উন্নয়ন ও গণতন্ত্র : সময় এসেছে পুবের দিকে তাকানোর

মোজাম্মেল খানমোজাম্মেল খান
Published : 31 Jan 2016, 01:30 PM
Updated : 31 Jan 2016, 01:30 PM

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর। স্থান: হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুম। ওয়াশিটন থেকে ১২ হাজার মাইল দূরে বাংলাদেশ নামক এক ভূখণ্ডে তখন বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনী বীর বিক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকার দিকে। উদ্বিগ্ন, আসন্ন পরাজয়ের শঙ্কায় বিপন্ন পাকিস্তানের প্রধান মদদদাতা তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন। জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভা চলছে। সভাপতিত্ব করছেন হেনরি কিসিঞ্জার। সেনাপতিরা দুঃসংবাদ দিলেন, "বাংলাদশের জন্ম এখন অবধারিত।"

এ পর্যায়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি রাষ্ট্রদূত ইউ এ জনসনের মন্তব্য:

"যুদ্ধ যখন শেষ হবে, তখন বাংলাদেশ হবে এক আন্তর্জাতিক ঝুড়ি।"

উত্তরে কিসিঞ্জার বললেন, "আমাদের ঝুড়ি না হলেই ভালো।"

১৯৭৫ সালে এমআইটি থেকে ১০ জন অধ্যাপকের (যার মধ্যে ৪ জন নোবেল বিজয়ী) লেখা নিয়ে প্রকাশিত হল একটি বই। তাদের অভিমত: বাংলাদেশ হল হাসপাতালের এমন এক রোগী যাকে কোনো চিকিৎসা দিয়ে আরোগ্য করা যাবে না। তারা বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানালেন, দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত বাংলাদেশকে পরিত্যাগ করে এমন সব রোগীদের দিকে হাত বাড়াতে যাদের চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা যাবে।

ওই বই প্রকাশের প্রায় চার দশক পর, ২০১৫ সালের ১৭ জুন, 'খাদ্য-ঝুড়ি থেকে খাদ্য-ভাণ্ডার: বাংলাদেশ কীভাবে ক্ষুধা কমানোর জন্য একটি মডেল হয়ে ওঠে' শিরোনামে একটা নিবন্ধ প্রকাশিত হল 'খ্রিস্টিয়ান সায়েন্স মনিটর' নামের দৈনিক সংবাদপত্রে। সেখানে লেখা হয়:

"চার দশক আগে, নবগঠিত এবং নিদারুণভাবে চরম দারিদ্র্য ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষুধায় আক্রান্ত দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ প্লাবিত হল এক ভয়াবহ বন্যায় এবং যার পরিণতিতে নেমে এল ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ। আজ, এক সময়ের খাদ্য 'বাস্কেট কেস' রুপান্তরিত হয়েছে একটি খাদ্য-ভাণ্ডারে এবং বাকি বিশ্বের জন্য ক্ষুধা কমানোর জন্য একটি মডেল হয়ে উঠেছে।"

প্রায় একইভাবে বললেন নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স স্কুলের অধ্যাপক এবং উন্নয়ন ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ গ্লেন ডেনিং:

"বাংলাদেশ গত ১০ থেকে ১৫ বছরে তিন সাফল্যের গল্পের এক– ইথিওপিয়া ও নেপাল হল অন্য দুই– যারা দিয়েছে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা নির্মূলে আমাদের এই লক্ষ্য অর্জনের উপর কিছু আশা।"

১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য ধান লাগত বার্ষিক দেড় কোটি টন, অথচ ধান উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। ঘাটতি ছিল ৪০ লাখ টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ধান উৎপাদন ৩ কোটি ৮৪ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে, যার ফলে দেশে মোটা ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে এখন খাদ্য রপ্তানির সক্ষমতা অর্জন করেছে।

অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিয়ে আশাবাদী বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ। তারা মনে করেন, তাদের নিজেদের আর্থিক সক্ষমতা বেড়েছে এবং আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এটি আরও বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) সাম্প্রতিক এক জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থার ওয়েবসাইটে সোমবার 'আইআরআই'স সেন্টার ফর ইনসাইট পোল: অপটিমিজম গ্রোয়িং ফর বাংলাদেশ'স ইকোনমিক ফিউচার' শিরোনামে এই জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়।

২০১৫ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের সাতটি বিভাগের ৬৪টি জেলায় ২ হাজার ৫৫০ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর জরিপটি চালানো হয়। এই জরিপ তত্ত্বাবধানে আরও ছিল গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারস।

জরিপে উঠে এসেছে, ৬৪ শতাংশ বাংলাদেশি মনে করেন, শিক্ষা, যোগাযোগ এবং অর্থনীতির উন্নয়নের কারণে দেশ সঠিক পথেই রয়েছে। আর ৩২ শতাংশের মতে, বাংলাদেশ ভুল পথে হাঁটছে, কারণ দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নেই। ২০১৩ সালে ৬২ শতাংশ মানুষ মনে করত, দেশ ভুল পথে যাচ্ছে। তবে এ জন্য রাজনীতিকে দায়ী করেছেন তাদের মাত্র অর্ধেক। এছাড়া বাংলাদেশের বর্তমান নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন জরিপে অংশগ্রহণকারী ৮০ শতাংশ মানুষ। একই বছরের জুন মাসে করা সংস্থার আরেকটি জরিপের ফলের চেয়ে এই হার ১২ শতাংশ বেশি।

৮০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছেন, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুবই ভালো অথবা ভালো পর্যায়ে রয়েছে। একই সঙ্গে চলতি বছরে নিজেদের অর্থনৈতিক সক্ষমতার ইতিবাচক পরিবর্তনের ব্যাপারে আশাবাদী ৭২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। আর প্রতি ১০ জনের ৯ জনই জানিয়েছেন, নিজেদের আয়েই পরিবারের মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারছেন তারা।

এছাড়া জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৭২ শতাংশ বর্তমান সরকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন; যা গত জুনে করা সংস্থার আরেকটি জরিপের চেয়ে ৬ শতাংশ বেশি। তারা মনে করেন, সরকার তার দায়িত্ব সঠিকভাবেই পালন করছে।

এছাড়া উন্নয়নের চেয়ে গণতন্ত্র বেশি জরুরি বলে মনে করেন বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ। যদিও গত জুন মাসে এই হার ছিল ৬৮ শতাংশ, কিন্তু তা কমে এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫১ শতাংশে। অন্যদিকে, গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়ন বেশি জরুরি বলে যারা মনে করেন, তাদের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। ২৭ শতাংশ থেকে এই হার বেড়েছে ৪৫ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে আইআরআইএর এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ড্রেক লুইটেন বলেন, 'বাংলাদেশের মানুষের কাছে অর্থনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে এই জরিপে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, যদিও প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে হলে সব ক্ষেত্রেই স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে হবে।'

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এই ক্রমবর্ধমান আশাবাদের মধ্যে এ জরিপে যে গুরুত্বপূর্ণ একটি শিফট হল, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং একটি সমৃদ্ধ অর্থনীতির অগ্রাধিকারের ব্যাপারে মানুষ প্রায় সমানভাবে বিভক্ত। যেটা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সেটা হল, গত জুনে যখন ৬৮ শতাংশ মানুষ গণতন্ত্রকে উন্নয়নের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভেবেছে, বর্তমান জরিপে সেটা ৫১ শতাংশে নেমে এসেছে, যে উদার ওয়েস্টমিনিস্টার টাইপ গণতন্ত্র বাংলাদেশ গত প্রায় ২৫ বছর ধরে অনুশীলনের চেষ্টা করে আসছে।

ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নিরিখে, বাংলাদেশ খুব ভালোভাবে পশ্চিমা দেশগুলির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। আমি বাংলাদেশে আমার সহকর্মী শিক্ষাবিদগণ, বিশেষ করে টিভি টক শোগুলোতে যে বল্গাহীন স্বাধীনতা ভোগ করেছেন সেটা দেখে ঈর্ষান্বিত হই। সে ধরনের স্বাধীনতা কানাডায় আমরা চিন্তা করতেও পারি না।

আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের সবচেয়ে বড় বিফলতা একটি বহুত্ববাদী রাজনৈতিক সিস্টেম তৈরি করতে ব্যর্থতা। এর বিপরীতে হয়েছে একটি মেরুকরণের রাজনৈতিক বিভক্তি– যেখানে বিভাজন এসেছে– দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের রক্তমাখা ইতিহাস। পৃথিবীর ইতিহাসে যারা আমাদের মতন এক সাগর রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছে, তাদের ক্ষেত্রে ঐ রক্তমাখা ইতিহাস যারা অস্বীকার করে বা যারা ঐ ইতিহাসের বিপরীতে অবস্থান নেয়, রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের অবস্থান বা পুনর্বাসন ঘটেনি। যার ফলে এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও ব্যর্থ হয়েছে, চূড়ান্ত সমাধান হিসেবে যার চিন্তা ছিল একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ও ক্ষমতার মসৃণ পরিবর্তন।

মেরুকরণের রাজনৈতিক বিভক্তির কারণে সে ব্যবস্থাও ম্যানিপুলেশনর শিকার হয়। ফলে সৃষ্টি হয় তথাকথিত 'এক এগারো' এবং পরিণামে দেশে নেমে আসে দুই বছরের সংবিধান-বহির্ভূত শাসন। আজকে যারা 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা' নিয়ে চিৎকার করছেন তাদের ক্ষমতালিপ্সাই এ ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী।

আইআরআই প্রতিবেদনে উন্নয়নের জন্য জনগণের পছন্দের উপরে বর্ণিত ফলাফল স্থানান্তরের দিকে তাকিয়ে এখন সম্ভবত সময় এসেছে বাংলাদেশের দৃষ্টি প্রাচ্য অভিমুখে ধাবিত করার যেখানে উন্নয়ন ওয়েস্টমিনিস্টারের উদার গণতন্ত্রের চর্চার উপরে অগ্রাধিকার পেয়েছে। এ ধারায় মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুর এক বিপ্লব সাধিত করেছে এবং উভয় দেশই গত ৫০ বছর ধরে মডেল প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।

সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা নেতা লি কুয়ান ইউ ২০১৫ সালের ২৩ মার্চ শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার প্রতি মৃত্যু-পরবর্তী শ্রদ্ধা জানাতে ফাইনানশিয়াল টাইমস লিখেছে:

"ওয়াশিংটন ডিসি দ্রুত এক 'অকার্যকর রাজধানীর প্রতিবিম্ব' হয়ে উঠছে এবং তার বিপরীতে সিঙ্গাপুর হয়েছে সুশাসনের ধারণার পোস্টার সন্তান।"

লি কুয়ান ইউএর মতে:

"উদার গণতন্ত্রের উচ্ছ্বাস অসংযম ও অগোছালো অবস্থার সৃষ্টি করে যেটা উন্নয়নের জন্য ক্ষতিকর হয় দাঁড়ায়। একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার মানের চূড়ান্ত পরীক্ষা হল ঐ ব্যবস্থা ঐ সমাজে তার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে কতটুকু অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছে তার উপর। গণতন্ত্র এটা করার একটা একটা উপায়, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনী প্রক্রিয়া যদি ঐ মূল্যবান শেষ প্রাপ্তি অর্জনে বেশি সহায়ক হয় তাহলে আমি উদার গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। এ দুটোর কোনো একটা পদ্ধতি পছন্দে নৈতিকতা বিসর্জনের প্রশ্নই উঠে না।"

সিঙ্গাপুরের এই লৌহমানবের মতে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অন্তর্নিহিত মূল্য নেই। মোদ্দা কথা হল সুশাসন। সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব 'স্থিতিশীল ও সুশৃঙ্খল সমাজ' যেখানে নাগরিকদের তাদের খাদ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান, এবং স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। মালয়েশিয়ার মাহাথিরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে লিএর যুক্তি হল, 'পূর্ব' ও 'পশ্চিমা' সংস্কৃতির মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। পূর্বের সংস্কৃতিতে পশ্চিমের তুলনায় ব্যক্তির চাইতে সমষ্টিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, যার ফলে সামষ্টিক ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিরাপত্তার প্রয়োজনে মানবাধিকার অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়।

এ প্রেক্ষিতেই বলছি, এখন আমাদের সামনে পূর্বের দিকে তাকানোই হবে যথোচিত পদক্ষেপ।