আমাদের লজ্জার দিন

ওমর শেহাব
Published : 13 April 2016, 05:31 AM
Updated : 13 April 2016, 05:31 AM

মানুষ যেমন ব্যক্তিজীবনে ভুল করে, তেমনি অনেক মানুষ একসঙ্গেও কখনও কখনও ভুল, অন্যায় বা ভীষণ লজ্জার কাজ করে ফেলে। কখনও কখনও গোটা একটি সমাজ তেমন ভুল করে। ব্যাপারটি বড় হয়ে যায় তখন, যখন গোটা একটি জাতি কোনো ভুল, অন্যায় বা ভীষণ লজ্জার কাজ করে ফেলে। এ রকম উদাহরণ আমাদের চারপাশে সব সময় ঘটছে।

একটু পূর্বদিকে গেলে দেখা যায়, মায়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা রোহিঙ্গাদের (যারা ইসলাম ধর্মাবলম্বী) নিজেদের দেশের নাগরিক হিসেবে মেনে নিতে চাচ্ছে না। একটু পশ্চিমে গেলে দেখা যাচ্ছে, ভারতে ভোটাররা গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় নির্বিকার থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছে।

ওদিকে একটু পশ্চিমে, পাকিস্তানে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের রায়গুলো কার্যকর হওয়ার পর সংসদে নিন্দা প্রস্তাব পাশ হচ্ছে। তাতে কোনো আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন পাকিস্তানির বাংলাদেশিদের সামনে মাথা উঁচু করে হাঁটতে পারার কথাও নয়। ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানের মিলিটারিরা আমাদের দেশে গণহত্যা চালিয়েছিল, সে ব্যাপারে তারা জোড়াতালি দিয়ে যুক্তি দিতে পারে যে, সে সময় যারা শাসক ছিল তারা জনপ্রতিনিধি ছিল না। কিন্তু এখন তাদের গণতন্ত্র আছে (যে মানেরই হোক)। এখন যারা জামায়াত আর বিএনপির যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সংসদে বিল পাশ করে তারা পাকিস্তানি নাগরিকদেরই জনপ্রতিনিধি। তাই দায় অস্বীকার করার উপায় তাদের নেই। বরং তাদের এখন লজ্জায় মাটির ভিতর ঢুকে যাওয়া উচিৎ।

পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় লজ্জাগুলোর একটি হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শুধুমাত্র ইহুদি হওয়ার অপরাধে গ্যাসের চুলায় অনেক মানুষকে পুড়িয়ে মারার ঘটনাটি। কাজটি করেছিল নাৎসি জার্মানরা। তারা হত্যা করেছিল দেড় মিলিয়ন শিশুকেও। ভাবা যায়? চমৎকার পৃথিবীর অপার বিস্ময় ওই শিশুদের হাতে ধরা দেওয়ার আগেই খুব নিষ্ঠুরভাবে তাদের জীবন সংক্ষিপ্ত করে ফেলা হয়। হিটলার নামের এক উন্মাদ বিকারগ্রস্তের খেয়ালের বশে আর তার অন্ধ সমর্থকদের উৎসাহে এটি হয়েছে।

জার্মানরা এখনও সেই লজ্জা থেকে বের হতে পারেনি। আমি কখনও জার্মানি যাইনি, তবে আমেরিকায় সে দেশের কিছু বন্ধু পেয়েছি। তারা খুব সহজে সে সময়ের কথা তুলতে চায় না। জার্মানিতে প্রত্যেক শিশুকে পাঠ্যবইয়ে পড়তে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাদের পূর্বসূরীরা অন্ধ দেশপ্রেম আর উগ্র জাতীয়তাবাদের নামে কী করেছিল সে ইতিহাস। তারা বইয়ে পড়ে কীভাবে এক জাতির শ্রেষ্ঠত্ব আর রক্তের বিশুদ্ধতা বজায় রাখার নামে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারা তাদের বয়সী সেই দেড় মিলিয়ন শিশুর কথা ভেবে নিশ্চয়ই শিউরে ওঠে আর প্রতিজ্ঞা করে,'নেভার অ্যাগেইন'।

ইহুদিদের মেরে ফেলার আগে যেসব বন্দিশালায় রাখা হত, পাঠ্যসূচির অংশ হিসেবে সেগুলোতে শিক্ষা সফরে যায় জার্মান শিশুরা। পাকিস্তানি শিশুদের যদি প্রতি বছর স্কুল থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর দেখতে পাঠানো হত তাহলে যেমন হত ব্যাপারটা অনেকটা তেমন।

দেশ হিসেবে আমাদের বয়স পঁয়তাল্লিশ বছর। এখানে যেসব জাতির কথা বলেছি তাদের তুলনায় নিতান্তই আমরা শিশু। আমাদের জাতির জীবনে কি এমন কোনো ঘটনা আছে যা ভীষণ লজ্জার? এমন কোনো ব্যাপার আছে যেটি নিয়ে অন্য দেশের মানুষেরা জিজ্ঞেস করলে আমরা মুখ দেখাতে পারব না?

কেউ কেউ বলতে পারেন ২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজা ধসে ১১২৯ জন শ্রমিক মারা যাওয়ার কথা। আমি অস্বীকার করতে পারব না। কয়েক সপ্তাহ আগে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ছাত্রছাত্রীদের একটি সংগঠন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের কিছু সাম্প্রতিক বিপর্যয় নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করেছিল। সেখানে রানা প্লাজার কথা এসেছিল। অন্য দেশের মানুষের মুখে নিজের দেশের ব্যর্থতা আর লজ্জার কথা শুনতে কেমন লাগে সেটি আমি খুব ভালো করে টের পেয়েছি সেদিন।

কেউ কেউ হয়তো ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীদের হাতে ভোলার নয় বছরের শিশুটির নিপীড়িত হওয়ার দিনটির কথা বলবে, যার মা বলেছিলেন, "বাবারা, আমার মেয়েটা ছোট, তোমরা একজন একজন করে এস, নইলে ও মরে যাবে।"

নতুন জাতি হিসেবে আমরা ইতোমধ্যে যথেষ্ট ঘটনার জন্ম দিয়েছি যাতে মাথা হেঁট হয়ে যায়। আমাদের যত অর্জন আর গৌরব, তাতে এই কলঙ্কগুলো ছোপ ছোপ হয়ে ফুটে আছে।

কিন্তু আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, কোনটি আমাদের সবচেয়ে লজ্জার দিন, আমি এই দিনগুলোর কথা বলব না। তাহলে কোন দিনের কথা বলব?

সেই দিনটি হল ১৯৮৮ সালের তেসরা জুন। সেদিন দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় ছোট্ট একটি খবর ছাপা হয়েছিল। সেটি হুবহু এখানে তুলে দিলাম:

সকল ধর্মকেই সমান মর্যাদা দেওয়া বাঞ্চনীয়

গতকাল (বৃহস্পতিবার) ঢাকার আর্চবিশপ মাইকেল রোজারিও, বাংলাদেশ চার্চের বিশপ বার্নাবাস ডি মণ্ডল, বাংলাদেশ ব্যাপ্টিস্ট সংঘের রেভারেন্ড পরিতোষ বিশ্বাস, গারো ব্যাপ্টিস্ট কনভেনশনের রেভারেন্ড সুভাষ মাংমা ও ন্যাশনাল খ্রিস্টিয়ান ফেলোশিপের রেভারেন্ড ডেনিশ দিলীপ দত্ত এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন:

''কোনো একটি বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে লব্ধ উত্তরাধিকারের পরিপন্থী। মুক্তিসংগ্রাম চলাকালে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে বিরূপ মনোভাব দূর করিতে সাহায্য করিয়াছে। ইহারই ফলে আমরা লাভ করিয়াছি সাম্প্রদায়িকতামুক্ত একটি পরিবেশ। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় আমরা দ্বিতীয় সারির নাগরিক হিসেবে গণ্য হওয়ার অভিশাপ হইতে মুক্তি লাভ করিয়াছি। বাংলাদেশে সকল নাগরিকের সমান অধিকার আছে। কাজেই সকল ধর্মকেই সমান মর্যাদা দেওয়া বাঞ্ছনীয়।''

ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম ঘোষণার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার আবেদন জানাইয়া বিবৃতিতে তাহারা বলেন:

''ধর্ম ও রাষ্ট্রকে যখন এক করা হয়, তখনই ধর্ম রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বার্থে জড়িত হইয়া পড়ে। তখন দলীয় রাজনীতির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধর্মের অতি পবিত্র বিষয়গুলি পর্যন্ত রাজনীতির বেদনাদায়ক বিতর্কে পরিণত হইতে বাধ্য। কারণ, রাজনীতি মানুষের সৃষ্ট। পক্ষান্তরে ধর্ম ঐশ্বরিক বিধান। কাজেই ধর্মকে কোনো প্রকার মানবিক দুর্বলতার অধীন করা চলে না।''

দৃষ্টান্তস্বরূপ বিবৃতিতে তাহারা বলেন যে, অভিজ্ঞতা হইতে শিক্ষার আলোকে পাশ্চাত্যের খ্রিস্টান দেশগুলিতে ধর্মকে রাষ্ট্র হইতে আলাদা করা হইয়াছে। এশিয়ার অনেক দেশে রাষ্ট্র ও ধর্ম পৃথক।

১৯৮৮ সালের তেসরা জুন কী হয়েছিল? দেশের সবচেয়ে ছোট ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর একটি, ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠদের কাছে দৈনিক পত্রিকায় করজোড়ে মিনতি করেছিল যেন দয়া করে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা না হয়। ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠরা কি সেই মিনতি রেখেছিল? না, রাখেনি। রাষ্ট্রধর্ম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সেটি এখনও আছে। একই সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা আর রাষ্ট্রধর্ম থাকায় এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

রাষ্ট্রধর্ম প্রতিষ্ঠার ফলে আমাদের কী ক্ষতি হয়েছে? এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বভিত্তিক রাজনীতি সাংবিধানিক উৎসাহ পেয়েছে এবং যারা এই ধরনের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে তারা জামায়াত, বিএনপি এসব ছোটখাট জায়গায় আগে তাদের এক্সপেরিমেন্ট শেষ করে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে এখন আওয়ামী ওলামা লীগ হয়ে দেশের সবচেয়ে বড় ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলে ঢুকে পড়েছে।

শাহবাগ আন্দোলন আমাদের এক ধাক্কায় অনেক দূর এগিয়ে দিয়ে গেছে। এখন আর কেউ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক করে না, যুদ্ধাপরাধ নিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে সুশীল গল্প করার সাহস পায় না। এখন আমাদের পরের পর্যায়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। সেই পর্যায়গুলোর একটি হল ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ যেখানে প্রত্যেক ধর্মবিশ্বাসী ও নিধার্মিক মানুষ সমান মর্যাদা আর একের জন্য অন্যের ভালোবাসা ও সহনশীলতা নিয়ে বাস করবে। রাষ্ট্র সবাইকে মানুষ হিসেবেই দেখবে। কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে ধার্মিক, কে নিধার্মিক তা নিয়ে কোন মাথা ঘামাবে না। রাষ্ট্র শুধু নিশ্চিত করবে যে যাই বিশ্বাস করুক বা অবিশ্বাস করুক, তা যেন অন্যকে বিরক্ত না করে পালন করার সুযোগ পায়।

দুঃখের ব্যাপার হল এই যে, সহজ সরল ব্যাপারটিও কেউ কেউ হতে দিতে চায় না। এখন অনেক ছেলেমেয়ে আছে যারা ১৯৮৮ সালের জুন মাস দেখেনি (আমি দেখেছি, কিন্তু অনেক ছোট থাকায় কিছু বুঝিনি)। আমার এই লেখা তাদের একটু একটু করে দীর্ঘ লড়াই করতে মানসিক প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। তাদেরকে বুঝানোর জন্য যে, আমাদের দেশের সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলো কী অপমান, কী কষ্ট বুকে চেপে নিয়ে আছে গত আটাশ বছর ধরে। তারা অপেক্ষা করছে কোনো একটি প্রজন্ম বারুদ স্ফুলিঙ্গ হয়ে জ্বলে উঠবে আর সংবিধান থেকে সব বৈষম্য আর অপমানের কথাগুলো সরিয়ে দিবে।

এই লড়াইয়ের শুরুটা হবে কীভাবে? যারা এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বভিত্তিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা কিন্তু ভীষণ 'চাল্লু'। তাদের মুখোশ খুলে দেওয়ার জন্য সঠিক ভাষা ব্যবহার করতে বাধ্য করতে হবে।

এ ধরনের লোকেরা কখনও 'এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বভিত্তিক রাজনীতি' এই কথাটি বলতে চায় না। তারা অনেক মোলায়েম আর সুন্দর সুন্দর কথা ব্যবহার করে। যেমন, 'ধর্মভিত্তিক রাজনীতি'। এটি একটি ফাঁকিবাজি। এটি বলে না ধর্মটি কোন ধর্ম। যদি একাধিক ধর্ম হয় তাহলে তাদের তুলনামূলক গুরুত্ব কেমন। তাই তারা বলার চেষ্টা করে যে, 'ধর্মভিত্তিক রাজনীতি' বন্ধ করার পাঁয়তারা হচ্ছে। মানুষকে তারা এমন একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করে যে, মানুষের ধর্মপালনের ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় রাষ্ট্র বাধা দিচ্ছে। যদিও সেটি ডাহা মিথ্যা কথা। কাজেই কেউ যদি রাষ্ট্রধর্মের পক্ষে ধানাই-পানাই করার সময় 'ধর্মভিত্তিক রাজনীতি' কথাটি ব্যবহার করে তাকে শুধরে দিয়ে বলতে হবে:

— ''মনে যা আছে সেটিই মুখে আন বাপু। তুমি তো রাজনীতিতে শুধুমাত্র তোমার যে ধর্ম সেটিরই অগ্রাধিকার চাও। তাহলে সেটিই বল! বল, এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বভিত্তিক রাজনীতি।''

কেউ কেউ বলে রাষ্ট্রের যদি রাষ্ট্রভাষা থাকে, রাষ্ট্রের যদি জাতীয় সঙ্গীত থাকে, তাহলে রাষ্ট্রধর্ম থাকবে না কেন? সেটির উত্তর কী হবে? রাষ্ট্রভাষা অগ্রাধিকার বা মর্যাদার বিষয় নয়। এটি নিতান্তই সস্তায় রাষ্ট্রীয় দলিল-দস্তাবেজ সংরক্ষণের জন্য আর নাগরিকদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সহজ আনুষ্ঠানিক মাধ্যম। তার উপর রাষ্ট্রভাষা শুধুমাত্র একটি হতে হবে তা নয়। যেদিন আমরা আমাদের আদিবাসীদের তাদের ছিনিয়ে নেওয়া সম্মান ফিরিয়ে দেব সেদিন নিশ্চয়ই আমরা তাদের ভাষারও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিব আর সব রাষ্ট্রীয় যোগাযোগ সেসব ভাষাতেও শুরু করব। তখন সভ্য জাতি হিসেবে আমাদের দাবিও আরেকটু শক্ত হবে।

যারা রাষ্ট্রধর্ম চায় তারা কি বাকি সব ধর্ম আর বিকল্প বিশ্বাসের (অজ্ঞেয়বাদিতা, সংশয়বাদিতা, নিধার্মিকতা ইত্যাদি) সঙ্গে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে জায়গা ভাগ করতে রাজি হবে? নিশ্চয়ই নয়। তাহলে রাষ্ট্রভাষার সঙ্গে তুলনা করা হলে কী বলতে হবে? বলতে হবে:

— ''তা বাপু, সব ধর্মকেই রাষ্ট্রধর্ম করে দিলে কেমন হয়? হবে না? তাহলে ধানাই-পানাই বাদ দাও। বল 'এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বভিত্তিক রাজনীতি'। যেটি তোমার মনে আছে স্বীকার করে নাও।''

আরেকটি দল আছে যারা বলে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করলে অসুবিধা কোথায়? এটির উত্তর পানির মতো সহজ। দেশের বেশিরভাগ মানুষ ডান-হাতি (যে কোনো জনগোষ্ঠীতে প্রতি দশ জনে এক জন বাঁ-হাতি)G তাই বলে কি আমরা ডান হাতকে রাষ্ট্রীয় হাত ঘোষণা করব? ডান তর্জনির মর্যাদা বাম তর্জনির মর্যাদার চেয়ে বেশি ঘোষণা করে, সেটি দিয়ে নাক খোঁচানোকে 'আঙুলানুভূতিতে আঘাত' বলে ঘোষণা দিব? তাই কেউ যদি 'সংখ্যাগরিষ্ঠ' কথাটি বলে তাকেও বলতে হবে:

— ''তোমার শব্দের খেলা বন্ধ কর বাপু! তুমি 'এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বভিত্তিক রাজনীতি' চাও তো? সেটিই সরাসরি বলে ফেল!''

যারা চায় কেউ অন্য ধর্ম পালন করলে তাকে রাষ্ট্রে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে থাকতে হবে তাদের বেশিরভাগই আমাদেরই আশেপাশের পরিচিত জন এবং অনেক সময় সুশীল সমাজের মুখোশ পরে থাকে। তাদেরকে যখন 'এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বভিত্তিক রাজনীতি' কথাটি উচ্চারণ করতে বাধ্য করা হবে তখন তাদের সেই সভ্যতার মুখোশ খসে পড়বে। খুব কম লোকই চায় সে মুখোশ খসে পড়ুক। কাজেই পেটের কথা মুখে আনতে বাধ্য করার একটি খুব চমৎকার অহিংস পদ্ধতি এটি।

সামনে আবার তেসরা জুন আসছে। ১৯৮৮ সালে যারা সবার কাছে কাকুতি-মিনতি করেছিলেন ধর্মীয় সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে তাদের যেন সংবিধানে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা না হয়, তাদের অনেকেই নিশ্চয়ই এখনও বেঁচে আছেন। কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তৈরি হওয়া ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের একটি দেশ চোখের সামনে বদলে গেল তারা তার সাক্ষী।

এই মানুষদের দিকে আমরা যখন তাকাব তখন তাদের অস্তিত্বই আটাশ বছর আগে তাদের মর্যাদারক্ষায় জাতি হিসেবে ব্যর্থ হওয়ার কথা মনে করিয়ে দেবে। তাদের অপমানিত, হেঁট হয়ে যাওয়া মাথা আমাদের দেখিয়ে দেবে কীভাবে আমরা তাদের প্রতিনিয়ত বলছি, তোমরা এদেশে থাকতে পার কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে। শিশুরা যখন স্কুলে গিয়ে পৌরনীতিতে রাষ্ট্রধর্মের কথা জানতে পারে তারা নিশ্চয়ই অপার বিস্ময়ে বইটির দিকে তাকিয়ে ভাবে, কীভাবে এক মুহূর্তে তার পাশের অন্য ধর্মের বন্ধুটি তার তুলনায় কত ছোট হয়ে গেল!

আমার এখনও বিশ্বাস হয় না আটাশ বছর আগে আমরা এই কাজটি করেছিলাম এবং এখনও সেটি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। আমরা কী করে সভ্য সমাজে মুখ দেখাই? তেসরা জুনের চেয়ে লজ্জার আর কোনো দিন কি আমাদের আছে?