প্রসঙ্গ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা আন্দোলন

জহিরুল হক মজুমদার
Published : 15 March 2016, 05:16 AM
Updated : 15 March 2016, 05:16 AM

কয়েক বছর ধরেই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জনগণের প্রধান আগ্রহ এবং আবেগের জায়গা দখল করে আছে। ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট এবং অনলাইন মিডিয়াগুলোর দৃষ্টিও মূলত সেদিকে নিবদ্ধ। এ রকম বড় মাত্রার ঘটনার পাশাপাশি কিছুটা হলেও মিডিয়া এবং জনগণের দৃষ্টি কেড়েছে গত বছর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের 'নো ভ্যাট অন এডুকেশন' আন্দোলন। অভিভাবক এবং সমাজের চোখে সুস্থির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্দোলনমুখর হয়ে উঠেছিল টিউশন ফিএর উপর সরকার-আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে। দেরিতে হলেও এই আন্দোলনের একটি মূল্যায়ন সামাজিক প্রয়োজনেই অত্যন্ত জরুরি।

সমাজের এক শ্রেণির শিক্ষিত মানুষের মধ্যে ছাত্রআন্দোলনকে শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্টকারী কর্মকাণ্ড হিসেবে দেখার প্রবণতা রয়েছে। সম্ভবত এ কারণে যে, ছাত্রআন্দোলনের কারণে অনেক সময় শিক্ষায়তন বন্ধ থাকে, সাময়িকভাবে শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাহত হয়। এছাড়া আন্দোলন রাস্তা পর্যন্ত গড়ালে ভাঙচুর কিংবা যানজটের মতো নাগরিক দুর্ভোগের ব্যাপারও ঘটে থাকে। কিন্তু যারা সমালোচকরা বোধহয় এই ধারণা পাশ কাটিয়ে যেতে চান যে, 'শিক্ষা আন্দোলন' ছাত্রআন্দোলন এবং ছাত্ররাজনীতিরই একটি বড় অংশ এবং ছাত্ররাজনীতি মুলত শিক্ষা-কেন্দ্রিক হওয়া উচিৎ।

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ছাত্রআন্দোলনের একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে ছাত্রদের শিক্ষা-সংক্রান্ত অধিকারগুলো। যদিও আমাদের দেশের মতো প্রথাগত ছাত্রআন্দোলন পৃথিবীর অনেক দেশেই নেই এবং রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনও অনুপস্থিত। কিন্তু উন্নত অনুন্নত প্রায় সব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ রয়েছে। এসব ছাত্র সংসদে নির্বাচন হয় এবং সংসদের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ছাত্রছাত্রীরা তাদের দাবি-দাওয়া পেশ করে। ছাত্র সংসদের বাইরেও অনেক সময় গুরুতর ইস্যুতে ছাত্রআন্দোলন দানা বাঁধে ভিন্ন ছাত্র-নেতৃত্বের মাধ্যমে। অনেক সময় সে সব আন্দোলন সারা পৃথিবী কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। বেতন বা টিউশন ফি বৃদ্ধির কোনো কোনো আন্দোলন এমন আলোড়ন তুলেছে।

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সব সময় ছাত্র-বেতন বৃদ্ধিবিরোধী এক ধরনের চাপ অব্যাহত রেখেছে বাম ছাত্র সংগঠনগুলো। শিক্ষকদের একাংশও তাদের নৈতিক সমর্থন দিয়ে থাকেন। ফলে এখানে 'ছাত্র-বেতন' খাতে প্রদেয় অর্থের পরিমাণ কর্তৃপক্ষ বৃদ্ধি করে না বটে, কিন্তু অন্যান্য ফি বাড়িয়ে কিছুটা হলেও রাষ্ট্রের বরাদ্দকৃত অর্থের সঙ্গে নিজস্ব আয় দেখিয়ে থাকে।

খুশি হয় রাজনৈতিক সরকারগুলো। নব্বই-উত্তর গণতান্ত্রিক যুগের সরকারগুলো সব সময় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব আয় বৃদ্ধির উপর চাপ প্রয়োগ করে আসছিল, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে বলে মনে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন, শিক্ষকদের আলাদা বেতন স্কেল কিংবা কখনও শিক্ষকদের সামান্য ভাতা বৃদ্ধির ব্যাপারেও বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় বাড়ানোর নসিহত প্রদান নব্বই-উত্তর সরকারগুলোর স্থায়ী অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা আইন দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রত্যেকটি আমাদের জাতীয় সংসদে পাশকৃত। প্রত্যেকটির আইন অনেকাংশেই অন্যটির সঙ্গে মিল রেখে করা হয়েছে। আবার কিছু কিছু অমিলও রয়েছে। সে জন্য সরকারি বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এই রকম একক শব্দে বললেও আইনি কাঠামোর ভিন্নতা রয়েছে প্রত্যেকটির। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট নেই। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বলা হয় 'সিণ্ডিকেট', আবার কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে 'রিজেন্ট বোর্ড' বলা হয়। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রেজারার বা প্রো-উপাচার্য পদ রয়েছে। কোথাও কোথাও উপাচার্যই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, প্রো-উপাচার্যের তেমন ক্ষমতা নেই। আবার কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে উপাচার্য এবং প্রো উপাচার্যের কাজ আলাদাভাবে বলা আছে।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনগুলোর নামেও রয়েছে ভিন্নতা, তাদের বিষয়বস্তুর মতোই। এর কোনোটা 'অর্ডার', কোনোটা 'অ্যাক্ট', আবার কোনোটা 'অর্ডিন্যান্স'। যেমন, দ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট ১৯৭৩, দ্য ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি অর্ডিন্যান্স ১৯৬১, দ্য রাজশাহী ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট ১৯৭৩।

অন্যদিকে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটি নির্দিষ্ট আইনের অধীনে পরিচালিত হওয়ায় তারা কাঠামোগতভাবে অভিন্ন এবং তাদের একটি অভিন্ন মূল্যায়ন, সফলতা, বিফলতা ও বিচ্যুতির মাপকাঠিতে দাঁড় করানো অধিকতর সহজ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো 'বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০'এর অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। এর আগে 'বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৯২'এর অধীনে পরিচালিত হত, যা নতুন আইনের পর রহিত করা হয়েছে।

সরকারি বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অরাজনৈতিক মিলিয়ে ছাত্রআন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরনো। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণআন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণআন্দোলন হয়ে এক-এগারোর সামরিক উর্দি-পরিহিত বেসামরিক সরকারবিরোধী আন্দোলনের কৃতিত্ব বহুলাংশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রাপ্য, বিশেষ করে ছাত্রসমাজের।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্ররা এই প্রথম সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করল। যদিও এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নব্বইএর দশক থেকে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে এবং তাদের সামনে একটি গণতান্ত্রিক এবং আপাত সুস্থির সময় ছিল, তারপরও এক-এগারোর উর্দি-পরা প্রলম্বিত অবৈধ তত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে তাদের ছাত্র সমাজের কোনো অবস্থান চোখে পড়েনি। এর কারণ সম্ভবত এই যে, এসব বিশ্ববিদ্যালয় সব সময় অরাজনৈতিক পরিবেশের নিশ্চয়তা দিয়ে আসছিল এবং তাদের ছাত্র ও অভিভাবকরা একে একটি ইতিবাচক পরিবেশ হিসেবে গ্রহণ করছিল। কিছু কিছু মেধাবী ছাত্রের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রণোদনাও ছিল এই রাজনীতিমুক্ত পরিবেশ।

তবে রাজনীতিমুক্ত পরিবেশ কথাটাই একটু প্রশ্নবোধক, আধুনিক রাষ্ট্র এবং সরকার কাঠামোর ভিতরে অবস্থানকারী যেকোনো নাগরিকের জন্য। যে কোনো সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে গ্যারান্টিযুক্ত রাজনীতিমুক্ত পরিবেশ নির্মাণ অবান্তর, হাস্যকর। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বিভিন্ন দাবি এবং অধিকার আদায়ের বিষয় কেন্দ্র করে এক ধরনের রাজনীতি সব সময় দাঁড়িয়ে যায় সাংগঠনিক জৈবিকতা (Biology of the Organization) এবং মিথস্ক্রিয়ার ভিতর দিয়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এটি আরও বড় সত্য। সম্পূর্ণ রাজনীতিমুক্ত পরিবেশের মধ্যেই ছাত্ররা সরকার আরোপিত ৭.৫ শতাংশ ভ্যাটের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছে, সংগঠিত হয়েছে এবং আন্দোলন সফল করেছে।

এই আন্দোলনের লক্ষণীয় ইতিবাচক দিক ছিল সুশৃঙ্খলা ও দৃঢ়তা। ছাত্ররা টানা ছয়দিন আন্দোলন করেছে, কোনো ছেদ ছাড়াই, যা তাদের দৃঢ়তার পরিচয়। শহরের বিভিন্ন মোড়ে সমাবেশ করে তারা জনগণকে তাদের দাবির কথা জানান দিয়েছে। নিজেদের পরবর্তী কার্যক্রম জানান দেওয়া, সমাবেশের ভিডিও আপলোড করা, অনুপ্রবেশকারীদের আক্রমণ কিংবা স্যাবোটাজ সম্পর্কে সতর্ক করা, এসব বিষয়ে জানান দেওয়ার জন্য তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক ব্যবহার করেছে দক্ষতার সঙ্গে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যে কোনো আন্দোলনকে এক ধরনের বিশ্বমাত্রা দিয়ে থাকে, সে আন্দোলনের মাত্রা যতই ছোট হোক না কেন।

লক্ষণীয় নেতিবাচক দিক ছিল ইতিহাস সম্পর্কে অসচেতনতা। "৫২ এ রাজাকাররা মেরেছে, এবার তোরা মারছিস" এই জাতীয় শ্লোগান থেকে রাজনৈতিক এবং ইতিহাস-জ্ঞানের মান সুস্পষ্ট। এটি ব্যক্তি-ছাত্রের দোষ নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষা-চেতনা, কারিকুলাম এবং সচেতনতা চর্চার পরিবেশ তারই জ্বলন্ত প্রতিফলন, যা পুনঃবিবেচনা এবং সংস্কারের দাবি রাখে। এছাড়া "জয় বাংলা VAT সামলা" এই জাতীয় শ্লোগানকেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।

সবচেয়ে আলোড়ন তুলেছে একজন ছাত্রীর হাতে ধরা সেই প্ল্যাকার্ডটি "দেহ পাবি, মন পাবি কিন্তু VAT পাবিনা"। অনেকেই গেল গেল বলে রব তুলেছেন এবং অশ্লীলতার অভিযোগ এনেছেন। একজন নারীর হাতে এই জাতীয় একটি প্ল্যাকার্ড দেখে মুহূর্তের মধ্যে আমাদের নগরবাসীর একাংশ এর মধ্যে যৌনতা খুঁজে পেয়েছে যা সম্পূর্ণ আরোপিত মনে হয়। একজন পুরুষের হাতে থাকলে হয়তো বাংলা ছবির ভিলেনের উদ্দেশ্যে নায়িকার এই চেনাজানা উক্তি জনগণের মধ্যে হাস্যরস উদ্রেক করেই শেষ হয়ে যেত। এখানে সমাজের এক শ্রেণির মানুষের লিঙ্গ-বৈষম্যমূলক এবং লিঙ্গভিত্তিক ন্যায়-অন্যায় নির্ধারণী মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে।

মনে রাখা প্রয়োজন, শ্লীলতা-অশ্লীলতা ব্যাপারটি আপেক্ষিক এবং সাংস্কৃতিক মনোভঙ্গির উপর নির্ভর করে। ক্যানাডার কুইবেক প্রভিন্সে টিউশান ফি বৃদ্ধি-বিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্রছাত্রীরা নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে, যে পরিমাণ নগ্নতা তাদের সমাজেও প্রাত্যহিক নয়। তারা এই পদ্ধতি গ্রহন করেছে এটা বুঝাতে যে, তাদের কিছু নেই, তাদের কাছে বেশি চাওয়া ঠিক নয়।

সবচেয়ে বড় যে সীমাবদ্ধতা এই আন্দোলনের চোখে পড়েছে তা হচ্ছে, আন্দোলনটি মূলত টিউশান ফিএর উপর সরকার-নির্ধারিত ভ্যাট-বিরোধী। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক আগে থেকেই উচ্চ টিউশন ফি নিচ্ছিল। এই ফিএর বিরুদ্ধে ছাত্রদের কখনও আন্দোলন করতে দেখা যায়নি। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-অবকাঠামো একেবারেই অনুন্নত। এই বিষয়েও ছাত্রআন্দোলন চোখে পড়েনি। তাহলে কি ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা-সংক্রান্ত দাবি-দাওয়া নেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে?

এমনটি হওয়ার কথা নয়। কোথাও সচেতনতার অভাব রয়েছে।

'বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০'এ ছাত্র সংসদের বিধান রাখা হয়নি। এটা এই আইনের একটি অসম্পূর্ণতা। যে ছাত্রআন্দোলন আজকে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হয়েছে, কোনো না কোনো সময় এ ধরনের আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ছাত্র সংসদবিহীন তাৎক্ষণিক নেতৃত্বের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত করতে পারে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ সংশোধন করে সেখানে নির্বাচিত ছাত্র সংসদের বিধান করা উচিৎ।

গত কয়েক বছরে বিশ্বব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-কেন্দ্রিক যে ছাত্রআন্দোলন হয়েছে তার সব কটি ছিল টিউশন ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ছাত্রআন্দোলন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (নভেম্বর ২০১৪), কানাডা (ফেব্রুয়ারি, ২০১২) এবং গ্রেট ব্রিটেন (নভেম্বর, ২০১০), অস্ট্রেলিয়া(নভেম্বর, ২০১০) এই আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছে। তুলনামূলক কম অনুন্নত দেশ যারা এই আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছে সেগুলো হচ্ছে, মেক্সিকো (মার্চ, ১৯৯৯), তাইওয়ান (জুন, ২০১৫), কেনিয়া (মে, ২০১৪) নাইজেরিয়া (জুন, ২০১৪)।

৩ জুন, ২০১৫ (তাইওয়ান):

'শিক্ষা পণ্যকরণ-বিরোধী জোট'এর ছাত্ররা রাজধানী তাইপের শিক্ষা মন্ত্রণালয়য়ের সামনে বিক্ষোভ করে। তেইশটি বিশ্ববিদ্যালয় মন্ত্রণালয়ের কাছে ১.৫ শতাংশ থেকে শুরু করে ৩.৫ শতাংশ পর্যন্ত টিউশন ফি বৃদ্ধির আবেদন করেছিল।

নভেম্বর ১৯, ২০১৪ (ইউএসএ):

ইউনিভারসিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সানফ্রান্সিসকোতে ছাত্ররা জোটের দশটি ভিন্ন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ডের টিউশন ফি বৃদ্ধি-সংক্রান্ত সভার হলের বাইরে বিক্ষোভ করে। তারা বছরে ৫ শতাংশ হারে মোট ২৫ শতাংশ টিউশন ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানায়। তারা বোর্ডের সদস্যদের হলে ঢুকতে বাধা দেয়, ভাঙচুর করে। একই রকম বিক্ষোভ হয় ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, ডেভিসে এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলিতে।

জুন ৬, ২০১৪ (নাইজেরিয়া):

নাইজেরিয়ার ইউনিভার্সিটি অব লাগোসের ছাত্ররা টিউশন ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে ক্যাম্পাস অবরোধ করে যান চলাচলে বাধা দেয়। তারা দ্রুত অতিরিক্ত টিউশন ফি প্রত্যাহারের দাবি জানায়।

মে ২০, ২০১৪ (কেনিয়া):

কেনিয়াজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা টিউশন ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। তারা রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনে এবং বলে যে, রাজনীতিবিদের পকেট ভর্তি করার জন্য তারা অতিরিক্ত টিউশন ফি দিতে পারবে না। ফি অর্ধেক না করা পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া এবং সংঘর্ষ হয়।

নভেম্বর ২৪, ২০১০ (অস্ট্রেলিয়া):

নিউক্যাসল শহরে স্কুল, কলেজ এবং ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা টিউশন ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদ করে এবং রাস্তায় নেমে আসে।

নভেম্বর ১০, ২০১০ (ইউকে):

প্রায় পঞ্চাশ হাজার ছাত্রের একটি মিছিল টিউশন ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে লন্ডন শহরের রাস্তায় বিক্ষোভ করে। কনজারভেটিভ পার্টির ডেভিড ক্যামেরন সরকার রাজস্ব ব্যয় কমানোর জন্য শিক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে টিউশন ফি বাড়ানোর প্রস্তাব করে যা আগের চেয়ে প্রায় তিন গুণ। বিক্ষোভকারীদের একাংশ কনজারভেটিভ পার্টির অফিস বিল্ডিংএর কাঁচ ভাঙচুর করে।

মার্চ ১১, ১৯৯৯ (মেক্সিকো):

টিউশন ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে মেক্সিকোর UNAM বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্র বিক্ষোভ করে মেক্সিকো সিটিতে। তারা বর্ধিত টিউশন ফি প্রত্যাহারের দাবি জানায় এবং সড়ক অবরোধ করে।

কানাডার আন্দোলনসমূহ:

ফি-বিরোধী ছাত্রআন্দোলনে সবচেয়ে এগিয়ে আছে কানাডার কুইবেক প্রভিন্স। সেখানে ১৯৯৬ এবং ২০১২ তে ছাত্রআন্দোলন সংগঠিত হয়। ২০০৫এ-ও ছাত্র ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয় কুইবেকে, তবে সেটা লিবারেল সরকারের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত অনুদানকে ঋণে পরিবর্তন করার প্রতিবাদে, যাতে ছাত্রদের শিক্ষা-ঋণের বোঝা বেড়ে যাওয়ার আশংকা ছিল। এই আন্দোলনও অনেক জোরালো ছিল।

মনট্রিয়েল, ম্যাকগিল, কনকরডিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং আরও কিছু টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির প্রায় আড়াই লাখ শিক্ষার্থী ধর্মঘট এবং ক্লাস বয়কটে অংশ নেয়। রাস্তায় মিছিল করে প্রায় এক লক্ষ শিক্ষার্থী। পরে শিক্ষার্থীদের সংগঠনের সঙ্গে সরকারের চুক্তির ভিত্তিতে আন্দোলন স্থগিত হয়, যদিও সব সংগঠন চুক্তি মেনে নেয়নি।

সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে ২০১২ সালের ছাত্রআন্দোলন। কুইবেক প্রভিন্সের লিবারেল সরকার পাঁচ বছর মেয়াদী টিউশন ফি বৃদ্ধির প্রস্তাব করলে ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পরে। দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন চলে ২০১২এর ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। লক্ষ লক্ষ ছাত্র ক্লাস বয়কট এবং ধর্মঘটে অংশ নেয়। আন্দোলনের তীব্রতা অনুসারে কখনও হাজার আবার কখনও লক্ষ ছাত্র রাস্তা অবরোধ করে, মিছিল করে। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস, লাঠিচার্জ এবং সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে, গ্রেফতার করে।

এ ঘটনায় শিক্ষামন্ত্রী পদত্যাগ করেন। আন্দোলন দমনের জন্য কুইবেকের ন্যাশনাল এসেম্বলি 'বিল ৭৮' পাশ করে, যাতে পুলিশের অনুমতি ছাড়া মিছিল বা সমাবেশ করলে ব্যক্তি বা সংগঠনের উপর মোটা জরিমানার বিধান করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে 'টিউশন ফ্রিজ' অর্থাৎ টিউশন ফি বৃদ্ধি করা হবে না মর্মে সিদ্ধান্ত হলে আন্দোলন শেষ হয়।

সুতরাং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ আন্দোলনই টিউশন ফি বৃদ্ধি-বিরোধী আন্দোলন। কিন্তু বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের আন্দোলন ছিল ভ্যাট-বিরোধী, যা ব্যতিক্রমী কিন্তু বৈশ্বিক ছাত্র আন্দোলনের ভাবধারার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তারপরও শিক্ষা আন্দোলনের ধারায় শান্তিপূর্ণভাবে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছে যা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

শিক্ষা আন্দোলন ছাড়া ছাত্রদের অধিকার আদায় হবে না এ সচেতনতার আরও বিকাশ ঘটবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, এ আশা রাখি। সরকারও শিক্ষার উপর ভ্যাট প্রত্যাহার করে শিক্ষাকে পণ্যায়নের ধারণা থেকে যে ফিরে এসেছেন, সে জন্য সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।