ারও ছিলেন। টাস্কফোর্সেও সুপারিশ অনুযায়ী মন্দা মোকাবিলার জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু অনেকের বিবেচনায় বাংলাদেশ ভালোভাবেই মন্দা মোকাবিলা করেছিল।

গত বছরের ডিসেম্বরে শেয়ারবাজারে বড় ধসের কারণ খুঁজতে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে একটি কমিটি করেন অর্থমন্ত্রী। সেই কমিটির রিপোর্ট জনসম্মুখে প্রকাশ করে সবাইকে অবাক করে দেন তিনি। শুধু তাই নয়, শেয়ারবাজার স্বাভাবিক করতে কমিটির সুপারিশের আলোকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা- এসইসি পুনর্গঠনসহ নানা পদক্ষেপ নেন। গ্রামীণ ব্যাংকের অনিয়ম তদন্তেও একটি কমিটি করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। সে কমিটির রিপোর্টও সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশ করেছেন।

অর্থমন্ত্রীর এ সব কর্মকাণ্ড খুব কাছে থেকে দেখেছি। ব্যাক্তিগতভাবে তিনি আমাকে চেনেন। তিনি যেনো হুট করে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নেন। যেহেতু বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক উঠেছে, সে কারণে এ বিষয়টি নিয়েও একটি কমিটি গঠন করতে পারেন অর্থমন্ত্রী। কমিটি যে সুপারিশ করবে তার আলোকে যেনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আমার বিশ্বাস অর্থমন্ত্রী প্রধানমন্ত্র্রীকেও কমিটি গঠনের বিষয়টি রাজি করাতে সক্ষম হবেন।

দেশের জন্যই রাজনীতি। দেশের অর্থনীতির জন্যই রাজনীতি। রাজনীতির চাকায় যেন অর্থনীতি পিষ্ট না হয়- সে বিষয়টি সবারই বিবেচনায় রাখা উচিৎ।

আবদুর রহিম হারমাছি: লেখক ও সাংবাদিক।