জাপানে ভূমিকম্প-প্রস্ততি ও বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

শোয়েব সাঈদ
Published : 11 Jan 2016, 05:32 AM
Updated : 11 Jan 2016, 05:32 AM

২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি ভোর পাঁচটার সাম্প্রতিক কম্পনটি গত বছরের নেপালের ভূমিকম্পের পর আবারও মনে করিয়ে দিল, বড় ধরনের ভূমিকম্প-ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। নেপাল-বিপর্যয়ের পর বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৬ থেকে ৭ মাত্রার বেশ কয়েকটি কম্পনের আশঙ্কা করা হচ্ছিল। ম্যাগনিচ্যুড ৬-৭ মাত্রাকে বলা হয় শক্তিশালী; ৭-৮ মাত্রাকে মেজর; ৮-৯ হল গ্রেট; তার উপর হলে গ্রেটার। অর্থাৎ আমরা শক্তিশালী থেকে মেজর ভূমিকম্পের সম্ভাবনার মধ্যে রয়েছি যাতে ঘটতে পারে লাখো প্রাণহানি।

এটা ঠিক, বাংলাদেশ সব সময় ভূমিকম্পের শঙ্কা-বলয়ের মধ্যে ছিল। শত বছরের ব্যবধানে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে ভূমিকম্পের ফিরে আসার ইতিহাস তো রয়েছেই। তবে সাম্প্রতিককালে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে উৎকণ্ঠা ক্রমাগত বাড়ছে। এ দেশের অবস্থান বেশ কয়েকটি বিপজ্জনকভাবে সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটের বলয়ের মধ্যে। তাছাড়া দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে সক্রিয় কিছু স্থানীয় ফল্ট বা চ্যুতি থেকে বিপদ আসতে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আমাদের অতি স্বল্প উচ্চতাও বিপদের আরেকটি বাড়তি কারণ।

লক্ষ্যণীয় যে, ভূমিকম্প হলে শুধু কম্পনজনিত ক্ষয়ক্ষতি নয়, ট্রেমার-পরবর্তী সুনামি বা অকস্মাৎ বন্যার ফলেও ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। বাংলাদেশে তো সর্বত্রই দুর্নীতির হাতছানি। আর তাতে ক্রমশ হৃষ্টপুষ্ট হয়ে বেড়ে ওঠা জবাবদিহিতাহীন নিম্নমানের নির্মাণ-শিল্পের বদৌলতে ৭ মাত্রার একটি ঝাঁকুনিতে ঢাকা শহর মৃত নগরীতে পরিণত হবার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে বললে ভুল হবে না। আড়াই কাঠার একটি প্লটের উপর ৬ তলা ফ্ল্যাট দাঁড়িয়ে যাচ্ছে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে, ভূমিকম্প প্রতিরোধের বিষয়টি মাথায় না রেখেই। শুধু পুরনো ঢাকার পুরাতন স্থাপনাগুলো নয়, ফ্ল্যাট-সংস্কৃতির এই যুগে ভূমিকম্প-অপ্রতিরোধী ফ্ল্যাটসমূহও কিন্তু একেকটি মৃত্যুফাঁদ।

এ প্রেক্ষিতেই জাপানে দীর্ঘদিন অবস্থানের কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি। ২০১১ সালের ১১ মার্চে সেদেশের তহুকু রিজিওনে প্রায় ৯ মাত্রার যে ভূমিকম্প হয় তাতে রাজধানী টোকিও শহরে ঝাঁকুনি লেগেছিল প্রায় ৭ মাত্রায়। কিন্তু এতেও রাজধানীর মাল্টি-স্টোরিড বিল্ডিংগুলো ধসে যাওয়ার বা মানুষ নিহত হবার ঘটনা নেই। নির্মাণ শিল্পে ভূমিকম্প-প্রতিরোধী প্রযুক্তি রক্ষাকবচ হিসেবে একটা পর্যায় পর্যন্ত পুরোপুরি কার্যকরী, এমনকি বিরল শক্তিমাত্রার কম্পনেও (৯ মাত্রার) ক্ষয়ক্ষতি কমাতে দারুণ ভূমিকা রাখে।

ভূমিকম্প প্রস্তুতিতে জাপানিরা যে বিশ্বে নেতৃস্থানীয় এর প্রমাণ অনেক বারই দিতে হয়েছে। ২০১১ সালের তহুকু ভূমিকম্পটি ছিল জাপানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মাত্রার আর বিশ্বে পঞ্চম। অতি দ্রুত ধেয়ে আসা সুনামি ছিল ধ্বংসযজ্ঞের মূল কারণ যাতে সমস্ত প্রস্তুতি অকার্যকর হয়ে পড়ে। এটা যদি ঘণ্টাখানেক সময় দিত, নিহতের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যেত। ফুকুশিমা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের দুর্ঘটনা সমস্যাটি আরও জটিল করে তুলে।

নেপালের গত বছরের ভূমিকম্প আর মণিপুরের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের পর বাস্তবতা হচ্ছে, এই বিপর্যয়ের আশঙ্কার মধ্যেই বাংলাদেশিদের বসবাস করতে হবে। এখানে শহরাঞ্চলে মূল ক্ষয়ক্ষতি হবে স্থাপনা-ধসে। মর্মান্তিক এক পরিণতির আশঙ্কায় ভীতির সঙ্গে বসবাসের চেয়ে কঠিন সময় কঠিনতম দৃঢ়তায় মোকাবেলা করার প্রত্যয় নিয়ে প্রস্তুত থাকা উচিত।

আমাদের সমাজে দুর্নীতি, পরিকল্পনাহীনতা সব কিছুর জন্যই মাশুল দিতে হয় আমজনতার। মাশুলটা দিতে হবে ধরে নিয়েই যতটা সম্ভব একটা বিপদকালীন প্রস্তুতি থাকা উচিত। বিপদে শান্ত থাকা বোধহয় সবচেয়ে বড় শক্তি। অন্যের সাহায্যে এগিয়ে যাবার প্রথম শর্তই হচ্ছে, নিজেকে বিপদমুক্ত রাখা। বিমানে নিরাপত্তা বিষয়ক নির্দেশনায় জরুরি অবস্থায় লাইফ জ্যাকেট নিজে পরে অন্যকে সাহায্য করার কথা বলা হয় এবং এটি আপদকালীন শৃঙ্খলার অংশ যা জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

বিপদ কখন আসবে যেহেতু জানা নেই, তাই প্রত্যেক মানুষের মূল দায়িত্ব হচ্ছে নিজের, পরিবারের আর সম্পদ রক্ষায় অগ্রিম প্রস্ততি নিয়ে রাখা। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভূমিকম্প হলে করণীয় সম্পর্কে ধারণা তৈরি করে সচেতন রাখা। কিছু বিষয়ে এখনই দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

• প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম, টর্চলাইটসহ শুকনো খাবারের মজুদ সব সময় ঘরে রাখা।

• পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যদের কীভাবে জরুরি প্রয়োজনে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস বন্ধ করতে হয় শিখিয়ে রাখুন। কম্পনের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। মনে রাখবেন, ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির অন্যতম কারণ বিদ্যুৎ ও গ্যাস থেকে আগুন লাগা।

• বইয়ের তাক, আলমারি ইত্যাদি দেয়ালের সঙ্গে এমনভাবে আটকে রাখুন যাতে ঝাঁকুনিতে পড়ে না যায়। বাচ্চাদের পড়ার টেবিলের পাশে উঁচু বইয়ের তাক কিংবা অন্য কোনো প্রকার তাকে ভারী জিনিস রাখবেন না যা বাচ্চাদের মাথায় বা শরীরে পড়তে পারে। পড়ার টেবিলটি বেশ শক্ত ধরনের হওয়া উচিত যাতে কম্পন শুরু হলেই বাচ্চারা টেবিলের নিচে আশ্রয় নিতে পারে।

• খাবার টেবিল কিংবা বিছানার ক্ষেত্রেও একই সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত যাতে উপর থেকে ভারী জিনিসপত্র মাথায় বা শরীরে না পড়ে।

• ফ্রিজ, টিভির মতো দামি ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, বড় আয়না, ওয়াল পেইন্টিং, দেয়াল ঘড়ি যাতে সহজে পড়তে না পারে তা নিশ্চিত করুন। স্কিড নিরোধক অ্যাপ্লায়েন্স ব্যবহার করে ফ্রিজের মতো ভারি ইলেকট্রনিক্সের সুরক্ষা করা যেতে পারে।

• ভূমিকম্পের সময় বাসায় থাকলে শান্তভাবে ভেতরেই থাকুন। ট্রেমারের সময় দরজার ছিটকানি খুলতে বা লাগাতে যাবেন না। হাঁটু গেড়ে খাট, টেবিল বা ভারী আসবাবপত্রের আড়ালে বা নিচে নিজেকে প্রটেক্ট করুন। যে অবজেক্ট আপনাকে প্রটেক্ট করছে তা শক্ত করে ধরে রাখুন কম্পন না থামা পর্যন্ত। যদি আশ্রয় নেবার কিছু না পান, হাত দিয়ে মাথা ও ঘাড় ঢেকে দেয়ালের ধার ঘেঁষে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ুন। কম্পন থেমে যাবার পর পরিস্থিতি বুঝে মাথা ও ঘাড় শক্ত কিছু দিয়ে ঢেকে সাবধানে মুভ করবেন।

• ভূমিকম্পের সময় শান্ত থাকুন এবং অন্যদের শান্ত থাকতে সাহায্য করুন। খালি পায়ে নয়, শক্ত জুতা পরে চলাফেরা করুন যাতে গ্লাস, মেটাল ইত্যাদির ইনজুরি থেকে রক্ষা পেতে পারেন।

• গ্যাস লিকেজ আছে কিনা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ম্যাচ, মোমবাতি জ্বালাবেন না।

• যদি শপিং মলে থাকুন তবে কোনো স্টোরে প্রবেশ করে জানালা বা তাক থেকে দূরে থাকুন।

• হুইল চেয়ারে থাকলে, চাকা লক করে হাত দিয়ে মাথা ও ঘাড় ঢেকে রাখুন।

• বাইরে থাকলে, যথাসম্ভব খোলা জায়গায় অবস্থান করুন, স্থাপনা থেকে দূরে থাকুন, বেশি মানুষের ভিড়ে প্যানিকজনিত চাপাচাপি থেকে দূরে থাকুন।

• গাড়িতে থাকলে রাস্তা ব্লক না করে একপাশে থেমে যান এবং ভেতরে থাকুন। ব্রিজ, ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, বিল্ডিং, বিলবোর্ড, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন থেকে দূরে থাকুন। পেছন থেকে ছুটে আসা গাড়ি থেকে সজাগ থাকুন, রিয়ার মিররের উপর নজর রাখুন। ঝাঁকুনি থামলে দেখেশুনে নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে আবার অগ্রসর হবেন।

• বাসে থাকলে এবং কম্পনে বাস থেমে গেলে হঠাৎ রাস্তায় নেমে পড়বেন না। মাথা ও ঘাড় ঢেকে বাসের ভেতরে থাকার চেষ্টা করুন।

• ভূমিকম্পের সময় লিফট ব্যবহার করবেন না। লিফটে থাকলে পরবর্তী তলায় তাড়াতাড়ি নেমে পড়ুন।

• সমুদ্র বা নদীর ধারে থাকলে যথাশীঘ্র দ্রুততার সঙ্গে উঁচু জায়গায় চলে যান।

• ভূমিকম্পের পর নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকুন। ঝুলন্ত, নড়বড়ে বা ভেঙে পড়তে পারে এমন স্থাপনা থেকে দূরে থাকুন। পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস বা স্যুয়ারেজ সিস্টেমের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হয়ে ব্যবহার করবেন না।

• প্রতিবেশি বা অন্যের সাহায্যে এগিয়ে যাবেন অবশ্যই। কিন্তু মনে রাখবেন পেশাদার উদ্ধারকারীদের কাজে যাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়। আপনার অযথা অতিউৎসাহে বা জটলা পাকানোতে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হতে পারে। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছাড়া বিপদসঙ্কুল উদ্ধার অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়বেন না। তাতে আপনার জীবন বিপন্ন হওয়া ছাড়াও সহজ কাজটি কঠিন হয়ে যেতে পারে।

• মানুষ মানুষের জন্যে। বিপদের সময় আপনার মনুষ্যত্ব যেন আপন মহিমায় আলো ছড়ায়। যা পাবেন নিজের জন্যে সব যোগাড় করার মানসিকতার চেয়ে সবার সঙ্গে শেয়ার করুন। মনে রাখবেন, সবচেয়ে বড় মানবপ্রেম বা দেশপ্রেম হচ্ছে বিপদের সময় নিজের চাহিদা যতটুকু সম্ভব সংকুচিত করে অন্যের সাহায্যে হাত বাড়ানো।

• বাচ্চাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে পূর্ব-প্রস্ততি থাকা অত্যাবশ্যক। জাপানি বাচ্চাদের প্লে গ্রুপ থেকেই ভূমিকম্পের ব্যাপারে প্রশিক্ষিত করা হয়। প্রতিটি স্কুলে ইমার্জেন্সি কিটস, শুকনো খাবার, পানির মজুদ থাকে। মাথার সুরক্ষা দেবার শক্ত হ্যাট, হাতমোজা ইত্যাদির ব্যবস্থাও থাকে। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে অভিভাবক না আসা পর্যন্ত বা অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগ না হওয়া পর্যন্ত বাচ্চাদের স্কুল থেকে ছাড়া হয় না। জাপানের শহরগুলোতে প্রায়ই দেখা যায়, মাথায় শক্ত হ্যাট পরে ভূমিকম্প প্রতিরোধ মহড়ায় শান্তভাবে অসংখ্য বাচ্চাদের অংশ নিতে। ভূমিকম্প বিষয়ে বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে ঘন ঘন মহড়াসহ ন্যাশনাল অ্যাকশন প্লান/পলিসি থাকা উচিত।

• ভূমিকম্প ওয়ার্নিং সিস্টেমের আওতায় রেডিও, টেলিভিশনকে আনতে হবে যাতে ভূমিকম্পের সঙ্গে সঙ্গেই স্বাভাবিক অনুষ্ঠানের বদলে ভূমিকম্পের সংবাদ প্রচার শুরু করা যায়।

'বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়'– কবিগুরুর মতো এতটা সাহসী না হয়ে বরং প্রার্থনা দুটোতেই: বিপদ থেকে রক্ষার পাশাপাশি বিপদে ভয় না পেয়ে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করার সক্ষমতার জন্যেও। বড় ধরনের ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে বলা মুশকিল, তবে প্রস্ততি থাকলে মোকাবিলা করতে সুবিধে হয়। জাতীয় পর্যায়ে লজিসটিক্যালি ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের সক্ষমতা হয়তো খুবই অপ্রতুল, কিন্তু ব্যক্তিগত বা দলবদ্ধভাবে উপরের গাইড লাইনগুলো মেনে চললে প্রাণহানি বা আহত হবার ঘটনা অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

সমাজের শেকড় থেকে বেড়ে ওঠা সততা, সহমর্মিতা, সহনশীলতা আর ধৈর্যের নীরব প্রয়োগ হচ্ছে যে কোনো জাতির জন্যে বিশেষ করে দুর্যোগের সময় সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সম্পদ। সততা আর সহনশীলতার প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থানের পরও জাতি হিসেবে আমাদের সহমর্মিতার ইতিহাস ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। তবে ভূমিকম্পের মতো ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মাঝে সহমর্মিতার বিষয়টি হতে হবে সততা আর সহনশীলতা সহযোগে আরও পরিপক্ক, রেজিমেন্টেড এবং দায়িত্বশীল।