স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল একটি পদকও পেল না

জাকারিয়া পিণ্টু
Published : 25 March 2016, 06:25 PM
Updated : 25 March 2016, 06:25 PM

স্বাধীনতার আগে যখন আমরা পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করতাম, তখন আমাদের ট্রায়াল হতো পাকিস্তানে। পাঞ্জাবি, মাখরানি, মানে পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকাংশ খেলোয়াড়রাই তখন ওদের দলে খেলত। ট্রায়ালের সময় ওরা আমাদের বলত, "তুম লোক চাউল খাতা হে, কিয়া ফুটবল খেলেগা?" (তোমরা চাউল খাও, ফুটবল খেলবে কিভাবে)।

ট্রায়ালটা বাংলাদেশে না করে ওরা আমাদেরকে রাওয়ালপিণ্ডি নিয়ে যেতো। নিয়ে গিয়ে মারত, যাতে আমরা খেলতে না পারি; চান্স না পাই। দুইরকম আচরণ করা হতো সবখানে। যেমন আমরা টয়লেট, গোসল সবই সারতাম খোলা আকাশের নিচে আর ওদের জন্য ছিল বাথরুমের ব্যবস্থা। তখন আমি, টিপু, হাফিজউদ্দিন, সান্টু মিলে আলোচনা করতাম। ভাবতাম-এদের নাগপাশ থেকে সরে আসতে হবে।

কিন্তু চাইলেই তো আর হয় না; চাওয়াটা পূরণ করতে হলে আলাদা রাষ্ট্র লাগবে। আমরা তো আলাদা রাষ্ট্র করতে পারব না। সুযোগটা এলো, যখন বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বললেন-'যার কাছে যা কিছু আছে, তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়।' ভাবলাম, আমার কাছে তো ফুটবল আছে। ফুটবল খেলে জনমত তৈরি করতে পারব, টাকা তুলে মুক্তিযুদ্ধের ফান্ডে দিতে পারব। তখনই মনে হলো ফুটবল দল গড়ব।

আবার মনে হলো যদি ফুটবল টিম করতে হয়, পাকিস্তানে থেকে তো পারব না, সেটা ইন্ডিয়া (ভারত) গিয়ে করতে হবে। তো ৭ই মার্চের পর আমি আর থাকলাম না; পরিবার নিয়ে পৈত্রিক বাড়ি নওগাঁতে গেলাম। ওখানে ইন্ডিয়ার বর্ডার খুব কাছে। ৪৫ মাইল দূরে হিলি বর্ডার। ওখানে বালুঘাট নামে জেলা আছে; পার হয়ে চলে গেলাম।

ইন্ডিয়া গিয়ে সম্মুখ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। ওখানে একটা রিসিপশন ক্যাম্প ছিল, ওখানকার অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হলাম; আর ছোট বেলার বন্ধু জলিল (আব্দুল জলিল) পরে যে আওয়ামী লিগের সাধারণ সম্পাদক ছিল, ওখানকার কমান্ডার, সে আমার ছোটবেলার বন্ধু। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছি কিন্তু ভেতরে ছিল ফুটবল টিম গড়ার স্বপ্ন। এই রকম স্বপ্ন দেখতে দেখতে ট্রেনিংয়ে বন্দুক, মর্টার চালানো– এগুলো শিখেও ফেলেছি। হঠাৎ অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট নজরুল সাহেবের একটা চিঠি এলো। তিনি লিখে পাঠিয়েছেন-তোমার সম্মুখ যুদ্ধে যাওয়া লাগবে না। এখানে একটা ফুটবল দল গঠন করা হচ্ছে। তুমি সেখানে খেলো, খেলে টাকা সংগ্রহ করে বঙ্গবন্ধুর ফান্ডে দাও।

কিন্তু আমার ইচ্ছা সম্মুখ যুদ্ধে যাওয়ার। সে ইচ্ছায় ছেদ পড়ল স্ত্রীর কারণে। সেও তখন ক্যাম্পে ছিল; আমাকে বলল-'দ্যাখো ফুটবল তোমার জীবন। এতবড় সুযোগ এসেছে, কাজে লাগাও।' হয়ত স্ত্রীর একটা ভয় ছিল সম্মুখ যুদ্ধে আমি মারাও যেতে পারি। সব মিলিয়ে ফুটবল খেলার সিদ্ধান্ত নিলাম।

দল গঠনের ওখানে গিয়ে দেখলাম, আলী ইমাম সাহেব সবকিছু করছেন। আমাকে পেয়ে তারা খুশি। আমরা নজরুল সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি বললেন, 'আকাশবানীতে একটা ইন্টারভিউ দিয়ে ফুটবলার যারা আছে, তাদের নিয়ে আসো।' এভাবেই সবকিছু হয়ে গেলো। ৪০ জন ফুটবলার এসেছিল। পার্ক সার্কাসে ট্রায়ালে আমরা ৩০ জন টিকে গেলাম (পরে আরও চারজন যোগ হয়)। দুই রুম ভাড়া করা হল। একটাতে আমরা থাকতাম, অন্যটা ক্রীড়া সমিতির অফিস। সবার সিনিয়র হওয়ায় আমাকে অধিনায়ক আর প্রতাপকে করা হলো সহ-অধিনায়ক।গড়া হলো ১০ জনের কমিটিও।

৮ জুন দল গড়া হয়ে গেলো। প্রথম ম্যাচ খেললাম ২৪ জুলাই। নদীয়ার কৃষ্ণনগর মাঠে; নদীয়া একাদশের বিপক্ষে। খেলার আগে আমরা আয়োজকদের একটা চিঠি দিয়েছিলাম, সেখানে বাধ্যবাধকতা ছিল, খেলার আগে আমরা পতাকা নিয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করব, পতাকা উত্তোলন করব এবং দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজাতে হবে। এখানে বলে রাখি, আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল কিন্তু স্বীকৃতি পাওয়া, খেলা নয়।

২৩ জুলাই নদীয়ায় পৌঁছালাম। খেলার দিন আমরা বুট-টুট পরে তৈরি, মাঠে নামব, তখন তাদের জিজ্ঞাসা করলাম-তোমাদের যে চিঠি দিয়েছিলাম, সেটার কি করলে? তারা বলল-আমরা তো সিদ্ধান্ত নেইনি। কারণ আমরা তোমাদের স্বীকৃতি দেইনি; তাই তোমার দেশের পতাকা উড়াতে দিতে পারব না। ওদের কথা শুনে আমরা বুট খুলে ফেললাম। সোজাসাপ্টা বলে দিলাম-আমরা খেলব না।

ততক্ষণে নদীয়া একাদশ মাঠে নেমে পড়েছে। সেসময় মেহেরপুর বর্ডার খোলা ছিল; সেদিক দিয়ে আসা বাংলাদেশের দর্শকে ভরে গেছে মাঠ। খেলা শুরুর কথা পাঁচটায়, সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। আমাদের দেশের মতো স্টেডিয়ামে দর্শক ভেঙে পড়া শুরু করল। তাদের প্রশ্ন-দল কই? পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ওখানকার ডিসি দীপক কান্তি ঘোষ মিটিংয়ে বসলেন। পরে এসে বললেন, "ঠিক আছে, তোমাদের দেশের পতাকা দশ মিনিট উত্তোলন থাকবে; এরপর নামিয়ে ফেলব।"আমি বললাম, আপনি এক মিনিটের জন্য হলেও করেন। কেননা, আমাদের উদ্দেশ্য হলো স্বীকৃতি নেওয়া। উনি বাঙালি ছিলেন। রাজি হলেন। সফল হলাম আমরাও।

আমি আর প্রতাপ পতাকা হাতে মাঠ প্রদক্ষিণ করলাম। তখন আমাদের পতাকার মধ্যে একটা মানচিত্র ছিল। সবাই উঠে বলল, জয় বাংলা, তোমরা সবাই এগিয়ে চলো, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আমার সৌভাগ্য সেদিন অধিনায়ক হিসেবে আমিই প্রথম দেশের পতাকা তুলেছি। ডিসি সাহেবও করেছিলেন। খেলার আগে দুই দেশের সঙ্গীত বাজল। সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এই দ্যাখো গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। ম্যাচটা ২-২ ড্র হলো। আমাদের শাহজাহান আর এনায়েত একটি করে গোল দিয়েছিল। খেলা শেষে আসার পথে শুনলাম-ডিসির চাকরি নাই; তাকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে।

ওই সময়টাতে ইন্ডিয়ার বারো-তেরোটা জায়গায় আমরা ১৬টা ম্যাচ খেলেছি। ৯টায় জিতেছি। ৪টায় হেরেছি; ৩টায় ড্র করেছিলাম। সব ম্যাচ মিলিয়ে আমরা ভারতীয় মুদ্রায় পাঁচ লাখ রুপি তুলে দিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের ফান্ডে। ম্যাচ খেলতে গিয়ে কখনও মজার, কখনও অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাদের।

একবার আমরা বিহারে খেলতে যাচ্ছি; আমাদের জন্য ট্রেন, বাসে যাতায়াত ছিল ফ্রি কিন্তু বিমানের হাফ টিকেট। আমরা হাওড়া থেকে সিয়নে যাচ্ছি। পরের দিন খেলা। হঠাৎ শুনি দরজা ধাক্কানোর শব্দ। ভাবলাম, বোধহয় চেকার। এরপর উঁকি দিয়ে দেখি পঞ্চাশজনের মতো লোক দরজার সামনে। হাতে ঝাণ্ডা। নেংটি মতো পরা। এক সঙ্গে বলছে, "ইনকিলাব জিন্দাবাদ। শালে লোক খোলো।"ওদের দেখে দরজার শেকল তুলে দিলাম। ঢিল দিয়ে জানলার কাঁচ ভেঙে ওরা ঢুকে দরজার শেকল খুলে দিল। তিরিশ জনের কামরার মধ্যে এসে জুটল আরও জনা পঞ্চাশেক। ওরা তো উচ্ছশৃঙ্খল, ছয় মাস গোসল করে না; গায়ে খুব গন্ধ। ওই গন্ধে তো এনায়েত, সালাউদ্দিন বমিই করে দিল। আমারও বমি আসে আসে ভাব। যখন ওরা চলে গেলো, দেখি সালাউদ্দিনের স্যান্ডেল নাই; কিট ব্যাগও নিয়ে গেছে!

সিয়ন স্টেশনে আরেক কাণ্ড। আমাদের নামতে দেবে না। সেখানে লেখা 'বিট্রেয়ার গো ব্যক"। বিহারিরা এটা লিখে এনেছে। পরে আমরা একটা সংবাদ সম্মেলন করলাম। ওরা শর্ত দিল-খেলতে পারবে কিন্তু গোল করতে পারবে না। ভাবলাম এসেই যখন পড়েছি, খেলে যাই। শর্ত মেনে খেলতে নামলাম। কিন্তু হঠাৎ চল্লিশ গজ থেকে সালাউদ্দিন এক শট নিল; গোলও হয়ে গেলো। সবাই 'মারো শালেকো' বলে ধাওয়া করল। তখন সন্ধ্যা। দৌড় দিলাম সবাই। পরে পুলিশ এসে আমাদের উদ্ধার করে।

বোম্বেতে খেলে দেড় লাখ রূপি পেয়েছিলাম আমরা; অভিনেতা দিলীপ কুমার কুড়ি হাজার দিয়েছিলেন। মহারাষ্ট্রের বিপক্ষে ম্যাচের একটা সুন্দর ঘটনা বলি। ওদের অধিনায়ক নওয়াব মনসুর আলি খান পাতৌদিকে চার্জ করল আমাদের কায়কোবাদ। পাতৌদি পড়ে গেলেন ডিগবাজি খেয়ে। এরপর উঠে শুধু বললেন-ভাই হাম তো থোড়াই ফুটবলার হে, হাম তো ক্রিকেট প্লেয়ার হে, হামকো কিউ মারতাহে। পাতৌদির ওই কথা শুনে, বিনয় দেখে আমি কেঁদেই ফেলেছিলাম।

সম্ভবত নভেম্বরের শেষের দিকে ইন্ডিয়া ক্যাম্প বন্ধ করে দিলে বালুঘাটে চলে এলাম আমি। জলিলকে বিস্তারিত বললাম; ওর আবার ফুটবলের প্রতি খুব অনুরাগ ছিল। ওর কথায় বালুঘাটে চলে এলাম সবাই। এখানেও দুইটা ম্যাচ খেললাম। ৬ গোলে জিতলাম বালুঘাটের সঙ্গে আর ৫ গোলে হারালাম মালদহকে। এর মধ্যেই স্বাধীনতা এসে গেলো। কায়েকোবাদ, প্রতাপরা কুষ্টিয়ার বর্ডার দিয়ে স্বাধীন দেশে ফিরল। আমি এদিক দিয়ে নওগাঁ ফিরলাম। আমাদের রিসিপশন দেওয়ার মতো পরিস্থিতিও তখন ছিল না। কে দেবে?

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দীপক সাহেব ১৯৭২ সালে আগা খান গোল্ড কাপে নদীয়া জেলা দল নিয়ে এসেছিলেন। তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। দেখা হওয়ার পর তিনিও কাঁদছেন, আমিও কাঁদছি। সে বলল, 'দ্যাখো আমার চাকরি চলে গেছে; আমি কিছু মনে করিনি। কিন্তু তোমার দেশের পতাকার সঙ্গে আমি প্রথম পতাকা উত্তোলন করেছি। এটা আমার অনেক বড় পাওয়া। এটা তো আর কেউ পারেনি।'

এই সরকাকে আমি বারবার বলেছি, ইন্দিরা গান্ধীর পর যদি একজন স্বীকৃতি পাওয়ার থাকে, তাহলে সেই লোকটাই পাবে, আমাদের দেশের জন্য যে সেদিন চাকরি হারিয়েছিল; সেই লোকটা দীপক বাবু। তিনি তো সেদিন 'না করলেও' পারতেন। বলতে পারতেন-পতাকা উড়াতে দিতে পারব না আমি; আমার আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে। এবার তাই আমরা চেষ্টা করছি আগামী ২৪ জুলাই তাকে নিয়ে আসব, বড় রিসিপসন দেবো।

এসব নিয়ে অবশ্য জাতির প্রতি আমার ক্ষোভ নাই; অভিমান আছে। এতকিছু করলাম কিন্তু আজ পর্যন্ত আমাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করা হয়নি। স্বাধীনতা পুরস্কার আছে, জাতীয় পুরস্কার আছে, যারা পাচ্ছে পাক কিন্তু কাদেরকে দেওয়া হচ্ছে? যেদিন থেকে পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়েছে, আমরা তো প্রথম তা পাওয়ার যোগ্য। ব্যক্তিগতভাবে আমি, সালাউদ্দিন, প্রতাপ পুরস্কার পেয়েছি কিন্তু আমার দুঃখটা এখানেই। শুধু আমাকে না দিয়ে যদি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলটাকে দেওয়া হতো, তাহলে আমি সবচেয়ে খুশি হতাম।

আমাদের মধ্যে পাঁচজন মরে গেছে; কর্মকর্তা যারা ছিল, তাদের কেউ-ই বেঁচে নেই। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় আমার অবর্তমানে একটা ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেছিল আইনুল (ইসলাম), সে এখন ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগছে। মোহামেডানে ১৫ বছর খেলেছে। একজন জাতীয় দলের খেলোয়াড়কে জীবনের তাগিদে সিকিউরিটি অফিসারের চাকরিও করতে হয়েছে। আজ সে টাকার অভাবে মারা যাচ্ছে। সে তো দেশের জন্য করেছে। অনেককে বলেছি; সবাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, দেখা যাক কি হয়। কিন্তু এটা তো পথ নয়। কদিন আগে আমাকে আইনুল বলল-'ভাই আমি আর বাঁচব না।'

আমার প্রশ্ন, বাংলাদেশ না হলে আজ কোথায় থাকতে তোমরা?

অনুলিখন: মোহাম্মদ জুবায়ের