একটি স্বীকারোক্তির জন্য নয় বছর অপেক্ষা ও তারপর

আমানুল্লাহ কবীর
Published : 29 Feb 2016, 07:23 AM
Updated : 29 Feb 2016, 07:23 AM

মাহফুজ আনাম দোষ স্বীকার করেও বিপদে পড়েছেন। এক ভুল স্বীকার করে আরেক ভুল করলেন। বিপদে এখন কেবল তিনি একা নন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর মনে হয় তিনি বিপদ ডেকে এনেছেন আরও অনেকের জন্য। প্রবল ঝাঁকুনি লেগেছে গোটা সম্পাদকীয় কর্তৃত্ব ও সাংবাদিকতা পেশার নীতিমালায়, যা সাংবাদিক সমাজের মধ্যেই কাঁপুনি সৃষ্টি করেছে। এতদিন মনে হয়েছিল বিষয়টি মাহফুজ আনামকে কেন্দ্র করে মামলা-মোকদ্দমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এখন মনে হচ্ছে, বিষয়টির আওতা আরও বেড়ে যাচ্ছে এবং তা আরও জটিল ও গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে। বিতর্ক কেবল মিডিয়াতেই নয়, ছড়িয়ে পড়েছে রাজনৈতিক মহলসহ সকল মহলে– সারা দেশে। না, সারা দেশে এখন আর সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে সীমান্তের বাইরে– আন্তর্জাতিক মহলেও। নীতিগত বিতর্ক ছাপিয়ে আস্তে আস্তে তা রাজনৈতিক বিতর্কের রূপ নিচ্ছে।

ড. ইউনূসকে কেন্দ্র করে যেমন বিতর্ক শুরু হয়েছিল, এ বিতর্ক অনেকটা তেমনি। দুটি বিতর্কের মধ্যে যোগসূত্রও রয়েছে: কেননা এক-এগারো-উত্তর সময়ে ড. ইউনূস ও মাহফুজ আনাম এক সময় একই মেরুতে অবস্থান নিয়েছিলেন। সুতরাং বর্তমান বিতর্কের দুটি দিক এখন স্পষ্ট– একটি রাজনৈতিক, অপরটি পেশাগত। তাহলে এ বিতর্কের সমাধান কী হবে– রাজনৈতিক, না পেশাগত?

মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে সারা দেশে প্রায় শখানেক মামলা হয়েছে। অভিযোগ রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির। মামলাগুলো করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা। মাহফুজের বিরুদ্ধে কয়েকটি আদালত সমনও জারি করেছে। একটি আদালত অতিউৎসাহী হয়ে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় তার বিরুদ্ধে বেআইনিভাবে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। আইনমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বেআইনি পরোয়ানা প্রত্যাহার করে ওই আদালত পরে সমন জারি করে। 'ডেইলি স্টার'এর সম্পাদক হিসেবে মাহফুজ সম্পাদকীয় সিদ্ধান্তে ভুল করেছিলেন নয় বছর আগে যখন এক-এগারোতে অভ্যুত্থানকারী সরকার ক্ষমতায়।

'ডেইলি স্টার' ও 'প্রথম আলো' দুই সহোদর। এক-এগারোর মাস্টারমাইন্ড ছিলেন জেনারেল মইন ইউ আহমেদ গং এবং তাকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছিলেন সুশীল সমাজের একটি অংশ, যাদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা ছিল বহুল প্রচারিত এ দুটি পত্রিকার সম্পাদকদের। ওই সময় পত্রিকা দুটির ভূমিকা কী ছিল, তা জানতেই যেন মাহফুজের ভুল স্বীকারের অপেক্ষায় নয় বছর কাটিয়েছেন আজকের সমালোচনাকারীরা। কোন মন্ত্রবলে এতদিন তাদের ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলেন দুই শক্তিধর সম্পাদক?

মাহফুজই-বা কেন নয় বছর পর বিবেকের দংশন অনুভব করলেন ভুল স্বীকারের জন্য? না কি এটা তার অপরাধবোধ? তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, নয় বছরে যে জল গড়িয়েছে, তাতে তার গায়ের দুর্গন্ধ ধুয়ে-মুছে গেছে। সুতরাং এখন ভুল স্বীকার করে মহত্বের পরিচয় দিলে বাড়তি কিছু বাহবা পাওয়া যাবে অকুতোভয় সম্পাদক হিসেবে।

কিন্তু গুড়ে বালি ছিটালেন প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। ওই সময়ের ভূমিকার জন্য তিনি মাহফুজের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির অভিযোগ আনলেন। তারপরই শুরু হল মামলার হিড়িক। যারা হুড়োহুড়ি করে মামলা করছে তাদেরও একটা হিসাব আছে। শীর্ষ নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলে ভবিষ্যতে প্রাপ্তিযোগের আশা আছে।

এক-এগারোর সরকারের সময় 'আমার দেশ'এর সম্পাদক থাকার কারণে আমার পক্ষে কাছ থেকে অনেক কিছুই দেখার ও জানার সুযোগ হয়েছিল। অনেকের মতো আমিও বহু ঘটনার সাক্ষী। প্রশ্ন হচ্ছে, ওই সময় সম্পাদক ও সাংবাদিকরা স্বতপ্রণোদিত হয়ে এক-এগারোর সরকারকে সহযোগিতা-সমর্থন প্রদান করেছিলেন, না পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতার কারণে?

দুভাবেই ঘটেছে। কয়েক জন সম্পাদক স্বতপ্রণোদিত হয়ে ওই সরকারকে সহযোগিতা-সমর্থন করেছিলেন– তাদের দুজন গোড়া থেকেই সরাসরি সরকারের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। 'প্রথম আলো' ও 'ডেইলি স্টার', বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় দুটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিক সংবাদপত্র হওয়ার ফলে পত্রিকা দুটির সম্পাদকদ্বয়ের ভূমিকা অন্যান্য সংবাদপত্র ও সম্পাদকদের জন্য এক ধরনের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে। এক-এগারোর কুশলীবদের আচার-আচরণ দেখে মনে হয়েছিল তারা যেন দেশে বিপ্লব ঘটিয়েছে। সমাজের খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার জন্য তাদের অবিমৃষ্য অভিযান রাজনৈতিক নেতানেত্রী, ব্যবসায়ী ও বেসামরিক প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত, তাদের শায়েস্তা করতে হবে, উচ্ছেদ করতে হবে।

দুর্নীতির স্তূপ থেকে ডিজিএফআই সে খবর বের করে সম্পাদকদের হাতে ধরিয়ে দিত, আর তা অতিউৎসাহে ছাপা হত। ডিজিএফআইএর দেওয়া খবর কতটুকু সত্য-অসত্য, সাংবাদিকতার নিয়মনীতি অনুসারে তা যাচাই-বাছাইয়ের বালাই ছিল না। সম্পাদকরা রাতারাতি নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে সেনা গোয়েন্দা সংস্থার বশংবাদ হয়ে পড়লেন। শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়াসহ রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে লুটতরাজ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষের খবর প্রতিদিনই বড় বড় হেডলাইনে প্রকাশিত হতে থাকে। একইভাবে তা প্রচার করে টিভি চ্যানেলগুলোও।

সম্পাদকদের মধ্যে দু-চারজন যে ব্যতিক্রম ছিলেন না, তা নয়। কিন্তু অবাধ্য বলে তাদের ডিজিএফআই মোকাবিলা করতে হয়েছে, তাদের সম্পাদিত পত্রিকাকে খেসারত দিতে হয়েছে। আর বশংবাদ সম্পাদকরা প্রতিদিনই ডিজিএফআই অফিসে হাজিরা দিয়ে তাদের আনুগত্য ঝালাই করে নিতেন। বাংলাদেশে ইতোপূর্বেও সামরিক সরকার এসেছে, কিন্তু কখনও সম্পাদকরা মাছির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে ডিজিএফআই অফিসে হাজিরা দেননি। জেনারেল এরশাদও রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন, কিন্তু সাংবাদিকদের দলে ভিড়াতে পারেননি, যদিও সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। ক্ষমতায় থাকাকালীন এরশাদকে কোনো দিনই জাতীয় প্রেস ক্লাবে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু মইনউদ্দিন-ফকরুদ্দিন কোন জাদুবলে সম্পাদকদের এমনভাবে হাত করতে পেরেছিলেন?

বিশ্লেষণ করলে অনেক কারণ পাওয়া যেতে পারে। তবে এক-এগারোর চক্রের সঙ্গে জড়িত 'ডেইলি স্টার' ও 'প্রথম আলো'এর সম্পাদকরা অন্য সম্পাদকদেরও প্রভাবিত করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, সাংবাদিক সমাজ দ্বিধা-বিভক্ত থাকার ফলে পেশাগত দায়িত্ব পালনে কোনো ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান (Institution) সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পূর্বসূরীদের পেশাগত সততা ও সাহসী ভূমিকার উপর।

এক-এগারোর চক্র ঢালাওভাবে রাজনৈতিক নেতানেত্রী, ব্যবসায়ী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে, রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে এবং তাদের কারাবন্দি করে কী করতে চেয়েছিল, তা স্পষ্ট হলে তাদের সহযোগী সম্পাদকদের ভূমিকাও পরিষ্কার হবে। তারা দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রধান শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করে সংস্কারের নামে তাদের অনুগত রাজনীতিকদের হাতে নেতৃত্ব তুলে দিতে চেয়েছিলেন। তারা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের ব্যবসা থেকে বের করে দিয়ে সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন নতুন ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। তেমনি প্রশাসনেও তারা তাদের বংশবদ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।

মোট কথা, সমাজে তারা একটা নতুন অনুগত এলিট গ্রুপ বা গোষ্ঠী তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যারা সরকার, ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রশাসন চালাবে। এই এলিট গোষ্ঠীর অংশীদার হতে বিভিন্ন মহলের অনেকেই এগিয়ে আসেন, যাদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একটা অংশসহ অন্যান্য বেশ কিছু রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজ ও পেশাজীবীদের অনেকে। নতুন এলিট গোষ্ঠী সৃষ্টির এই প্রক্রিয়াতেই সক্রিয় ছিলেন মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমান এবং তাদের সম্পাদিত পত্রিকা দুটিকে ব্যবহার করেছিলেন প্রতিষ্ঠিত বর্তমান এলিট শ্রেণির নেতৃস্থানীয়দের নির্বাসনে।

পুরো প্রক্রিয়াটাই ছিল জুয়া খেলার মতো, যে খেলায় মইনউদ্দিন-ফকরুদ্দিনের সঙ্গে হেরে গেছেন দুই সংস্কারবাদী সম্পাদকও। মাহফুজ আনাম যাকে ভুল সম্পাদকীয় সিদ্ধান্ত বলছেন, আসলে তা ছিল লালিত বাসনার আলোকে মতাদর্শগত সিদ্ধান্ত। যে কারণে তিনি ও মতিউর রহমান প্রতিষ্ঠিত এলিট শ্রেণির শক্তিধর অংশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন পরিবর্তন সূচনার জন্য।

এ পরিবর্তন সমাজ পরিবর্তনের নয়, ক্ষমতার পরিবর্তন। ক্ষমতার পরিবর্তনের জন্য একজন সম্পাদক ও তার পত্রিকার ভূমিকা থাকতেই পারে। সম্পাদক ও পত্রিকার মতাদর্শগত ভূমিকা থাকা বা কোনো বিশেষ রাজনীতি সমর্থন করা দোষের কিছু নয়। কিন্তু তিনি কি গণতান্ত্রিক শক্তির পরিবর্তে অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক শক্তির ক্ষমতা দখলে সক্রিয় সহযোগী হতে পারেন?

অগণতান্ত্রিক শক্তিকে সহযোগিতা করে মাহফুজ যা করেছেন, তা তাঁর সম্পাদকীয় সিদ্ধান্ত ছিল না, ছিল মতাদর্শগত। আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যা গণতন্ত্র ধ্বংসের জন্য উদ্ধত ছিল। মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে বানোয়াট খবর পরিবেশন করে রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের চরিত্রহনন ও জনসমক্ষে তাদের হেয় প্রতিপন্ন করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। চরিত্রহননের পাশাপাশি ইন্টারোগেশনের নামে তাদের নির্যাতনের জন্য সেনানিবাসে টর্চার সেলও খোলা হয়েছিল। সেই নির্যাতনের ক্ষত নিয়ে কেউ কেউ মারা গেছেন; অনেকে জীবিত আছেন। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর নির্যাতিত রাজনৈতিক নেতারা বিচারের জন্য চিৎকার করেছেন। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসেছে, কিন্তু তাঁরা বিচার পাননি।

জয়ের অভিযোগের মধ্যে সন্তানের আবেগ রয়েছে। সন্তান হয়ে দেখেছেন মায়ের দীর্ঘ বন্দিদশা প্রতিদিন পত্র-পত্রিকায় দেখেছেন তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা ও অপ্রচার। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকে স্বভাবতই ক্ষোভ পুঞ্জিভুত হয়ে ছিল তাঁর মনে, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে মাহফুজ আনামের স্বীকারোক্তির পর। এমনি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ছিল বহু পরিবার যাদের স্বজনরা শিকার হয়েছিলেন জেল-জুলুমের। অনেকেই জেল-জুলুম থেকে বাঁচার জন্য পালিয়েছিলেন দেশ ছেড়ে।

নির্যাতিত ব্যক্তিদের স্বজনদের অভিযোগ ও আহাজারি আমার জানার সুযোগ হয়েছে সম্পাদক হিসেবে– কখনও সামনাসামনি, কখনও টেলিফোনে, কখনও তাদের চিঠিপত্রের মাধ্যমে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই গোপনে চিঠি লিখেছেন জেল থেকে, যেসবের কিছু কিছু 'আমার দেশ'এর চিঠিপত্র কলামে বেনামে প্রকাশিতও হয়েছে। কয়েকটি বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান 'প্রথম আলো' পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধে লিখিত লম্বা অভিযোগ করেন সাক্ষ্য-প্রমাণসহ। টর্চার সেলে নিমর্মভাবে নির্যাতিত ব্যক্তিদের একজন তারেক রহমান। প্রতিদিনই বিশেষত 'ডেইলি স্টার' ও 'প্রথম আলো'তে ছবিসহ খবর ছাপা হত তার দুর্নীতি ও ও দুষ্কর্মের।

এসব খবরের অধিকাংশই ছিল পুনরাবৃত্তি, যেন স্বজনদের একদিনের জন্যও স্বস্তি না দেওয়াই ছিল এর উদ্দেশ্য। সাবেক প্রধানমন্ত্রী তার মা– অসহায়, দুঃস্বপ্নভরা চোখে তার স্ত্রী উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় অস্থির। মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমানকে ফোন করে কিছু হবে না, তাই ফোন করেছিলাম পত্রিকা দুটির স্বত্তাধিকারী লতিফুর রহমানকে। তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক শুরু থেকেই ভালো, কারণ শুরুতে আমি 'ডেইলি স্টার'এর বার্তা সম্পাদক ছিলাম। দীর্ঘক্ষণ কথা হল, সম্পাদকীয় নীতি নিয়েও প্রশ্ন উঠল। কিন্তু তাঁর এক কথা, 'কী ছাপা হবে, না হবে সে দায়িত্ব সম্পাদকের, আমার কিছু করার নেই'। আমাদের কথা শেষ হল তিক্ততার মধ্যে।

এক-এগারোর পর মাহফুজ আনামের ভূমিকা ছিল ক্ষমতার দখলদারদের 'ভাবমূর্তি' ফেরি করা ও নিজের কর্তৃত্ব প্রদর্শন করা। জেনারেল মইন সেনানিবাসে সম্পাদকদের সঙ্গে যে বৈঠক করেন তার আয়োজক ছিলেন মাহফুজ। তিনিই টেলিফোন করে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সম্পাদকদের।

আরেকটি ঘটনা। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। সব সম্পাদক ও টিভি চ্যানেলের কর্মকর্তাদের বৈঠকে ডেকেছেন তার মন্ত্রণালয়ে। মইনুল হোসেনের ফিউডাল মানসিকতার কথা সবারই জানা। তার বক্তব্য ও বাচনভঙ্গির এক পর্যায়ে মাহফুজ আনাম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। টেবিল চাপড়িয়ে উচ্চ কণ্ঠে বললেন, 'এ সরকার আমরা এনেছি। আপনি কে?' মতিউর রহমান তাকে সমর্থন করলেন। আমরা সবাই স্তম্ভিত। মইনুল হোসেনও বুঝতে পারেননি কার সামনে কী বলছেন। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সুর বদলালেন।

মাহফুজ আনামের বিচারের দাবি উঠেছে। দাবি উঠেছে প্রধানত আওয়ামী লীগ মহল থেকে এবং পার্লামেন্টেও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং দুই সম্পাদককে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কথা বলেছেন। বিচারের বিপক্ষেও শক্তিশালী মত রয়েছে। তারা প্রধানত সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ এবং দেশি-বিদেশি কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা। সম্পাদকদের বিচারের আওতায় আনার জন্য প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার ফলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নটি জোরালোভাবে এসেছে।

মাহফুজ আনামের হয়রানি ও বিচারের বিরুদ্ধে যারা, তাদের বক্তব্য– তাহলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হুমকিতে পড়বে। এক-এগারোর মূল ষড়যন্ত্রকারীদের বিচারের সঙ্গে তাদের সহযোগী সম্পাদকদের বিচারের কথা না বলে বিচ্ছিন্নভাবে সম্পাদকদের বিচারের দাবি ওঠায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি হুমকির বিষয়টি প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছে, যা উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ 'ডেইলি স্টার' বন্ধ করে দেওয়ার দাবি তুলেছেন। আওয়ামী লীগের অতীত ইতিহাসে একাধিকবার সংবাদপত্র বন্ধ করার ঘটনা রয়েছে, যে কারণে 'ডেইলি স্টার' বন্ধের দাবিতে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহলে আরও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীসহ কেউ কেউ বলেছেন, আত্মমর্যাদাবোধ থাকলে ভুল স্বীকারের সঙ্গে সঙ্গে মাহফুজ আনাম সম্পাদকের পদ থেকে সরে দাড়াতেন। ইতিহাসের কৃঞ্চ অধ্যায় এক-এগারোর দায় যাদের তাদের বিচার থেকে রেহাই দিয়ে মাহফুজ আনাম ইস্তফা দিলে কিংবা 'ডেইলি স্টার' বন্ধ করা হলেই কি দায়মুক্তি হবে? তাতে বরং ব্যক্তি-বিদ্বেষ, রাজনৈতিক অসহিঞ্চুতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের বিষয়টিই মুখ্য হয়ে হাজির হবে। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, সাংবাদিকরা কি আইনের ঊর্ধ্বে, অপরাধ করলে বিচার হবে না?

এক-এগারোর ষড়যন্ত্রের বিষয়টা যেহেতু জড়িত, সেহেতু ওই ষড়যন্ত্রের মূল নায়কদের বিচারের আওতায় না এনে কেবল তাদের সহযোগী সম্পাদকদের কাঠগড়ায় দাঁড় করালে তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হবে। সরকার যদি এক-এগারোর পুনরাবৃত্তি না চায়, তাহলে ওই ঘটনার মূল নায়কদেরই বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। সামরিক বাহিনী, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, সুশীল সমাজ ও সম্পাদকদের মধ্যে কারা এক-এগারোর ষড়যন্ত্রের সঙ্গেঁ জড়িত ছিল, কার কী ভূমিকা ছিল, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার কীভাবে বিঘ্নিত হয়েছিল, তদন্ত কমিশন করে তা উদঘাটন ও জনসমক্ষে প্রকাশ করা হলে বিচারপ্রক্রিয়া সহজ ও অভিনন্দিত হবে।

পেশাগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই সাংবাদিক ও সংবাদপত্র বা মিডিয়ার কর্মকাণ্ড তদারকির জন্য অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও প্রেস কাউন্সিল আছে। কিন্তু এ কাউন্সিলকে নিষ্ক্রিয় ও গুরুত্বহীন করে রাখা হয়েছে, যদিও মিডিয়ার দ্রুত প্রসারের ফলে সাংবাদিকতা পেশা-সংক্রান্ত সমস্যা ও জটিলতা বেড়েছে। এক-এগারোর সহযোগী সম্পাদকদের সম্পাদকীয় নীতি, পেশাগত আচরণ ও ভূমিকার কারণে আজ যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে এবং তাদের বিচারের দাবি উঠেছে, প্রেস কাউন্সিল সক্রিয় ও শক্তিশালী হলে সমাধান সেখানেই হতে পারত। আদালতের পরিবর্তে প্রেস কাউন্সিলই সংক্ষুদ্ধদের অভিযোগের উপযুক্ত বিচার করতে পারে।

মাহফুজ আনাম, মতিউর রহমান ও আর কোনো সম্পাদক বা সাংবাদিকের বিচার চাইলে সরকারের উচিত হবে বিচ্ছিন্নভাবে তাদের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় না করিয়ে প্রেস কাউন্সিলের আশ্রয় গ্রহণ করা।