বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব

জিয়াউল হক মুক্তা
Published : 28 August 2011, 12:34 PM
Updated : 28 August 2011, 12:34 PM

সাতটি দেশে পরিচালিত একটি চকিত পর্যবেক্ষণ থেকে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অক্সফাম সম্প্রতি জানিয়েছে যে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে পর্যাপ্ত খাবার কিনতে না পেরে রোজাদারগণ ইফতারে কম খেতে বাধ্য হচ্ছেন; এ বছর তারা পালন করছেন জীবনের কঠিনতম রোজা। অক্সফামের এ চকিত পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশ থেকে সাক্ষাতকার প্রদানকারী সকল নারী-পুরুষ স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে গত রোজার চেয়ে এবার ইফতারসহ খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে ব্যাপকভাবে। বাংলাদেশে আগস্টে রোজা শুরুর আগেই কেবল জুলাই ও জুন মাসে পণ্যমূল্যস্ফীতি ঘটেছে যথাক্রমে ১৩.৪ ও ১২.৫ শতাংশ; ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে তা সবসময়ই ছিল ১১ শতাংশের বেশি।

এশিয় উন্নয়ন ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ হলে ২.৫ পারসেন্টেজ পয়েন্ট মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নিপতিত হন; সংখ্যাবিচারে যা ৩৮ লক্ষ। সে বিবেচনায় যদি ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশের বেশি হয়, তাহলে প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গিয়েছেন। এ বিশ্লেষণের সাথে সামঞ্জস্য দেখা যায় ২০০৮ সালের পরিস্থিতির। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশ্লেষণে বলা হয়েছিল ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০৮ সালের মার্চের মধ্যে নতুন করে ৮.৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গিয়েছিলেন; দারিদ্র্য সীমার নিচের জনসংখ্যা পরিণত হয়েছিল ৪৮.৫ শতাংশে; ২০০৪ সালে যা ছিল ৪০ শতাংশ। ২০০৮ সালের আগস্টে বিশ্বব্যাংকের একটি অনুমান থেকেও বলা হয়েছিল যে দেশে সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যমূল্যের অস্থিতিশীলতার কারণে বাংলাদেশে হয়তো ৪০ লক্ষাধিক মানুষ দরিদ্রে পরিণত হয়েছিলেন। দেশি-বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর এসব গাণিতিক ও সামষ্টিক বিশ্লেষণ ও অনুমানের সাথে মিলে যায় মাঠ পর্যায়ের গবেষণার তথ্যও। ৬২টি গ্রামের ২০১০টি খানায় পরিচালিত ব্র্যাক-সমর্থিত একটি গবেষণা অনুসারে ২০০৮ সালে বাংলাদেশে গ্রামীণ দারিদ্র্য ছিল ৫৫ শতাংশ, যা তাদের হিসেবে, ২০০৪ সালের ৪৯ শতাংশের চেয়ে ছয় পারসেন্টেজ পয়েন্ট বেশি।

পরিসংখ্যান থেকে ফেরা যাক গুণগত পর্যবেক্ষণের দিকে। ২০০৯ ও ২০১০ সালে পরিচালিত গবেষণার ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালের মে মাসে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া ও জাম্বিয়ায় অক্সফাম ও যুক্তরাজ্যের ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (আইডিএস) পরিচালিত একটি গবেষণায় বলা হয়, জনগণ মনে করেন যে ২০১১-র খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি তাদের সকলের জীবনে প্রভাব ফেললেও দরিদ্রতম জনগণের জীবনে এর প্রভাব বেশি। তারা মনে করেন এ সময় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক ও প্রান্তিক পেশাজীবীদের প্রকৃত আয় কমেছে; অন্যদিকে কৃষিপণ্য উৎপাদক ও সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণী কিছুটা পরিমাণে পণ্যের মূল্য ও মজুরি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হলেও ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকগণ লাভবান হননি কেননা ফসল তোলার পরপরই তাদেরকে অল্পমূল্যে সেসব বিক্রি করে দিতে হয়েছে গৃহীত ঋণ পরিশোধের জন্য আর শ্রমিকদের বর্ধিত মজুরি মূল্যস্ফীতি মোকাবেলার সমানুপাতিক ছিল না। এসব দেশের সরকারগুলো খাদ্য পরিস্থিতি ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করলেও জনগণ মনে করেন যে সরকার তাদেরকে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে; মধ্যস্বত্তভোগী ও বড় ব্যবসায়ীরা ব্যাপকভাবে লাভবান হয়েছেন। তারা মনে করেন খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির ফলে তাদের খাদ্যাভ্যাস ও অপরাপর অভ্যাসের অবনতি হয়েছে; মাছ-মাংস-ডালের স্বাদ তারা ভুলতে বসেছেন; কম খেয়ে, বেশি কাজ করে ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য ব্যয় সংকোচন করেছেন। শিক্ষা-চিকিৎসা ও সামাজিকতা-বিনোদন ব্যয় তারা পরিহার করেছেন। বহু ক্ষেত্রেই তারা পেশা পরিবর্তন করতে ও অভিবাসী হতে বাধ্য হয়েছেন। ঢাকার নতুন বাজার এলাকার বানু জানিয়েছেন ২০১০ সালে যে খাদ্য তিনি ১৩৪ টাকায় কিনতেন, ২০১১ সালে তার মূল্য হয়েছে ২৮০.৫০ টাকা; কিন্তু তিনি ব্যয় করতে পারেন মাত্র ১৮৫ টাকা; সুতরাং কম খাদ্য গ্রহণই তার একমাত্র বিকল্প।

দরিদ্রতম জনগণের জীবনে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির প্রভাব বেশি; কিন্তু দরিদ্রতম নারীদের জীবনে তা সবচেয়ে বেশি। ২০০৮ সালের আগস্টে স্টেপস টুওয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট পরিচালিত একটি জরিপের ফলাফল থেকে দাবি করা হয় ওই সময় নতুন করে দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে যায় দেশের ২০ ভাগ মানুষ। ১০টি জেলার ৮৩৩ জন নারীর ওপর পরিচালিত জরিপে জানা যায় পাঁচটি প্রধান ক্ষেত্রে তাদের জীবনাচারের পরিবর্তন হয়েছে; এগুলো হল কম খাবার কেনা, মাছ-মাংস না কেনা, শিক্ষা ব্যয় কমানো, ডাক্তারের কাছে যথাসম্ভব না যাওয়া এবং যানবাহন ব্যবহার কমিয়ে দেয়া। তারা বিনোদন ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের পরিমাণও কমিয়ে দেবার কথা বলেছেন। তাদের ব্যাপক অংশ নতুন করে ঋণ নেয়া ও একাধিক কাজে যুক্ত হবার কথা জানিয়েছেন।

প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের ৯৫ শতাংশের যোগানদার দেশের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কিষাণ-কিষাণিদের অবস্থা কেমন? ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে দেশের ৩০টি কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলে অক্সফামের সহায়তায় ডেইলি নিউ এজ কর্তৃক সংগৃহীত ৩০টি কেইস স্টাডি থেকে দেখা যায় খাদ্যাভাবে তারাও দিশেহারা; ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কাজে দেয়া ছাড়া তাদের কোন গত্যন্তর ছিল না। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলো আরও নিরূপায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোলের সোনামনি বসাক বলেন, "যাই চাষ করি, ধনীদের হাতে চলে যায়। আমরা গরিব, আরও গরিব হচ্ছি। কিছু জংলি ফল আর সব্জি যোগাড় করি বিভিন্ন যায়গা থেকে। তাও আজকাল আর পাওয়া যায় না। এখন কী খাব আমরা? কিছু পেলে খাই, না পেলে উপোস থাকি।" দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জের সুরেন বর্মন কাঁদতে থাকেন, "বুড়ো মায়ের জন্য কষ্ট হয়। একবারও তাকে খাবার দিতে পারি না। অনাহারে মারা গেলে তারচেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে?"

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন দেশের কাউকে না খেয়ে থাকতে দেবেন না। সরকার অতীতের চেয়ে ব্যাপক ও ধারাবাহিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সম্পাদিত খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য অনুযায়ী পূর্ববর্তী এক বছরে দেশের ২৪.৫৭ শতাংশ খানা অন্তত একটি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা ভোগ করেছে। সরকারি এ জরিপে আরও বলা হয়েছে যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধাভোগীদের মধ্যে মাত্র ৪৩.৪ শতাংশ হচ্ছে দরিদ্র; যেখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ২৭.৫ শতাংশই কোন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অংশ নয়। অন্যদিকে জাতীয় দৈনিকগুলোতে অসংখ্য প্রতিবেদন রয়েছে কীভাবে ভিজিএফ-ভিজিডিসহ এসব কর্মসূচিগুলো অনাহারী মানুষের কাছে টাকার বিনিময়ে বিক্রি হচ্ছে; প্রতিবেদন রয়েছে কীভাবে সূচিত 'ফেয়ার প্রাইস কার্ড'গুলো প্রভাবশালীরা নিজেদের দখলে রেখে অনাহারী মানুষের খাবারগুলো লুটে নিচ্ছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি থেকেও লাভবান হওয়া যায়; মূল্যবৃদ্ধি মোকাবেলা-কৌশল থেকেও লাভবান হওয়া যায়। অর্থ ও ক্ষমতার বিপুল মৈত্রী আজ দরিদ্র ও দুর্বলের হন্তারক।