সেই জয় বাংলা এখনও কানে বাজে

রকিবুল হাসান
Published : 26 March 2016, 08:13 AM
Updated : 26 March 2016, 08:13 AM

এটা ছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১। সেই সময় কোনো দল পাকিস্তান সফরে এলে ঢাকাতে সব সময়ই একটা টেস্ট হতো। করাচিতে হতো, লাহোরে হতো, ঢাকাতেও হতো।

এটা একটা অনানুষ্ঠানিক টেস্ট ম্যাচ ছিল। পাকিস্তানের সঙ্গে কমনওয়েলখ একাদশের খেলা। আমার তখন ১৮ বছর বয়স। ঢাকা টেস্টের ওই দলে সুযোগ পেলাম আমি। দ্বাদশ খেলোয়াড় ছিলেন আমাদের তানভীর মাজহার তান্না।

আমরা পূর্বানী হোটেলে ছিলাম। তখন কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা উত্তাপ টের পাওয়া যাচ্ছিল। নির্বাচন হয়ে গেছে। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে। একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ। আমরাও খুব উৎসাহিত, উজ্জীবিত ছিলাম।

বয়স কম হলেও আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল। সবার মধ্যে রোমাঞ্চ খেলা করছিল। সবার মধ্যেই একটা ব্যাপার ছিল-এই প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের প্রশাসনে, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে যেতে চলেছি আমরা। তো ওই সময়ে কিন্তু একটা টালবাহানা চলছিল যে, আদৌ বাংলাদেশকে ক্ষমতায় যেতে দেবে কী দেবে না। ইলেকশন জেতার পরও আমরা দেখতে পেলাম যে ছয় দফার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু নির্বাচন করেছিল, যেটা ছিল আমাদের জনগনের ম্যান্ডেট সেটাকে মানতে রাজি না জুলফিকার আলি ভুট্টোরা।

এই প্রেক্ষাপটের মধ্যেই ম্যাচটি আসে। আমরা নিজেরাও খুব সচেতন ছিলাম। যখন পাকিস্তান টিম হোটেলে উঠে গেলাম, আমাদের তখন সব সরঞ্জাম দেওয়া হলো। হঠাৎ দেখি ম্যাচের আগের দিন পাকিস্তানের খেলোয়াড়ের ব্যাটে তলোয়ারের স্টিকার ছিল। আমাকে অবশ্য ওই স্টিকারের ব্যাট দেওয়া হয়নি। বিষয়টি হঠাৎ করে আমার মনকে অন্যরকমভাবে নাড়া দিল। ভাবলাম, ব্যাপারটা কী?

আমি তখন একজন সচেতন অ্যাক্টিভিস্টও ছিলাম। ছোট ছোট ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিতাম। এক বছর বড় হলেও শেখ কামাল আমাদের বন্ধু মানুষ ছিল। আমরা এক সঙ্গে ঘুরতাম।

তখন পূর্বানী হোটেলে এটা দেখার পর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমার ব্যাটেও স্টিকার লাগাব, তবে সেটা জয় বাংলার। তখন বাংলাদেশে গাড়িতে, দরজায় লাগানোর জন্য তিনকোনো একটা স্টিকার বের হয়। সেই স্টিকারটায় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র; লাল-সবুজের মধ্যে হলুদ আর উপরে জয় বাংলা লেখা।

আমি মনে করলাম,ওই তলোয়ার হলো জুলফিকার আলি ভুট্টোর নির্বাচনের মার্কা। ওই মার্কা যখন পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানদের ব্যাটে গেছে, তো আমিও তখন আমার ব্যাটে জয় বাংলার স্টিকার লাগাব।

সেই সময় হোটেলে সন্ধ্যার দিকে আমার রুমে শেখ কামাল ছিল। তাকে বললাম, আমি আমার ব্যাটে স্টিকারটা লাগাতে চাচ্ছি, স্টিকারটা দরকার। কারণ, আমি মনে করেছিলাম এটা সময়ের দাবি। আমরা বাঙালিরা তখন যার যার অবস্থান থেকেই সেই নির্বাচন পূর্ব বা পরবর্তী সময়ে বিভিন্নভাবে আমাদের প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছিলাম।

ওদের ব্যাটে ওই মার্কা দেখে আমার কাছে খটকা লাগল। আমার কাছে ওটা ভালো লাগেনি। আমি ভাবলাম, অন্তত আন্তর্জাতিকভাবে এটাকে ফোকাস করার এই সুযোগ। কারণ, এটা তো আন্তর্জাতিক খেলা; দেশে ও দেশের বাইরের পত্রিকায় আসবে। ইংল্যান্ডেও আসবে হয়ত। কামালকে বলি, আমি তো এটা করতে চাচ্ছি। যেমন কথা তেমন কাজ। কামাল সঙ্গে সঙ্গে জালালকে পাঠিয়ে দিল স্টিকার সংগ্রহ করে আনতে।

রাতে কামাল নিজেই স্টিকারটা ব্যাটের উপর লাগাল। সাদা ধবধবে ব্যাট। সেই ব্যাট নিয়েই পরের দিন আমি নামলাম।

আমি আর আজমত রানা। আজমতের বড় ভাই সাফাকাত রানা; ও অনেকদিন ধরেই পাকিস্তান দলে খেলেছে। আর আজমতের ছোট ভাই সুলতান রানা; এই এশিয়া কাপে ও এসিসির পক্ষ থেকে টুর্নামেন্ট ডিরেক্টর ছিল। আমার বন্ধু এরা।

ক্রিকেটারদের মধ্যে আসলে তেমন কিছু থাকে না। কিন্তু রাজনীতি যখন সবকিছুর মধ্যে ঢুকে যায়, তখন এগুলো মনকে নাড়া দেয়।

আমিও সেই সময় মনে করলাম, এটা আমার প্রতিবাদ। আমি আর আজমত রানা মাঠে নামলাম। মাঠে নামার সেই মুহূর্তের অনুভূতিটা এখনও আমার মনে শিহরণ জাগায়।

তখন তো আর এ সময়ের মতো এত মিডিয়া ছিল না। আর ফটো সাংবাদিকদেরও অত ভালো ক্যামেরা ছিল না। তারা খুব কাছাকাছি থাকত।

আমার যদ্দূর মনে পড়ে, তখন ফটো সাংবাদিক ছিলেন রশিদ ভাই। এ ছাড়া আলম ভাই ছিলেন। তারা তখন তরুণ ছিলেন।

আমি আর আজমত মাঠে নামছি; আমার ব্যাটে স্টিকার লাগানো। ফটো সাংবাদিকরা আমাদের একটু দাঁড় করাল। একটু স্লো করিয়ে দিল আমাদের। রশিদ ভাই, আলম ভাইরা ছবি তুললেন।

ব্যাট নিয়ে নামার সময় আমাকে কেন ছবি তুলতে থামানো হল সেটা বুঝতে দর্শকদের মিনিট খানেক সময় লেগেছিল। বুঝতে পারার পর ১২ থেকে ১৫ হাজার দর্শক এক সঙ্গে 'জয় বাংলা' স্লোগানে স্টেডিয়াম প্রকম্পিত করল। আমি যে এখন এই কথাগুলো বলছি, এখনও আমার শিহরণ লাগে। সেই জয় বাংলা ধ্বনি এখনও আমার কানে বাজে।

ব্যাটে জয় বাংলা স্টিকার লাগানোর ছবি পরের দিন পত্র-পত্রিকায় বড় আকারে প্রকাশ করা হলো। বড় খবর বের হলো।

মজার ব্যাপার হলো, ওই দিনই দুপুরে লাঞ্চের সময় আমাকে শো কজ করা হল। বার বার শো কজ। পাকিস্তান দলের ম্যানেজার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'এটা কী?' আমি বললাম, 'এটা একটা স্টিকার।' আবার চুপ। একটু পরে আবার জিজ্ঞেস করল, 'রকিবুল, এখানে কী লেখা আছে?' আমি বললাম, 'এখানে জয় বাংলা লেখা আছে।'

পাকিস্তানের খেলোয়াড়রা তখন মুচকি হাসছিল। সবাই মিলে মজা নিচ্ছিল। আমাকে তখন ও বোঝাতে বলল, জয় বাংলা আসলে কী। আমি তখন ওকে বোঝানোর জন্য বললাম, 'জয় বাংলা মিনস ইস্ট পাকিস্তান জিন্দাবাদ'। ও বলল, 'ও আচ্ছা'। আর কিছু বলল না।

পরের দিন সব পত্রিকায় এটা ছাপা হয়। ইংরেজি পত্রিকা, দৈনিক পাকিস্তানে। পরে শুনলাম, ইংল্যান্ডের পত্রিকায়ও এটা ছাপা হয়েছিল। তখন তো একটা গরম আবহ ছিল। একটা পট পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। এরকম সময়ে আমি খেলার মধ্যে এমন ঘটনা ঘটিয়ে ফেললাম।

পরে অবশ্য আমাকে এর মূল্যও দিতে হয়েছে। পয়লা মার্চ ছিল ম্যাচের চতুর্থ দিন। সেদিন দুপুরের মধ্যে খবর আসল ৩ মার্চ যে অ্যাসেম্বলি বসার কথা ছিল, সেটা তদানীন্তন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর পরামর্শে বাতিল করেছেন। এটা শোনার পর মাঠের মধ্যে যেন স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল।

রেডিওতে সবাই খেলার ধারা বিবরণী শুনছিল। রেডিওতেই অ্যাসেম্বলি বাতিলের খবর আসল। চারদিকে প্রতিবাদ শুরু হয়ে গেল। আমাদের মাঠ থেকে ড্রেসিংরুমে নিয়ে এলো। আমাদের বলল, অসুবিধা নেই। অবশ্য নিরাপত্তা ছিল। তবে মানুষ খেপে গিয়েছিল, স্টেডিয়ামে তখন আগুন জ্বলছিল।

আমাদের বলল, ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনাবাহিনীর ট্রাক আসবে। আমাদের সেখানে নিয়ে যাবে। কিন্তু আমি না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ, মনে হচ্ছিল বোধ হয় শেষ ঘণ্টা বেজে যাবে। সবাই গেল। কিন্তু আমি আর তান্না গেলাম না।

ম্যানেজারকে আমি বোঝালাম যে, হোটেলে গিয়ে আমি সবকিছু নিয়ে আসি। উনি আমাকে বললেন, তুমি তো এভাবে যেতে পারো না। কারণ, তুমি পাকিস্তান দলের খেলোয়াড়। যেতে হলে তোমাকে মুচলেকা দিয়ে যেতে হবে।

মুচলেকা দিয়ে আমি ক্রিকেটের পোশাক ছেড়ে সাধারণ পোশাক পরে বের হলাম। আস্তে আস্তে বের হয়ে মানুষের ভীড়ে হারিয়ে গেলাম। কিন্তু পূর্বানী হোটেলে গিয়ে আর ভেতরে ঢুকতে পারছিলাম না। কারণ, সেদিন সেখানে বঙ্গবন্ধুর একটা সভা ছিল। দেশী-বিদেশি সংবাদিকে ভরা হোটেল। আমি হোটেলের পেছন দিক দিয়ে ঢুকলাম। সিঁড়ি দিয়ে সাত তলায় গেলাম।

৪ মার্চ পাকিস্তানের অন্য খেলোয়াড়রা ফিরে গেল। কেউ গেল লাহোরে, কেউ গেল করাচি। সবাই তাদের শহরে চলে গেল। আমি ৬ মার্চ হোটেল ছাড়লাম। আমার পরিবার তখন গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। আমি গেলাম ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে কোয়ার্টারে আমার খালুর বাড়িতে।

আসলে ব্যাটে স্টিকার লাগানোর কাজটা করেছিলাম একটা চেতনার জায়গা থেকে। বাঙালিত্ব চেতনা থেকে। এর জন্য আমার নামে পরোয়ানা জারি হয়েছিল। আমাকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করা হয়েছিল। আমার বাড়ি লুট হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে দেখা মাত্র গুলির নির্দেশ জারি করা হয়েছিল।

এটা আমি পরে জানি। ২৭ মার্চ শহীদ মুশতাককে যখন গুলি করা হয়েছিল,তখন আমি পুরান ঢাকা থেকে তাকে দেখতে গিয়ে এটা শুনি। আমাকে হাতে ধরে ক্রিকেট শেখানো মুশতাককে কবরস্থ করে ফেরার সময় ফুটবলার দীপু ভাই আমাকে বললেন, তুমি এখনও শহরে? ভাগো। উনি বলেছিলেন, তোমাকে তো মেরে ফেলবে। আমি বললাম কেন? উনি বললেন, তুমি ব্যাটে স্টিকার লাগিয়েছিলা বলে তোমাকে মেরে ফেলার নির্দেশ জারি হয়েছে।

আমি দীপু ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি এই খবর কোথায় পেয়েছেন? উনি বললেন, 'পাকিস্তানের ফুটবলার ক্যাপ্টেন ইউনুস আমাকে খবর দিছে যে ওর ব্যাটালিয়ান পাকিস্তান থেকে মুভ করছে।'
দীপু ভাই মারা গেছেন। কিন্তু উনি আর ইউনুস আমাকে অনেক বড় উপকার করেছে। এরা জানানোর পরই আমি ঢাকা থেকে পালালাম। আসলে বেঁচে গেলাম।

দুঃখ যে, সেই ব্যাটটা এখন আর নেই আমার কাছে। তবে ওই ছবি এখনও আছে আর্কাইভে।

অনুলিখন: রুবেল আবিদ