পহেলা বৈশাখ হোক সেতুবন্ধন

আকতার হোসেন
Published : 15 April 2016, 04:11 AM
Updated : 15 April 2016, 04:11 AM

সংস্কৃতি যদি অবয়ব হয় তবে তার আত্মা লুকায়িত মানুষের মাঝে। একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক অবস্থানের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা উৎপাদন ব্যবস্থায় নিয়োজিত কলাকৌশল, আচার-অনুষ্ঠান, পোশাক-আশাক, আহার-বাসস্থান ইত্যাদির প্রতিফলন দেখা দেয় সাংস্কৃতিক পরিব্যাপ্তিতে। ইংরেজি 'কালচার' শব্দের বাংলা যদি হয় সংস্কৃতি তবে 'কৃষ্টি' শব্দটি কোথা থেকে এল! কৃষ্টি শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত 'কৃষ' ধাতু থেকে যার অর্থ কৃষি। কাজেই বাঙালির কৃষ্টি-সংস্কৃতি হল কৃষিভিত্তিক জীবন ব্যবস্থার প্রতিফলন।

কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে বহু দেশ বেরিয়ে এলেও বাংলাদেশ এখনও কৃষিনির্ভর। বাঙালির জীবন পদ্ধতিতে ছয় ঋতু আর বারো মাসের যে প্রভাব, বৈশাখ হল সে সবের উৎসমুখ। বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস বৈশাখ কেন্দ্র করে পালন করা পহেলা বৈশাখ, বাঙালিদের প্রধান সাংস্কৃতিক উৎসব। যদিও বৈশাখ মাস শুধু বাংলা মাসের নাম নয় কিংবা 'পহেলা বৈশাখ' শুধু বাঙালিদের উৎসব নয়। সামান্য এদিক-ওদিক করে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলসহ নেপাল ও শ্রীলংকাতে বৈশাখকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে গণ্য করা হয় এবং বছরের প্রথম দিনটি কেন্দ্র করে তাদেরও রয়েছে নানা উৎসব।

তবু বাঙালির জীবনে বৈশাখ ও পহেলা বৈশাখ খুবই স্বতন্ত্র। বিশেষ করে বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখের রাজনৈতিক পটভূমি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করায় এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করায় গোটা বিষয়ের গুরুত্ব অন্য সব জাতিগোষ্ঠী থেকে ভিন্ন।

এক সময় পৃথিবীর সব সংস্কৃতি কৃষি কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। চাষাবাদে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির উন্নতি এবং চিন্তা-চেতনার জগতে অভূতপূর্ব সাফল্য কৃষিযুগ ছাপিয়ে আধুনিক শিল্পযুগে প্রবেশের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। একের পর এক আবিষ্কার ও বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ফলশ্রুতিতে সভ্যতা এখন ডিজিটাল যুগে এসে ঠেকেছে।

যারা ডিজিটাল আবহাওয়ায় প্রথম প্রথম পাত্তা না দিয়ে বলতেন, এর মধ্যে না ঢোকাই ভালো, ডিজিটাল পদ্ধতি সব কিছু খেয়ে ফেলবে, না খেলেও বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে– আজ তাদের কণ্ঠ স্তব্ধ। অর্থাৎ ডিজিটাল বশীকরণের শিকার হয়েছেন তারা। তাই স্বভাবত প্রশ্ন জাগে ডিজিটালের প্রভাবে একদিন কি বাঙালিদের বর্ষবরনের রূপটাও বদলে যাবে? কেমন হবে আজ থেকে বিশ-ত্রিশ বছর পর পহেলা বৈশাখ উদযাপন?

না, তেমন কিছু হয়তো হবে না। কেননা সব কিছু ডিজিটাল হয়ে গেলে নিজস্বতা বলে কিছু থাকবে না। ডিজিটাল পদ্ধতির স্বভাব হল অভিন্ন প্রয়োগ। সংস্কৃতি ঠিক তার উল্টো। এক সংস্কৃতি থেকে অন্য সংস্কৃতি ভিন্ন বলেই সব সংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে। কাজেই বাংলার লোকজ সংস্কৃতি যদি ডিজিটালের বশ্যতা স্বীকার করে নেয় তবে সে তার স্বকীয়তা হারাতে বাধ্য।

সাধারণভাবে বলা যায় চলাফেরার অবাধ স্বাধীনতার অভাব, জান-মালের নিরাপত্তাহীনতা, উৎকট ঝামেলা, অচেনা আতঙ্ক, প্রতিযোগিতামূলক জীবনপদ্ধতি এই সমস্ত নানান জটিলতার কারণে মানুষ এখন বাইরের সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে ঘরকুনো করে রেখেছে। ঘরের বাইরে গিয়ে ঘরোয়া পরিবেশ পায় না বলে কেউ প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাইরে থাকতে অরাজি। ঘরের মধ্যে আঠার মতো আটকে থেকেই এখন তারা ভাবছে এক কদম না হেঁটেও কী করে অন্যের কাছে পৌঁছানো যায়।

ফেসবুক কিংবা অন্যান্য সামাজিক মিডিয়া এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বন্ধুর মতো পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এক সময় সমাজের মধ্যে মিলেমিশে মানুষ সামাজিক হত; এখন সামাজিক হতে মিডিয়া হল বিকল্প অবলম্বন। বলা চলে দূরকে আপন করার প্রক্রিয়া শেষ হতে চলেছে, এখন নিজকে দূরে পৌঁছে দেবার প্রতিযোগিতা।

প্রশ্ন এসে যায়, কেন আজ চলাফেরার অবাধ সুযোগ সঙ্কুচিত হল? কেনই-বা জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে সকলকে ভাবতে হয়? প্রকৃতি ছায়া দেবে মায়া দেবে জেনেও মানুষ ঘরের মধ্যে ফিরতে পারলে যেন বেঁচে যায়। অবস্থার পরিবর্তন না হলে প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং ডিজিটাল পদ্ধতির মাঝামাঝি সমঝোতা পূর্ণ অবস্থান সেটাও বেশিদিন টিকে থাকবে না। এই ব্যবস্থা একপাক্ষিক হয়ে ডিজিটাল দাসপ্রথায় চালু হবে। মানুষ হবে দাস আর ডিজিটাল ব্যবস্থা হবে দাসপ্রভু।

সেই ভয়ানক দিনে তাহলে ঝিনুক ঘষে কাঁচা আম খাওয়ার স্বাদ মিটবে কী করে? লাটাই সুতার টানে বাতাসে কে উড়াবে কাগজের ঘুড়ি? বৈশাখী ঝড় দেখে মনের মধ্যে জেগে ওঠা গুড়ুম গুড়ুম শঙ্কা সেটাই বা উপভোগ করবে কী করে? কবি নজরুল ইসলামের সেই গান:

'এলো এলো রে বৈশাখী ঝড় এলো এলো রে,
ঐ বৈশাখী ঝড় এলো এলো মহীয়ান সুন্দর'।

অথবা 'ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়-– তোরা সব জয়ধ্বনি কর'।

বন্ধ ছাদের নিচে বসে কি কালবৈশাখীর জয়ধ্বনি করে মজা পাওয়া যাবে?

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন:

'বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া বহে কিসের হর্ষ
আধো-ঘুমের প্রান্ত-ছোওয়া বকুল মালার গন্ধ'।

একটা বট গাছ চোখের সামনে থ্রি-ডির প্রতিফলন দেখালে কি তাতে মনের চোখ নেচে বেড়াবে! যদি বটগাছের ছায়াতলটা খুঁজে পাওয়া না যায়, তাহলে আর কীসের রৌদ্র, কীসের খরা, কীসের একটুখানি বিশ্রাম নেওয়া! বৈশাখ মানে প্রাকৃতিক শোভা। বৈশাখ হল অনুভূতি। বৈশাখ অন্তর্জগত ছুঁয়ে যাওয়া কানামাছি। কাশবনের ভেতর কিছুক্ষণ লুকিয়ে থাকতে না পারলে লুকোচুরির মজাটাই ষোলআনা বৃথা।

'ছাড়ো ডাক, হে রুদ্র বৈশাখ। ভাঙিয়া মধ্যাহ্ন তন্দ্রা জগি উঠি বাহিরিব দ্বার, চেয়ে রব প্রানীশুন্য দগ্ধতৃণ দিগন্তের পারে। নিস্তব্ধ নির্বাক। হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ'।

বৈশাখের বৃষ্টিভেজা প্রভাতে সামান্য দমকা বাতাস, সামান্য ঝড়ে, আম কুড়োবার যে প্রলোভন সে ডাক শুনতে না পাওয়া মানে বাঙালিত্বের হাতে হাতকড়া পরা। ইংরেজি নববর্ষের মতো পহেলা বৈশাখে বাঙালিদের শরীর দোলে না, দোলে না কোমর। দোলে বাঙালির পুরোটা মন। ইংরেজি নববর্ষ এলে জানা যায় নতুন বছরের আগমনবার্তা, কিন্তু তাতে উচ্চারিত হয় না 'জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক'– সে ডাক শুনতে হলে পালন করতে হবে পহেলা বৈশাখ।

দুঃখের বিষয় যে, বাংলাদেশের সব ব্যবস্থা এখন আর দশটা দেশের মতো শহরমুখী হয়ে পড়েছে। পুরো দেশ যেন যাত্রীবোঝাই লঞ্চের মতো শহরগুলোর দিকে হেলে আছে। এমনও শোনা যায় পহেলা বৈশাখ উদযাপন করতে গ্রাম কিংবা জেলা শহরের মানুষ এখন ঢাকার আত্মীয়স্বজনদের বাসায় এসে হাজির হয়। যাতে তারা 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'সহ পহেলা বৈশাখের সব আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারে। একে বিবর্তন না বলে বিলুপ্তি বলাই ভালো।

যদি এমন পরিবর্তন না হত তাহলে পহেলা বৈশাখ লোকজ সংস্কৃতি প্রাণ হয়ে বেঁচে থাকত বাংলার সর্বত্র। হয়তো একটি বিশেষ দিন কেন্দ্র করে আবারো গ্রাম-গঞ্জ জেগে উঠতে পারত। সব কিছু কেন নগরমুখী করার চেষ্টা? পান্তার মজাটা আদিভূমিতে গিয়ে খেলে দোষ কী?

বিকল্প কিছু ভাবতে হবে। নাগরিক দিনযাপন থেকে মুক্তির স্বাদ নিতে পালা করে যে যার গ্রামে গিয়ে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করলে বেঁচে যাবে গ্রাম, জেগে উঠবে সবুজের সৌরভ। আবারও হয়তো পিঠা পায়েসের গন্ধে ভরে উঠবে মন। শহরে মানুষ গ্রামের নকশী কাঁথা, নকশী পাখা নিয়ে ফিরে আসবে শহরে। এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা জানবে লাঠি নাচ, বলি নাচ কী জিনিস। তাদের হাতেই হয়তো বেজে উঠবে একতারা ডুগডুগি, আড়বাঁশি।

এগুলো সবই আশার কথা। এক সময় আপনজনকে দেখার জন্য নৌকায় চড়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে চলে আসত আদরের বোন। নানি-দাদিরা সারা রাত ঢেঁকিঘরে বসে চাল কুটত পিঠা-পায়েস বানানোর জন্য। সন্ধ্যার আলোতে মাদুর পেতে চলত কিচ্ছা-কাহিনি। ঠিক তেমনি পহেলা বৈশাখ কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম আপ্যায়নের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠুক। বিভিন্ন কারণে গ্রামের মানুষ নিত্যদিন শহরমুখী হয়। একটি দিন শহরের মানুষ পালা করে না হয় গ্রামমুখী হোক। তাহলে শহর আর গ্রামের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি হবে, বাড়বে আত্মীয়তার বন্ধন।

এখনও মানুষ ঈদ কিংবা পূজাতে গ্রামে ফিরে যায় আত্মীয়স্বজনের কাছে। এটা ধর্মীয় টান। সংস্কৃতির টানও না হয় আমাদের নিয়ে যাক গ্রামে। যার গ্রামের বাড়িতে কেউ নেই, বা গ্রামে যার জন্ম না সে যাবে বন্ধুদের গ্রামে। যাবে আদিবাসীদের বৈসুক, সাংগ্রাই কিংবা বিজু উৎসব দেখতে। যাবে আগন্তুক হয়ে।

এভাবেই হয়তো দাঁড়িয়ে যাবে সত্যিকারের সর্বজনীন উৎসব। কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় বন্ধন। আসুন নতুন কিছু ভাবি। নতুন করে ফিরে যাই পুরাতনের কাছে। সেটাই হবে আসল মঙ্গল শোভাযাত্রা।