রোয়ান্ডার গণহত্যা ও ইতিহাসের শিক্ষা

শারমিন আহমদ
Published : 30 April 2016, 08:17 AM
Updated : 30 April 2016, 08:17 AM

'আর কখনও নয়', এই প্রত্যয় নিয়ে প্রতি বছরের ৭ এপ্রিল রোয়ান্ডা তার রাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া বিংশ শতাব্দীর অন্যতম নৃশংস গণহত্যা দিবসের স্মরণ করে। ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় অধিষ্ঠিত আফ্রিকান ইউনিয়নের মূল কার্যালয়ে গত ৭ ও ৮ এপ্রিল সূচিত হয় রোয়ান্ডা গণহত্যা দিবস। ৭ এপ্রিল, অর্থোডক্স, ক্যাথলিক, প্রটেস্টান্ট, মুসলিম বিভিন্ন ধর্মের প্রার্থনা, শান্তি-প্রদীপ প্রজ্বলন এবং শিশু-কিশোরদের সংগীত ও অভিনয় অনুষ্ঠিত হয়। ৮ এপ্রিল সূচিত হয় গণহত্যা-বিরোধী আলোচনা সভা।

১৯৯৪ সালে মাত্র তিন মাসের (৭ এপ্রিল-১৫ জুলাই) মধ্যে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার সাধারণ নারী, পুরুষ ও শিশুর সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ লক্ষের উপরে যারা ছিল রোয়ান্ডার তৎকালীন জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ। সত্তর শতাংশ টুটসি গোত্র নিহত হয় সংখ্যাগুরু হুটু গোত্রের হাতে। এই নারকীয় গণহত্যার মূল কারণ হিসেবে সামাজিক বৈষম্য ও অবিচারের বিষয়টি চিহ্নিত করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ হুটু, যাদের অধিকাংশই ছিল কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত, তাদেরকে আর্থ-সামাজিকভাবে কোণঠাসা করে সংখ্যালঘু টুটসিরা ক্ষমতার শিখরে চেলে যায়। টুটসিরা ছিল ঔপনিবেশিক বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের আশীর্বাদপুষ্ট। হুটুদের ক্রমবর্ধমান এই তীব্র অভিযোগ ও অসন্তুষ্টি ভয়াবহ পরিণতি লাভ করে গণহত্যায়।

গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ী রোয়ান্ডার হুটু রাষ্ট্রপ্রধান এবং পার্শ্ববর্তী বুরুন্দির একই গোত্রের রাষ্ট্রপ্রধানকে বহনকারী যাত্রীবাহী একটি বিমান রোয়ান্ডার রাজধানী কিগালিতে অবতরণের সময় এটিকে গুলিবিদ্ধ করে ভূপাতিত করা হয়। তাতে নিহত হন দুই রাষ্ট্রপ্রধানসহ বিমানের সকল আরোহী। টুটসিরা এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে হবে, এই উন্মাদনা থেকে ৭ এপ্রিল শুরু হয় দানবিক গণহত্যা। হুটু-সমর্থিত রেডিও ও টেলিভিশন স্টেশন 'লিব্রে দে মিল কলিন্স' ঘৃণা, অবিশ্বাস, বিদ্বেষ ও সন্ত্রাস ছড়ানোর পক্ষে লজ্জাজনক ও অমানবিক ভূমিকা পালন করে। এই বিষয়গুলিই আলচিত হয় আফ্রিকা ইউনিয়নের রোয়ান্ডার গণহত্যা স্মরণ দিবসের বিশেষ সভা ও সেমিনারে।

আফ্রিকান ইউনিয়নে স্থায়ী প্রতিনিধি এবং ইথিওপিয়ায় নিযুক্ত রোয়ান্ডার রাষ্ট্রদূত হোপ গাসাতুরার বিশেষ আমন্ত্রণে আমরা উপস্থিত হই আফ্রিকান ইউনিয়নে। আমার স্বামী, যুক্তরাষ্ট্রে শান্তি ও সংঘর্ষ শিক্ষার প্রফেসর এবং বর্তমানে আদ্দিস আবাবা ইউনিভার্সিটির ইন্সটিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (ওচঝঝ) সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার, ড. আমর খাইরি আবদাল্লা সভায় বক্তব্য রাখবেন বাকি তিন রোয়ান্ডা বিষয়ক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে।

রাষ্ট্রদূত হোপ আমাদেরকে সভাকক্ষে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, "আপনার স্বামীর প্রতি আমরা অনেক কৃতজ্ঞ। তিনি যুদ্ধ-পরবর্তী রোয়ান্ডায় অনেকবার গিয়েছেন। সেখানে থেকে তিনি শান্তি নির্মাণে যে অবদান রেখেছেন তা আমরা আন্তরিকভাবে স্মরণ করি।"

বর্তমানে সে দেশের নতুন রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় জনগণের পরিচয় হুটু বা টুটসি হিসেবে নয়, রোয়ান্ডান হিসেবে। আফ্রিকান ইউনিয়নও দেশটির রাজধানী কিগালিকে আফ্রিকার সবচাইতে সুন্দর শহর হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমার স্বামী ড. আমর রোয়ান্ডায় প্রথম যান ১৯৯৮ সালে। তখনও দেশটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে গণহত্যার আতঙ্ক এবং অগুণতি নির্যাতিত ও ধর্ষিত নারী-শিশুর আর্তনাদ বিরাজমান। এরপর আরও কয়েকবার সেখানে যাওয়া।

প্রতিবার ফিরে এসে ড. আমর একই কথা বলেছেন, লিখেছেন। তা হল, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে শান্তির সংস্কৃতি লালন করতে হলে প্রয়োজন, চিন্তায়, আচার-আচরণে, শিক্ষা ব্যবস্থায়, সম্পদের ন্যায্য বণ্টনে, ন্যায়বিচার রক্ষায় এবং আইনের কার্যকারিতায় ঐ মূল্যবোধগুলি ধারণ করা। যে জাতি যত বেশি ঐ মূল্যবোধগুলি ধারণ করবে, সে জাতি তত বেশি শান্তির সংস্কৃতির উপযুক্ত প্রতিনিধিরূপে গণ্য হবে।

আমরের কথা শুনে মনে পড়ে যায় মধ্য আমেরিকার কোস্তারিকা রাষ্ট্রের কথা যেখানে আমাদের জীবনের প্রায় এক দশক কেটেছে। ড. আমর সেখানে জাতিসংঘ মনোনীত 'ইউনিভার্সিটি ফর পিস' (ইউপিস) বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিন ও ভাইস রেকটর পদে নিযুক্ত ছিলেন। সে সময় তাঁর উদ্যোগে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও শিক্ষার্থীরা ইউপিসের বৃত্তিতে শান্তি-শিক্ষার উপর উচ্চতর ডিগ্রি নিতে কোস্তারিকায় যেত।

রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে লিপ্ত এই রাষ্ট্র ১৯৪৮ সালে সাংবিধানিকভাবে তার সামরিক বাহিনী বিলুপ্ত করে এবং সামরিক খাতের অস্ত্র ব্যবহার করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে। বর্তমানে কোস্তারিকা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে পৃথিবীর প্রথম সারির একটি দেশ এবং লাতিন আমেরিকার সবচাইতে স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত।

রাষ্ট্র-নেতৃত্ব যখন পরিচালিত হয় এমন উন্নত চিন্তাধারা থেকে, তখনি শুরু হয় যাত্রা, সতিকারের প্রগতির পথে। এর বিপরীত চিন্তার প্রতিফলন হল রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহারের মাধ্যমে বৈষম্য, নির্যাতন, হত্যা ও গণহত্যার নিষ্ঠুরতম সংস্কৃতি টিকিয়ে রেখে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থ স্থায়ী করা। ১৯৭১ সালে মার্কিন নিক্সন কিসিঞ্জার প্রশাসন এবং মৌলবাদী দলগুলির প্রত্যক্ষ সহযোগিতা নিয়ে পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাংলাদেশেও ভয়াবহ গণহত্যা ঘটায় এবং এই এপ্রিল মাসেই (১০ এপ্রিল) গণপ্রজাতন্ত্রী প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। এই সরকার পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর গণহত্যা ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশের বিজয় নিশ্চিত করেছিল। সে বিষয়েও আয়োজক ও অতিথিদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়।

সভায় তরুণ ও শিক্ষার্থীদের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। প্যানেলের প্রথম বক্তা আফ্রিকা ইউনিয়নের রাজনৈতিক বিষয়ক পরিচালক ড. মাতলোসা বললেন, রোয়ান্ডায় গণহত্যা যখন ঘটছিল তখন আফ্রিকান ইউনিয়ন তা বন্ধের জন্যে সরাসরি কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। কারণ ১৯৬৪ সালে গৃহীত আফ্রিকা রাষ্ট্রপুঞ্জের নীতি ছিল এই যে, এক আফ্রিকান রাষ্ট্র অন্য আফ্রিকান রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না।

এই গণহত্যার পরে আফ্রিকান ইউনিয়নে গৃহীত নতুন নীতিটি ছিল এ রকম যে, তারা এমন নৃশংসতায় উদাসীন থাকবে না; শান্তিরক্ষার্থে হস্তক্ষেপ এবং নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করবে।

গণহত্যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং তা প্রতিরোধের জন্য কাঠামোগত বৈষম্য দূর, মুক্ত আলোচনা এবং 'এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের চাইতে উত্তম' এই মতবাদ বদলে জাতীয় একতার নীতি গ্রহণের কথা মাতলোসা বললেন।

দ্বিতীয় বক্তা ড. আমর বললেন, গণহত্যা অস্বীকার করার অর্থ হল গণহত্যা সমর্থন করা এবং অস্বীকারের আড়ালে গণহত্যার নীতি জিইয়ে রাখা। গণহত্যা যাতে সংঘটিত হতে না পারে তার জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি, মিডিয়ার বলিষ্ঠ ভূমিকা, জাতি-গোত্রভিত্তিক সংঘর্ষ ও গণহত্যার পূর্ব-সংকেত পর্যবেক্ষণ, সেই অনুযায়ী অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং শান্তি-শিক্ষার প্রশিক্ষণ সমাজের সর্বস্তরে প্রয়োগের কথা বললেন তিনি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণহত্যার ইতিহাস জানার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই প্রেক্ষিতে তিনি বাংলাদেশ এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে জার্মানির ইহুদি নিধনের কথা উল্লেখ করলেন।

আফ্রিকায়, মধ্যপ্রাচ্যের দায়েশ (ইংরেজিতে আইসিস) অনুগত বোকো হারাম, সেই সঙ্গে আল-শাবাব, আল-কায়েদা প্রভৃতি সন্ত্রাসী সংগঠন যারা দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইসলামের অপব্যবহার করে ত্রাস সৃষ্টি এবং নিরীহ জনগণকে হত্যা করছে, তাদের প্রতিরোধে রোয়ান্ডার হুটু ও টুটসি গোষ্ঠীভুক্ত মুসলিমদের শান্তিবাদী ভূমিকা ভয়াবহতার মধ্যেও আশার একটি বড় দৃষ্টান্ত এবং গবেষণার বিষয় হতে পারে– এই মত ব্যক্ত করলেন তিনি।

রোয়ান্ডায় গণহত্যা যখন সংঘটিত হচ্ছিল তখন হুটু ও টুটসিদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকাগুলি। রোয়ান্ডার মুসলিমরা উভয় গোত্রের অংশ হলেও তারা গণহত্যায় অংশ নেয়নি। বরং তারা হাজার হাজার মানুষের প্রাণ এবং শান্তি রক্ষা করেছিল। এর কারণ হিসেবে তারা জানায় যে, ইসলাম ধর্মে জাতি-ভিত্তিক যুদ্ধ এবং নিরীহ মানুষ হত্যা নিষিদ্ধ।

অনুষ্ঠানের তৃতীয় বক্তা, আফ্রিকা ইউনিয়নে ইথিওপিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি ড. তেকাদে আলেমু জানালেন, এই গণহত্যার কারণ নির্ণয়ে তাঁর উদ্যেগে যে অনুসন্ধানী কমিটি গঠিত হয় তার রিপোর্টে এই সত্যই প্রকাশিত হয় যে, এটি বন্ধ করা যেত যদি আফ্রিকান ইউনিয়ন, জাতিসংঘ এবং বিশ্ব সময়মতো রুখে দাঁড়াত।

প্যানেলের শেষ বক্তা, আফ্রিকান ইউনিয়নে নারী, শান্তি এবং নিরাপত্তা বিষয়ের বিশেষ দূত, রোয়ান্ডার নাগরিক ড. জন বসকো বুতেরা বললেন, গণহত্যা যখন চলছিল তখন পাশ্চাত্য শুধু উদাসীনতাই দেখায়নি তাদের অনেকের অবিবেচক লেখনী ও মন্তব্য, যেমন, 'এমন দেশে গণহত্যা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়' গণহত্যায় বৈধতা দিয়েছে। সাংবাদিক রবিন ফিলপট তো গণহত্যা অস্বীকারই করেছেন।

গণহত্যা চক্রান্তের মূল আসামিরা এখনও বিভিন্ন দেশে পলাতক। খোদ ফ্রান্সেই আশ্রয়গ্রহকারী, গণহত্যার অন্যতম আসামি, হুটু ধর্মযাজক সেরম্বাকে তার দেশ রোয়ান্ডায় ফিরিয়ে দিতে ফ্রান্স আপত্তি জানায়।

প্রশ্নোত্তর পর্বে আফ্রিকার বিভিন্ন রাষ্ট্রের তরুণদের প্রশ্ন ও মন্তব্য থেকে বোঝা গেল যে, জাতিসংঘ এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের উপর তাদের তেমন আস্থা নেই। এই প্রেক্ষিতে মনে পড়ল কোস্তারিকার প্রেসিডেন্ট লুইস সলিসের কথা। ইউপিসের ৩৫তম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে (৫ ডিসেম্বর, ২০১৫) তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সকল স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স ও চীন) পারমাণবিক অস্ত্রে শক্তিমান এবং বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র রফতানিকারক। অর্থাৎ এরা কেউ নিরপক্ষতা বজায় রেখে শান্তির পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করার উপযুক্ত নয়। যুদ্ধবাদী, পরসম্পদ লুণ্ঠনকারী রাষ্ট্রনীতিতে মানবিকতার নেই কোনো স্থান।

অনুষ্ঠান শেষে অনেক তরুণ ছুটে এল আমাদের কাছে। তারা শান্তি ও সংঘর্ষ শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চায়। এক তরুণ রোয়ান্ডায় ভাষায় বলল, 'কুইবুকা স্মরণ কর।' সত্যিই, ইতিহাসের স্মরণ ও রক্ষার মাধ্যেই তো নির্মিত হয় আগামীর পথ।

আদ্দিস আবাবা; ১৮ এপ্রিল, ২০১৬