সংসদের ভেতরে ও বাইরে সংগঠনকে বিরোধী দলের ভূমিকা গ্রহণের প্রস্তাবনা

মুশতাক হোসেন
Published : 17 March 2016, 01:59 PM
Updated : 17 March 2016, 01:59 PM

[জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)এর কেন্দ্রীয় সম্মেলনে কাউন্সিলরদের উদ্দেশে দলের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য মুশতাক হোসেনের প্রদত্ত ভাষণ]

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর কেন্দ্রীয় সম্মেলনের প্রিয় কাউন্সিলরবৃন্দ,

আমার শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। দীর্ঘ ৪৪ বছরের সংগ্রাম ও ৭ (১৯৯৬-২০০১ ও ২০১২-২০১৬) বছরে সরকারে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে উপস্থাপনের জন্য আমি নিম্নোক্ত প্রস্তাবনা উপস্থিত করছি।

জাসদ ১৪ দলীয় ঐক্যজোটের শরিক হিসেবে বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভায় অংশীদার। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জোটগত অংশগ্রহণ করলেও জাসদ মন্ত্রিসভায় অংশগ্রহণ করে সরকার গঠনের চতুর্থ বর্ষে। ইতিপূর্বে ১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগের জাতীয় ঐক্যমতের সরকারে জাসদের একাংশের নেতা সরকার গঠনের কয়েক মাস পরে মন্ত্রিসভায় অংশগ্রহণ করেন। তার পরের বছরে জাসদের দু অংশ ও বাসদের একাংশ ঐক্যবদ্ধ হবার সুবাদে পুনর্গঠিত জাসদ সরকারের অংশীদারে পরিণত হয় ১৯৯৭ সাল থেকে।

সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত একটি রাজনৈতিক দল কর্তৃক সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলসহ গঠিত যুক্তফ্রন্টের সরকারে অংশগ্রহণ করাটা অস্বাভাবিক কিংবা নীতিবিরুদ্ধ নয়। এ ধরনের সরকারে অংশ নেবার উদ্দেশ্য হচ্ছে যুক্তফ্রন্টের আশু গণতান্ত্রিক লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা ও দলের দীর্ঘমেয়াদী সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য এগিয়ে নেওয়ার পথ প্রশস্ত করা।

দু দফায় জাসদের সরকারে অংশগ্রহণ রাজনৈতিক বিবেচনায় সময়োপযোগী ছিল। ঐক্যমতের সরকার ও মহাজোটের সরকার কর্নেল তাহেরের প্রহসনের বিচারকে অবৈধ বলে রায় দেওয়া, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধের বিচার, বিশ্ব ব্যাংকের অন্যায় আবদারের কাছে মাথা নত না করে নিজস্ব উদ্যোগে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণে ঐতিহাসিক অবদান রেখেছে। আধুনিক বাংলাদেশ নির্মাণে এগুলোসহ অন্যান্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিশ্চয়ই মাইলফলক হয়ে থাকবে।

তবে এটা লক্ষ্যণীয় যে ১৯৯৬, ২০০৯ ও ২০১৪ সালের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ঐক্যমতের সরকার ও মহাজোটের সরকারের রূপ যুুক্তফ্রন্ট নয়। মূলত তা আওয়ামী লীগ সরকারেরই সম্প্রসারণ মাত্র। প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তথা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব। বাকি ১৩ দলের নেতৃত্ব তাকে অনুসরণ ও প্রচার করেন মাত্র।

জোট সরকারের এহেন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার কারণে মহাজোটের কোনো শরিক দলের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক বিকাশের ও অবদান রাখার সুযোগ নেই। এমনকি আওয়ামী লীগেরও রাজনৈতিক-সাংগঠনিক বিকাশ প্রশ্নের সম্মুখীন। শুধু তাই নয়, এ কারণে ১৩ দলের কোনো নেতা-কর্মী মানসিকভাবে নিজেদেরকে সরকারের শরীক হিসেবে ভাবতে পারছেন না, যদিও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি-ব্যর্থতার রাজনৈতিক দায়-দায়িত্ব সবাইকেই বহন করতে হচ্ছে, হবে।

এ ধরনের অবস্থায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) একদিকে নিজস্ব রাজনৈতিক স্বকীয়তা হারাতে বসেছে, অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান জনবিচ্ছিন্নতার শিকার হচ্ছে। সরকারের প্রধান শরীক আওয়ামী লীগ থেকে আলাদা জাসদের কোনো নিজস্ব ভূমিকা দেশবাসীর কাছে দৃশ্যমান নয়। যে কারণে দলের আলাদা অস্তিত্বের যৌক্তিকতা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন।

এটা ঠিক যে, ১৯৯৭ ও ২০১২ সালে জাসদ সরকারে অংশগ্রহণ করায় জাসদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের নীতি চর্চা করতে না পারা ও সরকার পরিচালনাকারী মূল দলের যান্ত্রিক অনুসরণ ও প্রশ্নহীন সমর্থনের কারণে জাসদ উল্লেখযোগ্য কোনো অর্জন করতে পারেনি। নিকট অতীতে তার প্রকাশ দেখা গেছে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের জয়লাভের পর। ১৯৯৭ সালে সৃষ্ট প্রাণচাঞ্চল্য তখন স্তিমিত হয়ে যায় এবং ক্ষমতার সুবিধাভোগী ব্যক্তিবর্গ কোনো কারণ ছাড়াই দল ছেড়ে গিয়ে আলাদা জাসদ গঠন করেছেন।

জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট রাজনীতির ত্রুটিপূর্ণ কর্মকৌশলের কারণে এক ভয়াবহ রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। মাঠের প্রধান বিরোধী দলের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, সাম্প্রদায়িক, প্রতিশোধমূলক, ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতির কারণে তারা জনগণের আস্থাভাজন নয়। তাই সরকারের যে সব নীতি ও কর্মকাণ্ড অগণতান্ত্রিক ও জনস্বার্থবিরোধী নীতি, সে সবের বিরুদ্ধে তারা বিশ্বাসযোগ্য রাজনৈতিক প্রতিবাদ সংগঠিত করছে না ও করতে পারছে না। অন্য কোনো অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলও সে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ফলে জনগণের মনে জমে থাকা ন্যায্য ক্ষোভ বিপথে চালিত হবার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) তার সমৃদ্ধ রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা দিয়ে এ ভয়াবহ শূন্যতা পূরণ করতে পারে। বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য জাসদকে মন্ত্রিসভা ও ১৪ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে এসে জাতীয় সংসদের ভেতরে ও বাইরে কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের মাধ্যমে রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসার জন্য আমি এ কাউন্সিলের কাছে প্রস্তাব করছি। এর মাধ্যমে শুধু জাসদের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক বিকাশই নিশ্চিত হবে না, দেশও এক অনিশ্চিত যাত্রার বদলে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যাভিমুখী হবে।

গোপন ব্যালটের মাধ্যমে জাসদ জাতীয় কাউন্সিলকে এ বিষয়ে ঐতিহাসিক রায় দেবার জন্য আমি বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।

আমার এ বক্তব্য লিখিত আকারে সম্মানিত কাউন্সিলরদের কাছে পাঠানোর অনুমতি দেবার জন্য দলের স্থায়ী কমিটিকে ধন্যবাদ। অনেকেই টেলিফোনে ও লিখিতভাবে তাদের মতামত দিয়েছেন, তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তাদের কারও কারও উত্থাপিত কয়েকটি প্রশ্নের জবাব এ কাউন্সিলে তুলে ধরতে চাই।

সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি এসেছে তা হল, এ প্রস্তাব গ্রহণ করার এটা উপযুক্ত সময় কি না। আমার মতে, সবচাইতে উপযুক্ত সময় ছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়রির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে। আমি জাতীয় কমিটিতে এ প্রস্তাব উত্থাপন করে সিদ্ধান্তের জন্য বিশেষ কাউন্সিল আহ্বান করার অনুরোধ করেছিলাম। তা হয়নি। আবার যখন ২০১৫ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে বিএনপি-জামাত আন্দোলনের নামে আগুন সন্ত্রাসের তাণ্ডবলীলা চালায় তখন আমি এ প্রস্তাব স্থগিত রাখি।

এখন দেশ মোটামুটি স্থিতিশীল। এখনই এ প্রস্তাব গ্রহণ করার উপযুক্ত সময়। কারণ যখন দেশ ও সরকার অস্তিত্বের হুমকির মুখে পড়বে তখন যদি আমরা সরকার ও ১৪ দল ত্যাগ করি সেটা হবে সুবিধাবাদিতা। আমার প্রস্তাবের উদ্দেশ্য হচ্ছে, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের বিকল্প একটি গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তির বিকাশ ঘটানো– গতানুগতিক অসুস্থ ধারার রাজনীতির অনুকরণে সরকারের সঙ্গে উদ্দেশ্যমূলক ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি করে সরকার থেকে বিদায় নেওয়া নয়। জাতীয় কাউন্সিলে সুচিন্তিত রাজনৈতিক-সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেই দেশ ও দলের স্বার্থে সংসদের ভেতরে ও বাইরে কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা নেওয়া; আকস্মিক ঘটনা ঘটানো নয়।

সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়ার কারণে জনগণকে নিয়ে রাজপথে লড়াই করতে হতে পারে, সেটা রাজনীতির ব্যাকরণের পরিপন্থী নয়। যত দিন সরকার দাপটের সঙ্গে দেশ শাসন করবে তত দিন একসঙ্গে থাকব আর বেকায়দায় পড়লেই আমরা সরকার ত্যাগ করব, এ ধরনের রাজনীতি সমর্থনযোগ্য নয়।

আমি আবারও কাউন্সিলরদের প্রতি এ প্রস্তাব সমর্থনের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে এ প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। আসুন, দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা এবং গণতান্ত্রিকভাবে গৃহীত সিদ্ধান্ত ঐক্যবদ্ধভাবে বাস্তবায়ন হয়, অর্থাৎ গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি যেন আমরা সবাই মেনে চলি তা নিশ্চিত করি।