রাজনীতির বটবৃক্ষ : আবদুস সামাদ আজাদ

আহমেদ নূর
Published : 27 April 2016, 09:48 AM
Updated : 27 April 2016, 09:48 AM

কী অভিধায় ভূষিত করা যায় তাঁকে? কোন বিশেষণ তাঁর বিশালত্ব ধারণ করতে পারে? রাজনীতির বরপুত্র নাকি রাজনীতির সিংহপুরুষ? গণমানুষের নেতা নাকি রাজনীতির ভূমিপুত্র?

কোনোটাই যেন যুতসই হয় না। কেমন যেন অপূর্ণতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আসলে এ রকম বিশেষণযুক্ত শব্দ চয়ন করে তাঁকে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ সম্ভব নয়। কারণ তিনি ছিলেন রাজনীতির এক বটবৃক্ষ। যাঁর বিশাল ছায়ায় সবাই একত্রিত হতেন। তাঁর সান্নিধ্য পেতে অনেকেই আসতেন সময়ে-অসময়ে, দুর্যোগে-সংকটে। তাই ব্যক্তি রাজনীতিক থেকে তিনি পরিণত হয়েছিলেন এক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে। সমুদ্রের মতো বিশাল তাঁর কর্মপরিধি। হাত বাড়ালেই যেমন আকাশ ছোঁয়া যায় না, তেমনি তাঁর সম্পর্কে যতই বলা হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে অনেক কিছুই বলা হয়নি।

তিনি এ মাটিরই সন্তান। জননেতা আবদুস সামাদ আজাদ। আজ তাঁর ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল ৮৩ বছর বয়সে তিনি মারা যান।

আবদুস সামাদ আজাদ একটি নাম, একটি ইতিহাস। মানুষের কাছে যিনি আপন আলোয় উদ্ভাসিত। এক ত্রিকালদর্শী রাজনীতিবিদ। ব্রিটিশ আমলে তাঁর রাজনীতির হাতেখড়ি। পাকিস্তান আমলে তুখোড় রাজনীতিবিদ। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের সঙ্গে ছিলেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিন পতাকার বাসিন্দা এই মানুষটি তাঁর মেধা ও প্রজ্ঞায় এক সময় ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল পেরিয়ে উপমহাদেশের রাজনীতির এক মহীরুহে পরিণত হন। তাঁর নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক অনন্ত জীবনের অধিকারী জননেতার প্রতিকৃতি।

আবদুস সামাদ আজাদ ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামেও তাঁর অবদান নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল। এছাড়াও প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন।

১৯২২ সালের ১৫ জানুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর থানার প্রত্যন্ত অঞ্চল ভুরাখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন গণমানুষের এই নেতা। ছাত্র অবস্থাতেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪০ সালে সুনামগঞ্জ মহকুমা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি হন। পরে অবিভক্ত আসামের মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৪৮ সালে আবদুস সামাদ আজাদ সিলেট এমসি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু সরকারবিরোধী রাজনীতির কারণে মাস্টার্স শেষ পর্বের পরীক্ষা তাঁকে দিতে দেওয়া হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনের কর্মচারিরা তাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের দাবিতে ধর্মঘট শুরু করেন। ছাত্রনেতা হিসেবে আবদুস সামাদ আজাদও সেই আন্দোলনে সমর্থন দেন এবং যুক্ত হন। এই অপরাধে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে বহিষ্কার করা হয়। ওই সময় একই অপরাধে শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৬ জনকে আর্থিক জরিমানা, ৬ জনকে চার বছরের জন্য বহিষ্কার এবং ১৫ জনকে হল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন বিলুপ্ত হয়ে গেলে আবদুস সামাদ আজাদ নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং ১৯৪৯-৫০ সালে এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তখন শাহ আজিজুর রহমান (সাবেক প্রধানমন্ত্রী) উক্ত সংগঠনের সভাপতি ছিলেন। ১৯৫১ সালে নতুন গড়ে ওঠা পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগে যোগ দেন আবদুস সামাদ আজাদ। নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় তিনি ওই সম্মেলনে যোগ দেন। শুধু তাই নয়, সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণের পর তিনি একটি খসড়া মেনিফেস্টো সম্মেলনে উপস্থাপন করেন।

এ অবস্থায় নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ তাঁকে তিনদিনের জন্য সংগঠন থেকে বহিস্কার করে। এই তিনদিনের মধ্যে তাঁকে যুবলীগের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছেদ করার কথা বলা হয়। অন্যথায় তাঁকে সংগঠন থেকে স্থায়ীভাবে বহিস্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সংগঠনের এই সিদ্ধান্তের পর আবদুস সামাদ আজাদ নিজেই নিখিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে এমনকি সংগঠনের প্রাথমিক সদস্য পদ থেকেও পদত্যাগ করেন।

আবদুস সামাদ আজাদ পাকিস্তান আমলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য এবং শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন, ১৯৫১ সালে মেডিকেল ছাত্রদের আন্দোলন এবং পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি প্রস্তাব-বিরোধী আন্দোলনেও নেতৃত্ব দেন।

বাঙালি জাতির আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় মহান ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনে আবদুস সামাদ আজাদ সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেন। সিলেটে এবং ঢাকায় আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ঢাকায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি।

এখানে একটি বিষয় প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখযোগ্য যে, একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা যে মিছিলটি বের করেন তাতে আবদুস সামাদ আজাদের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। সভায় কয়েকজন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরোধিতা করলেও তিনিসহ অন্যরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে অবস্থান নেন। যখন সেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তখন কীভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা যায় সেই দিকনির্দেশনাও তিনি দিয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে 'দশজনের' মিছিল এখন ইতিহাসের অংশ। এই 'দশজনী' মিছিলের প্রস্তাবক ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার দায়ে তিনি গ্রেপ্তার হন ও কারাবরণ করেন।

১৯৫৩ সালে মাহমুদ আলী, হাজী দানেশ ও আতাউর রহমান প্রমুখের নেতৃত্বে পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল (পিডিপি) নামে একটি অসাম্প্রদায়িক বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠিত হলে সেটির সঙ্গে তিনি যুক্ত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে পিডিপি যুক্তফ্রন্টে যোগ দেয়। আবদুস সামাদ আজাদ যুক্তফ্রন্ট থেকে নির্বাচন করে পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন।

শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে ১৯৫৫-৫৭ সাল পর্যন্ত আবদুস সামাদ সামাদ আজাদ সংগঠনের কেন্দ্রীয় শ্রম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনের পর মওলানা ভাসানীর সঙ্গে এক হয়ে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি এই দলের সহ-সম্পাদক ও দলের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন।

আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পর আবদুস সামাদ আজাদের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং তাঁর মাথার মূল্য ৫০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। এ সময় তিনি আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু এক সময় গ্রেপ্তার হন। প্রায় চার বছর জেলে থাকার পর ১৯৬২ সালে মুক্তি পান। ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে তিনি আবার আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন এবং বৃহত্তর সিলেট আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আবদুস সামাদ আজাদ অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন। যুদ্বকালীন সময়ে মুজিবনগর সরকার গঠনেও ছিল তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মুজিবনগর সরকারে তিনি ছিলেন রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত। এছাড়া তিনি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের সদস্যও ছিলেন।

১৯৭১ সালের ১৩-১৬ মে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব শান্তি সম্মেলন। এই সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। সম্মেলনে তিনি দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। সেদিন তিনি তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে হাজার বছর যুদ্ধ চালিয়ে যাবে বাংলাদেশের মানুষ। একই সঙ্গে তিনি আন্তর্জাতিক সংহতি এবং জাতিসংঘের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেন। বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে আবদুস সামাদ আজাদের দেওয়া এই বক্তব্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনুপম দলিল।

যুদ্ধে বিজয় লাভের পর ১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর আবদুস সামাদ আজাদ মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং তাঁকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি গঠিত মন্ত্রিসভায় তাঁকে পুনরায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির যাত্রা শুরু হয়। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির ক্ষেত্রে তিনি তাঁর ক্যারিশমাটিক সাফল্য দেখিয়েছিলেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এ সময় আবদুস সামাদ আজাদকে এক সপ্তাহ গৃহবন্দি করে রাখার পর ২২ আগস্ট তাঁকে গ্রেপ্তার করে জাতীয় চার নেতার সঙ্গে কারাগারে বন্দি রাখা হয়। কারাগারে থাকা অবস্থায় সামরিক আদালতে আবদুস সামাদ আজাদের বিচার করা হয় এবং বিচারে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। চার বছর কারাভোগের পর ১৯৭৯ সালে তিনি মুক্তিলাভ করেন।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের হত্যার পর আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে নানা চড়াই-উতরাই পেরুতে হয়। সে এক দুর্যোগময় সময়! বিশেষ করে নেতৃত্ব-শূণ্যতার কারণে দলটি অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। শেষ পর্যন্ত ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সভানেত্রী হিসেবে দলের হাল ধরলে সংকট কাটে।

১৯৮১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এটি আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। কিন্তু কাউন্সিল সামনে রেখে দলে চরম অর্ন্তদ্বন্দ্ব ও কোন্দল দেখা দেয়। মূলত দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ। পাল্টাপাল্টি কমিটিও হতে থাকে বিভিন্ন জেলায়। অনেক স্থানে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।

সে সময় একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দেন দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক এবং অন্য গ্রুপের নেতৃত্ব দেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদক তোফায়েল আহমদ। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌছে যে, কাউন্সিলের দুদিন আগে মহিলা আওয়ামী লীগও দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

আবদুস সামাদ আজাদ সেই কাউন্সিলের অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি সেই কাউন্সিল সফলভাবে করতে পেরেছিলেন এবং শেখ হাসিনাকে দলের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে সভানেত্রী নির্বাচিত করেছিলেন। সেদিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি উচ্চকণ্ঠে বলেছিলেন:

''কাউন্সিলের মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, আমরা শত্রুদের ঘৃণ্য চক্রান্ত ব্যর্থ করতে সক্ষম হয়েছি।''

দলের কোন্দলের জন্য তিনি বিদেশি শক্তির স্থানীয় এজেন্টদের দায়ী করেন এবং তাদের কর্মকাণ্ড আত্মঘাতী বলে মন্তব্য করেন। আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে আবদুস সামাদ আজাদ যেভাবে আওয়ামী লীগকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করে দলের নেতৃত্ব শেখ হাসিনার হাতে তুলে দিয়েছিলেন সেটি ছিল ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

১৯৮২ সালে এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে আবদুস সামাদ আজাদ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি সুনামগঞ্জ-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন। বিএনপি সরকারের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে তিনি প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তিনি পুনরায় একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এই সময়কালে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে কূটনীতিতে তিনি ব্যাপক সাফল্য বয়ে আনেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরপরই প্রতিবেশি ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন। তখনকার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আই কে গুজরাল ছিলেন তাঁর বন্ধুপ্রতিম। একইভাবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুও ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক গঙ্গাচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে আবদুস সামাদ আজাদ অনন্য ভূমিকা পালন করেন। কূটনৈতিক তৎপরতার বাইরে নিজের ব্যক্তিগত সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত সকল পক্ষকে ঐক্যমতে এনে সেদিন ঐতিহাসিক এই চুক্তিটি করে তিনি সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।

১৯৯৭ সালে বাংলা-ভারত পানিবণ্টন চুক্তি কার্যকর করার ক্ষেত্রেও তিনি ভূমিকা পালন করেন। একই বছর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি তাঁর সাফল্যের জয়যাত্রায় মাইলফলক হয়ে আছে।

২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি সপ্তমবারের মতো জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।

ত্রিকালদর্শী এই নেতা ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকায় বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য আবদুস সামাদ আজাদকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়।