বাংলাদেশ ব্যাংক সমাচার: যুক্তিনির্ভর হোক সকল পদক্ষেপ

দেবপ্রসাদ দেবু
Published : 21 March 2016, 03:16 AM
Updated : 21 March 2016, 03:16 AM

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে প্রয়োজনীয় লেনদেনের জন্য রক্ষিত কারেন্ট একাউন্টের একটি অংশ বেহাত হয়ে গিয়েছে। মিডিয়ার ভাষ্য মতে, সেটি ১০১ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে কিছু অংশ শ্রীলংকা থেকে ফেরত এসেছে। সেটা ২০ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ নিট বেহাত হওয়া ডলারের পরিমাণ ৮১ মিলিয়ন ডলার। আমাদের রিজার্ভ ২৮ বিলিয়ন ডলার হলে এই বেহাত হওয়া ফরেন কারেন্সির পরিমাণ মোট ফরেন কারেন্সির দশমিক দুই নয় ভাগ।

খুব বড় অংক হয়তো নয় কিন্তু সব ক্ষেত্রে অংক চলে না। এই ৮১ মিলিয়ন ডলার ইন-ওয়ার্ড করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। কারণ আমাদের রিজার্ভের পেছনে বড় অবদান কলিমুদ্দিন-রহিমুদ্দিনের ঘাম-ঝরানো ডলার। আরএমজি আমাদের মূল রপ্তানি খাত ধরা হলেও এই খাত থেকে নিট ফরেন কারেন্সি আর্নিং আশাব্যঞ্জক নয়। কারণ ক্রেতার শর্ত পূরণ করতে গিয়ে সুতা, জিপার, বোতাম এগুলো বা এগুলোর কাঁচামাল দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হয় এবং সেই আমদানি-ব্যয় বাদ দিলে যেটা থাকে সেটা আহামরি কিছু নয়। ফলে আজও আমরা কলিমুদ্দিন-রহিমুদ্দিনের পাঠানো ডলারের উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বেহাত হওয়া ডলারের লেনদেনটি সংঘটিত হয়েছে SWIFT নামক একটি সফটওয়্যারের মেসেজের মাধ্যমে। এটির সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা স্পষ্ট নয়। মিডিয়া-কর্মীদেরও তা নেই। সেটা হবার কথাও নয়। ফলে এটা নিয়ে এক ধরনের বিচ্ছিন্ন এবং জগাখিচুড়ি ধারণা মিডিয়াতে আলোচিত হচ্ছে। আমি সংক্ষেপে SWIFTএর মাধ্যমে ফান্ড ট্রান্সফারের প্রক্রিয়াটি উল্লেখ করার চেষ্টা করছি সাধারণ পাঠকের উদ্দেশে।

টেলেক্সএর বদলে SWIFT বিশ্ব ফাইন্যান্সিয়াল মার্কেটে জায়গা করে নিতে শুরু করে ১৯৭৭ সাল থেকে (প্রতিষ্ঠা ১৯৭৩ সালে)। শুরুতে এটি Dossভিত্তিক সফটওয়্যার হিসেবে পরিচালিত হলেও হাল আমলে এটি ওয়েব-বেস্ইজড বা অনলাইনের মাধ্যমে সরাসরি (লাইভ) পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্বের দুশ দেশে প্রায় এগারো হাজার প্রতিষ্ঠান এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে লেনদেন করছে। হেডকোয়ার্টার বেলজিয়ামে হলেও রিজিয়ন অনুসারে ভেন্ডর নিয়োগ করা আছে মেইনটেন্যান্সের জন্য। এশিয়া সাবকন্টিনেন্টের ভেন্ডর ইন্ডিয়াতে।

SWIFTকে বলা হয় ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টরের অন্যতম নিরাপদ এবং নির্ভরযোগ্য সফটওয়্যার। এটির নিরাপত্তা-বিষয়ক একটু ধারণা দেওয়া যাক।

দুটি ব্যাংক বা ফাইন্যান্সিয়াল ইন্সটিটিউট যদি পরস্পরের মধ্যে মেসেজ আদান-প্রদান করতে চায় তবে দুভাবে তা করতে পারে। একটি হল, নির্ভরযোগ্য বা বিশ্বস্ত ফরম্যাটে, অন্যটি হল ওপেন। নির্ভরযোগ্য ফরম্যাটে মেসেজ প্রেরণ তখনই সম্ভব হবে যদি ঐ দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে BKE (Bilateral Key Exchange) অ্যারেঞ্জমেন্ট থাকে। অন্যথায় অথেনটিক ফরম্যাটের মেসেজ NACK (নট একনলেজড) হবে। অর্থাৎ মেসেজ প্রাপকের কাছে পৌঁছুবে না।

মেসেজ ACK (একনলেজড) হবার জন্য শুধু BKE থাকাই যথেষ্ট নয়, SWIFTএর নির্ধারিত ফিল্ডে নির্ধারিত প্রি-অ্যারেঞ্জড গোপন কোড লিখতে হবে। এছাড়া প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নির্ধারণ করা আছে কোন লেভেলের ইউজার আইডি কতটুকু পর্যন্ত ফান্ড অথারাইজড করতে পারবে এবং কত জনের অথারাইজেশন লাগবে। প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তির পদবি এবং রেসপনসিবিলিটির উপর নির্ভর করে অথারাইজেশন পাওয়ারগুলো প্রতিষ্ঠান সেট করে।

এবার আসা যাক অটোমেটেড ট্রানজেকশন নিয়ে। সাধারণ মানুষের মনে একটা প্রশ্ন আছে; বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার ছিল ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে (ফেড), ওটা কীভাবে ফিলিপাইন গেল? SWIFT তো মেসেজ আদান-প্রদান করে, ফিজিক্যাল ডলার তো করে না। কিংবা মেসেজ গেলেই ফেড ফিজিক্যালি ফিলিপাইনে ডলার নিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে না। ফলে প্রক্রিয়াটা সাধারণের বুঝা দরকার।

এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, প্রত্যেক আন্তর্জাতিক ফান্ড ট্রান্সফারের ক্ষেত্রে কারেন্সি অরিজিনে মূল ট্রানজেকশন অনুমোদিত এবং সম্পন্ন হবে। যেমন ধরুন, ভারতের ইউনিয়ন ব্যাংক যদি বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংককে এক মিলিয়ন ডলার দিতে চায় তবে মূল ট্রানজেকশনটা হবে নিউইয়র্কে। বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশ, যাদের ডলারে ট্রানজেকশনের প্রয়োজন পড়ে, এরা সবাই নিউইয়র্কে কারও না কারও সঙ্গে একাউন্ট রক্ষা করে চলে লেনদেন নিস্পত্তির জন্য।

সে ক্ষেত্রে ভারতের ইউনিয়ন ব্যাংক তার নিউইয়র্ক প্রতিনিধি ব্যাংককে বলবে, 'তুমি সোনালী ব্যাংক ঢাকার জন্য এক মিলিয়ন ডলার তার নিউইয়র্কের সোনালী ব্যাংকের অমুক প্রতিনিধির একাউন্ট ক্রেডিট কর'। এই মেসেজটা SWIFTএ ২০২ ফরম্যাটে যাবে এবং এটুকু পর্যন্ত অটোমেটেড পদ্ধতিতে সংঘটিত হবে। কিন্তু এই ট্রানজেকশন ঘটে গেলেই ঢাকার সোনালী ব্যাংক ডলার পেয়ে যাচ্ছে না বা জানতেও পারছে না।

ঢাকাকে জানতে গেলে সোনালী ব্যাংকের নিউইয়র্ক শাখা (বা প্রতিনিধিত্বকারী ব্যাংক) ঢাকা শাখাকে আরেকটি মেসেজ দিয়ে জানাবে, 'তোমার জন্য অমুক রেফারেন্সে এক মিলিয়ন ডলার জমা হয়েছে নিউইয়র্কে'। সেই মেসেজের উপর ভিত্তি করে সোনালী ব্যাংক তার গ্রাহককে বাংলাদেশ থেকে ডলার দেবে। নিউইয়র্ক থেকে ফিজিক্যাল ডলার আসার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজনে সোনালী ব্যাংক নিউইয়র্ক বা তার প্রতিনিধি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের ফেড একাউন্টে ট্রান্সফার করে বাংলাদেশ ব্যাংক ঢাকা থেকে ডলার সংগ্রহ করে নেবে। এই হচ্ছে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।

এবার আসা যাক রিজার্ভ খোয়া যাওয়া প্রসঙ্গে। এখন পর্যন্ত আমরা জানতে পারলাম ফেব্রুয়ারি মাসের ৫ তারিখে সুইফট মেসেজের মাধ্যমে 'স্বয়ংক্রিয়ভাবে' লেনদেনগুলো সম্পন্ন হয়েছে। কতটুকু স্বয়ংক্রিয় সেটা উপরে আলোচনা করেছি। অর্থাৎ ফেড থেকে ফিলিপাইনের রিজল ব্যাংকের নিউইয়র্ক শাখায় বা তাদের প্রতিনিধি ব্যাংকের একাউন্টে ক্রেডিট হওয়া পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয়, সেখান থেকে ফিলিপাইন শাখায় যাওয়াটা অন্য প্রক্রিয়ায় বা আরেকটি মেসেজে বা আরেকটি ট্রানজেকশনে।

সেদিন ছিল শুক্রবার, অর্থাৎ বাংলাদেশে ছুটির দিন। যতটুকু জেনেছি তাতে বুঝা গেল, ৫ ফেব্রুয়ারি সাড়ে বারোটা নাগাদ মেসেজ ট্রান্সমিট হয়েছে। অর্থাৎ ৪ তারিখ দিবাগত রাতে। আমার জানা মতে, সুইফটের প্রাতিষ্ঠানিক সার্ভার ওয়ার্কিং আওয়ারের পর বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা এবং মূল সার্ভার বন্ধ থাকলে কোনো টার্মিনাল থেকেই মেসেজ আদান-প্রদান সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে কেবল ভেন্ডরের পক্ষে বিকল্প উপায়ে সার্ভারে প্রবেশ করা সম্ভব। সেটি ঘটেছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। ফলে আমাদের আলোচনা বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার বা ইউজার-কেন্দ্রিক হবে।

এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন, সাধারণত কয়টা পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার খোলা থাকে? প্রাইভেট কমার্শিয়াল ব্যাংকের ক্ষেত্রে সেটা আটটা/নয়টা অব্দি থাকে বলে আমার ধারণা। যত ক্ষণ সার্ভার খোলা থাকে তত ক্ষণ অপারেটর সেখানে থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিলিং রুম বা ব্যাক অফিস কতটা সময় পর্যন্ত খোলা থাকে এবং দায়িত্ব কারা থাকে?

বলে রাখা প্রয়োজন, ট্রানজেকশন এক্সিকিউট করতে ধাপে ধাপে পাসওয়ার্ড প্রয়োজন (অর্থমন্ত্রী এক সাক্ষাৎকারে হাত বা আঙুলের ছাপের কথা বলেছেন, সেটি হাস্যকর)। ৫টি ট্রানজেকশনে ৮১ মিলিয়ন যাওয়ার অর্থ অন্তত দুটি ট্রানজেকশন ১০ মিলিয়ন এভাব হবার সম্ভাবনা বেশি। সে ক্ষেত্রে ফোর লেয়ার পাসওয়ার্ড লাগার কথা অর্থাৎ চার জনের পাসওয়ার্ড লাগার কথা এবং ১০ মিলিয়ন এন্ড এবাভ পাসওয়ার্ড জিএম লেভেলের নিচে হবার সম্ভাবনা কম, উপরের লেভেলেরও হতে পারে। আমার মনে হয় না এতটা সময় কোনো জিএম বা ইডি বা ডিজি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে অবস্থান করছিলেন।

সুতরাং হ্যাকিংএর বিষয়টা ভুয়া বলার কোনো সুযোগ দেখছি না (কিছু মিডিয়া বা মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যে এমনটাই মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে কেবলমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংকের যোগসাজশে এটা ঘটেছে)। তবে হ্যাকিং ঘটার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কারও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা থাকতে পারে। ম্যালওয়ারের কথা শোনা যাচ্ছে, বলা হচ্ছে এর মাধ্যমে পিসি থেকে তথ্য চুরি করা হয়েছে এবং সেগুলো ব্যবহার করে হ্যাকিং ঘটনো হয়েছে। বিষয়গুলো তদন্তে বেরিয়ে আসবে।

যোগসাজশের বিষয়টা আরও জোরালো করে। কারণ সেদিন সিসি ক্যামেরা অফ ছিল, প্রিন্টার নষ্ট ছিল (কিছু ইনকামিং SWIFT মেসেজ ইন-ওয়ার্ড হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রিন্ট হয়ে যায়, সেটি লুকাতে এই ব্যবস্থা বলে ধারণা করা হচ্ছে)। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশাসনিক ঘাটতি আছে। যেমন, SWIFT সার্ভারে সর্বসাধারণের প্রবেশ সাধারণত নিষিদ্ধ এবং রেজিস্টার মেইনটেইন করা হয়, কে কখন সেই রুমে প্রবেশ করল সেটি প্রমাণ রাখতে। সেই সঙ্গে সার্ভার পিসিতে অন্য কোনো কার্য সম্পাদন করা হয় না, একমাত্র SWIFT অপারেশন ছাড়া। এমনকি সেই সার্ভার রুমের চাবি কে হোল্ড করবে সেটিরও অফিস অর্ডার থাকে।

এগুলো বলার একমাত্র কারণ, সার্ভার বন্ধ থাকলে অন্য টার্মিনালে কোনো কাজ সম্ভব নয়। এমনকি বাইরে থেকে হ্যাকিংও সম্ভব নয়। ফলে ঘটনার ঐ সময়ে কে সার্ভার রুম খুলে দিল বা কেন খোলা ছিল বা কে সার্ভার অন করল এগুলো গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আশা করব তদন্তের ফলে এগুলো খোলাসা হবে।

তবে একটা বিষয় স্পষ্ট, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রান্তে যা-ই হোক না কেন ফিলিপাইনের রিজল ব্যাংকের সর্বস্তরের কর্মকর্তা যে এই অর্থ লোপাটের সঙ্গে জড়িত সেটি স্পষ্ট। কেননা, যে পাঁচটি একাউন্টে লেনদেন সংঘটিত হয়েছে সেগুলো খোলা হয়েছে গ্রাহকের প্রয়োজনীয় তথ্যের ঘাটতি রেখে (মিডিয়ার তথ্য অনুসারে)। আবার সেসব একাউন্ট থেকে ৫৮ মিলিয়ন ডলার ডেবিট হয়েছে ফেড থেকে স্টপ পেমেন্ট ইন্সট্রাকশন আসার পরে। এছাড়া ফরেন কারেন্সিতে বড় অংকের কোনো ইন-ওয়ার্ড ট্রানজেকশন হলে সেটির উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে ডেবিট করার কথা নয় কোনো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়।

এ ক্ষেত্রে আমরা সে রকম কিছু দেখলাম না। এখন ফেডএর স্টপ পেমেন্ট ইন্সট্রাকশন না মানার কারণে ফেড কী ব্যবস্থা নেয় সেটি দেখার অপেক্ষায় থাকলাম। যদি কোনো ব্যবস্থা না নেয় তবে ধরে নিতে হবে যে, ফেড পরোক্ষভাবে এতে সহযোগিতা করেছে।

আদালতে গেলে রিজল ব্যাংক এই ডলার (অন্তত ৫৮ মিলিয়ন ডলার) ফেরত দিতে বাধ্য, কারণ স্টপ পেমেন্ট নির্দেশনা মানতে ব্যাংক বাধ্য– যদি ইন্সট্রাকশন আসার আগে ফান্ড ট্র্যান্সফার না হয়ে থাকে। এই বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশ আইসিসি (ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স) বা অন্য আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে। ফিলিপাইনের উপর রাষ্ট্রীয়ভাবে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করতে পারে মানি লন্ডারিং ইস্যুতে।

এবারে আসা যাক গভর্নরের স্বেচ্ছা বা অ-স্বেচ্ছা পদত্যাগ এবং তদপরবর্তী বা পূর্ববর্তী বিষয়গুলো নিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্ট একাউন্ট থেকে এত বড় অংকের ফরেন কারেন্সি লোপাট হয়ে যাওয়ার দায় নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ ব্যাংকের। বাংলাদেশের ফরেন কারেন্সি অ্যাক্ট অনুসারে ফরেন কারেন্সির মালিক সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক নয়। ফলে এই লোপাট হয়ে যাওয়া তৎক্ষণাৎ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে ফর্মালি জানানো উচিৎ ছিল তাদের। সেটাতে গাফিলতি হয়েছে।

তাছাড়া তারা অর্থ উদ্ধারে আন্তরিকতা নিয়ে চেষ্টা অব্যাহত রাখলেও দীর্ঘ এক মাসে কীভাবে কী ঘটল সেটার ন্যূনতম হদিস বের করতে ব্যর্থ হয়েছে। মিডিয়ায় সংবাদ আসার পরই মূলত কিছু ব্যবস্থা আমরা দেখতে পাই। এর পূর্বে কোনো প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি গঠন করার খবরও আমরা জানি না।

কিন্তু মিডিয়ার মুখে শুনে মাননীয় অর্থমন্ত্রী যেভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন এবং যেসব বক্তব্য দেওয়া শুরু করলেন তাতে এখানে ব্যক্তি ড. আতিউর রহমানের প্রতি অর্থমন্ত্রীর চরম ব্যক্তিগত ক্ষোভ আমরা দেখতে পাই। আমাদের সামনে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বয়হীনতার নগ্ন দিক এবং ব্যক্তিগত রেষারেষির নগ্ন চিত্র। যেটি বাংলাদেশের মুদ্রাবাজার বা আর্থিক খাতের জন্য সবচেয়ে বেশি দুঃখজনক।

আমরা দেখতে পেলাম সরকারি দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ-আলম-লেনিনসহ আরও অনেকেই ড. আতিউর সম্পর্কে প্রলাপ বকতে শুরু করলেন ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে। কেন তিনি বাংলা একাডেমি পুরষ্কার পেলেন, কেন তিনি বিদেশ ভ্রমণে গেলেন, তিনি কার 'দালালি' করেন এসব ইস্যুও বাদ গেল না। তারা বলতে শুরু করলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো কাজই প্রশংসা করার মতো ছিল না এই সাত বছরে। রিজার্ভ বাড়ার পেছনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকাই প্রধান।

এভাবে ভাবতে গেলে সব কিছুর জন্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকাই প্রধান এবং সব সফলতার পাশাপাশি সব ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বছরে কয়েক বার পদত্যাগ করতে হবে। উনারা আলোচনার সময় ভুলে যাচ্ছেন, বাংলাদেশের কলিমুদ্দিন-রহিমুদ্দিনরা আগেও প্রবাসে ছিলেন এবং আগেও ডলার পাঠাতেন। সেটি দেশে আসত হুন্ডিতে। সেটিকে মূলধারার ব্যাংকিংএ নিয়ে আসতে অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়েছে, এগুলো অস্বীকার করা নেহাত রাজনৈতিক গলাবাজি হবে বলে মনে করি।

এছাড়া স্মল এন্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজের (এসএমই) জন্য রিফাইন্যান্সিংসহ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিভিন্ন ইতিবাচক সুযোগ-সুবিধা, কৃষি খাতে সুদের হার কমিয়ে আনা– এসব পদক্ষেপ এই গভর্নরের আমলেই নেওয়া। তাছাড়া মুদ্রানীতিসহ অর্থনীতির অনেক ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছে। এগুলো আমার আলোচনার বিষয় নয়।

প্রসঙ্গক্রমে বলা এই কারণে যে, ব্যক্তি আতিউরকে একটি ঘটনায় আটকিয়ে, তাঁর সব কিছু অস্বীকার করার কোনো যৌক্তিক কারণ আমি দেখি না।

তাছাড়া এই ঘটনায় প্রশাসনিক দায় হয়তো ব্যক্তি আতিউরের আছে বৈকি, কিন্তু ঘটনার সঙ্গে ব্যক্তিগত সংশ্লিষ্টতা নেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবেই। অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের উচিৎ সেই সব দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে পদক্ষেপ নেওয়া যারা এই অপকর্মে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছে।

সরকারের উচিৎ ফেডএর সঙ্গে মিলে রিজল ব্যাংকসহ ফিলিপাইনের উপর রাষ্ট্রীয়ভাবে চাপ অব্যাহত রাখা। এরা কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না। সেই সঙ্গে দেশীয় যোগসাজশকারীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা। না হলে একজন গভর্নর বা দুজন ডেপুটি গভর্নরের বাদ পড়া নেহাত উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর নামান্তর হবে।