৫০ হাজার কোটি টাকার কিছুই পেলো না পোশাক শ্রমিকরা!

আবদুর রহিম হারমাছি
Published : 17 August 2011, 03:38 PM
Updated : 17 August 2011, 03:38 PM

পহেলা আগস্ট। সকাল ৭টা। রাজধানীর শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ড। আশ-পাশের গলিগুলো থেকে একটার পর একটা মিছিল এসে জড়ো হচ্ছে প্রধান সড়কে। এ মিছিল কোনো রাজনৈতিক দলের মিছিল নয়। এই মিছিল দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মিদের মিছিল। মিছিলে কোনো শ্লোগান নেই। এ মিছিল পল্টন ময়দান বা মুক্তাঙ্গনে যাবে না। যাবে- গার্মেন্টস কারখানায়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এই কর্মিরা তৈরি করবেন নানা ধরনের পোশাক। যা রপ্তানি করে দেশে আসছে কোটি কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা। বাড়ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার। মজবুত হচ্ছে দেশের অর্থনীতির ভিত।

শুধু শেওড়াপাড়া নয়, রাজধানী ঢাকা ও আশ-পাশের জেলাগুলোর প্রতিদিনের চিত্র এটি। ৩০ লাখের বেশি পোশাক কর্মি- এভাবেই মিছিল করে যান তাদের কর্মস্থলে। সন্ধ্যায় ফিরে আসেন আবার মিছিল করে। আর এই মিছিলের বেশিরভাগই মহিলা।

ছয় বছর আগে ২০০৩-২০০৪ অর্থবছরে দেশে মোট রপ্তানি আয় এসেছিল ৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন (৭৬০ কোটি) ডলার। আর গেলো অর্থবছরে (২০১০-১১) রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধিই হয়েছে- প্রায় ৭ বিলিয়ন ( ৭০০ কোটি) ডলার। অর্থ্যাৎ ২০১০-১১ অর্থবছরে ২০০৯-১০ অর্থবছরের চেয়ে ৭ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় বেশি এসেছে। টাকার অংকে যার পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ দিয়ে তিনটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। আর এই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনতে- সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছেন পোশাক কর্মিরা। অথচ এই বাড়তি আয়ের একটি পয়সাও পাননি তারা। সবই গেছে মালিকদের পকেটে।

এমনকি সরকার পোশাক শ্রমিকদের জন্য সর্বনিম্ন যে মজুরি (বেতন) নির্ধারণ করে দিয়েছে সে অনুযায়ী অনেক শ্রমিক বেতন পাচ্ছেন না। বেধে দেয়া লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করলে কর কর্মকর্তারা উৎসাহ বোনাস পেয়ে থাকেন। খেলাপি ঋণ আদায় করলে ব্যাংকাররা পান বাড়তি সুবিধা। বেশি রপ্তানি করলে- রপ্তানিকারকরা সরকারের কাছ থেকে পান রপ্তানি ট্রফি। পান সিআইপি-মর্যাদা। যে মর্যাদার জোড়ে বিমানবন্দরসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে পান বিশেষ সুবিধা। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, যে শ্রমিকরা ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি আয় করতে সবচেয়ে বেশি আবদান রাখলেন তারা একটি পয়সাও পেলেন না। আরও বিস্ময়কর হচ্ছে, বেশিরভাগ শ্রমিক জানেনই না যে, তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে গত অর্থবছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে।

৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি রপ্তানি আয় প্রসঙ্গে শেওড়াপাড়ার ইং মিং ইন্টারন্যাশনাল গার্মেন্টসের কর্মী নাসরিন আক্তার এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, "আমরা অতো কিছু জানি না। কাজ করি, পেতন পাই।"
কতো বেতন পান- এ প্রশ্নের উত্তরে নাসরিন আক্তার বলেন, "বেতন বলা যাবে না। স্যারদের (গার্মেন্টেসের কর্মকর্তারা) নিষেধ আছে।"

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রায় ২৩ বিলিয়ন (দুই হাজার ২৯২ কোটি ৪৪ লাখ) ডলার রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। যার ৮০ শতাংশের বেশি এসেছে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে এসেছিল ১৬ দশমিক ২০ বিলিয়ন (এক হাজার ৬২০ কোটি) ডলার। প্রবৃদ্ধির পরিমাণ হচ্ছে- ৪১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধির পরিমাণ ছিল মাত্র ৪ দশমিক ১১ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ছিল ১০ দশমিক ৩১ শতাংশ।

গত অর্থবছরে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে সবচেয়ে বেশি আয় হয়েছে। এ খাত থেকে আয় হয়েছে ৬৪৮ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। এর পরে ওভেন পোশাক। ৬০১ কোটি ৩৪ লাখ ডলার এসেছে এ খাত থেকে। এছাড়া পাট ও পাটজাত দ্রব্য, হিমায়িত মাছসহ অন্যান্য খাতেও রপ্তানি বেড়েছে।

৩০শে জুন শেষ হওয়া ২০১০-১১ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৮ দশমিক ৫০ বিলিয়ন (এক হাজার ৮৫০ কোটি) ডলার। এর বিপরীতে আয় হয়েছে দুই হাজার ২৯২ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। এ হিসাবে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন (৪৫০ কোটি) ডলার বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে।

ইপিবি'র রপ্তানি সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত অর্থবছরের প্রতি মাসেই বেড়েছে রপ্তানি আয়। আর এর উপর ভর করেই বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে। ১১ আগস্ট রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১০ দশমিক ৭০ বিলিয়ন (এক হাজার ৭০ কোটি) ডলার।

রপ্তানি আয়ের এই প্রবৃদ্ধিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান। তিনি বলেছেন, 'আমরা (সরকার) ভাবতেও পারিনি রপ্তানি আয় ২৩ বিলিয়ন ডলার হবে। সরকারের নানামুখি উদ্যোগ ও প্রণোদনা এবং গার্মেন্টস মালিক ও শ্রমিকদের নিরলস পরিশ্রমে এসেছে এই আয়। যা দেশের অর্থনীতির ভিত্তিকে মজবুত করেছে।'

মন্ত্রী বলেন, 'শুধু আয়ের অর্থবছরের চেয়ে নয়, নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার বেশি রপ্তানি আয় হয়েছে।'

বাড়তি এই রপ্তানি আয়ের জন্য শ্রমিকরা কোনো সুবিধা পায়নি- এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, গত বছর আমরা (সরকার) শ্রমিকদের নতুন বেতন কাঠামো নির্ধারণ করে দিয়েছি। ঐ কাঠামো অনুযায়ী, একজন শ্রমিক এখন নূন্যতম তিন হাজার টাকা বেতন পান। আগে পেতো ১ হাজার ৬০০ টাকার মতো। এ বাড়তি বেতনের কারণে শ্রমিকদের মধ্যে এক ধরনের উৎসাহ কাজ করেছে। এ কারণে তারা মনোযোগ দিয়ে কাজ করেছে। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে রপ্তানি আয়ে।

বর্তমান বাজারমূল্যে একজন শ্রমিকের তিন হাজার টাকা বেতন খুবই কম উল্লেখ করে শ্রমমন্ত্রী খোন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, 'মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে শ্রমিকদের বেতন কাঠামো ঠিক করা উচিৎ।'

প্রসঙ্গত, অনেক দেন-দরবারের পর গত বছরের অক্টোবর থেকে গার্মেন্টস খাতে নতুন বেতন কাঠামো কার্যকর হয়। অভিযোগ আছে- এখনও সব কারখানায় সরকার নির্ধারিত নতুন মজুরি কাঠামো অনুযায়ী বেতন-ভাতা দেয় না।
তবে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ'র সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন দাবি করেছেন, ৯৬ শতাংশ কারখানাতেই নতুন মজুরি কাঠমো অনুযায়ী বেতন-ভাতা দেয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমাদের (পোশাক কারখানা মালিকদের) অনেক কষ্ট হয়েছে। বেতন-ভাতা খাতে আমাদের ব্যয় হঠাৎ করেই দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছিল।

বিজিএমইএ প্রধান বলেন, "এ কথা ঠিক যে গত অর্থবছরে আমাদের রপ্তানি আয় বেশি হয়েছে। তবে এ অবস্থা হয়তো আর বেশি দিন থাকবে না। ইতিমধ্যেই আমরা তেমন আভাস পাচ্ছি। আমাদের অর্ডার (বিদেশী বায়ার বা ক্রেতাদের কাছ থেকে পোশাক কেনার অর্ডার) কমে গেছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আগামীতে রপ্তানি আয়ের এ ইতিবাচক ধারা থাকবে না। উল্টো কমতে পারে- এমন আশংকা করছি আমরা।"

তিনি বলেন, রপ্তানি আয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে আমাদের পোশাক রপ্তানি করতে হয়। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সমস্যা আমাদের প্রধান সমস্যা। অধিকাংশ কারখানায় নিজস্ব জেনারেটর ব্যবহার করে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। এতে একদিকে যেমন খচর বেশি পড়ছে, অন্যদিকে সময়মতো ক্রেতাদের কাছে পণ্য পৌছাতে পারছি না। দীর্ঘদিন ধরে আমরা এ সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারের কাছে অনুনয়-বিনয় করে আসছি। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না।

তবে গার্মেন্টস শ্রমিকরা বর্তমানে যে বেতন পান তা কম বলে স্বীকার করেন বিজিএমইএ সভাপতি।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা-সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা কেটে যাওয়ার ফলে বিভিন্ন দেশে তৈরি পোশাকের চাহিদা বেড়েছে। যার ফলে দামও বেড়েছে। এ সব কারণে গত অর্থবছরে রপ্তানি আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

এই প্রবৃদ্ধির কিছু অংশ শ্রমিকদের দেওয়া উচিৎ কিনা-এ প্রশ্নের উত্তরে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে এবারের রপ্তানি আয়ে। তবে বাড়তি আয়ের কিছু অংশ উৎসাহ ভাতা হিসেবে শ্রমিকরা পেলে আরও উৎসাহ পেতো। এক্ষেত্রে সরকার ও মালিকরা বসে একটি তহবিল গঠন করতে পারে। যে তহবিলে সরকার কিছু দেবে। মালিকরা কিছু দেবে। আর ঐ তহবিলের টাকা শ্রমিকদের উৎসাহ ভাতা বা বোনাস হিসেবে দিতে পারলে খুবই ভালো হতো বলে জানান তিনি।

ইপিবি'র তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত কয়েক অর্থবছর ধরেই রপ্তানি আয় বাড়ছে। ২০০৪-০৫ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৮ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে তা বেড়ে দাড়ায় ১০ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে দাড়ায় ১২ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ছিল ১৪ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে আয় হয় ১৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। ২০০৯-১০ ও ২০১০-১১ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ হচ্ছে যথাক্রমে ১৬ দশমিক ২০ বিলিয়ন ও ২২ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার।

গত অর্থবছরের প্রতি মাসেই ৪০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আর এ প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ বিলিয়ন (দুই হাজার ৬০০ কোটি) ডলার। বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান জোর দিয়ে বলেছেন, এবারও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রপ্তানি আয় দেশে আসবে। আর এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে যে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন –তার সব কিছুই করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। একইসঙ্গে তিনি রপ্তানি আয় আরও বাড়াতে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখিকরণ ও নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করতে- রপ্তানিকারকদের আহ্বান জানিয়েছেন।

আবদুর রহিম হারমাছি: লেখক ও সাংবাদিক।