মুক্তিযুদ্ধ ও শাহবাগের আলোয় আমাদের শিক্ষানীতি

ওমর শেহাব
Published : 7 Feb 2016, 10:12 AM
Updated : 7 Feb 2016, 10:12 AM

আমার প্রজন্মের আর দশজন মানুষের মতোই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা শাহবাগ আন্দোলন। এটি নিয়ে আমার গর্বের শেষ নেই। এ পর্যন্ত একাধিকবার শাহবাগ আন্দোলনের বর্ষপূর্তিতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এই পাতায় আমি তা প্রকাশ করেছি। মনে হচ্ছে যতদিন বিভাগীয় সম্পাদক নিজে থেকে আমাকে না থামাবেন ততদিন এটি আমি চালিয়ে যাব!

যখন প্রথমবার শাহবাগের বর্ষপূর্তিতে লিখি এটি ছিল মূলত সাদাচোখে আন্দোলনটির যা যা বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তারই গল্প। কিন্তু এরপর আর সবার মতো শাহবাগ আন্দোলনের যে আদর্শিক চেতনা, যেটি খালি চোখে দেখা যায় না কিন্তু বুকের ভেতর সবাই অনুভব করে, সেটি আমি স্পষ্ট টের পেতে শুরু করলাম। শাহবাগের চেতনা নিয়ে যখন লিখতে গেলাম, আবিষ্কার করলাম, শাহবাগ আন্দোলন আসলে মুক্তিযুদ্ধেরই ধারাবাহিকতা।

কাজেই আমি ভাবলাম, আগে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করা উচিৎ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতিগুলো আমি কীভাবে অনুভব করি। সেটি যদি আমার কাছে পরিষ্কার না হয় তাহলে এটিও পরিষ্কার বুঝব না যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোন অংশটির ধারাবাহিকতায় শাহবাগের চেতনার কোন কথাটি এসেছে। কাজেই এটি হয়ে গেল একটি দুই পর্বের লেখা। প্রথম পর্বে আমার অনুভবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর দ্বিতীয় পর্বে তার আলোয় শাহবাগের দ্যোতনা।

তাহলে এই বছর কী লিখব? ছোটবেলায় স্কুলে পড়ার সময় বিজ্ঞান বইয়ে 'এসো নিজে করি' নামের একটি ব্যববহারিক পরীক্ষা ছিল। মূল ব্যাপারটি ছিল বিজ্ঞানের কোনো তত্ত্ব যখন পড়ানো হচ্ছে, পাঠ্যবইয়ের লেখকরা চাইতেন আমরা যেন বাসায় টুকটাক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তত্ত্বটি যাচাই করে দেখি। ঘরে টুকটাক ভাঙচুর আর আগুন লেগে যাওয়ার ঝুঁকিটুকু বাদ দিলে ব্যাপারটি কিন্তু আমার বেশ মজারই লাগত। এই সেদিনও আমি বাসায় কাগজের টি-ব্যাগে আগুন লাগিয়ে দেখলাম এটি রকেটের মতো উপরের দিকে উড়ে যায়! যে কোনো তত্ত্বের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যাচাই করার মজাই আলাদা।

এখানে একটি বিষয় বলে নেওয়া দরকার। আমি যেভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও শাহবাগের চেতনা অনুভব করি তখন আশা করি না সবাই সেটি সেভাবেই করবে। এটি না করাই বরং স্বাভাবিক। একটি অসাধারণ আন্দোলন বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্নভাবে স্পর্শ করেছে। প্রত্যেকে যার যার মতো করে এই চেতনা বুঝবে, লালন আর চর্চা করবে। একই আদর্শের নানা ধরনের বাহ্যিক প্রকাশের চেয়ে চমৎকার ও বৈচিত্র্যময় আর কী হতে পারে?

তাহলে আজকের 'এসো নিজে করি' পর্বে আমরা কী করব? আমরা দেখব মুক্তিযুদ্ধ ও শাহবাগের চেতনা বলতে আমরা যা বুঝি সেটি আমরা কীভাবে চর্চা করছি। গোটা বাংলাদেশের সর্বস্তরের চর্চা নিয়ে কথা বলার মতো জায়গা এখানে নেই। তার চেয়ে বড় ব্যাপার হল, সেটি করার মতো কারিগরি যোগ্যতাও আমার নেই। আমি আজকে আমাদের জাতীয় শিক্ষা নীতিটি মুক্তিযুদ্ধ ও শাহবাগের চশমায় দেখব। আগেভাগে জানিয়ে রাখি যে, আমি শিক্ষা গবেষক বা শিক্ষা-সংক্রান্ত কোনো পেশায় যুক্ত নেই। কাজেই আমার কোনো কথাই খুব বেশি সিরিয়াসলি নেওয়া যাবে না।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আনুষ্ঠানিক রূপ হল বাহাত্তরের সংবিধানের চারটি মূলনীতি– জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র। তার সঙ্গে শাহবাগের চেতনা কী? আমার আগের লেখাটিতে আমি বলেছি মুক্তিযুদ্ধের চারটি চেতনা শাহবাগ আরও গভীর ও বিস্তৃত করেছে।

তাহলে শুরু করা যাক! 'এসো নিজে করি' মুক্তিযুদ্ধ ও শাহবাগের চেতনায় আমাদের জাতীয় শিক্ষা নীতি।

প্রথমে আমি অল্প কথায় আমাদের সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষা নীতির পেছনের ইতিহাসটুকু বলে দিই। ২০০৯ সালের মে মাসে এই শিক্ষা নীতির জন্য গঠিত কমিটি প্রথম কাজ শুরু করে। এতে সদস্য ছিলেন ১৮ জন। পূর্ণ কমিটি মোট ২৩টি সভা করে। একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত চূড়ান্ত খসড়ায় মোট অধ্যায় ছিল ২৯টি। এই খসড়া অনেকেই খুব পছন্দ করে। পরবর্তীতে যখন মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিক সংস্করণ প্রকাশ করে তখন সেটিতে অধ্যায় একটি কমে যায়।

কিছুদিন আগে কমিটির সদস্য অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল খুব মন খারাপ করে একটি লেখায় জানিয়েছিলেন যে, আমলারা তাদের না জানিয়েই কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিয়ে দিয়েছেন।

ইতিহাস বলা শেষ। এখন আমি কাজের কথায় যাচ্ছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চারটি মূলনীতির প্রত্যেকটি নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলব।

আমাদের জাতীয় শিক্ষা নীতিতে জাতীয়তাবাদটি কীভাবে আসা উচিৎ? আগের লেখায় বলেছিলাম শাহবাগের আগে আমাদের জাতীয়বাদের ধারণাটি বেশ অস্পষ্ট ছিল। আমাদের বাংলাদেশ একটি বহুজাতিক দেশ। এখানে ভাষাই আছে ত্রিশটির উপরে। আগে যে সমস্যাটি ছিল তা হল, বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতীয়তাবাদকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ঘোষণা করেছিলেন। সে সময় সংসদে দেওয়া তাঁর বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, তিনি বাঙালি পরিচয়টিকে সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয় থেকে বাড়িয়ে একটি রাজনৈতিক পরিচয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন।

এ ব্যাপারটিতে তখনকার আদিবাসী নেতাদের আপত্তি ছিল। কারণ ইতোমধ্যে বাঙালি পরিচয়টি সাংস্কৃতিক পরিচয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এই মতবিরোধ সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর ও তাদের মধ্যে কোনো বিদ্বেষ তৈরি হয়নি। তাঁরা একসঙ্গেই কাজ করেছেন। কিন্তু তাদের এই কথোপকথন পঁচাত্তরেই বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণতা পাওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়।

তারপর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ছদ্মনামে কৃত্রিম বাঙালি মুসলিম জাতীয়তাবাদ চালু করেন আর দেশে রাজাকারদের পুর্নবাসন শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি আদিবাসীদের জাতিগত নিধন শুরু করেন সেটেলারদের সেখানে সরকারি খরচে পাঠিয়ে। এই অবস্থা চলে অনেক দিন।

অনেক অনেক পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির পর সমস্যা সমাধানের সুযোগ কিছুটা তৈরি হয়। কিন্তু আমরা আদিবাসীদের সঙ্গে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এখনও চুক্তির বাস্তবায়ন ঝুলিয়ে রেখেছি। শাহবাগ এসে আমরা একাত্তরের পুরোনো শ্লোগান, 'তুমি কে, আমি কে, বাঙালি বাঙালি' শ্লোগানটি আবার পেলাম, 'তুমি কে, আমি কে, চাকমা মারমা বাঙালি' হিসেবে। আমার মনে হয় এই পরিবর্তন দরকার ছিল। আমাদের জাতীয়তাবাদ হওয়া উচিৎ বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। কিন্তু সেটি জিয়াউর রহমানের 'দুই নম্বর বাংলাদেশি' জাতীয়তাবাদ হবে না। সেটি হবে সত্যিকারের সর্বজনীন জাতীয়তাবাদ যেটি বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদ দিয়ে বুঝাতে চেয়েছিলেন।

আমাদের শিক্ষা নীতিতে কি আমরা সেটির প্রতিফলন রেখেছি? যতগুলো মাতৃভাষা আছে ততগুলো ভাষায় কি আমরা এই শিক্ষা নীতির আনুষ্ঠানিক সংস্করণটি প্রকাশ করেছি? আমরা কি ধরে নিয়েছি এই জাতীয় নীতি শুধু তাদের জন্য যারা বাঙালি পরিবারে জন্মেছে? নাকি আমরা ধরে নিয়েছি যেসব আদিবাসী বাংলায় স্বচ্ছন্দ নন তাদের এসব না জানলেও চলবে? নাকি সংখ্যায় বেশি বলে আমরাই শুধু গুরুত্বপূর্ণ?

শিক্ষা সচিবের গাড়ির এক বছরের তেল খরচ যত আদিবাসীদের ত্রিশটি ভাষায় (অন্তত যেগুলোর লিখিত রূপ আছে) এই শিক্ষা নীতি অনুবাদ করতে কি তার চেয়েও বেশি খরচ লাগে? বিশেষজ্ঞ কমিটিতে কোনো আদিবাসী সদস্য নেই। আদিবাসীদের মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষণে আমাদের বাঙালিদের ইতিহাস যেহেতু খুব একটা সমৃদ্ধ নয়, কাজেই এটিতে তাদের অংশগ্রহণ কি জরুরি ছিল না?

আমরা যতদিন বাঙালি চোখে আদিবাসীদের নিজেদের মতো সমান সম্মান দিব না, ততদিন তাদের আমরা মনে করব পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। কাজেই তাদের শুধু আমরা দান-খয়রাত করে যাব। আমরা ধরে নিব তাদের কাছে থেকে আমাদের কিছু শেখার নেই বা কোনো সাহায্য পাওয়ার নেই। কাজেই আমরা বাঙালিরা নিজেরা নিজেরা ঠিক করব তাদের কী দরকার, তারপর আমরা তাদের সে অনুযায়ী বরাদ্দ দিব।

একটি সুস্থ বহুজাতিক সমাজে সবার মর্যাদাই সমান, সবারই নিজস্ব কিছু মৌলিক শক্তির দিক আছে, সবারই সমাজকে কোনো না কোনোভাবে কিছু না কিছু দেওয়ার আছে। কাজেই কেউ যদি শিক্ষানীতিতে আদিবাসীদের জন্য রাখা বরাদ্দগুলো দেখিয়ে বলে, 'কই, সবই তো ঠিক আছে', তাহলে চলবে না। আত্মসম্মান ও মর্যাদাবোধ টাকা পয়সা দিয়ে মাপা যায় না। যদি যেত তাহলে ছয় দফাতে বঙ্গবন্ধু কেবল এক দফাই রাখতেন; সেটি হল, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বড় বাজেট। তিনি সেটি রাখেননি।

শিক্ষানীতিতে আদিবাসীদের জন্য রাখা সুপারিশগুলো আদিবাসীরা ঠিক করেননি। ভবিষ্যতে আরও অনেক শিক্ষানীতি হবে। এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে আমাদের আরও কয় দশক লাগে কে জানে!

আমার কাছে ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা, এই চমৎকার কথা দুটির মানে একই। অনেক মানুষই দুটি কথা একই অর্থে ব্যবহার করেন। কিন্তু একাধিক রাজনৈতিক দল খুব সম্ভবত তাদের কথায় ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে শুধু অসাম্প্রদায়িকতা করছেন নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় আওয়ামী লীগ থেকে আলাদা করার জন্য। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে বলে অন্য দলগুলোর সেটি নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগা উচিৎ নয়। ব্যাপারটি অনেকটি এ প্রজন্মের অভিনেতাদের সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় অভিনয় করতে না পারার দু:খে মন খারাপ করার মতো।

প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকেই ইতিহাস সুযোগ দেয় নিজের সময়টুকুতে ইতিহাসের গতি পাল্টি দেওয়ার জন্য। কেউ সেই সুযোগ কাজে লাগায়, কেউ লাগায় না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশের মালিকানা জনগণের হাতে, কোনো দলের হাতে নয়। যে চেতনায় এ দেশটির জন্ম হয়েছে তার একটি হল ধর্মনিরপেক্ষতা। কাজেই কেউ যদি আওয়ামী লীগের প্রতি বিদ্বেষবশত সচেতনভাবে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' কথাটি বাদ দেওয়া শুরু করে তাহলে সে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ফসল বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতিকে বাদ দিয়ে দেয়।

এত কথা বলছি তার কারণ হল, বিশেষজ্ঞ কমিটি তাদের খসড়ায় শিক্ষানীতির তিন নম্বর উদ্দেশ্যে কী বলেছিলেন সেটি দেখুন আর তার পাশে আমলারা কী অনুমোদন করেছেন সেটি দেখুন:

আমার ব্যক্তিগত কৌতূহল হল এই পরিবর্তন কি আমি যেভাবে দুটি কথা একই অর্থে ব্যবহার করি সেভাবে করা হয়েছে? নাকি অন্য কোনো কারণ? বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে বা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতার পরপর দেওয়া তাদের বক্তৃতাগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষতার যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, 'অসাম্প্রদায়িকতা' কথাটি কি তার চেয়েও বেশি কিছু বুঝায়? বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ এঁনারা কি যথেষ্ট পরিমাণ মুসলমান ছিলেন না?

আমি আরও একটি ব্যাপার নিয়ে একটু বলতে চাই। পুরো শিক্ষানীতি পড়ে আমার মনে হয়েছে বিশেষজ্ঞরা চেয়েছেন শিশুরা বুকের ভেতর সব ধর্মের মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা নিয়ে বেড়ে উঠুক। এ কারণে তারা বলেছেন বাচ্চারা যেন সব ধর্মেরই চমৎকার ব্যাপারগুলো শেখার সুযোগ পায়। একটি উদার, মুক্ত, মননশীল সমাজের জন্য এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কি আর কিছু আছে? কিন্তু আমলারা যত জায়গায় সুযোগ পেয়েছেন সব জায়গায় 'নিজ নিজ ধর্ম' কথাটি জুড়ে দিয়েছেন। নিচে কিছু ছবি দিলাম:

বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুদের মধ্যে এই 'নিজ নিজ ধর্মের' দেয়ালটি তুলে দেয়ার কি কোনো দরকার আছে? ইসলাম ধর্মাবলম্বী পরিবারে জন্ম নেওয়া একটি শিশুর কি জানার দরকার নেই হিন্দু ধর্মাবলম্বী পরিবারের একটি শিশু স্রষ্টা ও সৃষ্টির ধারণাটি কী চোখে দেখে? হিন্দু ধর্মাবলম্বী পরিবারে জন্ম নেওয়া একটি শিশুর কি জানার দরকার নেই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পরিবারের একটি শিশুর চোখে ইহকাল ও পরকালের ধারণাটি কী?

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পরিবারে জন্ম নেওয়া একটি শিশুর কি জানার দরকার নেই একটি নিধার্মিক পরিবারের শিশুকে কোনো অলৌকিক ধারণা ছাড়াই কী করে তার বাবা-মা ভালো মানুষ হিসেবে বড় করে চলছেন? নিধার্মিক পরিবারের শিশুদের কি ইসলাম ধর্মের মহামনিষীদের জীবনের গল্পগুলো পড়লে খুব বেশি ক্ষতি হবে?

একজন যদি আরেক জনের অনুভূতিটুকু বুঝতে না পারে তাহলে বড় হয়ে তারা একই সমাজে পাশাপাশি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে কী করে থাকবে?

গণতন্ত্র আর সমাজতন্ত্র হল আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানের বাকি দুটি মূলনীতি। আমি স্কুলে পড়ার সময় সমাজে একটু দুর্বল ছিলাম, তাই প্রায় সময় কোন বিষয় রাজনীতি আর কোন বিষয় অর্থনীতির মধ্যে পড়ে এই বিভাজন বুঝতে পারি না। আমার সৌভাগ্য, পলিটিক্যাল ইকোনমি বলে জ্ঞানের একটি শাখা আছে! আমি তাই আমাদের শিক্ষা নীতির এই দিকগুলো নিয়ে আমার খচখচানি তুলে ধরব।

আমি নিজে সাধারণ মাধ্যমের ছাত্র। তবে মাদ্রাসা মাধ্যম থেকে পাশ করে আসা বন্ধুদের সঙ্গে আমার মাধ্যমে যারা পড়াশোনা করেছে তাদের মেধার বা সম্ভাবনার কোনো পার্থক্য কোনো দিনই পাইনি। যদি কোনো পার্থক্য কখনও চোখে পড়ে সেটি হল, গড়পড়তায় তারা সুযোগ কম পেয়েছে, যেটি তাদের দোষ নয়। আর তাছাড়া এটি শুধু মাদ্রাসার জন্য প্রযোজ্য নয়। একই রকম পার্থক্য বাংলাদেশে শহর আর গ্রামের স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও চোখে পড়ে।

অনেক সময় নিজেদের মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে মানুষ এই দূরত্বটুকু অতিক্রম করে ফেলে। হয়তো তাদের কারও কারও একটু বেশি সময় লাগে, এই যা। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সরকারের উচিৎ এটি ধরে নে্ওয়া যে, সব মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীদের সম্ভাবনা ও মেধা সমান। কালকের পৃথিবীকে পাল্টে দেওয়ার সম্ভাবনা ও দায়িত্ব সাধারণ মাধ্যমে পড়া শিক্ষার্থীর যতটুকু একজন মাদ্রাসায় পড়া শিক্ষার্থীরও ততটুকু।

খসড়া শিক্ষা নীতিতে বিশেষজ্ঞরা ঠিক এই ব্যাপারটি চেয়েছিলেন। ষষ্ঠ অধ্যায়ে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাতে তারা তাই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে আগে থেকে ঠিক করে দেননি যে, কেউ যদি মাদ্রাসাতে ভর্তি হয় বড় হওয়ার পর তাদের জীবিকা কী হবে। তাই তারা মাদ্রাসা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য রেখেছিলেন আত্মিক উন্নতি সাধন। তারা খুব স্পষ্ট করে বলেছিলেন, আচার-সর্বস্ব ধর্মচর্চার যে অর্থনৈতিক বাস্তুতন্ত্র আছে তাতে মাদ্রাসা ব্যবস্থায় আসা শিশুদের অপরিমিত সম্ভাবনা বেঁধে ফেলা না হয়। আমি তাদের সেই কথাগুলো নিচে দিয়ে দিলাম:

এবার দেখুন আমাদের আমলারা শিক্ষানীতির আনুষ্ঠানিক সংস্করণে কী রেখেছেন:

কেউ যদি স্বেচ্ছায় আনন্দের সঙ্গে দ্বীন ও ইসলামের প্রচার ও প্রসার করে সেটি সমস্যা নয়। কিন্তু একটি শিক্ষা নীতি কি কোনো একটি নির্দিষ্ট মাধ্যমের শিশুদের জন্য ঠিক করে দিতে পারে যে, বড় হয়ে বা বিশ-পঁচিশ বছর পর সে কী হবে? আমলারা কি চান না মাদ্রাসা থেকে আগামী দিনের সত্যজিৎ রায়, তারেক মাসুদ, নীলিমা ইব্রাহিম, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ওয়াসফিয়া নাজরীন, জামিলুর রেজা চৌধুরী, মাশরাফিরা বের হয়ে আসুক?

সাধারণ মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো নির্দিষ্ট সম্ভাব্য জীবিকা ঠিক করে দেওয়া হয়নি। কেন সেটা করা হয়নি? কারণ আমরা চেয়েছি তারা যেন ছকে বাঁধা চিন্তা না করে। তারা যেন এটা মনে না করে তাদের সম্ভাবনা কেবল অতটুকুই। আকাশটাই তাদের সীমানা! জয়ের জন্য তাদের রয়েছে গোটা বিশ্ব।

মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা কি কেবল বড় হয়ে অবসরপ্রাপ্ত আমলার বাড়ির পাশের মসজিদের ইমাম হবে? তারা আমলা হবে না? বিশ্ব জয় কি কেবল আমরা সাধারণ মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা করব? আর মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা কেবল আমাদের জয় উদযাপনের মিলাদ পড়াবে?

যদি সম্ভাবনা ও সুযোগের উপর তাদেরও সমান অধিকার থাকে তাহলে শিক্ষানীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে এত শিশু বয়স থেকে তাদের সম্ভাব্য জীবিকা বলে দিতে হবে কেন?

প্রিয় পাঠক, একটি বিষয় খেয়াল করবেন আমি কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্যের ব্যাপারে আমার আপত্তিটি ধর্মনিরপেক্ষতার আলোচনায় রাখিনি। কারণ আমার অনুমান এভাবে মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়া বাচ্চাদের স্বপ্নডানা ছেঁটে দেওয়ার ব্যাপারটি পুরোপুরি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক।

খসড়া শিক্ষা নীতিতে আমার আরেকটি ভারি চমৎকার ব্যাপার চোখে পড়েছে। এটি হল, বিশেষজ্ঞরা পই পই করে বলে দিয়েছেন স্থানীয় সরকারের সঙ্গে যেন শিক্ষা ব্যবস্থার দায়িত্ব ভাগাভাগি করা হয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের কৌশলে আলাদাভাবে বলা হয়েছে দ্বাদশ শ্রেণির আগে (অর্থাৎ এইচএসসির আগে) কোনো পরীক্ষা জাতীয়ভাবে হবে না। পিএসসি হবে থানা-ভিত্তিক, জেএসসি হবে বিভাগ-ভিত্তিক, এসএসসি পরীক্ষা হবে অঞ্চল-ভিত্তিক। শুধু তাই নয়, এর ব্যবস্থাপনাও করতে বলা হয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে। কেন? তার ব্যাখ্যাও খসড়া শিক্ষা নীতিতে দেওয়া আছে।

মূল উদ্দেশ্য হল মানুষ যেন যার যার এলাকার শিক্ষা ব্যবস্থার মানোউন্নয়নের দায়িত্ব নেয় আর এটি যেন একদম তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু হয়। যদি আসলেই সেটি হত, তাহলে কার এলাকার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ায় ভালো সেটির একটি সুস্থ জাতীয় প্রতিযোগিতাও শুরু হত!

কিন্তু আমলারা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নীতিতে কী করলেন? সব স্থানীয় যোগাযোগ বাদ দিয়ে পিএসসি থেকে শুরু করে সব পরীক্ষা পাবলিক পরীক্ষা করে ফেললেন। তাহলে বিশেষজ্ঞরা যে চেয়েছিলেন সবাই যার যার এলাকার পড়াশোনার উন্নতির জন্য মনোযোগী হোক তার কী হবে? কেউ জানে না। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ খুব সম্ভবত আমলাদের সবচেয়ে 'অপ্রিয়' শব্দ।

এতদূর পর্যন্ত আসার পর পাঠকদের মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে গত পাঁচ বছরে এই দফাভিত্তিক তুলনাগুলো কেউ করেনি কেন? যারা নিজেদের শিক্ষা গবেষক হিসেবে বা শিক্ষা বিটের সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দেন তারা কী করছেন? আমি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানি না। অথবা আরেকটি ব্যাপার হতে পারে যে, আসলেই এই পার্থক্যগুলো কোনো চিন্তার বিষয় নয়। আমি যেহেতু শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপারে অনভিজ্ঞ, কাজেই শুধু শুধু ঝামেলা করছি। যদি এটিই সত্য হয় তাহলে আমার আনন্দের সীমা থাকবে না।

আমার লেখার মূল উদ্দেশ্য এটি দেখানো না যে, আমলারা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ডুবিয়ে দিচ্ছেন। আমি বলতে চাই আমাদের বিশেষজ্ঞদের দেখানো স্বপ্নের অনেকটুকুর সঙ্গেই দেখা যাচ্ছে আমলারা একমত নন এবং এই দূরত্ব আমাদের জাতির ভবিষ্যতের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই এটি নিয়ে আলাপ হওয়া জরুরি। সবার কাছে স্পষ্ট হওয়া উচিৎ আসলে কী হচ্ছে।

আমরা যদি জাতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ ও শাহবাগের আলোয় আলোকিত হতে চাই তাহলে তিনটি বিষয় আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই তিনটি বিষয় হল: ১) আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, ২) আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও ৩) আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা।