তনু হত্যা, সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ও প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্মান

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 30 March 2016, 09:32 AM
Updated : 30 March 2016, 09:32 AM

কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুর মৃতদেহ ২০ মার্চ রাতে উদ্ধার করেছেন তার বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী ইয়ার হোসেন। তনু সেদিন বিকেলে টিউশনি করতে গিয়ে রাত সোয়া দশটা পর্যন্ত বাসায় না ফেরায় উদ্বিগ্ন পিতা টর্চলাইট হাতে নিয়ে মেয়ের খোঁজে বেরিয়ে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে একটি কালভার্টের পাশে তনুকে পান। ইয়ার হোসেন বলেছেন:

''একটু উঁচু জায়গায় জঙ্গল ও গাছ-গাছালির মধ্যে তনুকে পেলাম। গাছের তলায় ওর মাথা দক্ষিণ দিকে আর পা উত্তর দিকে পড়ে আছে। মাথার নিচটা থেঁতলে গেছে। পুরো মুখে রক্ত আর আঁচড়ের দাগ। আমরা পাঁচজন মিলে ওকে সিএমএইচএ নিয়ে যাই।''

সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা তনুকে মৃত ঘোষণা করেন। তনু সম্পর্কে তার বাবা ইয়ার হোসেন আরও বলেছেন:

''আমার মেয়ে দুইটা টিউশনি করত, একদিন পর পর যেত। সাড়ে চারটার দিকে যখন বেরুত ওর মা আনোয়ারা বেগম এগিয়ে দিত। ফেরার পথেও ওর মা কিছু দূর গিয়ে নিয়ে আসত। ওই দিন তনু ওর মাকে বলেছিল, সে একাই আসতে পারবে। এখানে থেকে আমার মেয়েটা স্কুল ও কলেজের পড়াশোনা শেষ করেছে। আমি এখানে একত্রিশ বছর চাকরি করি। ৭/৮ বছর ধরে কোয়ার্টারে থাকি। নিরাপদ এলাকা। কারা ওকে মেরেছে, এখন এ নিয়ে কী বলব? আমি এর উপযুক্ত বিচার চাই।''

তনুর বাবা কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের নামে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। কিন্তু এ প্রতিবেদন লেখার দিন পর্যন্ত (২৯ মার্চ) ৯ দিন পেরুলেও তদন্তে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। মামলা থানা থেকে ডিবি ঘুরে সিআইডির হাতে ন্যস্ত হয়েছে। সন্দেহভাজন কাউকে গ্রেপ্তার করাও সম্ভব হয়নি।

তবে ঘটনাটিতে মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে:

''সেনানিবাসের মতো নিরাপত্তাবেষ্টিত এলাকায় এ ধরনের নৃশংস ঘটনা এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে আইনের আওতায় আনতে না পারা জনমনে নানা প্রশ্ন ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।''

হত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সারা দেশে প্রতিবাদ সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু খুনি-নির্যাতকদের গ্রেপ্তার কিংবা ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব হবে কি না তা নিয়েও দেশবাসীর মধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে। শুরু থেকেই ঘটনাটি আড়াল কিংবা গোপন করার এক ধরনের অপচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নানা ধরনের গুজবের জন্ম হচ্ছে। এটা সবারই জানা যে, গুজবের গরু খুব সহজেই মগডালেও উঠে যেতে পারে। দ্রুত রহস্য ভেদ করতে না পারলে বা সত্য ঘটনা প্রকাশ না করলে গুজবের ডালপালা বাড়তেই থাকবে।

তনু হত্যার ঘটনাটি শুরু থেকেই যে গোপন করার অপচেষ্টা ছিল সেটা স্পষ্ট হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক রাশেদা রওনাক খানের একটি লেখায়। রওনাক লিখেছেন:

''২০ মার্চ। রাত তখন ১টা ৪৫ মিনিট। হঠাৎ ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস চোখে পড়ল, একটি হাসি-খুশি, মিষ্টি মেয়ের ছবির পাশে তার এক বন্ধু লিখেছে, 'একটু আগেই তনুর সঙ্গে ইমোতে কথা হয়েছে… সেনানিবাসেও কেউ খুন হয়?' বন্ধু হিসেবে তিনি কোনোভাবেই তা মেনে নিতে পারছেন না। আমিও আঁতকে উঠলাম, সেনানিবাসে? কীভাবে সম্ভব সেনানিবাসে এই ধরনের হত্যাকাণ্ড? হঠাৎ দেখলাম, একটি অপরিচিত অনলাইন পত্রিকা খবরটি অতি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করেছে। এরপর কিছু 'জনপ্রিয়' পত্রিকার অনলাইন দেখলাম, কিছুই পেলাম না! অপেক্ষা করলাম, নিশ্চয়ই দেবে, হয়তো সময় লাগছে। কিন্তু আর খবর মিলল না ওইসব পত্রিকায় পাতায়!''

''ইতোমধ্যেই ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ল একটু একটু করে। দেখলাম, তনু কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী। আমার কলেজের, শুনতেই যেন আরও বেশি কষ্ট হচ্ছিল। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ছিলাম আমি। তাই গুমোট কান্না পাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল কলেজের এই ছোট বোনটি আমার অতি চেনা, চিরচেনা। বুঝত পারছিলাম না কী করব। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ৩টা, কাউকে ফোন দিয়ে জানব, তা-ও পারছি না।''

''পরদিন আমার মায়ের কাছ থেকে কুমিল্লার কয়েক জন সাংবাদিকের নম্বর নিয়ে ফোন দিই। অনেকের ফোনই বন্ধ পাচ্ছিলাম(!)। অবশেষে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের স্থানীয় প্রতিনিধিকে পেয়ে গেলাম। বিস্তারিত জানার চেষ্টা করলাম। তিনি একটা স্টোরি তৈরি করেছেন টিভিতে প্রচারের জন্য। কিন্তু তখন পর্যন্ত তনুর বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। বাবা-মা এবং পুরো পরিবারকে মিডিয়া থেকে দূরে রাখার প্রচেষ্টা চলছিল, এতটুকু বুঝতে পারলাম। বিষয়টা তখন আরও ঘোলাটে ঠেকল। এত লুকোচুরির কী আছে? সিভিলরা এই ধরনের কাণ্ড করলে দেশ-বিদেশ জানতে পারে, সেনাবাহিনীর ভেতরে হওয়াতে এত লুকোচুরি?''

''পরে আরও ২/৩ জন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হয়। সবাই প্রায় একই কথা বললেন। কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না, এমনকি যাদের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে খবরটি পেলাম, অর্থাৎ তনুর বন্ধুদেরও সবাইকে বাসায় ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, একেবারেই দুএকজন ছাড়া।''

দুই

এটা নিয়ে নিশ্চয়ই কারও মনে সন্দেহ নেই যে, সোহাগী জাহান তনু নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং তাকে হত্যা করা হয়েছে। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় ২৪ মার্চ কুমিল্লা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে দেওয়া ভিক্টোরিয়া কলেজ শিক্ষার্থীদের স্মারকলিপি থেকে। তনু ওই কলেজে পড়তেন। তার অনেক সহপাঠী নিশ্চয়ই তার সম্পর্কে আমাদের অনেকের চেয়ে অনেক বেশি জানেন। সাংবাদিকরা যেসব তথ্য বের করতে পারেননি, তা-ও নিশ্চয়ই তনুর বন্ধু-সহপাঠীদের অজানা নয়। তাই তাদের দেওয়া স্মারকলিপির বক্তব্য গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করা উচিত। স্মারকলিপিতে বলা হয়:

''গত ২০ মার্চ সন্ধ্যায় টিউশনি শেষে বাড়ি ফেরার সময় কুমিল্লা সেনানিবাসের অভ্যন্তরীন আবাসিক এলাকায় তনুকে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা অমানুষিক নির্যাতন করে, ধর্ষণ করে এবং তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে তার গলা কেটে ফেলে। ১২ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন কোয়ার্টার সংলগ্ন পাওয়ার হাউজ এলাকার কালভার্টের কাছে তার অর্ধনগ্ন লাশ ফেলে যায়। এই জঘন্যতম অপরাধের আলামত ও প্রমাণাদি নষ্ট করার জন্য নরপশুরা তার মৃতদেহের মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলে, পরনের পোশাক ছিঁড়ে ফেলে এবং তার চেহারা নষ্ট করে দেয়। আমরা পরদিন তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগে ব্যর্থ হয়ে তার বাসায় যাওয়ার উদ্যোগ নিলে কতিপয় সেনা সদস্য ক্যান্টনমেন্ট গেইটে এবং তার বাসায় যাবার রাস্তায় আমাদের বাধা দেয় এবং হয়রানি করে। তারা আমাদেরকে নিহত তনু সম্পর্কে অশালীন কথা বলে।''

''আমাদের ধারণা হচ্ছে, এই ঘটনায় কতিপয় বিপথগামী সেনা সদস্য জড়িত ছিল। কেননা, সেনানিবাসের মতো সুরক্ষিত ও নিরাপত্তাবেষ্টিত এলাকায় সন্ধ্যা ৭টায় সেনা সদস্য ব্যতীত বাইরের সন্ত্রাসীরা ঢুকে ২০ বছর বয়সী একজন মেয়েকে অপহরণ করে তাকে ধর্ষণপূর্বক হত্যা করে তার লাশ টেনেহিঁচড়ে ফেলে যাওয়ার সুযোগ ও সাহস পাবে বলে আমরা মনে করি না। যদি বাইরের কোনো সন্ত্রাসী এই অপরাধ করে থাকে তাহলে তারা নিশ্চিতভাবেই সেনানিবাসের কোনো সদস্যের পরিচিত ও মদদপুষ্ট।''

ঘটনাটি সেনানিবাসের মতো নিরাপদ এলাকায় হওয়াতেই সম্ভবত এ নিয়ে এক ধরনের লুকোচুরি খেলা শুরু হয়েছে। তনু আত্মহত্যা করেননি। তিনি দুর্ঘটনারও শিকার হননি। এক বা একাধিক ব্যক্তি তার ওপর অত্যাচার চালিয়েছে এবং হত্যা করেছে। একটি সংরক্ষিত এলাকা যেটাকে সবাই নিরাপদ ভাবে সেখানে একই সঙ্গে ধর্ষণ এবং হত্যার মতো দুটো গুরুতর অপরাধ যারা সংঘটিত করতে পারে তাদের বুকের পাটা যে অনেক বড় তা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না কারও। সাধারণ বখাটে কিংবা দুর্বৃত্তদের এতটা দুঃসাহস এর আগে দেখা যায়নি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবু সালে সেকান্দার তার এক লেখায় সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, তনু হত্যা কি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র? তিনি লিখেছেন:

''এ দেশের সাধারণ মানুষ সেনা সদস্যদের উপর সবচেয়ে বেশি আস্থা রাখেন। তাদের কাছে সেনা সদস্যরা অনেকটা দেবদূতের মতো। সেই কারণে কোথাও সাধারণ প্রশাসন ও পুলিশ ব্যর্থ হবে এমনটি মনে করলেই আমরা সেনাবাহিনী নিয়োগের দাবি করি। জাতীয় নির্বাচন অথবা অন্য যেকোনো নির্বাচনে সেনাবাহিনী নিয়োগের দাবি করা হয়। এদেশের সাধারণ মানুষের সেই আস্থা ও ভালোবাসার সেনাবাহিনীর নিরাপত্তার সুরক্ষিত সেনানিবাস এলাকায় যখন ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটে তখন ওই ঘটনা সত্যিই আমাদের বিচলিত করে।''

আইএসপিআরএর এক বিজ্ঞপ্তিতে ২৯ মার্চ বলা হয়েছে:

''সেনাবাহিনী প্রথম থেকে সকল তদন্তকারী সংস্থাকে আন্তরিকতার সঙ্গে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে আসছে। অথচ কিছু স্বার্থান্বেষী মহল এ ঘটনা কেন্দ্র করে সেনাবাহিনী সম্পর্কে অনুমাননির্ভর বক্তব্য প্রদান ও প্রচার করে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছেন, যা মোটেই কাম্য নয়।''

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়:

''তনুর বাবা ইয়ার হোসেন গত ৩০ বছর ধরে কুমিল্লার সেনানিবাস ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের একজন বেসামরিক কর্মচারী, যিনি সেনা পরিবারেরই সদস্য এবং তনু কুমিল্লা সেনানিবাসে বড় হয়েছেন, ও আমাদেরই সন্তান। তার এ ধরনের মর্মান্তিক মৃত্যুতে প্রতিটি সেনা সদস্য দারুণভাবে ব্যথিত ও মর্মাহত। সেনাবাহিনী জনসাধারণেরই অংশ এবং দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এ ব্যাপারে সকলের দায়িত্বশীল বক্তব্য বা প্রচার একান্তভাবে কাম্য।''

সেনাবাহিনী সম্পর্কে কোনো ধরনের অনুমাননির্ভর বক্তব্য প্রচার করে বিভ্রান্তি ছড়ানো নিশ্চয়ই কারও কাম্য নয়। তবে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে, সমাজে যেমন খারাপ প্রকৃতি ও প্রবৃত্তির মানুষ আছে, তেমনি বিভিন্ন বাহিনীতেও থাকা অসম্ভব নয়। কাউকে যেমন অমূলক সন্দেহ করা উচিত নয়, তেমনি অহেতুক কাউকে সন্দেহমুক্ত রাখাও ঠিক নয়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, সেনাবাহিনীর বিপথগামী সদস্যদের হাতেই আমাদের জাতির পিতা খুন হয়েছেন। আরও কিছু কিছু অঘটনের সঙ্গেও বিপথগামীদের নাম জড়িয়ে আছে। শরীরে কোনো ক্ষত তৈরি হলে তা উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময়ের উদ্যোগ নেওয়াই যথার্থ, তাকে আড়াল করা বা ঢেকে রাখা কোনো বিবেচনায় স্বাস্থ্যসম্মত নয়।

আমরা এখনও জানি না তনু হত্যার ঘটনায় সত্যি সত্যি কে বা কারা জড়িত। তবে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি অমলিন রাখার স্বার্থেই সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষী ব্যক্তিদের শনাক্ত করা প্রয়োজন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল কুমিল্লার পুলিশ সুপারকে টেলিফোন করে প্রকৃত ঘটনা খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন:

''তনু হত্যা মামলায় সরকার কোনো নাটক দেখতে চায় না।… আমরা অনেক বড় বড় ঘটনার রহস্য বের করেছি। এটিরও রহস্য উদঘাটন হবে। হয়তো একটু সময় লাগছে।''

দেখা যাচ্ছে, মামলা নিয়ে 'নাটকের' আশংকা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মনেও আছে। কুমিল্লার এসপি মোহাম্মদ শাহ আবিদ হোসেন ২৬ মার্চ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন:

''সুনির্দিষ্ট বলার মতো অগ্রগতি নেই। সংরক্ষিত এলাকায় কিছু আইনগত বিধি-নিষেধ থাকে। বলছি না যে, আমরা আইনগত সহযোগিতা পাচ্ছি না। তবে তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের অন্যের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।''

আবার ২৫ মার্চ রাতে আইএসপিআরএর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সোহাগী হত্যার কারণ উদ্ঘাটনের জন্যে ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সেনাবাহিনী এ হত্যার কারণ উদঘাটনে পুলিশ ও প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিচ্ছে।

কিন্তু অপরাধীদের গ্রেপ্তারে অগ্রগতি না থাকলেও তনুর পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে হয়রানির খবর গণমাধ্যমে ছাপা হয়েছে। কুমিল্লার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের এপিপি ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান মিঠু বলেছেন:

''ধর্ষণের পরই তনুকে হত্যা করা হয়, এটা আলামত থেকে বেশ বোঝা যায়। প্রথম থেকেই ময়না তদন্তসহ তদন্ত নিয়ে সন্দেহ হয়, আসল খুনিকে রক্ষার চেষ্টা চলছে।''

এ ধরনের কোনো অপচেষ্টা যদি সত্যি হয় তাহলে দেশে একটি অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি হওয়ার আশংকা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। ১৯৯৫ সালে দিনাজপুরের ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার পর সে রকম পরিস্থিতিই দেশে তৈরি হয়েছিল।

তিন

তনু হত্যার ডামাডোলের মধ্যেই একটি আনন্দ ও স্বস্তির খবর আমরা পেয়েছি। আমেরিকার 'ফরচুন' সাময়িকী বিশ্বের মহান ৫০ জন নেতার যে তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে ১০ নম্বরে রয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 'ফরচুন' সাময়িকীর নিজস্ব ওয়েবসাইটে গত ২৪ মার্চ তালিকাটি প্রকাশ করা হয়। এতে স্থান পেয়েছেন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, মানবহিতৈষী, শিল্পীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার এমন সব মানুষ, যাঁরা বিশ্বকে বদলে দিতে নিজেরা ভূমিকা রেখে চলেছেন; একই কাজে অন্যদের অনুপ্রাণিত করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিষয়ে 'ফরচুন' বলেছে, তিনি নিজ দেশে নারীদের অধিকার এগিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছেন। দেশে নারীদের জন্য আইনগত সুরক্ষা নিশ্চিত করেছেন। পাশাপাশি তিনি নারীদের অধিকতর শিক্ষা, আর্থিক স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দিতে কাজ করছেন।

প্রধানমন্ত্রীর এই অর্জন নিঃসন্দেহে আমাদের গৌরবান্বিত করেছে। আমরা জানি, তিনি নারীদের নিরাপত্তা, শিক্ষা, অর্থনৈতিক মুক্তি ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ। কিন্তু তাঁর এই সাফল্যের খবর আমরা সানন্দে উদযাপন করতে পারলাম না সোহাগী জাহান তনুর দুঃখজনক মৃতুর ঘটনায়। তনু আমাদের দেশের কোটি কোটি সংগ্রামী নারীর এক উজ্জ্বল প্রতীক। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেননি। তারা বাবা একজন সাধারণ চাকরিজীবী। নিজের লেখাপড়ার খরচ চালানো এবং হয়তো পরিবারকে কিছুটা সহযোগিতা করার জন্যই পড়াশোনা, নাচ-গান-অভিনয়চর্চার পাশাপাশি তনু দুটি টিউশনিও করতেন। লেখাপড়া শেষ করে শিক্ষাকতার পেশায় নিয়োজিত হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু তার স্বপ্ন পূরণের যে আর কোনো সম্ভাবনাই নেই!

দুঃখজনক যে, তার মৃত্যু কেন্দ্র করে নানা ধরনের 'সরস' গল্প ফাঁদার চিরাচরিত অপকৌশলও আমরা লক্ষ্য করছি। তার 'চরিত্র' কেমন ছিল, কারও সঙ্গে তার কোনো 'সম্পর্ক' ছিল কি না সেসব নিয়েও কারও কারও আগ্রহ বা কৌতূহলের শেষ নেই। ব্যাপারটা যেন এমন যে, যে মেয়েদের কারও সঙ্গে সম্পর্ক থাকে তাকে হত্যা করা কিংবা তার ওপর নির্যাতন করা জায়েজ!

এটা সত্য যে, কারও 'তথাকথিত' কোনো চারিত্রিক ত্রুটি-দুর্বলতা থাকলেও তাকে হত্যা করার অধিকার কারও নেই। তনু বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন। সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য নিজেকে তৈরি করার সংগ্রামের সামিল ছিলেন। তনু নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছেন, মর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীদের জন্য আইনগত সুরক্ষা নিশ্চিত করার সাফল্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি যখন পাচ্ছেন তখন তনু হত্যাকাণ্ডের সুবিচার নিশ্চিত হওয়া অতি জরুরি বৈকি।