পরাজিতের সংখ্যা-তত্ত্ব বনাম বিজয়ীর কলম

ফারজানা চৌধুরী
Published : 29 March 2016, 10:20 AM
Updated : 29 March 2016, 10:20 AM

শহীদ জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার আত্মজা মেঘনা গুহঠাকুরতার একটি সাক্ষাৎকার শুনছিলাম। মেঘনাদি বর্ণনা করছেন তাঁর বাবার কথা, বর্ণনা করছেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে দুঃসহ স্মৃতির কথা– সেই ভয়াল পঁচিশে মার্চের কালরাতের কথা। আবেগতাড়িত হচ্ছিলাম, চোখ উঠছিল ভিজে, হৃদয়ে হচ্ছিল রক্তক্ষরণ।

আমার বাবা ছিলেন শহীদ ডাক্তার আলীম চৌধুরী। দেশের শীর্ষস্থানীয় চক্ষু বিশেষজ্ঞ ছিলেন তিনি। তবে তার চেয়ে তাঁর অনেক বড় পরিচয় হল, তিনি একজন স্বাধীনতাকামী, নিখাঁদ দেশপ্রেমিক ছিলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবস্থায় তিনি ভাষার দাবিতে লড়াইযে অংশ নেন। তারপর স্বাধিকার আন্দোলনে ছিল তাঁর দীর্ঘদিনের সম্পৃক্ততা। সবশেষে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ। এই মানুষটিই আমার বাবা। এ সবই ছিল তাঁর অপরাধ। সেই অপরাধে একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর তাঁকে অস্ত্রের মুখে ধরে নিয়ে গেল আলবদর ঘাতকরা। তাঁর ক্ষত-বিক্ষত, প্রাণহীন দেহ আমরা খুঁজে পেলাম ডিসেম্বরের ১৮ তারিখে। অনেক সাধের স্বাধীনতা দেখা হল না আমার বাবার। বিজয়ের অল্প কিছু সময় আগেই তাঁর রক্ত মিশে গেল তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশে। তাঁর প্রাণহীন দেহ বাংলাদেশের বুকে পেল আশ্রয়, তাঁর রক্ত পতাকার লাল-সূর্যে পেল ঠিকানা। কিন্তু আমি, আমরা দুবোন ফিরে পাইনি আমাদের নির্ভরতার আশ্রয় আমাদের বাবাকে।

২৬ মার্চ আর ১৬ ডিসেম্বর। ৫৫,৫৯৮ বর্গমাইলের ১৬ কোটি মানুষের জন্য কী অসাধারণ দুটো দিন। কী আনন্দের, প্রাপ্তির ও গৌরবের। কিন্তু আমরা যারা শহীদ পরিবারের সদস্য তাদের সব আনন্দে কোথায় এসে যোগ হয় অসীম বেদনা, অপ্রাপ্তি। তাই ২৬ মার্চের আনন্দে উঁকি দেয় ২৫ মার্চ রাতের স্মৃতি! ১৬ ডিসেম্বরের উল্লাসে পড়ে ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বরের দীর্ঘশ্বাস! কারও ঘাড়ে ভয়াবহ স্মৃতির বোঝা, কারও গায়ে স্মৃতিহীনতার পাহাড়। এই বোঝা, এই পাহাড় আমাদের সঙ্গী ছিল, আছে, থাকবে– আমৃত্যু।

সেই বোঝা সবাইকে বইতে হবে তা বলি না, তা চাই-ও না। একদম না। আমার বাবার রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন দেশের স্বাধীন প্রজন্ম এই অসাধারণ দিনগুলি আনন্দিত চিত্তে উদযাপন করবে, সে-ও আমাদের ভীষণ বড় প্রাপ্তি।

চাই শুধু এতটুকুই– রক্তের বিনিময়ে পাওয়া ইতিহাস নিয়ে কেউ যেন নোংরা খেলা না খেলে। কিন্তু ৪৫ বছর পরও নূতন নূতন ইতিহাস শুনি। সে সব নোংরামি থেকে রেহাই নেই কারও– জাতির জনকের নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদেরও না। শহীদের সংখ্যা নিয়ে কুতর্ক তো বিরাট বিজ্ঞানমনস্ক হবার লক্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে! এই অপপ্রচার এখানেও শুধু বেড়েই চলেছে। ছড়িয়ে গেছে অনেক, অনেক দূর অব্দি। তার একটা উদাহরণ দিই।

এক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রে আছি। কদিন আগে আমার এক মার্কিন সহকর্মী খুব আনন্দিত চিত্তে, আগ্রহের সঙ্গে আমার কাছে এসে বলল, "ফারজানা, এখানে এক ফেলো এসেছে, ওর শেষ নামও চৌধুরী।… চল পরিচয় করিয়ে দিই।"

দুষ্টুমি করে বলে, "কে জানে, হয়তো সে তোমার আত্মীয়!''

পরিচয় হল এক চৌধুরীর সঙ্গে। কোনো এক কারণে দক্ষিণ এশিয়ার সব লোকজন দেখা হলে 'হাই' বলার পরই সাধারণত সাধারণত জানতে চায় ভারতীয় কি না। সে-ও তাই জানতে চাইল। বললাম, "না, আমি বাংলাদেশি।''

সে বলল, "আমি এদেশীয়, কিন্তু আমার মা-বাবা পাকিস্তানি।"

একটু চুপচাপ থাকলাম। চৌধুরী-চৌধুরী আলাপ জমল না।

এরপর একদিন সে আমাকে বলল, "তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?"

বললাম, "বল।''

"আমি অনেক বাংলাদেশিকে চিনি। তোমরা দুই ধরনের। এক দল পাকিস্তানিদের ভাইয়ের মতো পছন্দ কর; আরেক দল পছন্দ কর না। আমার ধারণা, তুমি দ্বিতীয় দলের। আমি কি ঠিক বললাম?"

"ঠিক!"

সে বলল, ''কেন বল তো?"

"তুমি পাকিস্তানের, তোমার তো জানার কথা"

সে বলে, "কী? ১৯৭১?"

"হ্যাঁ"।

''কিন্তু সেসব তো অতিরঞ্জিত গল্প আর ভারতের প্রোপাগান্ডা! ৩০ লক্ষ কীভাবে শহীদ হবে?"

পাল্টা বললাম, "তাহলে কত হবে?"

সে বলে, "২৬,০০০ তো শুনেছি।"

এসব শুনে শুনে আমি এত অভ্যস্ত। তাই বলতে শুরু করলাম, অকপটে বলতেই থাকলাম–

"তুমি কি দেখেছ ভয়াবহ গণহত্যা নিয়ে যে কোনো তালিকাতেই বাংলাদেশের ১৯৭১এর রক্তাক্ত গণহত্যার নাম থাকে? তুমি কি জান গণহত্যা সম্পর্কিত গবেষণাপত্রগুলিতে পরিসংখ্যানের ব্যাপক তারতম্য থাকে, থাকবে? যুগে-যুগে, দেশে-বিদেশে যেসব গণহত্যা হয়েছে তার প্রত্যেকটির তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সংশয় আছে। থাকবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কি ঠিক ৬০ লক্ষ ইহুদি মারা গেছে? ৫৯,৯৯,৯৯৯ নয় তো? বা ৬০,০০,০০১?''

''অপরাধীর নিষ্ঠুরতা আর ভুক্তভোগীর বেদনা মাপার কোনো যন্ত্র নেই, বাটখারাও নেই। কখনও তৈরি করাও যাবে না। মানবিক বিপর্যয়ে তাই রক্তরঞ্জিত, আনুমানিক সংখ্যাই ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে বিবেচিত হয়।"

সে বলে, "১৯৭১ নিয়ে তোমার আবেগ অনেক বেশি মনে হয়, তুমি তো কিছু দেখনি, তাই না?"

খানিক চুপ করে থেকে বললাম, "ইতিহাস দেখতে চাও? জানতে চাও? আমাকে দেখলেই চলবে।"

সে অবাক হয়ে বলল, "তার মানে?"

জীবনের সবচয়ে কষ্টের দিনের কথাটা তাকে বললাম। ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১। পাকিস্তানি চৌধুরী একদম নির্বাক হয়ে গেল। কিন্তু আমি তো আর থামতে পারছি না।

"… আরও শুনবে? আমার খুব কাছের একজন মানুষ আছেন যাঁর পরিবারের প্রত্যেক সদস্য চিরতরে হারিয়ে গেছেন একাত্তরে। খুব কম মানুষ সে কথা জানে, অনেকে জানে না। তিনি নিজে বেঁচে আছেন। তিনি স্বেচ্ছায় বন্ধ করে রেখেছেন সেই ভয়াবহ স্মৃতির দরজা। তিনি কোনো সংখ্যা নন, তিনি নেই কোনো পরিসংখ্যানে। … একাত্তরের হতাহত আর ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যানে আমাদের মতো সব স্বজনহারাদের কী আসে যায়? দেশেরই-বা কী আসে যায়? কত মানুষ মারা গেলে তা যথেষ্ট মর্মান্তিক বিবেচিত হয়? আমাদের যন্ত্রণার কাছে চরম অর্থহীন আর অপ্রাসঙ্গিক নয় কি এসব?"

অনেকক্ষণ নির্বাক থাকার পর সেই চৌধুরী আমাকে বলে, "আমি কিন্তু এই কথাগুলি বাংলাদেশিদের কাছ থেকেই শুনেছি।"

রাগে-দুঃখে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। তারপর বললাম, "গণহত্যা নিয়ে বিতর্ক করে কারা? যারা গণহত্যাকারী, তারাই। অপরাধী তার অপরাধের ব্যাপকতা ছোট করে, তুচ্ছ করে। ভুক্তভোগী নয়। শুধু বাংলাদেশই ব্যতিক্রম। কেন জান?… তুমি বলছিলে দুই ধরনের বাংলাদেশির কথা। এরা দ্বিতীয় ধরনের। এরা মনেপ্রাণে পাকিস্তানিই রয়ে গেছে।"

আর কথা বাড়ালাম না। পরাজিত, বিজিত পাকিস্তানি কী বলল, কী ভাবল আমার তাতে কিছুই যায় আসে না। বাংলাদেশেই এমন কত আলোচনা শুনি। যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, তাদের সহযোগী আর তাদের অর্ধশিক্ষিত, কুশিক্ষিত নতুন রাজাকার দল– তারা তো বলেই, আরও কত 'সুশীল'ও বলেন। মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে যারা প্রচণ্ড কপট, শঠ। মুক্তিযুদ্ধের জন্য তাদের ভালোবাসা আপাতদৃষ্টিতে সীমাহীন! তারা মুক্তিযুদ্ধ ভালোবাসেন, কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের ঘৃণা করেন না। তারা বিচার চান বলেই টেনে টেনে একটা 'কিন্তু' বলেন, আর তারপর এক হাজার একটা কপট যুক্তি দেন। তারা সুযোগ পেলেই সংখ্যা-তত্ত্বে মাতেন। জাতির পিতা আর শহীদদের নিয়ে জল ঘোলা করেন। সেই দলে রক্তরঞ্জিত এই স্বাধীন দেশের প্রাক্তন মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীও অন্তর্ভুক্ত!

আমি, আমরা আহত হই, ক্ষুব্ধ হই। চোখের জল মুছে তাই আমাদেরকেই আবার কলম ধরতে হয়। বলতে হয়: ১৯৭১এর আত্মত্যাগ কোনো গল্প নয়। 'ঘাতক' কোনো অচেনা, অদেখা ধারণা নয়। গোলাম আজম, সাঈদী, নিজামী, মুজাহিদ, সাকা– এরাই ঘাতক, এরাই সন্ত্রাসী, এরাই ধর্ষক, এরাই দানব। তারা ও তাদের তৈরি নব্য-রাজাকারেরাই সহিষ্ণু উদার বাংলাদেশের শত্রু। বিশ্বজুড়ে মানবতার শত্রু।

কলম ধরতে হয় যুদ্ধাপরাধীদের হয়ে সাফাই গাওয়া ভণ্ড, প্রতারকদের বিরুদ্ধে। সময় এসেছে সেই অপশক্তির মুখোমুখি দাঁড়ানোর। সময় এসেছে তাদের ওই 'উদার' লেবাস খুলে ফেলে আসল অবয়ব উন্মোচন করার।

পাকিস্তানের ফেলে যাওয়া অবর্জনাদের ধৃষ্টতাই আমাদের বাধ্য করে সব শোক-দুঃখ সরিয়ে রেখে কথা বলতে। তাই চেতনার আড়ষ্টতা দূর করে কলম সচল করি। অশ্রু মুছে অবলীলায় বর্ণনা করি সত্যের। আমরা বলেই চলি, লিখেই চলি। এভাবেই চলব আমৃত্যু! আমাদের হৃদয়ের অবিরাম রক্তক্ষরণ স্বাধীন দেশের স্বাধীন প্রজন্মের জন্য, শহীদ স্বজনদের জন্য, তাদের স্বপ্নের বাংলাদেশের জন্য।