কেন পাকিস্তানিরা ধর্ষণ করেছিল

আরিফ রহমান
Published : 25 March 2016, 06:02 PM
Updated : 25 March 2016, 06:02 PM

"পৃথিবীর সমস্ত যুদ্ধেই ধর্ষণ হয়, আমাদের যুদ্ধেও হয়েছে এটা স্বাভাবিক, না হওয়াটাই অস্বাভাবিক।"

মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণ সম্পর্কে অনেক বাঙালি এমন ধারণা করে থাকেন। কথা সত্য, যুদ্ধ মাত্রই ধর্ষণ, সম্ভবত পৃথিবীতে বড় পরিসরে ঘটে যাওয়া এমন একটি যুদ্ধও পাওয়া যাবে না যেখানে কোনো ধর্ষণ হয়নি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও প্রচুর ধর্ষণ হয়েছে। অনেক নিরপেক্ষ গবেষকের মতে, ধর্ষণেরই প্রকৃত সংখ্যা হতে পারে এমনকি ছয় লক্ষেরও বেশি। সংখ্যাটা অনেকের কাছে অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। বিরানব্বই হাজার পাকিস্তানি সৈনিক এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে এত বিরাট অঙ্কের ধর্ষণ হতে হলে প্রত্যেককেই একাধিক ধর্ষণে লিপ্ত হতে হয়। কেন একটি যুদ্ধকালীন সময়ে থাকা বেশিরভাগ সৈনিকই ধর্ষণ করেছিল সেটাও একটা জিজ্ঞাসা।

বর্তমানে চলমান কিংবা অতীতের যুদ্ধগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষণ হয়ে থাকে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু বিকৃতমনা সৈনিকের লালসা থেকে। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে নিঃশেষ করে দেওয়া কিংবা তাদের জেনেটিকসে পরিবর্তন ঘটানোর জন্য যে হত্যা আর ধর্ষণ পরিচালিত হয়, সেটা নিছক যৌন-লালসা মেটানোর জন্য হয়ে থাকে না। এ ধরনের ধর্ষণকে বলা হয় 'জেনোসাইডাল রেপ'।

আজ আমরা শুধু আলোচনা করে দেখব পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আদৌ ধর্ষণ করেছিল কি না? করলে কেন করেছিল? খুঁজে বের করার চেষ্টা করব ঘটনাগুলোর পেছনের কারণ।

এ বিষয়ে আমাদের কাজ সহজ করে দিয়েছেন একজন মানুষ, তাঁর নাম শর্মিলা বসু। যিনি একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সিনিয়র গবেষণা সহযোগী। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের ওপর বড় পরিসরে লেখা তাঁর বই 'ডেড রেকনিং: ১৯৭১এর বাংলাদেশ যুদ্ধের স্মৃতি' দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচনার রসদ যুগিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্মরণকালের সবচেয়ে বিতর্কিত বই হিসেবে এটি আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।

এছাড়া Economic and Political Weeklyএর ২০০৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বরের সংখ্যায় Losing the Victims: Problems of Using Women as Weapons in Recounting the Bangladesh War শীর্ষক প্রবন্ধেও একাত্তরে সংগঠিত যুদ্ধে নারীদের ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি উঠে এসেছে। আজকের নিবন্ধে তাই এই নিবন্ধের কিছু অংশ নিয়েই সংক্ষেপে আলোচনা করা হবে।

এছাড়াও শর্মিলা বোস তাঁর লেখা Anatomy of Violence: Analysis of Civil War in East Pakistan in 1971 (EPW, Oct 8, 2005) নিবন্ধটির প্রথম সংস্করণ ২০০৫ সালের ২৮-২৯ জুন যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতরের ইতিহাস বিভাগ আয়োজিত দুই দিনের এক সম্মেলনে উপস্থাপন করেন। সম্মেলনের শিরোনাম ছিল, 'সংকটে দক্ষিণ এশিয়া: যুক্তরাষ্ট্রের নীতি, ১৯৬১-১৯৭২'।

নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করলে যুদ্ধ নিয়ে বিজয়ী অংশের একটা গল্প থাকে, পরাজিতদেরও থাকে। স্বাভাবিকভাবেই দুটো গল্পে পরস্পরকে দোষারোপ করা হয়। দুটো গল্পেই থাকতে পারে অনেক ভুল তথ্য, মিথ্যাচার। কিন্তু অনেক অনেক বছর পর যখন ইতিহাস লেখা হয় তখন সব গল্পের জট খুলে সত্যটা বের হয়ে আসে। এটাই স্বাভাবিক।

প্রশ্ন হতে পারে, কেন এই প্রবন্ধে শর্মিলা বসুকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, অন্য কেউ নয় কেন? অনেকেই তো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন।

উত্তরটা অতি সহজ। ওয়াশিংটনের একটি কনফারেন্সে শর্মিলা বোসের নিবন্ধ উত্থাপিত হবার পরপরই পাকিস্তানি পত্রপত্রিকায় আবার মুক্তিযুদ্ধের ইস্যু নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়। ত্বরিত এ বিষয়ে লেখা ছাপা হয় 'দ্য ডেইলি টাইমস' (হাসান, জুন ৩০, ২০০৫; সম্পাদকীয় জুলাই ২, ২০০৫) এবং 'ডন' (ইকবাল, জুলাই ৭, ২০০৫)এর মতো প্রভাবশালী পত্রিকায়। দুটো পত্রিকাই বোসের বরাত দিয়ে উল্লেখ করে, বাংলাদেশের যুদ্ধে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে পাকিস্তানি জেনারেলদের অনেকেই লিখেছেন। যারা পড়েছেন তারা জানেন এসব বইয়ের প্রায় সবটাই মিথ্যাচারে ভরপুর। এদিকে বাংলাদেশেও অনেক গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে নির্মোহভাবে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য-উপাত্ত যাচাই করতে আমাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে আন্তর্জাতিক মিডিয়া। পাকিস্তানি বাহিনীর রক্তচক্ষুর ভেতর দিয়েও মুক্তিযুদ্ধ আর গণহত্যার সমস্ত খবর বিশ্বময় পৌঁছে যায় এসব পত্রিকার মাধ্যমে। পৃথিবীর বড় অংশ জানতে পারে পাকিস্তানিদের নির্মমতার কথা। সারা পৃথিবীর জনমত চলে আসে বাঙালিদের পক্ষে।

ওইসব খবর সরবরাহ করেন যে সাংবাদিক ও বিদেশি পর্যবেক্ষকরা, তারা ঘটনাগুলো নিরপেক্ষ ও নির্মোহভাবেই লিখেছেন। ওইসব টেলিভিশন আর সংবাদপত্রের প্রচারণার কারণেই মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী ও পাকিস্তানিদের নির্মমতা পৃথিবীর মানুষের কাছে পরিষ্কার। বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ঘৃণা করে।

অন্যদিকে, পাকিস্তান তাদের পক্ষে কোনো গ্রহণযোগ্য ইতিহাস দাঁড় করাতে পারেনি। যদিও পাকিস্তানের স্কুল-কলেজের বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক তারা নিয়মিত মিথ্যাচার ও

বাংলাদেশিদের প্রতি বিদ্বেষে পরিপূর্ণ করে রেখেছে। কিন্তু বাংলাদেশের পাঠ্যবইয়ে নিয়মমাফিক পাকবাহিনীর নির্মমতার কথাই বলা হয়; কখনও বিনা কারণে পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকদের প্রতি হিংসার বাণী নেই।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তানি জেনারেলদের লেখা বইগুলো খাপছাড়া। এসব বইয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার সঙ্গে সঙ্গে স্বগোত্রীয়দের বিরোধিতা করেছেন। সেনাবাহিনী পরাজয়ের জন্য দায়ী করেছেন রাজনীতিবিদদের। আবার রাজনীতিবিদরা দায়ী করেছেন সেনাবাহিনীকে। যুদ্ধকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এক জেনারেল আরেক জেনারেলকে দায়ী করে লিখেছেন প্রচুর।

'

তাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এমন কোনো বইয়ের গ্রন্থনা করতে পারেনি যেখানে সমস্ত খুন-ধর্ষণ-গণহত্যা-লুটপাটের দায়মুক্তি পেতে পারত। এককভাবে বাঙালিদের দায়ী করে কোনো বই তারা লিখতে পারেনি। তাদের এই শূন্যতা পূরণ করেছেন শর্মিলা বসু, তাঁর 'ডেড রেকনিং: ১৯৭১এর বাংলাদেশ যুদ্ধের স্মৃতি' নামের বইটি এবং অন্যান্য গবেষণা নিবন্ধের মাধ্যমে।

গুরুতর কিছু অভিযোগ:

শর্মিলা বসুর Losing the Victims: Problems of Using Women as Weapons in Recounting the Bangladesh War প্রবন্ধে মুক্তিযুদ্ধে নারী নির্যাতন নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক:

১.

বোস লিখেছেন:

"মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর বলছে, 'পঁচিশে মার্চ থেকে ষোলই ডিসেম্বরের মধ্যে তিরিশ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে, দুই লক্ষ নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং এক কোটিকে হতে হয়েছে শরণার্থী। এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঘটে যাওয়া সবচেয়ে জঘন্য গণহত্যা। মাত্র ৩৪,০০০ সদস্যের একটি সেনাবাহিনীর পক্ষে আট থেকে নয় মাসের মধ্যে এই মাত্রায় ধর্ষণ করতে হলে প্রত্যেককে ধর্ষণে লিপ্ত হতে হবে এবং প্রত্যেককে অবিশ্বাস্য সংখ্যক ধর্ষণ করতে হবে।"

[Losing the Victims: Problems of Using Women as Weapons in Recounting the Bangladesh War. P-3865]

২.

শর্মিলা জেনারেল নিয়াজীর যুদ্ধাবস্থায় (১৫ এপ্রিল, ১৯৭১) দেওয়া এক নির্দেশনার বরাত দিয়ে বলেছেন:

"যুদ্ধে কিছু ধর্ষণ হতেই পারে, তবে আমি আশা করব আমার সৈনিকেরা সব ধরনের লুট, ডাকাতি এবং অসৎ আচরণ থেকে বিরত থাকবে। যদি এ ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"

[Losing the Victims: Problems of Using Women as Weapons in Recounting the Bangladesh War. P-3866]

৩.

শর্মিলা লিখেছেন:

"বাংলাদেশে পাকিস্তানি হত্যাকাণ্ডের চাক্ষুষ সাক্ষীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে আমি জানতে পেরেছি, পাকবাহিনী সব সময় পুরুষদের টার্গেট করত। মহিলাদের সব সময় আলাদা করে ছেড়ে দেওয়া হত। কয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়তো ঘটতে পারে, তবে এত বড় স্কেলে ধর্ষণ অসম্ভব। হত্যাকাণ্ডের সময় কখনও নারীদের হত্যা করা হয়নি। কয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে থাকলে সে সব ছিল ক্রস ফায়ার।''

[Losing the Victims: Problems of Using Women as Weapons in Recounting the Bangladesh War. P-3866]

৪.

শর্মিলা লিখেছেন:

"আমার কাছে যে তথ্য-প্রমাণ আছে সেটা থেকে বলতে পারি, একাত্তরে কিছু ধর্ষণ হয়েছে, কিন্তু সংখ্যাটা কখনওই হাজার হাজার কিংবা লক্ষ লক্ষ নয়। ধর্ষিতাদের মধ্যে ছিল হিন্দু এবং মুসলিম, বাঙালি, বিহারি এবং পশ্চিম পাকিস্তানি। আর ধর্ষণ করেছিল বাঙালিরা, বিহারিরা, পশ্চিম পাকিস্তানিরা এবং আর্মি অফিসাররা। অনেক অবাঙালিদের ধর্ষণের পর হত্যা করে বাঙালিরা।''

[Losing the Victims: Problems of Using Women as Weapons in Recounting the Bangladesh War. P-3870]

৫.

শর্মিলা লিখেছেন:

"তখনকার কিছু জুনিয়র অফিসারের সঙ্গে কথা বলে আমি জেনেছি যে, কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এবং তাদের শাস্তিও দেওয়া হয়েছে আর্মিদের বিধান অনুযায়ী। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের জেলও হয়েছে। কিছু বিচ্ছিন্ন ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও এত বড় স্কেলে ধর্ষণ কখনওই ঘটেনি।"

[Losing the Victims: Problems of Using Women as Weapons in Recounting the Bangladesh War. P-3866]

প্রবন্ধজুড়ে শর্মিলা বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন কয়েকটি পয়েন্ট:

১. পাকসেনাদের দ্বারা ধর্ষণ একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা;

২. ধর্ষণ হয়েছে, কিন্তু সংখ্যা খুবই কম;

৩. পাকিস্তানিদের পাশাপাশি অনেক বাঙালিও ধর্ষণ করেছিল;

৪. অনেক বাঙালি নারী সেনাবাহিনীকে মনোরঞ্জন করতে সম্মত ছিল।

আসুন দেখা যাক, পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘটিত ধর্ষণ কি নিতান্তই বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল, না কি তাদের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিল।

ঈমানি দায়িত্ব:

স্বাধীনতার পর ধর্ষিতা বাঙালি নারীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত অস্ট্রেলীয় ডাক্তার জেফ্রি ডেভিস গণধর্ষণের ভয়াবহ মাত্রা দেখে হতবাক হয়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে আটক পাক অফিসারকে এ মর্মে জেরা করেছিলেন যে, তারা কীভাবে এমন ঘৃণ্য কাজ করতে পারল। অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক বিচলিত হলেও পাক অফিসারদের সাচ্চা ধার্মিক হৃদয়ে এ কথায় কোনো রেখাপাত ঘটেনি। তাদের সোজা জবাব ছিল এ রকম:

"আমাদের কাছে টিক্কা খানের নির্দেশনা ছিল যে, একজন ভালো মুসলমান কখনওই তার বাবার সঙ্গে যুদ্ধ করবে না। তাই আমাদের যত বেশি সম্ভব বাঙালি মেয়েকে গর্ভবতী করে যেতে হবে।''

[We had orders from Tikka Khan to the effect that a good Muslim will fight anybody except his father. So what we had to do was to impregnate as many Bengali women as we could.]

ধর্ষণকারী এক পাকিস্তানি মেজর তার বন্ধুকে চিঠি লিখেছে:

"আমাদের এসব উচ্ছৃঙ্খল মেয়েদের পরিবর্তন করতে হবে যাতে এদের পরবর্তী প্রজন্মে পরিবর্তন আসে, তারা যেন হয়ে ওঠে ভালো মুসলিম এবং ভালো পাকিস্তানি।''

[We must tame the Bengali tigress and change the next generation Change to better Muslims and Pakistanis.]

উপরের ঘটনা দুটো প্রচণ্ড তাৎপর্যপূর্ণ। এটা শুধুমাত্র নিম্নপদস্থ সৈনিকদের মানসিকতার প্রতিনিধিত্ব করছে। আর উচ্চপদস্থ অফিসারদের অবস্থা ছিল আরও ভয়াবহ।

একাত্তরের সেপ্টেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানের সকল ডিভিশান কমান্ডারের কনফারেন্সে এক অফিসার পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক বাঙালি নারীদের ধর্ষণের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। নিয়াজী তখন সেই অফিসারকে বলেন:

"আমরা যুদ্ধের মধ্যে আছি। যুদ্ধক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা স্বাভাবিক বলে ধরে নিও।''

তারপর তিনি হেসে বলেন:

"ভালোই তো, এসব বাঙালি রক্তে পাঞ্জাবি রক্ত মিশিয়ে তাদের জাত উন্নত করে দাও।''

ধর্ষণের পক্ষে তিনি যুক্তি দিয়ে বলতেন:

"আপনারা কীভাবে আশা করেন একজন সৈন্য থাকবে, যুদ্ধ করবে, মারা যাবে পূর্ব পাকিস্তানে এবং যৌনক্ষুধা মেটাতে যাবে ঝিলমে?''

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার আবদুল রহমান সিদ্দিকী তার East Pakistan The End Game বইতে আরও লেখেন:

"নিয়াজী জওয়ানদের অসৈনিকসুলভ, অনৈতিক এবং কামাসক্তিমূলক কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করতেন।''

"'গত রাতে তোমার অর্জন কি শেরা (বাঘ)?' চোখে শয়তানের দীপ্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করতেন তিনি। অর্জন বলতে তিনি ধর্ষণকে বোঝাতেন।''

পাকিস্তানি জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা 'আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ঔন কান্ট্রি' বইতে লিখেছেন:

"নিয়াজী ধর্ষণে তার সেনাদের এতই চাপ দিতেন যে তা সামলে উঠতে না পেরে এক বাঙালি সেনা অফিসার নিজে আত্মহত্যা করতে বসেন।''

"বেগ সাহেবের জন্য ভালো মাল পাঠাবেন। রোজ অন্তত একটা।''

মাল বলতে এখানে বাঙালি মেয়েদের কথা বলা হয়েছে। শর্মিলা বসু বারবার বলেছেন, পরিকল্পিত ধর্ষণ হয়নি, যা হয়েছে তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বীভৎস নির্যাতনের ব্যাপারটি সতর্কভাবে এড়িয়ে গেছেন তিনি। একে কি তাঁর opportunistic rape মনে হয়? পাকিস্তানি হেরেম থেকে চার হাজার বাঙালি মেয়েকে পাওয়া নিশ্চয়ই বিচ্ছিন্ন ঘটনা শর্মিলা বসুর কাছে। সিলেটের শালুটিকরে পাকিস্তানি ক্যাম্পের দেয়ালে ঐ নরপশুদের আঁকা কয়েকটি ছবির দিকে দৃষ্টিপাত করছি। এর থেকে বড় প্রমাণ বোধহয় আর হয় না।

এবারে দৃষ্টিপাত করি আরও কিছু ঘটনার দিকে, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গবেষণা গ্রন্থ 'যুদ্ধ ও নারী'তে উঠে আসে অনেক তথ্য যা পাঠকদের নিঃসন্দেহে আগ্রহ জোগাবে।

"যুদ্ধ শেষে ক্যাম্প থেকে কয়েকটি কাঁচের জার উদ্ধার করা হয়, যার মধ্যে ফরমালিনে সংরক্ষিত ছিল মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন অংশ। অংশগুলো কাটা হয়ে ছিল খুব নিখুঁতভাবে।''

[ডা. বিকাশ চক্রবর্তী, খুলনা]

"আমাদের সংস্থায় আসা ধর্ষিত নারীদের প্রায় সবারই ছিল ক্ষত-বিক্ষত যৌনাঙ্গ। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ছিঁড়ে ফেলা রক্তাক্ত যোনিপথ, দাঁত দিয়ে ছিড়ে ফেলা স্তন, বেয়োনেট দিয়ে কেটে ফেলা স্তন-উরু এবং পশ্চাৎদেশে ছুরির আঘাত নিয়ে নারীরা পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসত।''

[মালেকা খান, যুদ্ধের পর পুনর্বাসন সংস্থায় ধর্ষিতাদের নিবন্ধীকরণে যুক্ত সমাজকর্মী]

"কোনো কোনো মেয়েকে পাকসেনারা এক রাতে ৮০ বারও ধর্ষণ করেছে।''

[সুসান ব্রাউনি মিলার (অ্যাগেইনেস্ট আওয়ার উইল: ম্যান, উইম্যান অ্যান্ড রেপ; ৮৩]

এই সব খণ্ড খণ্ড জবানবন্দি এই কথাই প্রমাণ করে যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণ সাধারণ কোনো যুদ্ধের ধর্ষণ নয়। এটা পাকবাহিনী শুধু আনন্দের জন্য করেনি, তারা এটা করেছে দায়িত্ববোধ থেকে। শুধু আনন্দের জন্য এত বীভৎসতা, এত বার ধর্ষণ করতে হয় না। খুলনার ক্যাম্প থেকে কাচের জারে ফরমালিনে সংরক্ষিত নারীশরীরের অংশ উদ্ধার আর সিলেটের দেয়ালে সদম্ভে এঁকে রাখা কৃতকর্মের ছবি দেখে বুঝে নিতে হয় যে, এই ধর্ষণ দু-একজন সামরিক কর্মকর্তার বিচ্ছিন্ন মনোরঞ্জনের ঘটনা নয়। তারা এসব করেছিল এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে।

সেই এজেন্ডার কথা কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক তাঁর কালজয়ী উপন্যাস 'নিষিদ্ধ লোবান'এ তুলে ধরেছেন বাস্তবসম্মতভাবে:

"আমি তোমায় সন্তান দিতে পারব। উত্তম বীজ উত্তম ফসল। তোমার সন্তান খাঁটি মুসলমান হবে, খোদার ওপর ঈমান রাখবে, আন্তরিক পাকিস্তানি হবে, চাও না সেই সন্তান? আমরা সেই সন্তান তোমাদের দেব, তোমাকে দেব, তোমার বোনকে দেব, তোমার মাকে দেব, যারা হিন্দু নয়, বিশ্বাসঘাতক নয়, অবাধ্য নয়, আন্দোলন করে না, শ্লোগান দেয় না, কমিউনিস্ট হয় না। জাতির এই খেদমত আমরা করতে এসেছি।''

''তোমাদের রক্ত শুদ্ধ করে দিয়ে যাব, তোমাদের গর্ভে খাঁটি পাকিস্তানি রেখে যাব, ইসলামের নিশানা উড়িয়ে যাব। তোমরা কৃতজ্ঞ থাকবে, তোমরা আমাদের পথের দিকে তাকিয়ে থাকবে, তোমরা আমাদের সুললিত গান শোনাবে।''

জাতিগত শোধন বা এথনিক ক্লিনজিংএর এই অপচেষ্টার বিষয়টি অস্বীকার বা একে ভিন্ন খাতে নেবার চেষ্টা করে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো গণহত্যার ভয়াবহতা হালকা করার কোনো উপায় নেই।

সূত্র:

১. bn.wikipedia.org/wiki/বাংলাদেশের_স্বাধীনতা_যুদ্ধ#cite_note-MathewWhite-8

২. 2. bn.wikipedia.org/wiki/শর্মিলা_বসু#cite_note-DailyStarThoughts-11

৩. archive.thedailystar.net/forum/2006/december/skewing.htm

৪. sachalayatan.com/tanveer/17731

৫. opinion.bdnews24.com/2010/12/15/1971-rape-and-its-consequences/

৬. opinion.bdnews24.com/2010/12/01/rape-in-1971-in-the-name-of-pakistan/

৭. ব্রিগেডিয়ার আবদুল রহমান সিদ্দিকী: East Pakistan: The End Game

৮. জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা: আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ঔন কান্ট্রি

৯. যুদ্ধ ও নারী: ড. এম এ হাসান

১০. বীরাঙ্গনা ১৯৭১; ড. মুনতাসীর মামুন

১১. ডাক্তার ডেভিসের ডায়েরি: দ্য চেঞ্জিং ফেইস অব জেনোসাইড (অনুবাদ: অমি রহমান পিয়াল)

১২. নিষিদ্ধ লোবান: সৈয়দ শামসুল হক

১৩. মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর

১৪. মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট

১৫. International Crimes Strategy Forum

১৬. cbgr1971.org/