ধিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ধিক

ওমর শেহাব
Published : 28 April 2016, 07:24 AM
Updated : 28 April 2016, 07:24 AM

এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন এবছরও ফাঁস হওয়া শুরু হয়েছে। এ বছর এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন গত বছরের তুলনায় অনেক কম ফাঁস হয়েছে দেখে আমরা আশা করেছিলাম যে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রশ্নফাঁসের পদ্ধতিগত ফাঁকফোঁকরগুলো ধরে ফেলেছে আর সেগুলো একটি একটি করে বন্ধও করা শুরু করেছে। কিন্তু আমাদের সে আশা ভুল ছিল। এই মুহূর্তে পরীক্ষার্থীদের ফেসবুক টাইমলাইন আর হোয়াটসঅ্যাপের ইনবক্স ফাঁস হওয়া প্রশ্নের কপিতে ভর্তি। এখন পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ড, আইন শৃংখলারক্ষাকারী বাহিনী থেকে কোনো বিবৃতি আসেনি তারা কীভাবে এটির প্রতিকার করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শীর্ষব্যক্তিরা নিজেদের পরিবারের পরীক্ষার্থীদের কাছে কী করে মুখ দেখান সেটি আমার কাছে এখনও রহস্য হয়ে আছে।

যখনই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, অনেক মানুষ সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের এ ব্যাপারে প্রমাণ পাঠিয়ে দেন যাতে তারা সে রাতেই ব্যবস্থা নিতে পারেন। ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, এই সব কর্তাব্যক্তিরা ভদ্রতা করে ফিরতি ইমেইলে এই স্বেচ্ছাসেবার জন্য ধন্যবাদ দিয়েছেন বলেও কোনোদিন শুনিনি।

তেমন একটি দল হল ফেসবুকের 'প্রশ্নপত্র ফাঁস: মানি না, মানব না' গ্রুপটি। আমার শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবালের একটি ব্যানার থেকে ধার করা এই শ্লোগানটি দিয়ে যারা এই গ্রুপটি তৈরি করেছে তাদের গড় বয়স পঁচিশও নয়। আমি নিশ্চিত যাদের প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার কারণে রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাওয়ার কথা সেই সব সরকারি কর্মকর্তাদের গড় বয়স এর কমপক্ষে দ্বিগুণ।

প্রায়ই প্রশ্নপ্রত্র ফাঁসের অভিযোগ আসার পর সরকার প্রথমেই যে কাজটি করে সেটি হল, এটি যে ঘটেছে সেটি অস্বীকার করা। আজকের লেখায় তাই আমি সবাইকে জানিয়ে দিব কবে কখন কোন সরকারি কর্মকর্তাকে জানানো হয়েছে যে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। তাহলে আর যদি কেউ অস্বীকার করে তাহলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে এই লেখার সূত্র ধরিয়ে দেওয়া যাবে।

এই গ্রুপের পক্ষ থেকে প্রথম প্রশাসনকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনা জানানো হয় ২০১৪ সালের এপ্রিলের ছাব্বিশ তারিখ রাত দশটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে। ইমেইলটি করা হয়েছিল ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের ইমেইল অ্যাড্রেসে (controller@dhakaeducationboard.gov.bd)। সেই ইমেইলে পদার্থবিদ্যা প্রথম ও দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার প্রমাণ পাঠানো হয়। শুধু তাই নয়, ফেসবুকের যে পেইজ থেকে বাইশে এপ্রিল রাত আটটা বাইশ মিনিটে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয় তার ঠিকানাও দেওয়া হয়। বলাবাহুল্য, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সৌজন্যমূলক প্রাপ্তিস্বীকারও করেননি।

এরপর গণিত দ্বিতীয় পত্রের ফাঁস হওয়ার প্রমাণ একই কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয় ছাব্বিশে মে ২০১৪ তারিখ বেলা বারটা বেজে বার মিনিটে। যথারীতি কোনো প্রাপ্তিস্বীকার নেই। পরদিন আরও কিছু প্রমাণ এবং অনলাইনে সেগুলো কোথায় কোথায় পাওয়া যাচ্ছে সেটিও পাঠানো হয়। সেই ইমেইল মন্ত্রণালয়ের মেইল সার্ভার থেকে কেউ কোনোদিন খুলে দেখেছে কিনা জানি না।

প্রশাসনের নির্লিপ্ততা তরুণ স্বেচ্ছাসেবীদের উৎসাহ একদমই নষ্ট করতে পারেনি। পরের বছর এসএসসি পরীক্ষার ইংরেজি প্রথম পত্রের প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার প্রমাণ পাঠানো হয় বারই ফেব্রুয়ারি দুপুর একটা বায়ান্ন মিনিটে। ইমেইল পাঠানো হয়েছিল ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের (controller@dhakaeducationboard.gov.bd,) আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কন্ট্রোল রুমের ঠিকানায় (examcontrolroom@moedu.gov.bd)।

একই দিন দুপুর দুইটা ঊনচল্লিশ মিনিটে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর মন্ত্রণালয় আর সংসদের ইমেইল অ্যাড্রেস (sylhet.6@parliament.gov.bd, minister@mopme.gov.bd) দুটিতেই জানানো হয় যে, শিক্ষা বোর্ডে প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রমাণ পাঠানো হয়েছে। কিন্তু 'কোথাও কেউ নেই'।

সে বছর জানুয়ারির চৌদ্দ তারিখে সকাল আটটা পনের মিনিটে মন্ত্রণালয় আর শিক্ষা বোর্ডে জানানো হয়েছিল যে, ফেসবুকে রেজাউল ইসলাম লিটন নামে একজন বাংলা প্রথম পত্র, ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র এবং হিসাববিজ্ঞান প্রথম পত্রের প্রশ্ন বিলি করছে। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে স্ক্রিনশট সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়। একই ইমেইল থ্রেডে ফেব্রুয়ারির ঊনিশ তারিখ সকাল এগারটা সাতচল্লিশ মিনিটে জানানো হয় ফেসবুকে আরও ছয়টি জায়গায় ফাঁস হওয়া প্রশ্ন বিলি হচ্ছে। পনের মিনিটের মধ্যে এই সব তথ্যের অনুলিপি দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীকেও ইমেইল করা হয়।

একই বছর মে মাসের ঊনিশ তারিখ সকাল এগারটা ত্রিশ মিনিটে স্বেচ্ছাসেবকরা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডে জানায়, ফেসবুকের একটি নির্দিষ্ট লিংকে এইচএসসির একটি বিষয়ের প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে। সেদিন রাত বারটা ত্রিশ মিনিটে কোন তিনটি ফোন নাম্বারে যোগাযোগ করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের প্রশ্ন পাওয়া যাবে তার তথ্যও কর্মকর্তাদের জানানো হয়। কোনোদিন কোনো কর্মকর্তা একটি ফিরতি ইমেইল করেননি।

এই সব তরুণ স্বেচ্ছাসেবকরা কিন্তু গোটা বছর ধরে একই কাজ করে যাচ্ছে। এই গ্রুপের পক্ষ থেকে প্রশাসনকে জেএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের তথ্য প্রথম জানানো হয় ২০১৫ সালের চৌঠা নভেম্বর রাত নয়টা আঠার মিনিটে। প্রাপক যথারীতি মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ড। মোট নয়টি অ্যাটাচমেন্ট পাঠানো হয়েছিল। সাতই নভেম্বর দুপুর বারটা তেতাল্লিশ মিনিটে পরদিনের প্রশ্নপত্র ফাঁসের সম্ভাব্য প্রমাণ। পরদিন দেখা যায় নয়টি প্রশ্নের মধ্যে তিনটি মিলে গেছে যার মোট নম্বর ত্রিশ। ২০১৫ সালেও আমরা কোনো কর্মকর্তার কাছ থেকে ফিরতি ইমেইল পাইনি।

স্বেচ্ছাসেবকরা এ বছরও তাদের কাজ করে যাচ্ছে। ছয়ই এপ্রিল দুপুর দুইটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডে পাঠানো হয়েছে ইংরেজি প্রথম পত্রের প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার সম্ভাব্য প্রমাণ। এ বছর আমরা নতুন আরেকটি ব্যাপার দেখা শুরু করি। সেটি হল, শিক্ষা বোর্ডের ইমেইল সার্ভার থেকে স্বয়ংক্রিয় উত্তর পাচ্ছি যে, আমাদের জিমেইল সার্ভারটি শিক্ষাবোর্ডের স্প্যাম ফিল্টারে কালো তালিকাভুক্ত আছে। কেন এ রকম হল জানি না। যাই হোক, নয়ই এপ্রিল দুপুর বারটা ঊনষাট মিনিটে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার সম্ভাব্য প্রমাণ পাঠানো হয়। সঙ্গে ফেসবুকের দুটি অ্যাকাউন্টেরও খোঁজ দেওয়া হয় যারা কি না প্রশ্নপত্র বিলি করছে।

দশই এপ্রিল রাত দুটা পনের মিনিটে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ (examcontrolroom@moedu.gov.bd), ঢাকা বোর্ড (info@dhakaeducationboard.gov.bd), কুমিল্লা বোর্ড (info@comillaboard.gov.bd), সিলেট বোর্ড (info@sylhetboard.gov.bd), বরিশাল বোর্ড (barisalboard@gmail.com), যশোর বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (controller@jessoreboard.gov.bd), চেয়ারম্যান (chairman@jessoreboard.gov.bd), রাজশাহী বোর্ডের চেয়ারম্যান (chairman@rajshahiboard.gov.bd), পুলিশ (addlspcon@police.gov.bd), বিটিআরসির কর্মকর্তা (qmrahman@btrc.gov.bd, touseef@btrc.gov.bd), দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী (pro_minister@moedu.gov.bd), শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা (ds_sec@moedu.gov.bd) এ সব জায়গায় ইমেইল করে জানানো হয় যে, ফেসবুকের পাঁচটি ভিন্ন জায়গায় ও হোয়াটসঅ্যাপে গত চব্বিশ ঘন্টায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হচ্ছে। ইমেইলের সঙ্গে সহপ্রাপক হিসেবে রাখা হয়েছিল চব্বিশটি গণমাধ্যমকে।

বাড়তি যা হল তা হচ্ছে, মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি এখন আমরা গণমাধ্যম থেকেও বাউন্সড মেসেজ পাচ্ছি।

একই প্রাপকদের ঊনিশে এপ্রিল বিকেল পাঁচটা চব্বিশ মিনিটে জীববিজ্ঞান প্রথম পত্রের প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার প্রমাণ পাঠানো হয়। বিশে এপ্রিল রাত এগারটা এগার মিনিটে পাঠানো হয় জীববিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার প্রমাণ। এপ্রিলের একুশ তারিখ সকাল দশটা চার মিনিটে তাদেরকে জানানো হয় যে, 'আহমেদ নিলয়' নামে ফেসবুকের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হচ্ছে। প্রথমবারের মতো তখন আমরা আবিষ্কার করি, কিছু পত্রিকা এই তথ্যটি লুফে নেয়; কারণ খুব সম্ভবত সেই অ্যাকাউন্টের বর্ণনাতে ছাত্রলীগের নাম আছে।

যে কোনো দেশের ভোটারদের মধ্যে একটি সহজাত অ্যান্টাই-ইনকামবেন্সি আবেগ থাকে। যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকারে, কাজেই তাদের সঙ্গে জড়িত কারও অন্যায় খবর হিসেবে বেশি বিক্রয়যোগ্য। তাই বোধহয় গণমাধ্যমের এই ব্যাপারটি পছন্দ হয়েছে। এতদিন তাদের কিন্তু কোনো খবরই ছিল না। পড়ে মনে হচ্ছিল, এখন থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ জড়িত থাকলে কত সুবিধা হত! অন্তত গণমাধ্যমের নজর তো থাকত!

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পাঠক-পাঠিকাদের মূল্যবান সময় আমার এই একঘেয়ে লেখা দিয়ে নষ্ট করার জন্য আমি ভীষণভাবে দুঃখিত। কিন্তু এটি ছাড়া উপায় ছিল না। কারণ এখন পর্যন্ত সরকারের কোনো উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে না। আমি আর অল্প কয়েকটি কথা বলে লেখাটি শেষ করব।

প্রিয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাবৃন্দ, আপনাদের সন্তানের বয়সী স্বেচ্ছাসেবকরা আপনাদেরই সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দিনরাত আপনাকের কাছে তথ্য পাঠিয়ে যাচ্ছে আর আপনারা একটু শুকনো ধন্যবাদ দেবারও তাগিদ অনুভব করেন না! আপনাদের ধিক!

প্রিয় শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাবৃন্দ, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের প্রধান কাজ হল পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করা। আপনাদের সে কাজে আমরা সাহায্য করছি, বিনে পয়সায়। আর আপনারা একই কাজের জন্য বেতন নিয়ে থাকেন। যারা আপনাদের সাহায্য করছে তাদের ইমেইলের প্রাপ্তিস্বীকারের স্বাভাবিক ভদ্রতাটুকুও আপনাদের নেই। আপনাদের ধিক!

প্রিয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাবৃন্দ, যখন কোন লেখক ব্লগে কিছু লিখে আপনাদের অনুভূতিতে এতটা আঘাত লেগে যায় যে, তাদের রাতারাতি গারদে পাঠিয়ে দেন, কিন্তু ফেসবুকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করলে আপনাদের অনুভূতিতে একটু আঁচড়ও লাগে না। টনটনে অনুভূতিওয়ালা আপনাদের ধিক!

প্রিয় বিটিআরসির কর্মকর্তাবৃন্দ, প্রশ্নপত্র ফাঁস একটি জাতীয় দুর্যোগ। বন্যা, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় এসব যেমন আমাদের অর্থনীতি ধ্বংস করে দেয়, প্রশ্নপত্র ফাঁস আমাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দেয়। আমাদের স্বপ্নগুলো মেরে ফেলে। এর আগে এতবার কারণে অকারণে ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছেন আর প্রশ্নপত্র ফাঁসের সময় আপনারা এত নির্লিপ্ত! আপনাদের ধিক!

সবশেষে, একটি বোনাস ধিক থাকবে বেশিরভাগ গণমাধ্যমের জন্য। যেদিন প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় তার পরের দিন আপনাদের সংবাদ শিরোনাম থাকে ভিন্ন কিছু। ফাঁসের খবর থাকে নিচের দিকে এক কলাম ইঞ্চিতে। এই সহজ সত্যটি কেন আপনারা বোঝেন না যে, এটিই আপনাদের দেশ, এটিই আপনাদের সমাজ, এটিই আপনাদের সংবাদ বিক্রির বাজার।

এই দেশ, এই সমাজ, এই বাজার ধ্বংস হয়ে গেলে আপনারা কী করে খাবেন!