উপমহাদেশে শান্তি কি অলীক চিন্তা

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 13 March 2016, 04:41 AM
Updated : 13 March 2016, 04:41 AM

পাক-ভারত সীমান্তে যখন পা রাখি তখন বিকেলের সূর্য প্রায় অস্তাচলে। অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির দেখে ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছিল, কী আশ্চর্য এই রাজনীতি। যে শিখরা ভারতকে যুদ্ধে জেতায়, যাদের শৌর্যে-বীর্যে ভারত গৌরবের শিখরে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল এক সময়। সে এক নিদারুণ ইতিহাস।

ইন্দিরা গাঁধীর মতো দেশপ্রেমিক প্রধানমন্ত্রী ও কঠিন নেতার সঙ্গে শিখদের ভুল-বোঝাবুঝি এমন এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, মনে হচ্ছিল আর কোনো দিন এ সম্পর্ক আগের মতো হবে না। শিখ ধর্ম যেমন কঠিন তেমনি নিয়ামনুবর্তী। এবার গিয়ে দেখলাম তারা কতটা ধার্মিক আর নীতি মেনে চলেন। বলতে দ্বিধা নেই, এমন সেলফ-সার্ভিসড বা নিজের কাজ নিজে করার ধর্মাশ্রম আগে দেখিনি। শয়ে শয়ে মানুষ খাটছেন। সবাই যার যার ইচ্ছে আর মনের তাগিদে এসে সেবা কাজ করছেন। কেউ রান্নায়, কেউ পরিষ্কারে, কেউ-বা পাহারায়। যারা জুতো রাখার দায়িত্বে তারাও স্বেচ্ছাসেবী।

মধ্যবয়সী এক মহিলা, মুখ দেখলেই বোঝা যায় তিনি অবস্থাপন্ন ঘরের, আমার জুতো জোড়া ফেরত দেওয়ার সময় তার একটা ছবি তুলতে চাইলে আপত্তি জানালেন। জানতে পারলাম, তার স্বামী প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, তিনি সুখী স্ত্রী। নিজ থেকে এই কাজ করেন।

মানুষের জুতো রাখার মতো কাজে যে ধর্ম প্রেরণা দেয়, তার দুটো দিক তো থাকবেই। এক, আকর্ষণের চুম্বক পাওয়ার। আরেকটি হল, এর নিয়ম ও নিষ্ঠার পাশাপাশি কঠোরতা। সে জায়গাটা পুুঁজি করে সতবন্ত সিং ভিন্দ্রেনওয়ালারা স্বর্ণমন্দিরে ঢুকে জঙ্গিবাদী কাজ চালাতে চেয়েছিল। ইন্দিরা গাঁধী তা হতে দেননি।

অবশ্য তার পরিণতিতে তাঁকেও জানে বাঁচতে দেওয়া হয়নি। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস!

যেদিন তিনি প্রাণ হারান সেদিন সন্ধ্যায় আমি বর্ডার পার হয়ে ভারত যাই। চারদিকে থমথমে অবস্থা। কলকাতা ছাড়া সব জায়গায় তাদের জান হাতের মুঠোয়। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার সেই অপারেশনে ভারতের ঐক্য টিকে গেলেও ইন্দিরা প্রাণ হারান। পরে বুটা সিংহ ও অন্যান্য শিখ নেতাদের ইজ্জত ধুয়ে গালে জুতোর বাড়ি খেয়ে মাথায় জুতো নিয়ে সমাজে ফিরতে হয়েছিল।

এমন কঠিন শিখ সম্প্রদায়ে খালিস্তান আন্দোলন তখন তুমুল জনপ্রিয়। বিদেশে যে কোনো খেলা বা সুযোগ পেলেই তারা খালিস্তানের পতাকা হাতে মাঠে ছুটতেন। বলাবাহুল্য, সে দূর্যোগে পাকিস্তানও চুপ করে বসে ছিল না। পাকিস্তানি মদদে শিখদের বিচ্ছিন্নতাবোধ চাগিয়ে উঠলেও বেশিদূর গড়াতে পারেনি। কারণ মহাত্মা গাঁধীকে হত্যার পর ভারতীয়রা যেমন নেতাদের উদারতা ও সহিষ্ণুতা দেখেছিল, বহু বছর পর ইন্দিরার বেলায়ও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বড় ছেলে রাজীব যেমনি মনোহর তেমনি পরিমিত। দুদিন পর টিভি ও অন্যান্য মিডিয়ায় তিনি ও তাঁর দল হানাহানি ও হিংসার বিরুদ্ধে বলে সাময়িক উত্তেজনা থামানোর পাশাপাশি ভারতীয় ঐক্য ও সংহতির যে উপকার করেছিলেন তাতে শিখ ও পাঞ্জাব এখনও ভারতের অনিবার্য অংশ।

এবার দেখলাম পাক-ভারত সীমান্ত সামলাচ্ছে তারাই। লাহোর থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরের এই সীমান্ত জনপদে পতাকা-বিনিময় ও সমবেত জনতার উত্তেজনা সামলানোর কাজে নিয়োজিত এদের দেখে কে বলবে একদা এরা প্রায় ম্বাধীন হবার পথে পা বাড়িয়েছিল।

উভয় দিকে সমবেত পাকিস্তানি ও ভারতীয়দের ভেতর অার যাই থাকুক, দেশপ্রেমের ঘাটতি ছিল না। তারা নিজ নিজ অবস্থান ও দেশের ব্যাপারে একরোখা। একমাত্র অামরাই এখনও নিজেদের কথা ভুলে এই দুদেশের রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করে চলেছি। যারা দেশে ভারতীয় রাজনীতির বাহক বা নানা কারণে এদের লবিং মেনে চলেন, তারা কেন হিংসা ও বিবাদ ভুলে সমঝোতার পথ বেছে নিতে পারেন না?

যারা কংগ্রেসেের নেতাকে মারল, যারা ইন্দিরার মতো নেতাকে খুন করল তাদের মাফ করে দেওয়ার ভেতর যে উদারতা ও অতীত দূরে সরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা সেটা অামরা মানিনি। একই সঙ্গে যারা অামাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির দুশমন তারাও তাদের প্রতিশোধ-স্পৃহা দমিয়ে জাতীয় স্রোতে অাসেনি। যে কারণে একাত্তরের হানাহানি ও হিংসাই এখনও রাজনীতির মূল হাতিয়ার। এভাবে চললে এক সময় নতুন প্রজন্ম হয়তো জানতে চাইবে এই স্বাধীনতা অাসলেই জরুরি ছিল কি না।

ভারতের কথা না হয় বাদ দিলাম, পাকিস্তানের অংশেও তাদের নেতা জিন্নাহ ও তাদের পতাকার গৌরব পতপত করে উড়ছিল। এত লড়াই মারামারি হানাহানির পরও পাকিস্তানের ঐক্য টাল খায়নি। অামাদেরই যত অাপদ। যে কোনো দেশের সীমান্তে গিয়ে দাঁড়ালে বাংলাদেশিদের মনে বিকার এসে ভীড় করে। কারও কাছে ভারত দেবনগরী, আবার কারও কাছে পাকিস্তান মানে বেহেস্ত!

জাতীয় রাজনীতি যত দিন এর বিহিত না করবে তত দিন সুরাহা মিলবে না। অামার মনে হয়েছে বড় বড় নেতাদের অকালমৃত্যু ও ইতিহাস নিধনের কুফলে শাসনভার এমন সব নেতাদের হাতে গিয়েছে যাদের অনেকে এদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না। অার এক দল রাগে অপমানে এদের উৎখাত করাটাই দেশপ্রেম বলে মেনে নিয়েছেন। যে কারণে কোনো বিষয়ে অামরা অাসলে একক কোনো জাতিসত্তা নই।

সীমান্তে যখন গোধুলি তার অালো দিয়ে রাতের সম্ভাষণ জানাচ্ছিল, পতাকা মুড়ে চৌকিতে ফেরত যাওয়া উভয় দেশের সেনাদের দেখলেই বোঝা যায় তারা ক্লান্ত। আর কাঁহাতক! যারা দেখতে যায় তারা কয়েক ঘণ্টার অতিথি। তাদের উত্তেজনা সাময়িক। যারা পাহারাদার তাদের জীবন ও পরিবারের কথা কেউ ভাবে না। সীমান্ত যখন সুনসান, ভোরে দুপুরে বা গভীর রাতে এরা মুখোমুখি হয় জীবনের। এদের বুকের ভেতর কেবল গুলির অাওয়াজ থাকে, এমন ভাবনা সঠিক নয়। এদের ভেতর ভাববিনিময়, এমনকি দোস্তিও অাছে। রাজনীতি ও শাসকদের হয়ে লড়াই করতে করতে এক সময় পশুর মতো অাচরণে বাধ্য হয় এরা।

অামাদের চেহারা অারও করুণ। একতরফা মার খাওয়া অার কথায় কথায় এর-ওর দুশমন বলে গাল খাওয়া। রাজনীতির কঠিন শিকলে বাংলাদেশের দেশপ্রেম এমন অাটকা পড়েছে যে, এর পরিত্রাণ কোথায় কেউ জানে না। বহুকাল অাগে শোনা একটি গল্পের কথা মনে পড়ছিল। বলা হয়, যারা ফরাসী কলোনি ছিল, এক সময় তারা অাবার একীভূত হয়ে যায়। যারা পর্তুগিজ বা অন্য কারও উপনিবেশ ছিল, তাদেরও মিলন ঘটে। শুধু নাকি ইংরেজ ভাগ করে দিয়ে গেলে তারা অার এক হতে পারে না।

পাক-ভারত সীমান্তে দাঁড়িয়ে নিজ দেশের কথা ভাবতে ভাবতে মনে হচ্ছিল এই কী অামাদের নিয়তি? কোনো কালেও কি অার কোনো নেতা বা দেবদূত এসে এই তিন দেশের মানুষদের অালাদা অালাদা করে ভালো থাকার মন্ত্র শিখিয়ে দিতে পারবে না? দেশ ও মানুষ কি পরাধীনতামুক্ত হয় হিংসা ও প্রতিশোধ চরিতার্থ করতে? না সামনে এগিয়ে যেতে?

এর উত্তর অামাদের জানা জরুরি।