টিআইবি ও সরকার: অর্জন ও বাস্তবতা

সঙ্গীতা ইয়াসমিন
Published : 6 Feb 2016, 09:27 AM
Updated : 6 Feb 2016, 09:27 AM

বেশ কয়েক মাস যাবত টিআইবি প্রসঙ্গে কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করছি; সময়াভাবে সেটা যথাসময়ে হয়ে ওঠেনি। এরই মধ্যে সময়ের ঘড়ি ক্যালেন্ডারের পাতায় যোগ করল আরও একটি নতুন বছর। নতুন বছরে অনেক নতুন কিছুর সঙ্গে পুরনো ঘটনা চাপা পড়ে যায়। তবু কিছু বিষয় থেকেই যায় যা পুরাতন হয় না কখনও, দাবি রাখে আলোচনার। তাই আশা করব সঙ্গে থাকবেন পাঠক, আর ক্ষমা করবেন এই পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটার দায়ে।

হ্যাঁ, প্রসঙ্গ টিআইবি। মূলত টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন পার্লামেন্ট ওয়াচ ২০১৫ প্রকাশ-পরবর্তী সময়ে মহান সংসদ ও এর বাইরে নানাবিধ প্রতিক্রিয়া থেকেই আমার এই লেখার তাড়না তৈরি হয়। বিশেষ করে সংসদ, আইন ও বিচার বিভাগীয় সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারপারসন শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া এক বক্তব্যের প্রেক্ষিতেই এ লেখা।

আলোচনার শুরুতেই একটা সরল স্বীকারোক্তি করছি: কোনো দল, মত, প্রতিষ্ঠানের কিম্বা স্বয়ং টিআইবির প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে এই লেখা লিখছি না। নিতান্তই সামাজিক দায় থেকে, একজন সচেতন মানুষ হিসেবে এ লেখার অবতারণা। ২৫ অক্টোবর, ২০১৫ টিআইবির নিয়মিত প্রকাশনা পার্লামেন্ট ওয়াচ প্রকাশিত হবার পরে নভেম্বর ৯, ২০১৫এর সংসদ অধিবেশনসহ বিভিন্ন মহলে টিআইবির বিরুদ্ধে নানা রকম বিষোদগার করা হয়েছে ষে বিষয়ে পাঠক নিশ্চয়ই অবগত। তাই এর কারণ অনুসন্ধানের পূর্বেই আমাদের জেনে নেওয়া দরকার কেন এই পার্লামেন্ট ওয়াচ নামের গবেষণা প্রতিবেদন এবং কী-ই-বা এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য?

টিআইবির গবেষণা বিভাগের নিয়মিত কার্যক্রমের মধ্যে পার্লামেন্ট ওয়াচ একটি ধারাবাহিক গবেষণাকর্ম। যা সংসদ অধিবেশন শুরু হলেই নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, তথ্য সংগ্রহ ও সন্নিবেশন শুরু হয় এবং তার ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আমরা জানি, সংসদীয় গণতন্ত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অপরিহার্য স্তম্ভগুলোর অন্যতম একটি হল জাতীয় সংসদ। এই মহান জাতীয় সংসদ কীভাবে আরও জনকল্যাণমুখী আইন প্রণয়ন করতে পারে, কীভাবে সেখানে জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটানো যায়, কীভাবে সরকারকে আরও বেশি জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসা যায় এবং সর্বোপরি দুর্নীতি প্রতিরোধে জাতীয় সংসদের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা আরও বৃদ্ধি করা যায় সে লক্ষ্যেই টিআইবি অষ্টম জাতীয় সংসদ থেকে নিয়মিত এবং ধারাবাহিকভাবে এই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

২০১৫ সালের অক্টোবরের প্রতিবেদনটি ছিল দশম জাতীয় সংসদ অধিবেশনের ওপর দ্বিতীয় প্রতিবেদন। এর ফলাফলে অসন্তোষ প্রকাশ করে টিআইবিকে সংসদে গিয়ে ব্যাখ্যা দিতে ও সংসদ অবমাননার দায়ে ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিলেরও সুপারিশ করা হয়েছে সরকারি সংশ্লিষ্ট মহল থেকে। যদিও, টিআইবির জন্য এ জাতীয় মন্তব্য নতুন কিছু নয়। টিআইবির যে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশিত হবার পর বেশ কিছুদিন সংসদ খুব সরগরম থাকে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় (যাদের বিপক্ষে যায় প্রতিবেদন) এই বিষয়ে তীব্র বিষক্রিয়া ব্যক্ত করতেই থাকেন।

টিআইবি যথারীতি এসব মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে খুব বিনয়ের সঙ্গে তাদের দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করে থাকে। অতি আশ্চর্যজনক ব্যাপার যে, চূড়ান্তভাবে টিআইবি সব সময় বিজয়ী হয়। যদিও, প্রকৃতপক্ষে এটা জয়-পরাজয়ের খেলা নয়। সরকারের পেছনে লাগাও টিআইবির কাজের লক্ষ্য নয়। বরং তারা সরকারের হাত শক্তিশালী করার লক্ষ্যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আরও সুসংহত করার জন্য, দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্যই কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।

তাই প্রতিটি প্রতিবেদন প্রকাশের পরই তারা সংবাদ সম্মেলন করে, পত্রিকায় প্রতিবেদন পাঠিয়ে, ওয়েবসাইটে তথ্য আপডেট করে যথাসম্ভব সুস্পষ্টভাবে নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করার ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকে। তথাপিও এই আক্রমণ! অনাহুত ভয়ঙ্কর আক্রমণ! কেন?

খুব সাদা চোখে এবং কোনো রকম গবেষণা না করেই এর কারণ বিশ্লেষণ করা যায়; প্রধানত দুটো কারণে এটা ঘটে বলে ধারণা করা হয়। প্রথমত, পরমতসহিষ্ণুতার অভাব; যা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিতেই নেই। আমরা অন্যের সমালোচনা কখনও ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করতে শিখিনি। আর এ বিষয়ে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন ও তার নেতৃবৃন্দ আরও কয়েক কাঠি সরেস। দ্বিতীয়ত, টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন ত্রুটিমুক্ত এবং যথার্থ; সরকার ভেতরে ভেতরে সে কথা বিশ্বাস করেন। কিন্তু, প্রতিবাদবিহীন নীরব সমর্থনে টিআইবির সকল সুপারিশ মেনে নেওয়ার মতো উদারতা প্রদর্শন করে দেশের আপামর জনতার কাছে নিজেদের হেয় করতে চান না। আর সে কারণেই কিছু উদ্ভট মন্তব্য, অনাহুত তর্কবিতর্ক আর বালখিল্য আচরণ করে দেশবাসীকে বিভ্রান্তিতে রাখেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১০ সালে টিআইবির জাতীয় খানা জরিপের (জনমত জরিপ) ফলাফলে 'বিচার বিভাগ' দুর্নীতির শীর্ষে থাকাতে দুজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বিচার বিভাগকে অসম্মান করার অপরাধে টিআইবির বিরুদ্ধে দু দুটি পৃথক মানহানির মামলা করেন যথাক্রমে চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লার আদালতে। দুবছরেরও অধিক কাল সেই মামলা চলার পর দুটি মামলায় টিআইবির পক্ষে রায় ঘোষিত। এটি কোনো হাস্য-পরিহাস, জয়-পরাজয়, শক্তি-পরাশক্তির লড়াই কিম্বা টিআইবির প্রতিষ্ঠানিক দম্ভের বিষয় নয়।

এটি মূলত অর্জনের বিষয়; সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় টিআইবি তার যে প্রতিষ্ঠানিক লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও গন্তব্য ঠিক করেছে সে অনুযায়ী যে কর্মকৌশল, কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করেছে এবং সে লক্ষ্যেই তাদের ক্রমাগত যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। এই অর্জন সততার, বিশ্বস্ততার, দেশপ্রেমের, সামাজিক দায়বদ্ধতার এবং নাগরিক দায়িত্বশীলতার।

প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি কাঠামোর মধ্যে থেকে এ জাতীয় অর্জন খুব সহজ কি? সম্ভবত সহজ নয়। আর নয় বলেই টিআইবির কার্যক্রমে সরকারের এত ভীতি! কী জানি, যদি কখনও টিআইবি সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে? রাজনীতির বাইরে থেকেও যারা এত শক্তিমান তারা এই মাঠে এলে সরকার কিম্বা আমাদের দেশের যে কোনো রাজনৈতিক সংগঠন পারবে তো পাল্লা দিতে?

এসব ভীতি অহোরাত্র শাসকগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনায় আচ্ছন্ন করে রাখে। তাই সত্য অকপটে মেনে নেওয়ার বদলে ক্ষমতা হারানোর শঙ্কায় পড়ে যান তারা। আমার এ বক্তব্য যে খুব একটা অনুমান-নির্ভর নয় তা আইন, সংসদ ও বিচার বিভাগীয় সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারপারসন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বক্তব্যে যথার্থই প্রমাণিত। সুরসিক সুরঞ্জিত ২০১০ সালে বিরোধী দলে থেকে টিআইবির খানা জরিপ প্রতিবেদন ফলালফল সম্পর্কে এ রকম মন্তব্য করেছিলেন:

"আমরা যখন ক্ষমতার বাইরে থাকি তখন টিআইবির প্রতিবেদন শুনে বলি আলহামদুলিল্লাহ্‌! আর ক্ষমতায় থাকলে বলি নাউজুবিল্লাহ!"

তখন তিনি প্রকারান্তরে সেই প্রতিবেদনের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি যে সেদিন সত্য উপলব্ধি প্রকাশ করেছিলেন তা নিজের আচরণেই প্রমাণ করেছেন টিআইবি সম্পর্কিত তাঁর বর্তমান অবস্থানে। টিআইবির ২০১৫এর পার্লামেন্ট ওয়াচ প্রতিবেদন প্রকাশের পর তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন:

"টিআইবি মহান জাতীয় সংসদ নিয়ে কথা বলে সংসদের অবমাননা করেছে, তারা সব বিষয়ে কথা বলছে, আজ সংসদ নিয়ে বলছে, কাল হয়তো আরও বড় কিছু নিয়ে কথা বলবে। সুতরাং তাদের নিবন্ধন বাতিল করে দেওয়া উচিৎ।"

তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন যে, একটি গণতান্ত্রিক স্বাধীন দেশে কারও মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা যায় না।

আমার অতি ক্ষুদ্র জ্ঞানের বিশ্লেষণে আমি এটা বিশ্বাস করি যে, টিআইবি তার প্রতিষ্ঠানিক যে স্বীকৃতি ইতোমধ্যেই অর্জন করেছে, তার চেয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল কিম্বা ভোগ কোনো অংশেই বেশি আনন্দের তো নয়ই বরং মহত্ত্বর কিছুও নয় টিআইবির কাছে। সুতরাং, টিআইবির সেই অসদিচ্ছা কখনও ছিল না এবং অদূর ভবিষ্যতেও তেমনটি ঘটার আশঙ্কা দেখছি না।

এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় মনে করছি। পাঠক নিশ্চয়ই জ্ঞাত আছেন যে, টিআইবি চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল ২০১১ সালে তত্ত্ববধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হয়েও সম্পূর্ণ নীতিগত কারণে স্বেচ্ছায় সে পদ প্রত্যাহার করে নেন। কারণ, তিনি অন্যায়ের সঙ্গে, দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে, অসতের সঙ্গে কোনোরূপ সহ-অবস্থান মেনে নিতে জানেন না। এছাড়াও, অতীতে অনেক স্বনামখ্যাত বৈদেশিক দাতাগোষ্ঠী টিআইবির কাজের জন্য অনুদান দিতে চেয়েছে, কিন্তু নিজেদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও নীতিমালার সঙ্গে সাযুজ্য না থাকায় টিআইবি দৃঢ়তার সঙ্গে সেই অনুদান প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতেও দ্বিধাগ্রস্ত হয়নি।

সুতরাং, টিআইবি কেবল একটি মামুলী এনজিও নয়; একটি অসরকারি, অরাজনৈতিক, অলাভজনক ও পক্ষপাতমুক্ত প্রতিষ্ঠান। কোনো রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি, সংগঠনের প্রতি কোনোরূপ পক্ষপাতিত্ব, ক্ষোভ কিম্বা অসহিষ্ণুতা নেই তাদের। কেবল একটি বিষয়ে বড় অসহিষ্ণু তারা, একটি বিষয়ের প্রতি তাদের সংবেদনশীলতার বড় অভাব! সেটি হল দুর্নীতি। দুর্নীতিমুক্ত, সুশাসিত একটি সুখী সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে তারা; যেখানে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, চাকরিজীবিসহ সুশীল সমাজের সকলেই ন্যায় ও আইনানুগ সমাজের বাসিন্দা হবেন।

টিআইবির এই স্বপ্নের সারথী হয়ে সারা দেশের সুশীল সমাজ, যুবা-তরূণ ও পেশাজীবী সংগঠন একাত্ম হয়েছে। তাই প্রকৃতপক্ষে, টিআইবি জনগণের মুখপাত্র। তারা এখন গণমানুষের কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছে বললেও এতটুকু অত্যুক্তি হবে না।

তাদের আজকের এই অবস্থান কেবল প্রাতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের ভিত্তি সুদৃঢ় করেনি, উপরন্তু গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় সুশাসন নিশ্চিত করতে সরকারের সকল পদক্ষেপ কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। টিআইবির পলিসি অ্যাডভোকেসি জাতীয় যে সকল গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে অবদান রেখে সফল হয়েছে তার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হল রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা সরকারি দল। যার মধ্য থেকে যৎসামান্য কিছু উদাহরণ পাঠক সমীপে তুলে ধরছি।

১। দুর্নীতি দমন আইন-২০০৪ ও একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনে টিআইবির অ্যাডভোকেসি কার্যক্রম ছিল গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক।

২। ২০০৬, ২০০৭ ও ২০০৯ সালে সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর কৃত গবেষণার সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশ পাসপোর্ট এবং অভিবাসন অফিস, পাবলিক সার্ভিস কমিশন এবং সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের অফিসসমূহে ব্যাপক সংস্কার গ্রহণ।

৩। হুইসেল ব্লোয়ার প্রটেকশন আইন-২০১১ প্রণয়নের ক্ষেত্রেও টিআইবির প্রত্যক্ষ ভূমিকা।

৪। নির্বাচন কমিশনের ওপর টিআইবির ২৯টি সুপারিশের ১৯টি সরকার কর্তৃক গৃহীত ও বাস্তবায়িত।

৫।  ২০০৭ সালের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের শিক্ষাক্রমে দুর্নীতিবিরোধী বিষয় অন্তর্ভুক্তকরণ।

৬। তথ্য জানার অধিকার আইন-২০০৯ প্রবর্তনে অন্যান্য সকল সংস্থার সঙ্গে টিআইবির ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ । সেবাদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানে সিটিজেন চার্টার বাস্তবায়ন।

৭। ২০১০ সালের টিআইবির সুপারিশক্রমে বিচার বিভাগের দুর্নীতি প্রতিরোধকল্পে ৫ সদস্য বিশিষ্ট বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠন, সিনিয়র বিচারকদের সম্পদের পরিমাণ প্রকাশসহ সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের অফিসে অভিযোগ বক্স স্থাপন।

৮। পাবলিক-প্রাইভেট সেক্টরের ক্রয় কমিটি এবং পদ্মা ব্রিজের ক্রয়ে সুশীল সমাজ সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে টিআইবিকে পর্যবেক্ষক হিসেবে অন্তর্ভুক্তকরণ এবং এলজিইডির এডিবির প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসন সম্পর্কিত কারিগরি সহায়তা প্রদানে টিআইবির ওপর দায়িত্ব অর্পণ।

৯। বিগত পার্লামেন্ট ওয়াচ প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে দশম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনেই সবকটি পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটির গঠন ও ডিজিটাল টাইম কিপারসহ পার্লামেন্ট মেম্বারদের কোড অব কন্ডাক্টের বেসরকারি বিল উত্থাপন।

১০। সর্বোপরি, বাংলাদেশে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী আইন বাস্তবায়নে ও এর পর্যালোচনা প্রতিবেদন তৈরিতে সরকারকে সহায়তাকরণ।

সুতরাং, এহেন পরিস্থিতিতে সরকারি দল সুবিবেচক হলে টিআইবি সম্পর্কে বৃথা আস্ফালন বন্ধ করে, তাদের সুপারিশসমূহ খতিয়ে দেখতে পারেন। কিম্বা টিআইবির সকল পরামর্শ মেনে না নিয়েও সে বিষয়ে নীরব থাকতে পারেন। আর এই মৌনতা দুভাবে সরকারকে লাভবান করতে পারে। যেমন:

১। সরকারের সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতার অভাব নামে যে কলঙ্ক রয়েছে সেটি মোচন হতে পারে এবং প্রকৃত অর্থেই সরকার সংসদকে আরও বেশি কার্যকর করে গণতন্ত্র সুসংহত করার লক্ষ্যে চেষ্টা চালাতে পারেন। যা আমাদের মতো সদ্য গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার পথে অগ্রগামী দেশের জন্য অতীব জরুরি।

২। নীরবতা যেমন সম্মতির লক্ষণ তেমনই বড় ধরনের প্রতিবাদও হতে পারে। উপরন্তু, সর্বসাধারণের কাছে তার অর্থ দাঁড়াতে পারে এরূপ; সরকার টিআইবির কথায় কোনোরূপ কর্ণপাতই করলেন না! কিম্বা আরও একটু বৃহৎ পরিসরে গভীর বিশ্লেষণ করলে মনে হতে পারে, দেশে গণতন্ত্রের প্রকৃত চর্চা হচ্ছে বলেই টিআইবির কর্মকাণ্ডে সরকার হস্তক্ষেপ করছে না। তারা স্বাধীনভাবে গবেষণা করতে পারছে। সংবাদ মাধ্যমগুলোও তা প্রকাশ করতে পারছে। সুতরাং সরকার কারও বাকস্বাধীনতা হরণ করছে না।

কিন্তু এ দুইয়ের কোনো পন্থাই অবলম্বন না করে বরাবরই একই স্টাইলে সরকারি দল একইরূপ বিষোদগার কেন করেন সেটা ভাবনার বিষয়। আর তাদের এই টানাপড়েনে যে বিষয়টি খুব বেশি স্পষ্টতর হয় সেটি হল, টিআইবির অস্তিত্ব! টিআইবির গুরুত্ব! আর আমি মনে করি এটিই টিআইবির সর্বোচ্চ অর্জন।

বাংলাদেশের কোনো সরকারই ক্ষমতায় থাকাকালীন টিআইবিকে পছন্দ করেন না কিম্বা টিআইবির বক্তব্য মেনে নেওয়া খুব সহজ হয়ে ওঠে না, আবার একে উপেক্ষা করাও খুব কঠিন হয়ে যায়। টিআইবিকে সরকারের গণনার মধ্যে রাখতেই হয়। সেটি যে প্রকৃত বাস্তবতা তার উদাহরণ উপরেই উল্লেখ করেছি। সুতরাং, এ কথা অনুধাবন করতে খুব ক্লেশ করতে হয় না যে, কোনো সরকারের পক্ষেই আইনত টিআইবি বন্ধ করা সম্ভব নয় (যদি না তা ৫৭ ধারার মতো আরও শক্তিশালী কিছু নতুন করে আবির্ভূত হয়)।

পরিশেষে বলব, আর নয় বৃথা ক্রন্দন! আর নয় মিছে আস্ফালন! সময় এসেছে রূখে দাঁড়ানোর। এক টিআইবি বন্ধ হলে দেশের ষোল কোটি কণ্ঠস্বর হবে আরও বেশি সোচ্চার। তাই আসুন, একটি দুর্নীতিমুক্ত সুন্দর সোনার বাংলাদেশ গড়তে আরও বেশি পর মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই। আরও বেশি গঠনমূলক রাজনীতির চর্চা করি, হই আরও বেশি জনকল্যাণমুখী। দুর্নীতি দূর করে, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এবং শুদ্ধতম গণতন্ত্রের চর্চায় আসুন জন অংশগ্রহণ নিশ্চিত করি।

শত শহীদের রক্তে কেনা পূণ্যভূমিকে দুর্নীতি নামক সাপের ছোবলে আর দংশিত হতে না দিই। এখনই সময় দুর্নীতির বিষদাঁত ভেঙ্গে দিয়ে এর ছোবল থেকে স্বপ্নের স্বদেশকে বাঁচানোর।

লেখকঃ সঙ্গীতা ইয়াসমিন, টরন্টো, কানাডা থেকে ।