লাইসেন্স টু কিল: অপারেশন মানিকগঞ্জ

বিদিশা
Published : 3 Feb 2011, 07:53 PM
Updated : 18 August 2011, 04:09 PM

আমার বিশ্লেষণী ক্ষমতা খুবই কম। কেউ যখন কিছু বলে, কোনো ঘটনার বর্ণনা দেয়, অবলীলায় আমি তা বিশ্বাস করি। কিন্তু একই ঘটনার সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা বর্ণনা যখন পাই অন্য একজনের মুখ থেকে, তখন বিভ্রান্ত হই। বুঝতে পারি না, মানুষ বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কেনো বলবে?

গত কয়েকদিন ধরে দারুন এক বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে আমি আছি। মানিকগঞ্জের সেই মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার পর মানুষ যখন শোকের তীব্রতায় হতভম্ব, তখন কয়েকজন মন্ত্রী উল্টাপাল্টা কথা বলা শুরু করলেন। রাস্তাঘাটের দায়িত্বে যে মন্ত্রী, তিনি বললেন, এই ঘটনার জন্য রাস্তা কিংবা ট্রাফিক সিস্টেম দায়ী নয়। দায়ী-চালকরা। বিশেষ করে ইঙ্গিত করলেন তিনি বিধ্বস্ত গাড়ির চালকের প্রতি। সে নাকি আর একটি গাড়িকে ওভারটেক করতে যেয়ে এই বিপর্যয় ডেকে এনেছে। মন্ত্রী মহোদয় যে ব্যক্তিকে দোষী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, সেই বেচারীর পক্ষে এর প্রতিবাদ করা সম্ভব নয়।

কারণ ইতোমধ্যেই তিনি মৃত, এইসব বাদ-প্রতিবাদের উর্ধে চলে গেছেন। বিষয়টা আমার কাছে বোধগম্য হলো না, ওই হতভাগ্য চালক তো তার প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নয়, তাহলে মন্ত্রী কেনো তাকেই দায়ী করছেন পুরো দুর্ঘটনার জন্য। তাছাড়া তিনি নিজে ওই সময় গাড়িতে কিংবা আশপাশে ছিলেনও না। তাহলে কীভাবে এতো নিশ্চিত হয়ে দায় চাপাতে পারলেন তিনি মৃত চালকের উপর?

কিন্তু ওই যে বললাম, আমার বিশ্লেষণী ক্ষমতা খুবই কম, তার প্রমাণ দিলো এক বন্ধু। বললো সে, কেন তুমি মন্ত্রীর উচ্চারিত বক্তব্যের অন্তর্নিহিত লক্ষ্যটির দিকে তাকাচ্ছ না? তিনি তো মৃত ড্রাইভারের উপর দায় চাপাচ্ছেন না, বরং নিজেকে নিরাপদে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাইছেন। আর একই সঙ্গে অভিযোগের আঙ্গুলটি সরিয়ে দিচ্ছেন পরিবহন শ্রমিকদের নেতা আর এক মন্ত্রীর দিকে!

এইখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো আর একটি চমক। পরিবহন শ্রমিকদের নেতা নিশ্চয়ই দেশের মন্ত্রী হতে পারেন। কিন্তু মন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি কী করে শ্রমিক নেতৃত্বের সেই পদটি ধরে রাখতে পারেন? বাংলাদেশে পরিবহণ শ্রমিকদের সঙ্গে পরিবহণ মালিক কিংবা যাত্রীদের স্বার্থের বিরোধ নতুন কিছু নয়। এই যে আর কদিন পর ঈদ আসছে, তখনই দেখা যাবে পরিবহণ শ্রমিক-মালিকদের দৌরাত্মের বিকট নমুনা। যাত্রীদের সেই ভোগান্তি আর অসহায়ত্বের সময় এই মন্ত্রী যা কিছু বলবেন তা কি কোনো একটি পক্ষের বক্তব্য হয়ে যাবে না? এর মাঝে একটি পত্রিকায় দেখলাম পরিবহণ ফেডারেশনের এই 'নেতা কাম মন্ত্রী' নাকি কিছুদিন আগে অনেকটা চাপ দিয়েই কোনোরকম পরীক্ষা ছাড়া ১৮ হাজার ড্রাইভিং লাইসেন্স করিয়ে নিয়েছেন। সেই একই পদ্ধতিতে, অর্থাৎ পরীক্ষায় না বসে আরও ২৫ হাজার অবৈধ ড্রাইভারকে লাইসেন্স দেয়ার জন্য এখন নাকি চাপ অব্যাহত রেখেছেন। খুব শিগগীরই এটা নাকি হয়েও যাবে। যথাযথ যোগ্যতা ছাড়া এই গাড়ি চালানোর লাইসেন্সপ্রাপ্তি, এটা হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আরও অনেক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার জন্ম দেবে। তবে পাশাপাশি পরিবহণ ফেডারেশনে ওই মন্ত্রীর নেতৃত্বের আসনকে যে অনেকটাই দৃঢ় করবে তা বলা যায় নির্দ্বিধায়।

নিহত ড্রাইভারকে দায়ী করে যোগাযোগ মন্ত্রী'র বক্তব্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। কেবিনেট মিটিংয়েও তিনি বলেছেন ওই কথা, প্রধানমন্ত্রীকে শুনিয়েছেন। পরে অবশ্য গাড়িতে থাকা এক যাত্রী, যিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছেন, জানালেন ওই দিন ওভারটেকিংয়ের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। একই কথা বললেন যে বাসের সঙ্গে ঘটেছে দুর্ঘটনা সেই বাসের ধৃত চালকও। তাহলে, যোগাযোগ মন্ত্রী কেনো আন্দাজে মন্তব্য করলেন? ঘটনার মনগড়া বিবরণ দিলেন প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রীদের বৈঠকে? এরকম দায়িত্বপূর্ণ একটি পদে থেকে এতটা বালখিল্য আচরণ কি মানানসই? আমার মনে আরও একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আচ্ছা, আমাদের প্রধানমন্ত্রী কি এখনো যোগাযোগ মন্ত্রীর ওই বক্তব্যই বিশ্বাস করে বসে আছেন? যদি না করে থাকেন, সেটাই বা আমরা বুঝব কী করে?

আশপাশের বন্ধুদের বক্তব্য থেকে আর একটি বিষয় আমার কাছে স্পষ্ট হলো, যোগাযোগ মন্ত্রীর এই যে আগ বাড়িয়ে 'আমি কলা খাই না' জাতীয় বক্তব্য, এর পেছনে আসলে রয়েছে দেশজুড়ে মহাসড়কগুলো যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষন করতে না পারার বিষয়টি। এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ও সম্ভবত এটি। ইতোমধ্যেই কয়েকটি মহাসড়ক যানচলাচলের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। এতটাই খারাপ অবস্থা ওগুলোর যে, ওই রুটের বাসগুলো ঘোষণা দিয়ে চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিলো। এই প্রসঙ্গটিও কিন্তু কেবিনেট মিটিংয়ে উঠেছিলো। এবং যোগাযোগ মন্ত্রী যথারীতি দায়টি অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, অর্থমন্ত্রণালয় টাকা পয়সা দিচ্ছে না বলেই নাকি রাস্তা মেরামত করা যায়নি। কিন্তু সমস্যা হলো, এক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী ওই হতভাগ্য ড্রাইভারের মতো মৃত নন। তিনি ঠিকই প্রতিবাদ করলেন। যোগাযোগ মন্ত্রীর অজুহাতকে নাকচ করে দিয়ে বললেন, রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকমতো না হওয়াতেই মহাসড়কগুলোর এই দুরবস্থা।

এই যে দুই মন্ত্রীর দায়িত্ব এড়ানোর ধাক্কাধাক্কি, এটা কিন্তু খোদ প্রধানমন্ত্রীর সামনেই হলো। তিনি দুই মন্ত্রীকেই শান্ত করার চেষ্টা করলেন, এবং পারলেনও একসময়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব কি মন্ত্রীদেরকে শান্ত করা? নাকি জনগণকে শান্ত করা? তিনি কি অর্থ কিংবা যোগাযোগ মন্ত্রীর প্রধানমন্ত্রী, নাকি জনগণের প্রধানমন্ত্রী? মহাসড়কগুলোর এই দুরবস্থা হঠাৎ করে আচমকা একদিনেই তো আর হয়নি, এটা দীর্ঘ অবহেলার চুড়ান্ত একটা রূপ। এই সড়কগুলোর দেখভালের জন্য সরকারের বিশাল একটা বিভাগ রয়েছে। কী করেছেন তারা এতদিন? এর দায়িত্ব কি এড়াতে পারবেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মহোদয়? অন্য অনেক মানুষের মতো আমিও আশা করেছিলাম, যোগাযোগ মন্ত্রীর এই ব্যর্থতাটুকু অন্ততঃ চোখে পড়বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর। কিন্তু সেরকম কিছু হয়েছে বলে অবস্থাদৃষ্টে এখনো মনে হচ্ছে না। বরং দু'দিন পর দেখলাম প্রধানমন্ত্রীর ধমক খেয়ে যোগাযোগ মন্ত্রী নিজে গেলেন ভাঙাচোরা মহাসড়ক দেখতে। পত্রিকায় এমনও পড়লাম যে, মন্ত্রীর বিলাসবহুল গাড়িটি ওই খান-খন্দক আর কাদাময় মহাসড়কের কয়েক জায়গায় আটকে গিয়েছিলো। অথচ এই মন্ত্রীই দু'দিন আগে বলেছিলেন রাস্তাগুলো নাকি অতটা খারাপ নয়!

আলোচিত এই মন্ত্রীর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যেই। আওয়ামী লীগের সিনিয়র এক মন্ত্রী তো বলেই ফেললেন, 'মন্ত্রীর চেহারা চকচকে, রাস্তার কেনো বেহাল দশা?' রাস্তার এই বেহাল দশা দূর করতে তড়িঘড়ি করে অনেক টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আগামী কয়দিন হয়তো বেশ জোড়াতালিও চলবে। কিন্তু সেটা টিকবে কয়দিন, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা যায়। কিন্তু এতকিছুর পরেও সন্দেহ নেই এই মন্ত্রীর টিকে থাকা নিয়ে। হতে পারে প্রধানমন্ত্রী তার অন্য কিছু যোগ্যতায় খুবই খুশি।

আমি জানি না, ছোট মুখে বড় কথা বলে ফেললাম কিনা। তবে গত কয়েকদিনে বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে অনেকের মুখেই এ ধরনের উচ্চারণ শুনেছি। সাধারণ মানুষের এমন প্রতিক্রিয়ার দীর্ঘমেয়াদী কোনো প্রভাব আছে কিনা, তা অভিজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার পর রাজনীতিকরা এসবকে তেমন গুরুত্ব দেন কিনা, বিগত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় এবিষয়ে আমার মধ্যে বিপুল সন্দেহের জন্ম নিয়েছে।

লেখাটি শুরু করেছিলাম তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা দিয়ে। এ বিষয়ে আর একটি তথ্য মাত্র সেদিন জানতে পারলাম। একটি পত্রিকায় পড়লাম, কোনো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে, তাতে একাধিক ব্যক্তি মারা গেলেও, দায়ী চালকের সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড হতে পারে! এমন দুর্বল আইন সব সময় ছিল না। পরিবহণ শ্রমিকরা আন্দোলন করে এটা আদায় করে নিয়েছে। এখন তদন্তে যদি প্রমাণিত হয় ধৃত ওই বাস ড্রাইভারের কারণেই ঘটেছে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, তাহলে তার তিন বছরের বেশি কারাদণ্ড হবে না? এটা তো 'লাইসেন্স টু কিল!'

এই তথ্যটি আমার জানা ছিলো না। এখন মনে হচ্ছে, অবিশ্বাস্য এই তথ্যটি জানা না থাকলেই বোধ করি কিছুটা কম আতঙ্ক নিয়ে রাস্তায় বের হতে পারতাম। অজ্ঞতা আসলেই অনেক সময় আশীর্বাদ।