ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা: কিছু করণীয়

মাসিউল হক চৌধুরী
Published : 6 Dec 2021, 08:33 PM
Updated : 8 April 2016, 02:36 AM

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা আমদানি-রফতানি, সভারেইন রিস্ক রেটিং, খাদ্য নিরাপত্তাসহ ব্যাংকিং খাত বেশ ঘটনাবহুল অবস্থা পরিক্রম করছে। সে প্রেক্ষিতেই ব্যাংকিং খাত নিয়ে কিছু করণীয় প্রসঙ্গে এ প্রবন্ধের অবতারণা।

সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, তিরিশ লাখ শহীদের আত্মদানসহ সমগ্র জাতির ত্যাগের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি একটি দেশের, একটি জাতির পরিচয়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশ এবং এ দেশের ভবিষ্যত সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমাদেরকে তলাবিহীন ঝুড়ি (bottomless basket) আখ্যা দিয়েছিলেন। নব্বইয়ে দেশ স্বৈরাচারমুক্ত হল, যেন আরেক বার দেশ স্বাধীনতার স্বাদ পেল। নব্বই থেকে দুহাজার ষোল, ছাব্বিশটি বছর পার করলাম আমরা। শত বাধা সত্ত্বেও এ সময়টিতে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেশ আশাব্যঞ্জক। নিচের সারণীতে বাংলাদেশের জনপ্রতি বার্ষিক আয়ের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হল:

বাংলাদেশের দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়েও একটি ধনাত্মক প্রভাব ফেলেছে।

বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনীতির বিবিধ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করে বাংলাদেশ কেবল গড়ে শতকরা ছয় ভাগ হারে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জনে সক্ষম হয়নি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও কলেবর অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, প্রবাসী রেমিট্যান্সের সাফল্য, তৈরি পোশাক খাতে প্রবৃদ্ধি, জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য শিল্প কাঁচামালের দাম কমে যাবার ফলে আমাদের রিজার্ভের পরিমাণ রেকর্ড ছাড়িয়েছে।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যাবস্থাপনায় কৃষিঋণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে উন্নয়ন, নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়স, ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে যেমন অন্তর্ভুক্তি ব্যাংকিং প্রসারিত হয়েছে, তেমনি সেবার মানে উৎকর্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমেও ব্যাংকিংএ আধুনিকতা এসেছে।

বিশ্ব এখন একটি বৃহৎ ভিলেজে পরিণত হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে আমরা রিয়েল টাইম-ইন্টিগ্রেটেড। নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে বাংলাদেশের গচ্ছিত রিজার্ভের অর্থ হ্যাকারদের দ্বারা আত্নসাতের ঘটনা যেমন আমাদেরকে চিন্তা করার খোরাক দেয়, তেমনি ব্যাংকিং জগতে বিগত বছরগুলোতে ঘটে যাওয়া কতিপয় ঘটনা, যথা বেসিক ব্যাংক, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, যুবক বা ডেসটিনি কেলেংকারিও বিশেষ প্রণিধানে নিয়ে আসে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ক্রমবর্ধমান মন্দ ঋণের ভারের কারণে সুদের হার কমানোও একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। তদুপরি, এ মন্দ ঋণের কারণে মূলধন ঘাটতিতে বেশ কটি ব্যাংক চলে যাওয়ায় সমগ্র ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা আমাদের অর্থনীতির চাকা কিছুটা হলেও দুর্বল করে দিয়েছে।

উপরে উল্লিখিত বিষয়াবলী বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। আমরা যদি শেকড়ের সমস্যাগুলো (root causes) পর্যালোচনা করি তাহলে কিছু মৌলিক দুর্বলতা অবশ্যই দৃষ্টিগোচর হয়।

প্রথমত, সুশাসনের সঠিক প্রয়োগ, তা সেটি পরিষদ পর্যায়ে হোক বা ব্যবস্থাপনার পর্যায়ে অথবা মিলিত। সুশাসন নিশ্চিত কল্পে করণীয় তালিকায় রয়েছে:

১. গ্রাহক-সংক্রান্ত Know Your Customer (KYC) পরিপূর্ণ যাচাইকরণ-পূর্বক গ্রাহকের নাম, ঠিকানা, ব্যবসার প্রকৃত অবস্থা ও অবস্থান;

২. ঋণ-প্রস্তাব এবং অনুমোদনে কোনো প্রকার প্রভাব না খাটানো;

৩. যথাযথভাবে অনুমোদিত ঋণ কেবল ঋণ-সংক্রান্ত যাবতীয় জামানত এবং প্রয়োজনীয় দলিলাদির যথার্থতা যাচাইকরণ এবং সম্পাদনের পরই অর্থ প্রদান;

৪. গ্রাহকের ঋণগ্রহণের সঠিক কারণ; cash flow এর সঙ্গে সঙ্গতিকরণের প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ;

৫. ঋণের প্রদেয় অর্থ মুনাফাসহ সঠিক সময়ে ফেরত নিয়ে আসার তাগিদে উপযুক্ত তদারকি ও ব্যবস্থা।

ব্যাংকের অবকাঠামোগত উৎকর্ষতার প্রতি সচেষ্ট থাকার বিষয়টিতে বিশেষ যত্নের প্রয়োজন। কোর ব্যাংকিংএর সফল প্রয়োগের সুফল হিসেবে ব্যাংকিং ব্যবস্থার সামগ্রিক মনোন্নয়ন সম্ভব। BASEL নিয়ম পালন করে ব্যাংকের সম্পদের গুণগতমান উন্নতিকল্পে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা জোরদার করার বিকল্প নেই। সম্পদ বলতে ব্যাপকার্থে ব্যাংকের মানবসম্পদ, বিনিয়োগ, স্থায়ী এবং চলতি সম্পত্তি, বাট্টাকৃত বিল বুঝায়। সঠিকভাবে সম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যালান্স সিটের অন্যপাশে রক্ষিত মূলধন, গ্রাহকের আমানত এবং সঞ্চিতির সুষ্ঠু সংরক্ষণ সম্ভব।

ব্যাংক ব্যবসা প্রকৃত প্রস্তাবে সেবা-ব্যবসা। আমানতকারীর অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে যে লাভ অর্জিত হয় তা পরিচালন-খরচ, সঞ্চিতি এবং আয়কর প্রদানের পর অবশিষ্ট একটি অংশ লভ্যাংশ হিসেবে ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের মাঝে বিতরণ করা হয়। যে ব্যাংক বিনিয়োগ এবং আমানতের মধ্যে পার্থক্য বেশি রাখতে পারবে (spreads), সে ব্যাংকের পরিচালন-মুনাফা সে রকমভাবে বেশি হবে। যে ব্যাংকের মন্দ ঋণের পরিমাণ বেশি, সে ব্যাংক স্বাভাবিকভাবে কম মুনাফা অর্জন করবে। আজকের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে যে ব্যাংকের সেবা প্রদান যত ভালো, সে ব্যাংকের ব্যবসার প্রসার সেভাবে নন্দিত।

সেবার মানের উন্নয়নের জন্য ব্যাংকগুলো এখন প্রযুক্তি-নির্ভর। তবে এ প্রযুক্তি-নির্ভরতার জন্য অত্যাবশ্যকীয় হচ্ছে ব্যবহারকৃত সফটওয়্যারগুলোর অরিজিনালিটি, তথা পাইরেটেড বা আনসাপোর্টেড না হওয়া।

একটি ব্যাংক স্বাভাবিক নিয়মানুযায়ী প্রতি বছর তিন প্রকারের নিরীক্ষক দ্বারা নিরীক্ষিত হয়; যথা অভ্যন্তরীন নিরীক্ষক, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিরীক্ষক এবং বিধিবদ্ধ নিরীক্ষক। প্রযুক্তির উত্তরোত্তর ব্যবহার বৃদ্ধি পাবার পরও প্রযুক্তি নিরীক্ষকের অপ্রতুলতার কারণে বিষয়টি প্রয়োজনমাফিক নজরদারির মধ্যে না থাকায় এ ঝুঁকি সাধারণত উন্মুক্ত থেকে যায়।

বৈদেশিক বাণিজ্য তথা ঋণপত্র অনেক ক্ষেত্রে অবৈধ অর্থ বিনিময়ের একটি বহুল ব্যবহৃত পথ। তাই বিষয়টি ব্যাংকের বিশেষ তত্বাবধানে থাকা উচিত। আমদানিকৃত পণ্যের আন্তর্জাতিক মূল্য সম্পর্কে জানা বাঞ্ছনীয়। এ জন্য প্রয়োজনে রয়টার্স কিংবা ওয়েবে গিয়ে জেনে নেওয়া উচিত।

আর আমদানির পর বিশেষ নজর দেওয়া উচিত আমদানিকৃত পণ্যের জন্য কাস্টমস থেকে বিল অব এন্ট্রির কপি নিয়ে আসার বিষয়ে। ঠিক একইভাবে রফতানিকৃত পণ্যের মূল্য যেন ব্যাংকের নিকট সময়মতো পৌঁছায়, সেই বিষয়ে যত্নবান হওয়া বিশেষ প্রয়োজন।

ব্যাংকিং ব্যবসায় লাভের অন্য পিঠে ক্ষতি থাকে। আর এ বিষয়ে গোপনীয়তা বা লুকোচুরির আশ্রয় নিতে গেলে পরে যখন এটি একটি সারপ্রাইজ হিসেবে নিরীক্ষকদের নিকট ধরা পড়ে, তখন হয়তো-বা অনেক দেরি হয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে অনেকেই আগে চাকুরিচ্যুত হয়েছেন।

এখন সময় হয়েছে ঘটে যাওয়া ঘটনাপঞ্জির সঠিক বিশ্লেষণ এবং এর থেকে নেওয়া শিক্ষা কেস স্টাডি হিসেবে তুলে ধরা যাতে ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি রোধ করা যায়।