দেখেছ, আমি গরিব, আমার কোনো পয়সা নেই

কাজী ফারহানা জাবীন
Published : 16 Dec 2021, 00:43 AM
Updated : 25 March 2016, 06:15 PM

বুম… বুম… বুম!

কামানের গোলার শব্দ!

আমি ভেবেছিলাম যুদ্ধ শেষ। তাহলে বাইরে কী হচ্ছে?

আমি দৌড়ে আমার আর ভাইয়ার রুম থেকে বেরিয়ে আম্মার কাছে গেলাম।

"কী হচ্ছে, আম্মা? যুদ্ধ না শেষ? আব্বু কই?"

"এটা টোয়েন্টি-ওয়ান গান স্যালিউট।"

"মানে?"

"এটা তোমার জন্মদিনের জন্য।"

১৯৭২ সালের ছাব্বিশে মার্চ, আমার জন্মদিন! এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না। ছয় বছর বয়স হল আমার।

আমি সারা বাড়ি আব্বুকে খুঁজলাম। সকালে উঠে সবার আগে সেদিন আমি তাঁরই মুখ দেখতে চেয়েছিলাম। তিনি আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।

আমি তাঁকে কোথাও পেলাম না। অবশেষে আম্মা আমাকে বললেন, আব্বু নাকি আমার জন্য একটি প্যারেড আয়োজন করতে গেছেন, ঠিক যে রকম কথা শিশুদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলা হয়।

প্রকৃত ঘটনা ছিল, আমার বাবা ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্যারেড কমান্ডার।

১৯৭২ সালের মার্চে তিনি ছিলেন কর্নেল সফিউল্লাহ, যুদ্ধকালীন 'এস' ফোর্সের কমান্ডার, যা পরে ৪৬ ব্রিগেড হয়। পরে ১৯৭২ সালের পাঁচই এপ্রিল তিনি বাংলাদেশের সেনাপ্রধান হন।

ঢাকা পুরাতন বিমানবন্দরে বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবসের প্যারেড আয়োজনে ব্যস্ততার কারণে তিনি আসলে আমার জন্মদিন প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। অন্তত সেটাই আমার সেদিন মনে হয়েছিল।

পুরো পরিবার কুচকাওয়াজে গিয়েছিল। আমি তখনও ভাবছিলাম, এর সব কিছুই আমার জন্য করা হচ্ছিল। কারণ সেদিন তো শুধু আমার জন্মদিন।

যা-ই হোক, আমরা প্যারেড গ্রাউন্ডে গেলাম। সব কিছু সাজানো-গোছানো। আমার জন্মদিনের আয়োজন সম্পন্ন। আব্বুর স্যালুট নেওয়ার জন্য আমি প্রস্তুত।

আমি আম্মা ও ভাইয়ার সঙ্গে সামনের সারিতে বসেছিলাম, ঠিক ছোট একটি মঞ্চের পিছনে। মঞ্চ কেন করা হয়েছিল সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না। তবে মনে মনে চেয়েছিলাম, ওইটা আমার জন্যই করা হয়েছে। ভুলে যাবেন না, ওই দিন ছিল আমার জন্মদিন!

কিন্তু কুচকাওয়াজ শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে গেল। কিছু মানুষ মঞ্চে উঠে গেল; তাদের দেখে মনে হল যেন ওটা তাদেরই জায়গা, আমার নয়!

কিছুক্ষণের মধ্যে কুচকাওয়াজ শুরু হল, আমার আব্বু, আমার কাছে সবচেয়ে হ্যান্ডসাম মানুষ, সেনা ইউনিফর্মে 'মার্চ পাস্ট' করে যাচ্ছিলেন।

বিষয়টি আমাকে এতটাই আন্দোলিত করেছিল যে, ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছিলাম না। ওই দিনটা ছিল আমার এবং সব ঐশ্বর্য নিয়ে বাবা আমার সামনে হাজির হলেন, বেল্ট-বাকল ও পদকগুলো জ্বলজ্বল করছিল। সবার সামনে আব্বু ডান দিকে মাথা বাঁকিয়ে স্যালিউট দিল! সব কিছু আমার জন্য!

তবে আমি সালামটি গ্রহণের ঠিক আগেই মঞ্চের একজন তা করে ফেললেন। আমি এটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কেউ একজন আমার দিনটাই মাটি করে দিলেন।

পরে অনুষ্ঠানের পুরোটা সময় আম্মার পাশে আমি চুপ করে বসে ছিলাম। তখন সময় কাটানো ছিল আমার জন্য খুবই কঠিন, আব্বুর ফিরে আসা এবং তাঁর কাছে এমনটা কেন ঘটল তা জানার অপেক্ষায় ছিলাম।

আব্বু এলেন। তাঁর সঙ্গে সেই মানুষটিও এলেন, যিনি আব্বুর সেই সালাম গ্রহণ করেছিলেন, যেটা আমি ভেবেছিলাম আমার জন্য।

লম্বা শক্তিশালী একজন মানুষ, যাঁর ভরাট, জোরালো কণ্ঠস্বর। তাঁর হাসি যেন একেবারে ভেতর থেকে আসছিল।

হাসতে হাসতে তিনি আম্মার সঙ্গে কথা বলছিলেন।

আমি এটা আর মেনে নিতে পারছিলাম না। আমার এটা জানতেই হবে তাঁর কাছ থেকে, কেন তিনি এটা করলেন।

আমি সরাসরি 'বড়দের' দিকে হেঁটে গেলাম এবং বললাম, "আমি রীমা এবং আজ আমার জন্মদিন। আব্বু যে স্যালিউট দিল সেটা তো আমার জন্য ছিল, তাইলে তুমি কেন নিলা? তোমার কোটের কোনো হাতা নেই কেন? আমার আব্বুর সব স্যুটে তো হাতা আছে!"

তিনি খুব গুরুত্ব দিয়ে আমার দিকে তাকালেন, তাঁর হাত দুটো 'মুজিব কোটের' পকেটে ঢুকিয়ে মুঠো বের করে এনে দেখালেন তাঁর খালি হাত। বললেন, "দেখছ, আমি গরিব। আমার কোনো পয়সা নেই। সে জন্য আমার কোটের কোনো হাতা নেই।"

২৬ মার্চ, ২০১৬। আবার আমার জন্মদিন। পঞ্চাশ বছর হল আমার।

আমি এখন যা জানি তখন (১৯৭২) যদি তা জানতাম তাহলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রথম দেখার মুহূর্ত অন্য কোনোভাবে ধারণ করে রাখতে পারতাম।