মাহফুজ আনামকে হয়রানি বন্ধ করুন

তৌফিক ইমরোজ খালিদী
Published : 22 Feb 2016, 04:51 PM
Updated : 22 Feb 2016, 04:51 PM

সেই দুবছরে অন্তত দুশ শিরোনাম পাওয়া যাবে, যেখানে সাংবাদিকতার মান রক্ষা করতে পত্রিকাটি ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু আট বছর পর মানুষ এখন কথা বলছে দুটি শিরোনাম নিয়ে। এর একটির বিষয়বস্তু শেখ হাসিনা; অন্যটি সম্ভবত খালেদা জিয়া ও তাঁর সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী মোসাদ্দেক আলী ফালুকে নিয়ে।

'ডেইলি স্টার' পত্রিকায় গত ২৫ বছরে প্রকাশিত আরও শত শত শিরোনাম নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। আরও বহু খবর আছে, যা তারা গোপন করেছেন; প্রশ্ন তোলা যায় তা নিয়েও। বাংলাদেশের যে সব সংবাদপত্র নৈতিকতার বুলি কপচায় অথচ নিজেরা তার চর্চা করে না, 'ডেইলি স্টার' কেবল তারই একটি।

শেখ হাসিনার ছেলে সজীব আহমেদ ওয়াজেদ জয় ৪ ফেব্রুয়ারি ফেইসবুকে কথা বলতে গিয়ে তাঁর ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। সেখানে তিনি সম্ভবত এক-এগারোর ক্ষমতা বদলের আগের 'সুশীল সমাজের' সেই প্রচারণার কথা বলেছেন, যা বিদেশি অর্থপুষ্ট 'সিপিডি', 'ডেইলি স্টার', 'প্রথম আলো' ও 'চ্যানেল আই'এর মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছিল। আসলে তারা চাচ্ছিল 'মেরিটোক্রেসি'। তার জন্য দরকার বিরাজনীতিকীকরণ।

সেনাবাহিনীর বসানো সেই তত্ত্বাবধায়করা যদি তখন ক্ষমতা না নিতেন, সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইএর প্রভাবশালী কিছু দুর্বৃত্ত কর্মকর্তার নির্দেশে যা তারা করেছিলেন– তা যদি না ঘটত, তাহলে সে সময় পত্রিকা দুটিতে প্রকাশিত মন্তব্য প্রতিবেদনগুলো হয়তো এ দেশের গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক ইতিহাসের বিস্মৃত অধ্যায়েই পরিণত হত।

জয় মনে করছেন, 'সুশীল সমাজের' সেই প্রচার এবং ডিজিএফআইএর ছকে সাজানো সংবাদ প্রতিবেদনের কারণেই তাঁর মা এবং তাঁর মতো আরও অনেককে সে সময় গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল, মিথ্যা অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, নির্জন কারাগারে বহু মাস কাটাতে হয়েছিল।

ডিজিএফআইএর দেওয়া তথ্যে সেইসব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও দুর্বল লেখা 'ডেইলি স্টার' একাই প্রকাশ করেনি– মাহফুজ আনামের এ বক্তব্যের সঙ্গে সবাই একমত হবেন। 'ডেইলি স্টার'এর সিংহভাগের মালিকের আরেকটি মালিকানাধীন পত্রিকা 'প্রথম আলো'ও একই কাজ করেছিল। কখনও কখনও তারা আরও একধাপ এগিয়ে সেনাবাহিনী পরিচালিত যৌথবাহিনীর অভিযানের ক্ষেত্র প্রস্তুতের কাজটিও করেছে। তথাকথিত যৌথবাহিনী ওই সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিচালিত হত মূলত ডিজিএফআইএর নির্দেশনায়।

অনেকেরই মনে থাকবে, সে সময় একসঙ্গে বেশ কয়েকটি পত্রিকায় খবর আসত– অমুক অমুক রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীকে এবার বিচারের মুখোমুখি করা হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই বিচারের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। এর কারণ অংশত তদন্তকারীদের পেশাগত দক্ষতার অভাব; কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযোগের আদৌ কোনো সত্যতা ছিল না।

সেই সব সংবাদের ভাষা, তথ্যের ফাঁকফোকর আর কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো দেখে যে কোনো অভিজ্ঞ সাংবাদিক এর উৎস বুঝে ফেলতেন। খবরগুলো বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপনের খুব একটা চেষ্টাও পত্রিকাগুলো সে সময় করেনি। কাটতিতে শীর্ষে থাকা ইংরেজি দৈনিক 'ডেইলি স্টার'এও সেই চেষ্টা দেখা যায়নি।

তখনকার একটি ঘটনায় আমরা সদ্য-বিদায়ী বিএনপি সরকারের একজন সাবেক মন্ত্রীকে 'টার্গেট' হতে দেখি। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে খবর ছাপতে 'প্রথম আলো'এর পুরো প্রথম পৃষ্ঠা উৎসর্গ করা হয়েছিল। বিএনপির সেই নেতা ২০১০ সালের জুলাই মাসে মারা যান। এক-এগারোর পর তার অনেক সহকর্মীকে কারাগারে যেতে হলেও তাকে কখনও গ্রেপ্তার বা বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। বলা হয়, গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি 'সংস্কারবাদী' বনে গিয়েছিলেন। পরিণামে তিনি তার দীর্ঘ দিনের দল থেকেই বাদ পড়েন।

দুটি ভাষায় ২৪ ঘণ্টার সংবাদ লাখ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে সামনের কাতারে চলে আসা নতুন একটি সংবাদমাধ্যমের জন্য কঠিন সময় গেছে সে সব দিনে। সূত্রের নাম প্রকাশ করে প্রতিটি তথ্য প্রকাশের প্রতিজ্ঞাই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল সে সময়। ওই ধরনের কোনো খবরের সূত্র হিসেবে সংবাদমাধ্যমে তাদের নাম আসুক, ডিজিএফআই কর্মকর্তারা তা চাইতেন না। সাধারণ কাগজের ওপর সইবিহীন সে সব প্রতিবেদনের তথ্য সংবাদ হিসেবে প্রকাশ করার কোনো যুক্তি দেশের প্রথম ইন্টারনেটভিত্তিক সংবাদপত্রটি সে সময় খুঁজে পায়নি।

'দুর্নীতিবাজ' ব্যক্তিদের ৫০ জনের প্রথম তালিকাটি ২০০৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অন্য সব সংবাদমাধ্যমের আগেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বার্তাকক্ষে পৌঁছেছিল।

কোনো লেটারহেড, সই বা ভূমিকা ছিল না ওই তালিকার সঙ্গে। ফলে যে অভিপ্রায় থেকে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে ওই তালিকা পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল, তা পূরণ হয়নি। তাৎক্ষণিকভাবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ওই তালিকা না ছাপলেও অন্য সংবাদপত্রগুলো তা লুফে নিয়েছিল।

আট কলাম শিরোনামের সেই খবরে সেদিন কেউ সূত্র উল্লেখ করেনি। অথচ ৫০ জন ব্যক্তিকে সেখানে বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল 'দুর্নীতিবাজ'। সংবাদে অন্তত 'সন্দেহভাজন' শব্দটি ব্যবহার করা যেত, যা কেউ সেদিন করেনি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমও পরদিন তালিকাটি প্রকাশ করে। ততক্ষণে প্রায় ১৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা তখনকার উপদেষ্টা, যিনি আবার সেনাবাহিনী পরিচালিত দুর্নীতিসহ গুরুতর অপরাধ দমন সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটির প্রধান, তিনি সেদিন নিশ্চিত করে বলেছিলেন– তালিকাটি কর্তৃপক্ষেরই তৈরি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদনে ওই তালিকার ব্যক্তিদের 'সন্দেহভাজন' বলা হয়েছিল। পরের দুটি তালিকা প্রকাশের সময় অন্য সংবাদ মাধ্যমগুলো অনুসরণ করেছিল সেই নজির।

বিবিসিতে প্রচারিত শেখ হাসিনার একটি সাক্ষাতকারের বিষয়বস্তু খবর হিসেবে প্রকাশ করার পর তা সরিয়ে নিতে এক কর্নেলের কাছ থেকে ২৬ বার কল পেয়েছিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একজন বার্তা সম্পাদক। অন্য কোনো পত্রিকায় সেই খবর আসেনি। তিনি বলেছিলেন–- "এই নিয়ে ২৬ বার ফোন পেলাম। এখন আমি কী করব?"

সাংবাদিকের কাজ সংবাদ লেখা; শেষ পর্যন্ত তাই তিনি করেছেন, অন্য কিছু নয়।

তৃতীয় তালিকাটি প্রকাশ করতে গিয়ে নিজেদের ফাঁদেই পা দিতে হয়েছিল 'প্রথম আলো'কে। পত্রিকাটির মালিক লতিফুর রহমানের নাম এসেছিল ওই তালিকায়। তিনি 'ডেইলি স্টার'এরও সিংহভাগের মালিক। সে সময় লতিফুর রহমানের সদ্য কিনে নেওয়া এবিসি রেডিওর কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে এই ব্যবসায়ীকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একজন বলেছিলেন, সাংবাদিকতার সাধারণ নিয়মগুলো অনুসরণ করলেই ফাঁদ এড়ানো সম্ভব ছিল।

কিন্তু মাহফুজ আনাম (অথবা 'প্রথম আলো') সে সময় যা করেছিলেন, তার পেছনে ঠিক কী কারণ ছিল? অন্য অনেকের ক্ষেত্রে সেই কারণ স্পষ্ট; কিন্তু মাহফুজ আনাম বা 'প্রথম আলো'?

তখনকার ঘটনাপ্রবাহ যারা খেয়াল করেছেন, এর উত্তর তারা জানেন। কিন্তু যাদের বয়স সে সময় ১৩ কী ১৪, অর্থাৎ এখন যারা বিশের ঘরে, তাদেরকে সেই ইতিহাস আবার শোনাতে হবে।

গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, অন্যরা ছাপছে বলেই মাহফুজ আনাম বা 'ডেইলি স্টার' সে সময় প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ করেছিল?

তারা কি অন্যদের অনুসরণ করছিল? নাকি নেতৃত্ব দিচ্ছিল?

'ডেইলি স্টার', মাহফুজ আনাম বা অন্য যারা সে সময় একই কাজ করেছেন, তার পেছনে কী প্রণোদনা ছিল?

অবশ্য অন্য কেউ তো আর নিজেদের কাজ 'ভয় অথবা পক্ষপাতমুক্ত সাংবাদিকতা'র উদাহরণ বলে দাবি করেননি।

যদি ধরে নিই যে, মাহফুজ আনাম সে সময় সত্যিই ভয়মুক্ত ছিলেন, তাহলে বলতে হয় তিনি সেনা-নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে কাজ করেছেন। তা সম্ভব ছিল, কেননা বৈধ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে আসা ব্যক্তিদের পরিচালিত এ ধরনের একটি সরকারের পক্ষে তিনি নিজেও কথা বলেছেন।

"এটা আমাদের সরকার… এই সরকার আমরা এনেছি… আমরা যা বলব, তা আপনাদের শুনতে হবে"– আলোচিত এই উক্তির বক্তা হিসেবে মাহফুজ আনামের নামই বলা হয়।

তখনকার তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টার সঙ্গে এক বৈঠকে ওই উক্তি করা হয়। আরও বহু সম্পাদক যেখানে উপস্থিত ছিলেন। গত ১০ ফেব্রুয়ারি টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার হওয়া এক টক শোতে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রিয়াজউদ্দিন আহমেদকে যখন জিজ্ঞেস করা হল, বিষয়টি তিনি এড়িয়ে গেলেন; বললেন, সেই বৈঠকে তিনি উপস্থিত ছিলেন না। আরেক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, 'আমার দেশ'এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আমানুল্লাহ কবীর তাৎক্ষণিকভাবে ফোন করেন। ওই টিভি অনুষ্ঠানের দর্শকদের তিনি জানান, রিয়াজউদ্দিন আহমেদের মতো তিনিও ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এবং সেই উক্তি মাহফুজ আনামই করেছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে এর কোনো প্রতিবাদ রিয়াজউদ্দিন আহমেদ করেননি।

'ভয় অথবা পক্ষপাতমুক্ত সাংবাদিকতার' প্রশ্নে ফিরে আসি। মাহফুজ আনাম যদি পক্ষপাত থেকে সেই সব কাজ না করে থাকেন, তাহলে তিনি তা করেছিলেন ভয় থেকে। কীসের ভয়ে ছিলেন তিনি? অর্থের অভাব তার ছিল না; সে সময় 'ডেইলি স্টার' ছিল আর্থিকভাবে সবচেয়ে ধনী পত্রিকা। তাদের মুনাফা ছিল 'প্রথম আলো'এর চেয়ে অনেক বেশি, কেননা প্রচার সংখ্যায় অত্যন্ত কম হলেও প্রায় সমান বিজ্ঞাপন পেত 'ডেইলি স্টার'। অথচ প্রায় সব সংবাদ মাধ্যমকেই সে সময় অর্থসঙ্কটে পড়তে হয়েছিল। অনেক পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেল মাসের পর মাস কর্মীদের বেতন দিতে পারেনি।

সত্যটা যে কেউ বুঝে নিতে পারেন, সেই সেনা-তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে কোনো চাপের কারণে মাহফুজ আনাম সে সব করেননি। বরং তিনি সমর্থন জুগিয়েছেন, একই কাজ করেছেন তাঁর মতো আরও অনেকে। বলা হয়, বাংলাদেশে রাজনীতিবিদমুক্ত একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়তে যারা কাজ করে আসছেন, মাহফুজ আনাম তাদের একজন। এটা কি অপরাধ? বিস্ময়কর বিষয় হল, এ প্রশ্নে বাংলাদেশ কখনও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। নাগরিক সমাজের একটি অংশ মনে করে, শহুরে অভিজাতরাই বুদ্ধিজীবী, আমলা আর ব্যবসায়ীদের নিয়ে আরও ভালোভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারবে। মাহফুজ আনাম তাদেরই একজন। ঠিক এ কারণেই মুহাম্মদ ইউনূসের মতো লোকদের তিনি সমর্থন দিয়ে গেছেন। আবার এমন লোকও আছেন, যারা সে ইসব 'অর্ধশিক্ষিত' রাজনীতিবিদের ওপরই আস্থা রাখেন, যারা যুগ যুগ ধরে নির্বাচিত হয়ে আসছেন ত্রুটিপূর্ণ এক ভোটিং ব্যবস্থায়, যেখানে সুষ্ঠু ভোট মানে সবার জন্য কারচুপির সমান সুযোগ।

মাহফুজ আনাম যা করেছেন, সে জন্য তাঁকে ক্ষমা করে দেওয়া চলে বহু কারণে।

'ডেইলি স্টার' সম্পাদক কেবল অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠেছিলেন। রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার ভালো একটি সুযোগ তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন। সমস্যা ছিল কেবল একটি। তিনি এবং তাঁর সুশীল সমাজের কমরেডরা রাজনৈতিক ক্ষমতা পাওয়ার জন্য পথের কাঁটা সরাতে জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদদের কালিমালিপ্ত করার সহজ পথটি বেছে নিয়েছিলেন। মুহাম্মদ ইউনূসের রাজনৈতিক দল খোলার ব্যর্থ চেষ্টার সঙ্গে মাহফুজ আনামের যোগাযোগের কথাও অনেকের জানা। গোপন বৈঠকগুলো কাদের আয়োজনে হত এবং সেখানে কোন বিষয়ে আলোচনা হত– তাও অনেক সাংবাদিক জানেন। প্রস্তাবিত সেই রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্য বৈঠকগুলো হত সেনা-পরিচালিত প্রশাসনের বদান্যতায়। অথচ গুরুত্বপূর্ণ দলগুলোর প্রকাশ্য কার্যক্রম তখন নিষিদ্ধ, অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ নেতাও কারাগারে।

মাহফুজ আনামের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার পক্ষে যুক্তিতে সমর্থকরা বলছেন, দেশের ইতিহাসে এ রকম বহু নজির আছে। অন্যদিকে সমালোচকদের ভাষ্য, সে সব নজিরের সবগুলোই অনুসরণযোগ্য নয়।

সংবাদপত্রের উপসম্পাদকীয়তে অনেকেই লিখছেন, মাহফুজ আনামের সেই সব কর্মকাণ্ড ছিল সরল বিশ্বাস থেকে। সুতরাং তাঁকে দায়ী করা চলে না। তিনি মনে করেছিলেন, ওই পরিস্থিতিতে সেটাই ছিল সঠিক পদক্ষেপ। সমস্যাটা হল, একজন সাংবাদিকের কাজ যে এগুলো নয়– তা তিনি জানতেন না, অথবা বুঝতে পারেননি। কেবল প্রশ্নের মুখে পড়ার পরই তিনি ভুলটা ধরতে পেরেছেন।

যেহেতু সাংবাদিকতায় মাহফুজ আনামের অভিজ্ঞতা নিতান্তই স্বল্প, সংবাদ সংগ্রহের কোনো অভিজ্ঞতাই যেখানে তাঁর নেই, ব্যবস্থাপনার বাইরে সংবাদকক্ষের কাজেও কোনো সময় যেহেতু তাঁর কাটেনি, এসব বিবেচনায় তাঁকে অবশ্যই ক্ষমা করে দেওয়া যায়। চলুন আমরা 'দ্য গার্ডিয়ান'এর খ্যাতিমান সম্পাদক সিপি স্কটের সেই বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করি: ''মতামত (স্টার সম্পাদক যা লিখতে উপভোগ করেন) সহজ, কিন্তু তথ্য পবিত্র।''

'ডেইলি স্টার' সম্পাদক তাঁর 'ভুলগুলো' স্বীকার করে নেওয়ায় প্রশংসিত হয়েছেন। অবশ্য কেউ কেউ বলেছেন, সন্দেহাতীত প্রমাণ হাজির করার পরই ওই স্বীকারোক্তি তাঁর কাছ থেকে এসেছে। এটিএন নিউজ টকশোর নাটকীয় ওই সময়টায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি কোনো অপরাধ করেননি বলে দাবি করে আসছিলেন।

অনেকে যুক্তি দিচ্ছেন, মাহফুজ আনাম যখন বিষয়টি 'স্বীকার' করে নিলেন, তখনই তাঁর সমালোচনা করা হচ্ছে। অথচ অন্যরা তাও করেনি।

এরপর আরও তিনটি প্রশ্ন সামনে এসে যায়: ১. এত বছর পর কেন; ২. অন্য কাউকে কেন একই প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে না এবং ৩. আর কারও নাম কেন বলা হচ্ছে না।

পাল্টা যুক্তি খুবই সরল: মাহফুজ আনাম ভয় ও পক্ষপাতমুক্ত সাংবাদিকতা করে আসার উন্নাসিক দাবি তুলে যে ভুল করেছেন, অন্যরা তা করেননি। নিজের পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ঠিক আগে টক-শোতে হাজির হয়ে তিনি ওই বিষয়ে কথা বলতে গেছেন। তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর মাহফুজ আনাম নিজেই দিয়েছেন– "সে সময় সবাই একই কাজ করেছে।" অবশ্য পরমুহূর্তেই তিনি বলেন, "সবাই নয়।"

মাহফুজ আনামকে ঘিরে গণমাধ্যমকর্মীদের একটি অংশের ঈর্ষার বিষয়ও রয়েছে। তারা বিশ্বাস করেন– স্টার সম্পাদক নিজের যোগ্যতার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছেন। প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও যোগ্যতা না থাকার পরও নিজের পেশার শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন এমন ব্যক্তি মাহফুজ আনামই প্রথম নন। এই দেশে তাঁর মতো উদাহরণ ভুরি ভুরি আছে। তাহলে শুধু মাহফুজ আনামকে কেন অভিযুক্ত করা?

'ডেইলি স্টার'এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এস এম আলীর অকালমৃত্যুর পর মাহফুজ আনাম যথেষ্ট ভালো করেছেন, প্রতিদ্বন্দ্বী সংবাদপত্রগুলো যখন একে একে হারিয়ে যাচ্ছিল, নিজের পত্রিকাকে তিনি টেনে নিয়ে গেছেন শীর্ষে। তাঁর ওই সাফল্যে প্রতিদ্বন্দ্বীদের অবদানও কম নয়। তারা নিজেদের পায়ে কুড়াল মারতেই ব্যস্ত ছিল।

মাহফুজ আনাম হয়তো সুসাংবাদিকতা এগিয়ে নিতে খুব বেশি কিছু করতে পারেননি, কিন্তু বাংলাদেশের একমাত্র ইংরেজি দৈনিক হিসেবে 'ডেইলি স্টার'কে একটি পর্যায় পর্যন্ত তিনি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন– এ যুক্তি ঠিক। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল– বিনিয়োগকারীদের জন্য তিনি অন্য পত্রিকাগুলোর তুলনায় অনেক বেশি লাভ এনে দিতে পেরেছেন।

'নিউ মিডিয়া'র আগমনে 'ডেইলি স্টার'এর মুদ্রিত সংস্করণ চাপের মধ্যে রয়েছে। সব ধরনের সহযোগিতাই তাঁর এখন দরকার। আর ব্যক্তিকে নিয়ে আলোচনা না করে কথা বলা উচিৎ প্রতিষ্ঠান নিয়ে। আসুন আমরা কাগজটি বাঁচানোর চেষ্টা করি।

যেভাবে তাঁকে হয়রানি করা হচ্ছে, তা আমরা সমর্থন করি না। যতগুলো মামলা তাঁর বিরুদ্ধে হয়েছে, সেই সংখ্যা আতঙ্কজনক; সব মিলিয়ে যে পরিমাণ ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়েছে, তা অবিশ্বাস্য। এটা যেন ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক প্রতিশোধের বিষয়ে পরিণত না হয়।

কেউ কেউ বলছেন, মড়ক যদি লাগে একটি ছাগল কাটলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না। অন্যপক্ষের যুক্তি, একটি আক্রান্ত হয়েছে বোঝা গেলে ব্যবস্থা নিতেই হবে, অন্যগুলো চিহ্নিত করার জন্য অপেক্ষা করা যাবে না।

যারা মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে আদালতে যাচ্ছেন, তাদের আমরা নিষেধ করতে পারি না, ক্ষতির বিষয়েও প্রশ্ন তুলতে পারি না। তবে এর পেছনে সরকারের হাত থাকার যে অভিযোগ এসেছে, তা সত্যি হলে আমরা বলব– এসব থামান।

যারা ক্ষমতায় আছেন, সেই রাজনীতিবিদদের আমরা বলব, আরও উদার হতে হবে, প্রতিশোধপরায়ণ নয়। চোখের বদলে চোখ নেওয়ার নীতি এখানে খাটে না। তাদের ক্ষমা করতে জানতে হবে।

মাহফুজ আনামকে শাস্তি দেওয়ার ভার পাঠকের ওপরই ছেড়ে দিন; অথবা পত্রিকার মালিকপক্ষই তাঁর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিক। আমরা 'ডেইলি স্টার' কর্তৃপক্ষকে একটি সুষ্ঠু সম্পাদনা নীতি-প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানাব, যার অভাব কাগজটিতে রয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের 'ভুল' এড়াতে তা হবে দীর্ঘমেয়াদী একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ। পত্রিকাটি আমাদের বাঁচাতে হবে।

বিষয়টি আমরাই প্রথম প্রকাশ্য আলোচনার টেবিলে এনেছিলাম বলে কেউ কেউ আমাদের দোষ দিতে চাইছেন। ৩ ফেব্রুয়ারি টক শোর উপস্থাপক ওই প্রসঙ্গ তোলার পর আমারই এক সহকর্মী মাহফুজ আনামকে কঠিন সেই প্রশ্নগুলো করেছিলেন। সেই বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে স্টার সম্পাদক ডিজিএফআইএর গছানো খবর ছেপে দেওয়ার কথা স্বীকার করে নেন। টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারে তাঁর ওই স্বীকারোক্তির গুরুত্ব বিবেচনা করে আমরাই প্রথম একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করি, যদিও আমাদের মতো আরও অনেকেই মাহফুজ আনাম ও অন্যদের সেইসব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আগে থেকেই ওয়াকিবহাল।

একজন ব্যক্তির পেছনে লাগার অভিযোগ যারা আমাদের বিরুদ্ধে করছেন, তাদের শুধু এটুকু বলব– আমরা কেন মাহফুজ আনাম ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপিনি, সেই অভিযোগও আমাদের শুনতে হয়। বলা হয়, অনুসন্ধান না হওয়ায় স্টার সম্পাদক ও তাঁর স্ত্রী, যিনি মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন চালান, তাঁরা বড় ধরনের ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন।

আমরা যদি সবাই সোসাইটি অব প্রফেশনাল জার্নালিস্টসএর নীতিমালা মেনে চলি, গণমাধ্যমের অনিয়মের বিষয়েও ওয়াচডগের ভূমিকায় অবতীর্ণ হই, তাহলে আমাদের এই প্রিয় কর্মক্ষেত্র আরও অনেক ভালো একটি জায়গা হয়ে উঠতে পারে।

সবশেষে এটুকুই বলব, আমরা মাহফুজ আনামের পাশে আছি।

[ইংরেজি থেকে অনূদিত]