নতুন মুদ্রানীতি: সম্প্রসারণমূলক কিন্তু ধারাবাহিক

সায়মা হক বিদিশা
Published : 25 Jan 2016, 09:18 AM
Updated : 25 Jan 2016, 09:18 AM

একটি দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সর্বোপরি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সুচিন্তিত ও বলিষ্ঠ মুদ্রানীতির ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৪ জানুয়ারি, ২০১৬, বাংলাদেশ ব্যাংক এ অর্থবছরের দ্বিতীয় মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রথম বছর হিসেবে উচ্চতর প্রবৃদ্ধির লক্ষমাত্রা অর্জনের প্রেক্ষিতে এই মুদ্রানীতি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

জানুয়ারী-জুন ২০১৬ মুদ্রানীতি অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপির) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৬.৮ থেকে ৬.৯ শতাংশ। অপরপক্ষে মূল্যস্ফীতি প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ৬.১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাষায় এই মুদ্রানীতি 'সংযত কিন্তু সমর্থনমূলক' অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির উচ্চ লক্ষমাত্রায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ঠিকই কিন্তু তা করা হয়েছে যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে যার প্রতিফলন দেখা গেছে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি প্রক্ষেপণের মতো বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে।

জানুয়ারি-জুন ২০১৬এর মুদ্রানীতিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে এবং এ লক্ষ্যে গত ফেব্রুয়ারি ২০১৩এর পর প্রথমবারের মতো ব্যাংকের নীতি সুদের হার (রেপো ও রিভার্স রেপো) কমানো হয়েছে– রেপোর হার ৭.২৫ থেকে ৬.৭৫ এবং রিভার্স রেপোর হার ৫.২৫ থেকে ৪.৭৫ করা হয়েছে। রেপোর হার হচ্ছে যে হারে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করে; অপরপক্ষে রিভার্স রেপো হচ্ছে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য যে হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে।

নীতি সুদহার কমানোর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক মূলত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম প্রসারের উদ্যোগ নিয়েছে– নীতি সুদের হারের হ্রাস বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ব্যবসায়ী মহলকে ভবিষ্যতে সার্বিক সুদের হারের নিম্নগামিতার ইঙ্গিত দেয়, যা কিনা বিনিয়োগ উৎসাহিত করবে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অতিরিক্ত তারল্য ও ঋণের চাহিদা কম থাকার কারণে রেপো-সংশ্লিষ্ট চাহিদা বেশ কিছু দিন থেকেই নিম্নগামী। সেই একই কারণে রিভার্স রেপো-সংশ্লিষ্ট যোগান আবার উর্ধ্বগামী। এই অতিরিক্ত তারল্য/রিজার্ভ আবার মুদ্রার বিনিময় হার, বিশেষত রিয়েল এফেক্টিভ রেট স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করবে।

তবে বর্তমানে রেকর্ড পরিমাণ রিজার্ভের (ডিসেম্বর ২০১৫এর রিজার্ভ ছিল ২৭৪৯৩.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) পরিপ্রেক্ষিতে রিজার্ভের উৎপাদনশীল ব্যবহারের ক্ষেত্রে মুদ্রানীতিতে সুনিদৃষ্ট কোনো নীতি নেই। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুচিন্তিত দিকনির্দেশনার প্রয়োজন রয়েছে।

মূল্যস্ফীতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদের পরিবর্তনের পদক্ষেপ যথেষ্ট সময়োপযোগী। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, রেপো তুলনামুলকভাবে সস্তা হবার ফলে কম তারল্যের ব্যাংকগুলো এই সুযোগের অপব্যবহার করতে পারে যা খেলাপি/খারাপ ঋণের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকগুলো যাতে রেপোর মাধ্যমে ঋণ না নিতে পারে সে ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সতর্ক থাকতে হবে।

নীতি সুদের হারের এই হ্রাস দেশের পুঁজিবাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়াবে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পুঁজিবাজার চাঙ্গা করার লক্ষ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারে অতিরিক্ত বিনিয়োগ সমন্বয় করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক সময়ে গৃহীত নীতি এবং পুঁজিবাজারের তালিকা-বহির্ভূত প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণের ফলে সাম্প্রতিক মুদ্রানীতি পুঁজিবাজারের জন্য আশাব্যঞ্জক ফল বয়ে আনবে বলে মনে করা যায়।

তবে রেপো ও রিভার্স রেপো কমার ফলে সুদের হারেও এর প্রভাব পড়বে যা কিনা ব্যক্তিখাতে সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। ব্যক্তিখাতে সঞ্চয়ের হার বাড়ানোর মাধ্যমে উৎপাদনশীল বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে নীতি সুদের হারের হ্রাসের সকল দিক তাই সাবধানে বিবেচনা করা দরকার।

এই মুদ্রানীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমানো এবং এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৪.৮ শতাংশ যা গত জুলাই-ডিসেম্বরের জন্য ছিল ১৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, এই লক্ষ্যমাত্রা 'আগের মুদ্রানীতির চেয়ে কম হলেও প্রকৃত অর্জনের চেয়ে বেশি' তাই তা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার পরিপন্থী হবে না।

একইভাবে ব্যাপক মুদ্রা জোগানের প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশ করা হয়েছে যা ছিল ১৫.৬ শতাংশ। রিজার্ভ মুদ্রার ক্ষেত্রেও নতুন মুদ্রানীতিতে প্রবৃদ্ধি ১৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৪.৩ শতাংশ প্রক্ষেপন করা হয়েছে। ২০১৬ অর্থবছরে জাতীয় সঞ্ছয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রার ৪৪ শতাংশ অর্থবছরের প্রথম চার মাসেই অর্জিত হওয়ায়, ব্যাংক থেকে সরকারি খাতে ঋণগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা কমতে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার নিম্নমুখী পরিবর্তন চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলা চলে।

বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি বা নীতিসুদের হ্রাসের মতো নীতিগুলো বিনিয়োগ-বান্ধব হলেও এ কথা মনে রাখতে হবে যে, আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্বল ভৌত অবকাঠামো, দীর্ঘমেয়াদী ঋণের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মতো যোগান-ভিত্তিক জটিলতাগুলোর যদি আশু সমাধান না হয় তবে বিনিয়োগ-বান্ধব মুদ্রানীতির প্রকৃত সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য সেই ইঙ্গিতই দেয়। এছাড়া ব্যাংকিং খাতের অব্যাবস্থাপনা ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ না কমাতে পারলে দীর্ঘমেয়াদে আভ্যন্তরীন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনও কঠিন হবে।

সাধারণত মুদ্রানীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা থাকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে। মূল্যস্ফীতি গত কয়েক বছর ধরে নিয়ন্ত্রণে থাকলেও গত ডিসেম্বর ২০১৫এর মূল্যস্ফীতির (৬.১০ শতাংশ), বিশেষত খাদ্য-বহির্ভুত মূল্যস্ফীতির (৭.০৫ শতাংশ) উর্ধমুখী প্রবণতা কিছুটা উদ্বেগের জন্ম দেয়। মূল্যস্ফীতি ৬-৭ শতাংশের মধ্যে রাখার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারের নিম্নগামী গতি ও দেশের কৃষি উৎপাদনের ভূমিকাই ছিল মূল– কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি নির্দেশনার তেমন কোনো প্রভাব এ ক্ষেত্রে ছিল না।

এ প্রেক্ষিতে স্থানীয় বাজার-কেন্দ্রিক পণ্যর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংককে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। উচ্চ প্রবৃদ্ধি আর মূল্যস্ফীতির তাত্বিক বিতর্কের ভিত্তিতে আমাদের মতো উন্নয়নশীল ও নিম্ন আয়ের দেশের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৬-৭ শতাংশে সন্তুষ্ট না থেকে আন্তর্জাতিক বাজারের সুবিধাজনক অবস্থার সুযোগ নিয়ে মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও উচ্চাভিলাষী হতে পারে এবং এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট মুদ্রানীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

মুদ্রানীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হচ্ছে মুদ্রা বিনিময় হারের ব্যবস্থাপনা। বিগত কয়েক বারের মতো এবারের মুদ্রানীতিতেও এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই। আমদানি-রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান বজায় রাখতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শিগগিরই টাকার বিনিময় হারের নিম্নমুখী সংশোধন করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের কম দাম থাকার কারণে মুদ্রা বিনিময় হারের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য এটি একটি সুবিধাজনক সময়।

পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশ অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে কিছুটা সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি প্রায় স্থবির বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও গতিশীলতা আনবে বলে মনে করা যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতি মোটামুটি সন্তোষজনক হলেও সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি যাতে করে প্রভাব ফেলতে না পারে সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সতর্ক থাকতে হবে।

আন্তর্জাতিক বাজারের ক্রম-নিম্নগামী জ্বালানি তেলের সুযোগ নেবার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জানুয়ারী-জুন মুদ্রানীতি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।