প্লিজ সালাউদ্দিন, আপনি পদত্যাগ করুন

মারুফ মল্লিক
Published : 29 Dec 2015, 04:23 AM
Updated : 29 Dec 2015, 04:23 AM

১৯৯৩ সালের সাফ গেমসে নেপালের কাছে বাংলাদেশের পরাজয়ের পরের ঘটনা। তখন বাংলাদেশ দক্ষিণ এশীয় ফুটবলের তথাকথিত বড় শক্তি। নেপালের সঙ্গে খেলা মানে নিদেনপক্ষে এক গোলের জয় অথবা ড্র। কিন্তু নেপালের সঙ্গে হেরে যাওয়াটা কোনোভাবেই কাম্য ছিল না।

অপ্রত্যাশিত সেই হারের পর আমাদের নারায়ণগঞ্জ শহরের ডিএনডি বাঁধের দেয়ালে কেউ একজন লিখে রেখেছিলেন, ''এই হার শেষ নয় আরও হার আছে, সেই হার নিয়ে যাবে ভুটানেরও কাছে।''

ওই সময় টেলিভিশনে প্রচারিত আবদুল কুদ্দুস বয়াতির একটি শিক্ষামূলক বিজ্ঞাপনের অনুকরণে এই দেয়াল লিখন। সেটা ছিল হয়তো কোনো সমর্থকের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু ওই সময় আমরা ভুলেও ভাবিনি যে, আসলেই বাংলাদেশের ফুটবলের মান ভুটানের কাতারে গিয়ে দাঁড়াবে। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ ও ভুটানের ফুটবলের মধ্যে এখন আর ইতর-বিশেষ আছে বলে মনে হয় না। ভুটান মালদ্বীপের কাছে ৩-১ গোলে হার মানে। ভারতের সঙ্গে ড্র করে। বাংলাদেশও এখন মালদ্বীপ ও নেপালের সঙ্গে ম্যাচে হরহামেশাই হেরে যায়। আর ভারতের সঙ্গে জেতে কদাচিৎ।

অনেকেই দ্বিমত করতে পারেন। কিন্তু ভুটানের ফুটবলের উন্নতির পাশাপাশি বাংলাদেশের যে অবনতি হয়েছে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। দুটি দেশের ফুটবল এখন একই সমান্তরালে। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা ছাড়া এক অদ্ভুত স্বপ্ন নিয়ে পথ চলছে বাংলাদেশের ফুটবল। আমাদের ফুটবলের কর্মকর্তা, খেলোয়াড় সবাই অবাস্তব জয়ের নেশায় উন্মত্ত। দিবাস্বপ্নের ঘোরে কল্পনা করেন নিদেনপক্ষে দক্ষিণ এশিয়া পর্যায়ের টুর্নামেন্ট জয়ের। কিন্তু মাঠে নিয়মিত খেলা না থাকলে ও সঠিক পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন না হলে যা ঘটার তাই ঘটছে। দুই ম্যাচে সাত গোল হজম করে সাফ ফুটবল থেকে বাংলাদেশের বিদায়!

বাংলাদেশের ফুটবল-কর্তা ও খেলোয়াড়দের সাম্প্রতিক আচার-আচরণ ও মিথ্যা উচ্চাশা বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে ফুটবলের বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে তিনটি পর্যবেক্ষণে স্থির হওয়া যেতে পারে:

১. যদি শুধু মুখের কথায় ম্যাচ জেতা যেত, তাহলে বাংলাদেশ ফুটবলে এখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন থাকত;

২. যদি কোনো ধরনের বাস্তব পরিকল্পনা ছাড়া সফল হওয়া সম্ভব ছিল, তাহলে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নই হত;

৩. যদি সব দোষ কোচের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে কাঙ্ক্ষিত জয় পাওয়া যায়, তাহলে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে ফুটবলে এখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন থাকত।

সাবেক গোলরক্ষক বিপ্লব ভট্টাচার্য বলেছেন, খেলা মাঠে খেলতে হয়, মুখের কথায় ম্যাচ জেতা যায় না। তিনি ভুল বলেননি। আবেগ দিয়ে ম্যাচ জেতা যায় না। গত বিশ্বকাপে সেমিফাইনালের আগের ম্যাচে নেইমারকে হারানোর পর ব্রাজিলের ফুটবলাররা সেমিফাইনালে নেইমারের জার্সি নিয়ে নেমেছিলেন। বিষয়টা এমন যেন আবেগ দিয়েই ব্রাজিল জিতে যাবে। কিন্তু খেলার ফলাফল, জার্মানির কাছে সাত গোল হজম। ভাগ্যিস বিরতির সময় জার্মানরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আর হেনস্থা না করার। না হলে হয়তো গোলের সংখ্যা ডজন পার হয়ে যেত!

বাংলাদেশের ফুটবলও এই আবেগজনিত এক ব্যারামে ভুগছে। এ রোগে আক্রান্তরা সাফল্যের স্বপ্নে বিভোর থাকেন। কিন্তু সেটা অর্জনের জন্য যা যা করা দরকার তার থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করেন। আসলে মাঠে জয়ের জন্য দক্ষতা লাগে। আরও দরকার নিষ্ঠা। এ সব অর্জিত হয় সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। হতাশাজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) এখন একখানা আপাদমস্তক ব্যর্থ ও চাপাবাজদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। এখানে কাজের চেয়ে কথা বেশি। যার নিট ফলাফল, অভিবাসী আফগান দলের কাছে চার গোল হজম এবং সাফ ফুটবলে বাংলােদেশের রেকর্ড সংখ্যক গোলে পরাজয়।

দুনিয়ায় এমন কোনো ক্রীড়া সংগঠন নেই যার সভাপতি খেলোয়াড়দের বলেন, 'আগে তোমরা ম্যাচ জিত, তারপর আমি স্পনসর আনতে পারব।' এভাবে আর যাই হোক, ফুটবলের উন্নতি সম্ভব নয়। সব দেশেই সব খেলার উন্নতির জন্য বিনিয়োগ করতে হয়। আগে বিনিয়োগ, পরে ফলাফল। আর বাফুফের সভাপতির নীতি হচ্ছে, আগে ফলাফল, এরপর বিনিয়োগ। বিনিয়োগ আগে না ফলাফল আগে, এটা নিয়ে লম্বা বিতর্ক হতে পারে।

প্রশ্ন হল, যেখানে দেশের ফুটবল নিয়মিত হয় না এবং যা কিছু খেলা হয় তার পুরোটাই রাজধানী-কেন্দ্রিক, সেখানে জাতীয় দল সফল হবে কীভাবে? স্কুল ফুটবল নিয়মিত নয়, পাইওনিয়ার ফুটবল বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন। জেলা শহরগুলাতে লীগ হয় না। জাতীয় পর্যায়ে খেলোয়াড়ের সরবরাহ নেই। অর্থের অভাবে সিলেটের একাডেমি বন্ধ। এতসব নেতিবাচক বিষয় নিয়েই চলছে আমাদের ফুটবল।

বাফুফের বড় সমস্যা হচ্ছে, এরা দেখেও শিখে না। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড একটা মডেল হতে পারত তাদের জন্য। এক সময় দেশে ফুটবলের জনপ্রিয়তা ক্রিকেটের চেয়ে বেশি ছিল। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ একদিনের ক্রিকেটে প্রতিষ্ঠিত শক্তি। আশা করা যায়, আরও সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করলে টেস্টেও ভালো করবে। সে দিন খুব দূরে নয়। অনেকেই বলে থাকেন, বাংলাদেশে ক্রিকেটের উন্নতির অন্যতম কারণ হচ্ছে নব্বইয়ের দশকের নির্মাণ স্কুল ক্রিকেট এবং এর পরবর্তীতের বয়সভিত্তিক দলের পরিচর্যা। এই সৌম্য বা মোস্তাফিজুররা কিন্তু বয়সভিত্তিক দল পরিচর্যার ফসল।

অনেকে বলতে পারেন, বিসিবির আর্থিক স্বচ্ছলতা আছে। তাই তারা বয়সভিত্তিক দলগুলোকে নিয়মিত পরিচর্যা করতে পারে। আবার বাংলাদেশ বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করার পর বা বড় বড় ম্যাচে জয়ের পর অনেক স্পনসর কোম্পানি এগিয়ে এসেছে। নির্মাণ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ক্রিকেটের স্পনসর করছিল। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে, বিসিবি যখন নির্মাণ ক্রিকেট শুরু করে তখন তাদের আর্থিক অবস্থা খুবই নাজুক ছিল। এমনকি ভারতের কলকাতায় এশিয়া কাপ খেলতে যাওয়ার জন্য তাদের পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না। যেতে হয়েছিল সড়কপথে।

আর সে সময় বাংলাদেশ দুই এক বছরে একটি কী দুটি আর্ন্তজাতিক ম্যাচ খেলত। সে সব খেলায় গোহারা হারত। এমন প্রেক্ষিতে বিসিবি নির্মাণ ক্রিকেট শুরু করে এবং সেটা স্পনসর ম্যানেজ করেই। সেখানে থেকেই পরিকল্পিত পথে এগিয়ে বিসিবি এখন ক্রিকেট উন্নয়নের মডেল। আইসিসি বিভিন্ন দেশে এই মডেল বাস্তবায়নের চিন্তা-ভাবনা করছে। খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছে বাংলাদেশের উন্নতির কারণ।

এদিকে বাফুফে যেন পথহারা পথিক। দিশেহারা নাবিকের মতো মাঝ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। হা হুতাশ করে স্পনসর নেই বলে। তাই নাকি খেলার আয়োজন করা যাচ্ছে না। এগুলো আসলে কুযুক্তি। নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করার অপপ্রয়াস। এই বাফুফেই কিন্তু কোটি টাকার সুপার কাপ আয়োজন করতে পারে। আর্ন্তজাতিক টুর্নামেন্ট করতে পারে। কিন্তু সারাদেশে ফুটবলের তৃণমূলে কোনো কাজ শুরু করতে পারে না। অনেক সমালোচক বলে থাকেন, বড় বাজেটের টুর্নামেন্ট হলে অনেকের আয়-ইনকামের সুবিধা হয়। তৃণমূলের আয়োজেন সে সুবিধা নেই।

ফুটবলের অধঃপতনের কিছু কারণের একটি হল, সারাদেশে নিয়মিত লীগ না হওয়া; দক্ষ সংগঠকদের হাত থেকে ফুটবল দলবাজদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়া এবং নিম্নমানের বিদেশি ফুটবলাদের লীগে আনা। অবশ্য শেষোক্তটির জন্য ক্লাবগুলো দায়ী।

প্রকৃত সত্য হচ্ছে, বর্তমান কর্মকর্তাদের বাফুফের মতো একটি সংগঠন পরিচালনার দক্ষতা নেই। বরং তাদের কিছু উদ্ভট কর্মপরিকল্পনার কথা আমরা শুনেছি। বাফুফের চিন্তার দেউলিয়াপনা যে কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তার বড় একটা নমুনা হতে পারে কিছুদিন আগে বিদেশিদের জাতীয় দলে নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা। এটি যদি বাস্তবায়িত হত, তাহলে দৃশ্যটা এ রকম হতে পারত: বাংলাদশের জাতীয় ফুটবল দল চলমান সাফে মাঠে নামছে ভাড়াটে বিদেশি ফুটবলাদের নিয়ে। খবরের কাগজের হেডলাইন হত এ রকম: এলিটা কিংসলের গোলে আফগানিস্তানকে হারিয়ে দিল বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তী সালাউদ্দিন এখন ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি। স্বাধীন বাংলা ফুটবলে দলের অন্যতম এই সদস্যের হাত ধরে দেশের ফুটবল জেগে উঠেছিল। তাঁর ঝাঁকড়া চুলের দৌড় আর ড্রিবলিং দেখে মোহিত হত ঢাকার দর্শক। টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দেখে অনেক শিশু কিশোর নতুন সালাউদ্দিন হওয়ার স্বপ্ন দেখত। সালাউদ্দিনই প্রথম বাংলাদেশি ফুটবলার হিসেবে বিদেশি লীগে খেলতে গিয়েছিলেন।

ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ ফুটবলের হত্যাযজ্ঞ ও শেষকৃত্য সম্পন্ন হওয়ার জোগাড় প্রায় হয়ে গিয়েছিল। হতে পারে এখন যারা বাফুফের নেতৃত্বে আছেন, এদের অনেকেই মেধাবী ফুটবলার ছিলেন। কিন্তু সংগঠক হিসাবে তারা খুবই নিম্নমানের। তাদের চিন্তার দৈন্যতার প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে।

বিদেশিদের দলে নেওয়ার পরামর্শটা তৎকালীন কোচ ক্রুয়েফ দিয়েছিলেন। তিনি হিসেবি কোচ। তিনি দেখেছেন, এইসব মানহীন খোলোয়াড় দিয়ে বাফুফের কর্তারা যে ফলাফল আশা করেন তা অর্জন সম্ভব নয়। জেতার জন্য গোল করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ দলে সেই স্কোরার কই?

ক্রুয়েফ বেতনভুক্ত কোচ ছিলেন। তাকে জবাবদিহিতা করতে হত। তাই তিনি সাফল্যের সহজ রাস্তা বাফুফেকে বাতলে দিয়েছিলেন। কর্তারা সে পথ মেনে নিয়ে হাঁটার চেষ্টা করেছিলেন। কিছু মানুষের চিন্তার কতটা অধঃপতন হলে এ ধরনের পরামর্শ মেনে নিয়ে তা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয় এবং এর সপক্ষে কিছু কুযুক্তি দাঁড় করায়, তার উৎকৃষ্ট নমুনা হচ্ছে এটা।

এর সপক্ষে হাস্যকরভাবে বলা হয়েছিল যে, ইউরোপের অনেক দেশের পক্ষে অনেক অভিবাসী খেলোয়াড় খেলে থাকেন। মানুষ বোকার স্বর্গে বাস করলেই এমন তুলনা করতে পারে। উনারা জানেন না যে, ওই দেশগুলোতে কীভাবে ও কোন কারণে অভিবাসীরা খেলেন। ওই খেলোয়াড়দের বড় একটা অংশ সংশ্লিষ্ট ওই দেশেই জন্মগ্রহণ করেছেন বা শৈশবেই পরিবারের সঙ্গে ওই দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তাদের বড় হওয়া ও ফুটবল-চর্চা ইউরোপের জল-বাতাসে।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, অন্য দেশে থেকে সরাসরি এসেও তো কেউ কেউ খেলছেন। কিন্তু বাংলাদেশের মতো এ রকম দুম করে ভাড়ায় এনে কেউ খেলাচ্ছে, এমন নজির মনে হয় নেই। বলা হয়েছিল, এটা হবে সাময়িক। কিন্তু বাফুফের বর্তমান কর্মকাণ্ডে এমন কোনো লক্ষণ দেখাও যাচ্ছে না যে, সহসাই আমাদের একজন আসলাম না হোক, নকিব বা আলফাজ, কাঞ্চন বেরিয়ে আসবে। বাফুফের এমন কী পরিকল্পনা এখন বাস্তবায়ন হচ্ছে যে, আমাদের ক্রিকেটার মোস্তাফিজুরের মতো একজন ফুটবলার বেরিয়ে আসবে?

বরং শঙ্কা হচ্ছে যে, বিদেশিদের যদি একবার নেওয়া হত, তবে জাতীয় দলে এদের সংখ্যা বাড়তেই থাকত। যদিও শেষ পর্যন্ত সমালোচনার মুখে সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়নি।

যে দেশে ক্লাবের চাপে ফুটবল লীগ পিছিয়ে দেওয়া হয় সে দেশের ফুটবল ক্রমাগত পিছনের দিকে হাঁটবে সেটাই স্বাভাবিক। আমাদের ফুটবলের আবাহনী-মোহামেডান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এখন আবার নতুন উৎপাত শেখ জামাল ও শেখ রাসেল। খবর পড়ে জেনেছি, শেখ জামাল ক্লাবের বেশ কয়েকজন আহত ছিলেন, যথাযথ প্রস্তুতি হয়নি। তাই সর্বশেষ পেশাদার লীগের দ্বিতীয় পর্বের খেলা পিছিয়ে দেওয়া হয়। বিষয়টা যেন অনেকটা এ রকম: মেসি, নেইমার আহত, তাই স্প্যানিশ লীগ পিছিয়ে দেওয়া হল বার্সেলোনার দাবির মুখে। অথবা চ্যাম্পিয়ন্স লীগের খেলা বাতিল করা হল; কারণ ক্রিশ্চিয়ানা রোনাল্ডো বা ওয়েইন রুনি অসুস্থ।

জাতীয় দলের রিপোর্টিং বা ট্রেনিং বাদ দিয়ে শেখ জামালের খেলোয়াড়রা ক্লাব সভাপতির সঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজন করেছেন। সেই দল আফগানিস্তান বা মালদ্বীপের সঙ্গে তিন-চার গোল খাবে এটাই স্বাভাবিক। এভাবে ক্লাবের স্বার্থ দেখলে দেশের ফুটবল এগুবে না।

চলমান সাফে বাংলাদেশ দলের খেলা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে যে, বতর্মান দলের খেলোয়াড়রা বেশিরভাগ সময় দু-তিনটির বেশি ধারাবাহিক পাস খেলতে পারেন না। গোলরক্ষণ থেকে আক্রমণভাগ, কোথাও এমন কোনো খেলোয়াড় দেখলাম না যে খেলাটা ধরতে পারে। সত্যি কথা বলতে কী, গত শতকের নব্বই দশকে আমাদের নারায়ণগঞ্জ জেলা লীগের চ্যাম্পিয়ন দলে এই জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা নিয়মিত সুযোগ পেতেন কিনা তা নিয়ে আমার ঘোর সন্দেহ আছে। বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় লীগ বা ঢাকা প্রিমিয়ার লীগ থেকেও ওই সময়ের নারায়ণগঞ্জের লীগ বেশ জমজমাট ছিল। চট্টগ্রামের লীগের কথা বাদই দিলাম।

কারা খেলতেন সে সময়ের নারায়ণগঞ্জের প্রথম সারির দলগুলোতে? মুন্না, এমিলি, গাউস, জাকির, স্বপন, রিয়াজ, সালাউদ্দিন, বরিউল, সুজন, মন্টু। এরা সবাই মানসম্পন্ন স্থানীয় খেলোয়াড় ছিলেন। খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। মানুষ খেলা দেখতে মাঠে যেত। কেন যেন মনে হয়, এখনকার আবাহনী-মোহামডানের খেলার চেয়েও আমাদের ওই লীগে বেশি দর্শক হত।

কেন এই অবস্থায় এসে পৌঁছাল আমাদের ফুটবল? এর উত্তর সবারই জানা এবং সহজ। মূল সমস্যা হচ্ছে, ভালো করার জন্য তাড়া নেই কর্মকর্তাদের মধ্যে। এত সমস্যার পরও যে কিছু খেলোয়াড় খেলতে আসেন এবং বাংলাদেশ জাতীয় দল গঠন করতে পারে এর জন্য তাদের ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। এরা সবাই ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় এ পর্যায়ে উঠে এসেছেন। এখানে বাফুফের কৃতিত্ব নেই।

অর্থ এখানে সমস্যা নয়। দরকার সঠিক ও যুগোপযোগী পরিকল্পনা। ক্রিকেটার পাইলট ব্যক্তিগত চেষ্টায় রাজশাহীতে একটি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে সাব্বির তাইজুলরা জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলছেন। আর আমাদের বাফুফের বড় কর্তারা পারেননি সিলেটের ফুটবল একাডেমি চালু রাখতে।

আমার বিশ্বাস, আমাদের ফুটবল কর্তারা সর্বৈব মিথ্যা বলছেন। ক্রিকেটের হালের ক্রেজ মোস্তাফিজুর কিন্তু বয়সভিত্তিক ক্রিকেট কর্মসূচির ফসল। বাফুফের কোথায় সেই বয়সভিত্তিক কর্মসূচি? ঢাকায় কোটি টাকার সুপার কাপ না করে দেশের ৬৪ জেলায় ২ কী ৩ মাসের অনুর্ধ্ব-১৬ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি সময়টাতে স্কুলে পড়াশুনার চাপ কম থাকে। এই তিন মাস ক্যাম্প করতে পারে বাফুফে। জেলা পর্যায়ে বাছাই করা খেলোয়াড়দের নিয়ে সিলেট একাডেমিতে দীর্ঘমেয়াদে ক্যাম্প পরিচালনা করার উদ্যোগ নেওয়া যায়।

টানা পাঁচ বছর এই কর্মসূচি পরিচালনা করলে কিছু কিছু খেলোযাড় নিশ্চিত বেরিয়ে আসবে। এরাই দেশের লীগগুলো জমিয়ে দিবে। এমন অনেক পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করা সম্ভব। কিন্তু এর জন্য ঠাণ্ডা মাথায় বসে সময় দিতে হবে। বাফুফের শীর্ষ পদে যারা আছেন তাদের দিয়ে যে কোনো সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব নয় সেটা বিলক্ষণ স্পষ্ট। রাইট উইং বা লেফট উইং দিয়ে ডজ দিয়ে ড্রিবল করে ঢুকে গোল করা আর টেবিলে বসে পরিকল্পনা করা এক জিনিস নয়।

পরিত্রাণের জন্য কিছু সুপারিশ রাখছি:

প্রথমে বর্তমান কমিটি ভেঙে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, সারাদেশে আবার খেলা নিয়মিত করতে হবে। অন্তত জেলা লীগ শুরু করতে হবে। তৃতীয়ত, স্কুল ফুটবলের নিয়মিত আয়োজন জরুরি। চতুর্থত, বয়সভিত্তিক দলগুলার পরিচর্যা করতে হবে। সবশেষে, ঢাকার ক্লাবগুলার খপ্পর থেকে ফুটবলকে বের করে আনা দরকার।

বাফুফের আর্থিক সমস্যা প্রসঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীর একটা বক্তব্য মনে পড়ল। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো এক বক্তৃতায় তিনি অনেকটা এ রকম বলেছিলেন, একটি দেশের উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক বা দাতাদের সহায়তাই একমাত্র সমাধান নয়। সঠিক পরিকল্পনা করে এগুলেও উন্নয়ন সম্ভব।

বক্তব্যটি যদি আমরা বৃহৎ পরিসরে রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রয়োগ না করে ছোট একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করি, বাফুফে হতে পারে তার বড় উদাহরণ। তাদের দরকার সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা এবং সেই পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন।

যখন শুনেছিলাম সালাউদ্দিন বাফুফের সভাপতি হতে চান বা সভাপতি পদে নির্বাচন করবেন, তখন ভেবেছিলাম বাংলাদেশে ফুটবল আবার প্রাণ ফিরে পাবে। খোকা-হানিফ-সুলতান কমিটির চেয়ে এই কমিটি ভালো করবে। কিন্তু আমাদের এভাবে হতাশ হতে হবে এটা ঘুণাক্ষরেও ভবিনি।

দুই ম্যাচে সাত গোল হজমের প্রতিক্রিয়ায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এ রকম কমিটি আগেও হয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বাফুফের পক্ষ থেকে জাতীয় দল ঢেলে সাজানোর কথা বলা হয়েছে। আসলে গোটা ফেডারেশন ঢেলে সাজানো উচিত।

প্লিজ সালাউদ্দিন, আপনি দয়া করে বাফুফের পদ থেকে আপনার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে চলে যান। ইতোমধ্যেই কোচ মারুফুল হক ও অধিনায়ক মামুনুল ইসলাম দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আপনিও সবাইকে নিয়ে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে ফেলুন। ফুটবলের সমর্থকরা এতে খুশি হবেন। আপনাকে আমরা সেই কিংবদন্তির ফুটবলার হিসেবেই মনে রাখতে চাই। বাফুফের ব্যর্থ সভাপতি হিসেবে নয়।

ফুটবলের এ অধঃপতন একদিনে হয়নি। তাই আর অপেক্ষা না করে এখনই সময় নতুন করে বাংলাদেশের ফুটবল জাগিয়ে তোলার, নতুন শুরুর। ফুটবল এখন যে পর্যায়ে আছে এর থেকে আর নিচে নামা সম্ভব নয়। বিশ্বাস করি এখান থেকেই বাংলাদেশের ফুটবল আবার ফিরতে শুরু করবে। আন্তরিকতায় ভরা সাংগঠনিকভাবে দক্ষ কর্মকর্তাদের হাতে ফুটবলের সেই সুদিনে ফিরে যাওয়া সম্ভব, যখন বাংলাদেশ মালদ্বীপকে ৮ গোলে হারাত।

মারুফ মল্লিক: জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী।