হারানো বাংলাকে কি খুঁজে পাব আমার

আবেদ খান
Published : 25 March 2016, 06:15 PM
Updated : 25 March 2016, 06:15 PM

দেখতে দেখতে তো পেরিয়ে গেল পঁয়তাল্লিশটি বছর। একাত্তর। উনিশ শ' একাত্তর। সেদিন আমি ছিলাম ছাব্বিশ বছরের দুরন্ত যুবক। ছিলাম সুকান্তের সেই কবিতার মতো 'বিপ্লব স্পন্দিত বুকে, মনে হয় আমিই লেনিন'। তখন আমার কাছে জেল-টিয়ার গ্যাস-গুলি– সব খুব তুচ্ছ ছিল। মিছিল আর পোস্টারে, লিফলেট আর শ্লোগানে পরিপূর্ণ ছিল আমার উদ্ধত বর্ণিল জীবন।

সেই একাত্তরের মতো এখন আমিও একাত্তর। মাঝখান থেকে পেরিয়ে গেছে পয়তাল্লিশটি বছর। সেই রবীন্দ্রনাথের কবিতার পংক্তির মতো:

"কতদিন কেটে গেছে আহা কত কাল

তবু যেন মনে হয় সেদিন সকাল।"

আমরা যারা একাত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলোর ভেতর দিয়ে গেছি; অগ্নিবলয়ের মধ্যে অবরুদ্ধ জীবনের নাগপাশে আবদ্ধ থেকে ছটফট করেছি; ট্যাংকের ঘর্ঘর শব্দ, দাঁতাল শুয়োরের মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে ছুটে বেড়ানো জলপাইরঙা জিপগুলোর টায়ারের কর্কশ শব্দ আর রাইফেল, শটগান, মেশিনগান, কামান-মর্টারের ক্রুদ্ধ গর্জনের ভেতর দিয়ে গেছি; পোড়া বিধ্বস্ত হাট-বাজার, জনপদ আর অঙ্গার হওয়া বাংলার জলাভূমি-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গেছি; রক্তাক্ত লাশ আর বারুদের স্তূপ পেরিয়েছি কতবার, দীর্ঘ নয়টি মাস– আমরা, একাত্তরের সেই মানুষগুলো—যুদ্ধ-করা মানুষগুলো — হার না-মানা মানুষগুলো– এই পঁয়তাল্লিশ বছর পর এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছি আমাদের সেই রক্তমাখা স্বপ্নঝরা একাত্তরকে।

এখন সময়ের সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে আমাদের ক্লান্ত পা শরীরটাকে টেনে তুলতে যখন অস্বীকার করে, তখন আবার চোখের সামনে ফুটে ওঠে সেই সব পুরনো ছবি। আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে ভাঙা ঘর, পোড়া কাঠ, বিরান লোকালয়, উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলা ঘরছুট মানুষের স্রোত।

–দুই–

মনে পড়ে–রাতের বেলায় ইত্তেফাকের বার্তাকক্ষে খবর এল। উপকূলের সংবাদদাতার ক্ষীণ কন্ঠে উচ্চারিত আতঙ্ক। খালি লাশ আর লাশ। সাগরের নোনা পানিতে ফুলে-ফেঁপে ভারী করছে বাতাস। গরু-মহিষ-মানুষ সব একাকার। কক্সবাজারের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ইত্তেফাকের ফটোগ্রাফার বড়ুয়া বিপন্ন কন্ঠে বলল, 'লাশ গুনতে গুনতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি আমি। কী ছবি পাঠাব? কী খবর পাঠাব?'

আমাদের অফিসের বার্তা সম্পাদক আর নির্বাহী সম্পাদক, রেজা ভাই আর সিরাজ ভাই জিজ্ঞেস করলেন, 'কত লাশ হবে? ঝড় হয়েছে, জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। ঘর-বাড়ি, গাছপালা তো কিছু এলোমেলো হবেই। আর মানুষ-গরু-ছাগলও বানের পানিতে ভেসে যাবে, এ-ও স্বাভাবিক। কিন্তু বডুয়া যেভাবে বলছে তেমনটি কি হতে পারে? হওয়া সম্ভব?'

ডেস্কের সাব এডিটর হিসেবে আমাকে টেলিফোনে সংবাদটি নিতে হল এবং রিপোর্ট লিখতে হল। আমাকে সতর্ক করে দেওয়া হল, যেন এমন কোনো অবিশ্বাস্য মৃত্যুর সংবাদ বা বিপর্যয়ের কাহিনি না লিখি যা মানুষের কাছে আতঙ্ককর হয়ে উঠবে। আমাদের পরিবেশিত সংবাদ যেন ভুল বার্তা না দেয়। কারণ সামরিক জান্তা সুযোগ বুঝে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন ভণ্ডুল করে দিতে পারে। ইত্তেফাক আওয়ামী লীগের মুখপাত্র। কাজেই ইত্তেফাকে যদি এমন কোনো ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয় উপকুল অঞ্চলের, তাহলে ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা তার পুরো সুযোগ নিতে পারে।

সাধারণ নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ প্রায়। উগ্র বাম রাজনীতিকরা নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য 'ভোটের আগে ভাত চাই' শ্লোগান দিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে। দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোও আওয়ামী লীগের নির্বাচন প্রস্তুতিতে শঙ্কিত। ঠিক এই সময় এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় অনেককেই ভাবিয়ে তুলছিল।

ইত্তেফাক সাবধানতা অবলম্বন করলেও তদানীন্তন দৈনিক পাকিস্তান ব্যানার হেডিং করে উপকূল অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও লক্ষ লক্ষ মানুষের নিহত হওয়ার সংবাদ এবং পরবর্তী পর্যায়ে আলোকচিত্র প্রকাশ করে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ নির্বাচন প্রস্তুতি সাময়িক স্থগিতের ঘোষণা দিয়ে ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতার নেমে পড়েন। প্রাকৃতিক বিপর্যয় আওয়ামী লীগের জন্য প্রতিকূল পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটালেও আওয়ামী লীগের দূরদর্শী ও প্রজ্ঞাবান নেতৃত্ব শতাব্দীর অন্যতম প্রাকৃতিক বিপর্যয়কেও নির্বাচনী হাতিয়ারে পরিণত করতে সক্ষম হল। কাজেই ইয়াহিয়া সামরিক জান্তার নির্বাচনকেন্দ্রিক ষড়যন্ত্রও কার্যকর হতে পারল না।

বঙ্গবন্ধু যথাসময়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্ততি গ্রহণ করলেন। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল এবং দেশের রাজনীতির ইতিহাস নতুনভাবে রচিত হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গেল। বলা যায়, এই নির্বাচনের ফলাফলের মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজের অঙ্কুরোদগম ঘটল। একাত্তরের স্বাধীনতার লড়াইএর এ এক আলাদা দৃশ্যপট।

–তিন—

একজন কর্মরত সাংবাদিক হিসেবে এবং একই সঙ্গে একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে মার্চ মাসের প্রথম দিন থেকে শুরু করে মার্চ মাসের প্রতিটি দিন এখনও পর্যন্ত আমার স্মৃতিতে অতিশয় জীবন্ত। ৭ মার্চের গণপ্লাবন, বিশ্বের কয়েক হাজার বছরের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাকাব্যিক ভাষণ থেকে শুরু করে ২৫ মার্চের নৃশংস গণহত্যা, স্বাধীনতার ঘোষণা, বাঙালির প্রতিরোধ লড়াই সব কিছুর প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী হিসেবে যা কিছুর ভেতর দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে তা আমার পেশাগত এবং রাজনৈতিক জীবনের অনুপম সঞ্চয়।

২৫ মার্চের অগ্নিবলয়ে ইত্তেফাক ভবনে বারংবার গুলিবর্ষণ, খুলি উড়ে যাওয়া ক্যান্টিন বয় কিংবা নিরীহ হকারকে দেখেছি স্বচক্ষে; দেখেছি কামানের গোলায় ওড়ানো দৈনিক ইত্তেফাকের বিধ্বস্ত ভবন; দেখেছি পিলখানা, জগন্নাথ হল, পুলিশ লাইন, বিভিন্ন পুলিশ ফাঁড়ি, কমলাপুর রেলস্টেশন, তাঁতিবাজার, শাঁখারি বাজার, লঞ্চঘাট; বিভিন্ন বস্তিতে রক্তাক্ত সারিবদ্ধ লাশ। পঁচিশ তারিখের পর জীবন্ত মানুষের চাইতে নিহত মানুষের সংখ্যা যে খুব কম ছিল আনুপাতিকভাবে, তেমনটি জোর করে বলতে পারব না।

মার্চের উনত্রিশ তারিখে ঢাকা পেরিয়ে জিঞ্জিরাতে যখন পা রাখলাম তখন সেটাকে মনে হয়েছিল মুক্ত এলাকা। মাত্র-দুদিন সেখানে ছিলাম। যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম সেই বাড়িতে নদী-পেরুনো শত শত মানুষের আহারের সংস্থান ছিল। এপ্রিলের মাঝামাঝিতে কিছুক্ষণের জন্য জিঞ্জিরাতে পা রেখেছিলাম। সে বাড়িটি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বাড়ির জীবন্ত মানুষের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। একাত্তরের কী নির্মম ছাপ যে পড়েছিল সেখানে তা আজ আর কল্পনায়ও আনা যাবে না।

যুদ্ধের পর যখন এই বিধ্বস্ত দেশে ফিরেছিলাম তখন অনেক চেনা মানুষ, অনেক নমস্য মানুষকে হারিয়ে ফেলেছি চিরতরে।

তখন আমি সাতাশ। কিন্তু এখনও আমি এই সত্তরের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি আমার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত দেশটি দেখার অপেক্ষায়।

হারানো বাংলাকে কি খুঁজে পাব আমার!