কেন আজও পাকিস্তানকে ঘৃণা করতে হয়

আরিফ রহমান
Published : 27 Dec 2015, 02:03 PM
Updated : 27 Dec 2015, 02:03 PM

''আপনি কিংবা আপনারা পাকিস্তানকে ঘৃণা করেন ভালো কথা, কিন্তু আজকে সকালেই পাকিস্তানের যে শিশু আলোর মুখ দেখল, ১৯৭১ সালের গণহত্যার সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? কিংবা যে শিশু এখনও জন্ম নেয়নি, হয়তো কাল জন্ম নেবে পাকিস্তানের মাটিতে, তার অপরাধ কী? পাকিস্তানে জন্ম নেওয়া নিশ্চয়ই অপরাধ নয়। তাহলে একাত্তর-পরবর্তী পাকিস্তানি প্রজন্মকে কেন আমাদের ঘৃণা করতেই হবে?"

খুব সরল, স্বাভাবিক এবং যৌক্তিক কিছু প্রশ্ন। এই প্রশ্নগুলো আছে আমাদের অনেকের মনেই এবং এমন একটা প্রশ্ন যে কারও মনে আসতেই পারে।

এবার আপনাকে একটা প্রশ্ন করি:

সাধারণত ইসরায়েলি অথবা ইহুদিদের খ্রিস্টান-মুসলমান নির্বিশেষে অনেক মানুষই ঘৃণা করেন। কিন্তু আজকে সকালে যে ইহুদি শিশু জন্ম নিল তার অপরাধ কী? কিংবা যে শিশু এখনও জন্ম নেয়নি, হয়তো কাল সকালে জন্ম নেবে কোনো ইহুদি পরিবারে, তার অপরাধ কী? নিশ্চয়ই ভাগ্যক্রমে কোনো ইহুদি পরিবারে জন্ম নেওয়া অপরাধ নয়, তাহলে কেন সকল ইহুদিকে ঘৃণা করতেই হবে?

সত্যি বলতে কী, ইহুদিদের ঘৃণা করতে হবে, এটা একটা অবান্তর কথা।

আপনার বুকে বড়সড় একটা ধাক্কা লাগার আগে আসুন হাতে-কলমে প্রমাণ করে দিই ব্যাপারটা। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষকে হত্যা করার জন্য যে লোকটাকে এককভাবে দায়ী করা হয়ে থাকে তার নাম হিটলার। তিনি কিন্তু ইহুদি নন, বরং তার ঘাড়ে আছে ষাট লাখ ইহুদি হত্যাকাণ্ডের দায়।

ঢালাওভাবে ইহুদি বলে কাউকে গালি দেওয়ার আগে আসুন কয়েক জন মানুষ সম্পর্কে জেনে নিই।

উনিশশ চল্লিশ পঞ্চাশ দশকের কথা। দুনিয়াজুড়ে পোলিও রোগের প্রকোপ বেড়েই চলেছে। প্রতি বছর সাড়ে সাত লাখ শিশু আক্রান্ত হচ্ছে এতে। বিজ্ঞানীরা প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছেন রোগটির ভ্যাকসিন, ওষুধ বা টিকা বের করতে। লাভ হচ্ছে না, মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ছে এই রোগ। অবশেষে আলো নিয়ে এলেন এক বিজ্ঞানী, নাম তাঁর Jonas Edward Salk, যাঁর নিরন্তর গবেষণায় বের হয়ে এল একটি টিকা। হাজার মানুষের দুঃখ ঘুচল। আজ পৃথিবী থেকে পোলিও নির্মূলের পথে।

Jonas Edward Salk নামের মানুষটা একজন ইহুদি।

পারমাণবিক বোমা ও পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতার কথা কে না জানে। বলা হয়ে থাকে, পাঁচটা বালতি সাইজ পারমাণবিক বোমা দিয়ে নাকি পুরো পৃথিবী একসঙ্গে উড়িয়ে দেওয়া যায়। এই বোমার করুণ ব্যবহার আমরা দেখেছি হিরোশিমায়। আমরা তো ভালো করেই জানি এইসব বোমা যারা তৈরি করে তারাও মানুষ। শুধু মানুষই নয়, বড় মাথাওয়ালা মানুষ। হাজার হাজার বিজ্ঞানী মিলেই তৈরি করেছেন এই মারণঘাতী প্রযুক্তি। শক্তি প্রদর্শনের এই আদিম খেলায় পৃথিবী কিন্তু চুপচাপ।

প্রথমবারের মতো যে মানুষ বিশ্ব বিবেকের ঘুম ভাঙিয়ে এর প্রতিবাদে কাজ করেন তাঁর নাম Sir Joseph Rotblat, যিনি তাঁর কাজের জন্য নোবেল পুরস্কার পান ১৯৯৫ সালে। এই মানুষটাও কিন্তু ইহুদি ছিলেন। কাল সকালে আপনার মাথার ওপর পারমাণবিক বোমা পড়বে না, এই নিশ্চয়তা দিতে আজীবন কাজ করেছিলেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় আসন্ন, কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে নারাজ। তারা শান্তিচুক্তি করতে চায়, পরাজিত হতে রাজি নয়। বাংলার বিজয়কে বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় আত্মসমর্পণ। বিশ্ব বিবেকেরও তেমন আপত্তি নেই শান্তিচুক্তিতে। ভুট্টো জাতিসংঘে শান্তিচুক্তির পক্ষে কাজ করছেন। বলা হয়ে থাকে, পাকিস্তানকে আত্মসমর্পণের টেবিলে বসানোর পিছনের এক নায়ক ভারতীয় জেনারেল জ্যাকব। বাংলার পরম বন্ধু। লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব ইহুদি ছিলেন।

বোরের পরমাণুবাদ পড়েছেন? নিলসন বোর ইহুদি।

পাওলির বর্জননীতি পড়েছেন? পাওলিও ইহুদি।

আলবার্ট আইনস্টাইনের নাম শুনেছেন? আচ্ছা, স্টিফেন স্পিলবার্গ? উনারাও ইহুদি।

উপরে যাদের কথা বললাম, তাদের মধ্যে জেনারেল জ্যাকব ও স্পিলবার্গ ছাড়া সবাই নোবেল বিজয়ী। তবে এখানে আমি আজ ইহুদিদের গুণগান করতে বসিনি। একটু ঘাঁটলে হাজারটা 'ভালো' খ্রিস্টান পাওয়া যাবে; পাওয়া যাবে 'ভালো' মুসলমানও। যাদের অনেকের অবদান হয়তো এদের চাইতেও বেশি। তাহলে এই লেখার উদ্দেশ্য কী?

এবার আসুন একটু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখি। কেন ইহুদিদের কথা বলছি সেটি তাহলে পরিস্কার হয়ে যাবে।

ধরুন, আপনি ইসরায়েল আর গাজার সাম্প্রতিক সংঘাতের বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। ইসরায়েলের অন্যায্য হত্যাযজ্ঞের কিছু ছবি আপনার কাছে আছে, একেবারে বলতে পারেন প্রামাণ্য দলিল। আজকের ইসরায়েলের ইহুদিরা গাজার নিরপরাধ সাধারণ মানুষদের ওপর যে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করছে, সেই ঘটনার তিরিশ-চল্লিশ বছর পর সব কিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল।

তখন আপনি ইসরায়েল গিয়ে যদি একজন ইহুদি যোদ্ধার ঘরে জন্ম নেওয়া শিশুকে দেখান তার পূর্বপুরুষের নির্মমতার প্রামাণ্য দলিল এবং তারপরও যদি সেই প্রজন্ম চোখ উল্টে সব কিছু অস্বীকার করে বসে– মনে করে যে, তাদের পূর্বপুরুষ গাজার নিরপরাধ মানুষদের সঙ্গে যা করেছিল তা আসলে 'উচিত কাজ' ছিল, তাহলে ঠিক সেই মুহূর্তে আপনার কেমন লাগবে? তাদের পাঠ্যপুস্তকে যখন প্রতিপক্ষকে সন্ত্রাসী-দালাল বলে অসম্মান করা হবে তখন কেমন লাগবে আপনার?

তবে ইজরায়েলের পরবর্তী প্রজন্ম যদি এই গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তাহলে অবশ্যই তা প্রশংসার দাবি রাখবে।

ঠিক একইভাবে প্রত্যেক পাকিস্তানিকে ঘৃণা করতে হবে এটাও অবান্তর। অনেক পাকিস্তানি নাগরিক বাংলাদেশে সংঘটিত অপরাধের জন্য ক্ষমা চায়, লজ্জিত হয়। পাকিস্তানের কয়েকজন নেতা প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়েছেন বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রসঙ্গে। পাকিস্তানি অনেক সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মীও বাংলাদেশে তাদের পূর্বপুরুষের আচরণের কারণে লজ্জিত। কিন্তু সেই দেশের বড় অংশের মানুষ ভুল ইতিহাস জানে। ভুল জানা মানুষদের ঠিকটা জানিয়ে দিলেও যদি তারা অস্বীকার করে বসে, তাহলে তারা অবশ্যই তাদের পূর্বপুরুষদের মতো ঘৃণার পাত্র।

অন্যায়কারী আর অন্যায় সহ্যকারী দুজনই অপরাধী। এ দায় যেমন তাদের ইতিহাস-প্রণেতাদের, ঠিক তেমনি সেই মানুষদেরও বটে।

একটু ব্যাখ্যা করি। ধরুন, আমি একজন মানুষের বিরুদ্ধে আপনাকে একগাদা ভুল তথ্য দিয়ে, উসকানি দিয়ে, বিভ্রান্ত করে তাকে খুন করতে পাঠালাম। আপনি কথামতো খুনটা করে আসলেন এবং ঘটনাক্রমে এক সময় পুলিশের কাছে ধরাও পড়লেন। আদালতে গিয়ে আপনি হড়হড় করে বললেন, খুনটা আপনি করেছেন আমার প্ররোচনায়, উসকানিতে। পুলিশ আমাকে ধরে আদালতে নিয়ে গেল। ধরুন বিচারে আমার ফাঁসি হয়ে গেল। এখন আপনার কি ধারণা আদালত আপনাকে বেকসুর খালাস করে দেবে?

কোর্ট হয়তো আমাকে ফাঁসি ঠিকই দেবে, কিন্তু আপনাকেও ছেড়ে দেবে না। ভুল জেনে আপনি যাচাই বাছাই না করে একটা খুন করে ফেলবেন আর তারপর দোষ চাপিয়ে কেটে পড়বেন সেটা হবে না।

একইভাবে ভুল ইতিহাস জেনে পাকিস্তানে যে নির্বোধ প্রজন্ম জন্ম নিচ্ছে, তারা প্রতিনিয়ত মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশের জন্ম, পৃথিবীর অন্যতম বড় একটা গণহত্যা, এসব অস্বীকার ও অপমান করছে। তাদের পূর্বপুরুষদের প্রত্যেকে ধর্ষক। তারা আমার মা, আমার বোনকে ধর্ষণ করেছে। আমার ভাই, আমার পিতাকে হত্যা করেছে। বিরানব্বই হাজার সৈন্য ছয় লাখ ধর্ষণ করলে সেই অপরাধের মাত্রা আপনারা বুঝতে পারেন। অথচ কোনো দিন শুনেছেন কোনো পাকিস্তানি সৈনিকের সন্তান বলছে এটা তাদের পিতাদের কৃত অপরাধ ছিল?

এবার আসুন আরেকটু নিরপেক্ষ ও নির্মোহভাবে চিন্তা করি। পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাসগুলো কীভাবে তৈরি হয় আর আমাদের যুদ্ধের ইতিহাসই-বা কীভাবে এসেছে?

আমাদের মানতেই হবে, যে কোনো যুদ্ধের পর সেই যুদ্ধ নিয়ে যুদ্ধে বিজয়ীদের দেশে এক রকম ইতিহাস লেখা হয়ে থাকে আর পরাজিত দেশের ইতিহাসে লেখা থাকে অন্য রকম কথা।স্বাভাবিকভাবেই দুটো ইতিহাসের বয়ানে পরস্পরকে দোষারোপ করা হয়। দুটো ইতিহাসেই থাকতে পারে অনেক ভুল তথ্য, মিথ্যাচার। কিন্তু অনেক অনেক বছর পর যখন একাডেমিকভাবে ইতিহাসবিদদের হাতে ইতিহাস লেখা হবে, তখন সব গল্পের জট খুলে সত্যটা ঠিকই বেরিয়ে আসে। এটাই ইতিহাসের নিয়ম।

এবার একটা জিনিস লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু দুটো পরাশক্তি কিংবা দুটো সেনাবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ ছিল না। যুদ্ধটা হয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের নিরীহ সাধারণ জনগণের। সুতরাং এই যুদ্ধে আমরা একই সঙ্গে নির্যাতিত ও বিজয়ী গোষ্ঠী। অন্য সব যুদ্ধের সঙ্গে এই যুদ্ধ মিলিয়ে ফেলার আগে বিষয়টা বোঝা খুবই জরুরি।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে মূলত পাকিস্তানে লিখেছেন পাকিস্তানি জেনারেল ও রাজনীতিবিদরা। এদিকে বাংলাদেশেও অনেক গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে একেবারে নির্মোহভাবে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য-উপাত্ত যাচাই করতে আমাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে আন্তর্জাতিক মিডিয়া। পাকিস্তানি বাহিনীর রক্তচক্ষুর ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ আর গণহত্যার অনেক কম খবরই দেশের বাইরে যেতে পেরেছে। তবু যতটুকু বেরিয়েছে, সে সব বিশ্বময় পৌঁছে যায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে। পৃথিবীর বড় অংশ জানতে পারে পাকিস্তানিদের নির্মমতার কথা।

সারা পৃথিবীর জনমত চলে আসে বাঙালিদের পক্ষে। আর এইসব খবর সরবরাহ করেছেন যেসব সাংবাদিক ও বিদেশি পর্যবেক্ষক, তারা ঘটনাগুলো নিরপেক্ষ ও নির্মোহভাবেই লিখেছেন। এইসব টেলিভিশন আর সংবাদপত্রের প্রচারণার কারণেই মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী ও পাকিস্তানিদের নির্মমতা পৃথিবীর মানুষদের কাছে পরিস্কার। বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষেরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ঘৃণা করেন।

অন্যদিকে, পাকিস্তান তাদের পক্ষে কোনো গ্রহণযোগ্য ইতিহাস দাঁড় করাতে পারেনি। তাদের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে তারা নিয়মিত মিথ্যাচারিতা, বাংলাদেশি সাধারণ নাগরিকদের প্রতি বিনা কারণে বিদ্বেষে পরিপূর্ণ করে রেখেছে। অথচ বাংলাদেশের সমস্ত পাঠ্যবইতে নিয়মমাফিক পাকবাহিনীর নির্মমতার কথাই বলা আছে। কখনও কোনো পুস্তকে পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকদের প্রতি কোনো হিংসার বাণী ছড়ানো হয়নি, পাকিস্তানিদের হেয় প্রতিপন্ন করা হয়নি।

কেউ দেখাতে পারবেন না আমাদের কোনো শ্রেণির কোনো পাঠ্যপুস্তকে পাকিস্তানের সাধারণ জনগণদের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে কোনো কথা বলা হয়েছে।

অন্যদিকে, পাকিস্তানের স্কুল-কলেজে পাঠ্যপুস্তকগুলোর মোটিভ মূলত একটাই– বাংলাদেশ এবং বাঙালি-বিদ্বেষ। যে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বিদ্বেষের ওপর দাঁড় করানো তাদের কাছে আর কী আশা করা যায়? বারবার রেফারেন্স ছাড়া 'ভুল ইতিহাস', 'ভুল ইতিহাস' কথাটার পুনরাবৃত্তি উচিত হচ্ছে না। তাই কথা না বাড়িয়ে আসুন দেখে নেওয়া যাক পাকিস্তানের বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে ১৯৭১, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কী লেখা আছে:

পঞ্চম শ্রেণি:

— ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর ভারত পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের সহযোগিতায় সেখানকার অধিবাসীদের পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলে। পরে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করে। ভারতের ষড়যন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তান পৃথক হয়ে যায়।

নবম-দশম শ্রেণি:

— পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বহু সংখ্যক হিন্দু শিক্ষক কর্মরত ছিলেন। হিন্দু শিক্ষকেরা বাঙালিদের মনে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করে।

— পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় এক কোটি হিন্দু বাস করত। ভারত তাদের স্বার্থ বাস্তবায়নে এই হিন্দুদেরকে ব্যবহার করে। ভারত পূর্ব পাকিস্তান পৃথক করতে চেয়েছিল। অনেক হিন্দুই ভারতের চর হিসেবে কাজ করে। পাকিস্তান আমেরিকাকে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দেওয়ায় রাশিয়া পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিল। ফলে রাশিয়া ভারতের সামরিক আগ্রাসনে সমর্থন দেয়। অন্যদিকে আমেরিকাও পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা চেয়েছিল।

— আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তানের পতন হয়।

উচ্চ মাধ্যমিক:

— মার্শাল ল কর্তৃপক্ষ পুর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অভিযানে জামায়াতে ইসলামী সশস্ত্র সেচ্ছাসেবক দিয়ে অংশগ্রহণ করে। সামরিক অভিযানের মুখে আওয়ামী লীগের অনেক কর্মী ভারতে পালিয়ে যায় এবং শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে। ভারত তাদেরকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ প্রদান করে এবং পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পূর্ব পাকিস্তানে প্রেরণ করে। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যায়। ডিসেম্বর ৩, ১৯৭১ ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। স্থানীয় জনগণের সমর্থনের অভাব, সামরিক বাহিনী ও সরঞ্জামাদি সরবরাহের দুর্বল ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে পাকিস্তানের সৈন্যরা ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্নসমর্পণে বাধ্য হয়।

— ১৯৭১ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সাহসিকতার এক নতুন রেকর্ড স্থাপন করে।

উপরের অল্প কিছু উদাহরণ থেকেই দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানি শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত প্রত্যেক মানুষ মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভুল তথ্য জেনে আসছে। কোনো কিছু ভুল জেনে একটা দেশ সম্পর্কে ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ফলে দিনের শেষে তারা তাদের পূর্বপুরুষের হাতে এই মাটিতে সংঘটিত এত বড় একটা গণহত্যা অস্বীকার করছে; কিছু হাস্যকর খোঁড়া যুক্তি দিয়ে নিজেদের জাতির বর্বরতার ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। এহেন প্রতিহিংসামূলক ইতিহাস জেনে পাকিস্তানে বছরের পর বছর আত্মাভিমানী, নির্বোধ, অথর্ব প্রজন্ম জন্ম নিচ্ছে যারা প্রতিনিয়ত আমাদের দেশ, মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যার অপমান করছে।

তবু পাকিস্তানকে ঘৃণা করা বলতে পাকিস্তানের সদ্য জন্ম নেওয়া কোনো নিস্পাপ শিশুকে বোঝানো হয় না। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা করা তরুণ দলকে বোঝানো হয় না। 'বাংলাদেশ' নামের উর্দু কবিতা লেখা কবি কাইফি আজমীকে বোঝানো হয় না। বোঝানো হয় যে, আদর্শের ওপর পাকিস্তান ১৯৭১ সালে দাঁড়িয়েছিল এবং ২০১৫ সালেও দাঁড়িয়ে আছে, সেই আদর্শ ঘৃণা করার কথা।

ফিলিস্তিনের ওপর আগ্রাসন চালানো ইসরায়েলকে ঘৃণা করি। ইরাকে আক্রমণকারী আমেরিকাকে ঘৃণা করি। ফেলানিকে সীমান্তের কাঁটাতারের মাঝখানে লাশ করে দেওয়া ভারতের আগ্রাসনের প্রতিও রয়েছে আমাদের ঘৃণা।

কিন্তু যে ইসরায়েলের মানুষেরা, মার্কিন নাগরিকেরা, আফগানিস্তানের জনগণ তাদের দেশে চলতে থাকা এইসব রীতিনীতির সমালোচনা করেন, তাদের বুকে টেনে নিই। যে ভারতীয় মানবাধিকার কর্মীরা ফেলানির ন্যায়বিচারের জন্য রাজপথে মিছিল করে রাতের পর রাত, দিনের পর দিন– তাদের জন্য টুপি খুলে রাজপথে বিছিয়ে দিই। যে পাকিস্তানি নাগরিক বাংলাদেশের কাছে তার রাষ্ট্রকে ক্ষমা চাইতে বলে– তাকে 'ভাই' বলে সম্ভাষণ জানাই।

যত দিন না তিরিশ লাখ মানুষকে নির্বিচারে হত্যার বিচার হচ্ছে, ছয় লাখ নারীকে ধর্ষণের বিচার হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতিপূরণ না পাচ্ছি, প্রত্যেক পাকিস্তানি নাগরিক
তাদের পূর্বপুরুষের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইছে নতজানু হয়ে– ততদিন পর্যন্ত একজন যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবেই দৃঢ় উচ্চারণ করি হুমায়ুন আজাদ স্যারের সেই কথাটি–

''পাকিস্তানকে আমি ঘৃণা করি, যখন তারা গোলাপ নিয়ে আসে তখনও…''

সবশেষে বিজয়ের মাসে গণহত্যার দুটো গল্প শোনাই। প্রথম গল্পটা রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের লেখা 'মুক্তির সোপান তলে' বই থেকে নেওয়া।

"মালতিয়া গ্রামের সীমানা থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গাড়ির গতি মন্থর হয়ে যায়। রাস্তায় এত মৃতদেহ, ওগুলো না সরালে গাড়ি নিয়ে এগুনোই যাচ্ছে না। পাকিস্তানি সৈন্যরা কয়েকজন লোক ডেকে আনে এবং অস্ত্রের মুখে তাদের বাধ্য করে ওখান থেকে চৌরাস্তা ও চৌরাস্তা থেকে ডুমুরিয়ার দিকে কিছুদূর পর্যন্ত রাস্তার উপরের লাশগুলো টেনে একপাশে সরিয়ে ফেলতে; যেন জিপ নিয়ে পাকিস্তানিরা ঐ পর্যন্ত যেতে পারে।

সেই গাড়ি আস্তে চলতে চলতে চৌরাস্তায় এসে থামে। কেশবপুর হয়ে যশোরের রাস্তায় এত লাশ যে, ওগুলো সরিয়ে যেতে অনেক সময় লাগবে। ডুমুরিয়া-খুলনা কাঁচা রাস্তার অবস্থাও একই। কিছু লাশ টেনে সরিয়ে জিপ ডুমুরিয়ার পথে ধীরে ধীরে এগুতে থাকে কয়েক মিনিট। তারপর থেমে যায়। আবার ফিরে এসে চৌরাস্তায় থামে। ওদিকেও লাশের স্তূপ। যাওয়া যাবে না।

খেয়া পারাপারের জন্য কোনো লোক নেই। ভদ্রা নদীর বুকে ডুবে আছে অনেক নৌকা, বহু মৃতদেহ। ভদ্রার তীরে পড়ে আছে অসংখ্য মৃতদেহ। ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ছুটছে চৌরাস্তার দিকে। পাকি ক্যাপ্টেন এসেছে জিপ নিয়ে, সঙ্গে কয়েকজন। হুকুম দিয়েছে, ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ও অন্য স্থানীয় নেতারা যেন অবিলম্বে তার সঙ্গে দেখা করে।

রুমাল নাকে চেপে জিপে বসে আছে ক্যাপ্টেন। কড়া হুকুম তার, আজ সন্ধ্যার মধ্যে সব লাশ নদীতে ফেলতে হবে। সবাই একে অন্যের দিকে চেয়ে থাকে। কিন্তু ক্যাপ্টেনকে কিছু বলার সাহস পায় না কেউ। একজন সাহস অর্জন করে বলে ফেললেন–

'স্যার, এই অল্প সময়ে এত লাশ নদীতে ফেলা সম্ভব নয়।'

'কিঁউ', বিশ্রীভাবে চিৎকার করে ওঠেন। কতজন লোক পাওয়া যাবে জানতে চান ক্যাপ্টেন সাহেব।

'পুরো এলাকা খুঁজে একশ জন।'

'একশ লোকই যথেষ্ট। কাজ শুরু কর।'

'চার পাঁচদিন লাগবে স্যার। দুইজনের এক একটা দল দিনে বড়জোর ৮ ঘণ্টা কাজ করতে পারবে। ঘণ্টায় গড়ে ৬টা লাশ সরাতে পারে। ৮ ঘণ্টায় ৪৮ বা ৫০। খুব চেষ্টা করলে না হয় ৬০। এর বেশি কোনোমতেই সম্ভব না।'

'ক্যায়া বক বক করতা হ্যায়', ক্যাপ্টেন রেগে ওঠে।

'লাশগুলো টেনে নদী পর্যন্ত নিয়ে যেতে সময় লাগবে। ২ জনের একটা দল বয়স্কদের ১টার বেশি লাশ নিতে পারবে না, ছোট ছেলে মেয়ে না হয় ৪/৫টা নিতে পারবে। নদীর লাশগুলো না হয় বাঁশ দিয়ে ঠেলে ঠেলে ভাটার টানে ছেড়ে দিলে সমুদ্রে চলে যাবে। কিন্তু ডাঙার লাশ সরাতে খাটুনি অনেক।

'তব তো কাল তক হোনা চাহিয়ে?

'না, সাহেব, লাশ অনেক।'

'কিতনা?'

মালতিয়া গ্রামের আশপাশ, রাস্তাঘাট, চুকনগর বাজার, পাতাখোলার মাঠ, বিল— এখানেই প্রায় ১০/১২ হাজার। নদীতে ৩/৪ হাজার। গাড়িতে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে আসা দোভাষী বিষয়টা বুঝিয়ে বললে ক্যাপ্টেন বিশ্বাস করতে চায় না। জিপের সিটের উপর দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন দেখতে থাকে চারপাশ, আসলে লাশের সংখ্যা কত? কিছুক্ষণ দেখার পর ক্যাপ্টেন শান্ত কণ্ঠে বলল, সে সোমবার বিকালে অথবা মঙ্গলবার সকালে আসবে।''

এবার শেষ গল্পটি।

''দিনটা ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের আট তারিখ। রাওয়ালপিণ্ডির সিএমএইচে এক তরুণ পাকিস্তানি অফিসারকে আনা হয়েছে মানসিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য যে একাই প্রায় ১৪,০০০ মানুষকে হত্যা করেছে। এত এত লাশ দেখতে দেখতে সে পাগল হয়ে গেছে। যুদ্ধের কথা মনে পড়লেই তার ক্রমাগত খিঁচুনি হচ্ছে এবং ঘুমিয়ে পড়লে দুঃস্বপ্ন দেখছে। তাকে ফিরে যেতে হবে এবং হিন্দুদের শেষ করতে হবে।''

আমাদের জানা মতে, অফিসিয়ালি একজন মানুষের হাতে সর্বোচ্চ হত্যা-সংখ্যা ২,৭৪৬ এবং এই বিশ্ব রেকর্ডটির মালিক যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট ডিলার্ড জনসন। এই যোদ্ধা তার সৈনিক জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছে ইরাকে।

সে হিসেবে উপরের ঘটনা সার্জেন্ট ডিলার্ড জনসনকেও ছাড়িয়ে যায়। বলে নেওয়া ভালো যে, উপরের গল্পটি কোনো বাঙালি লেখক নিজের বইয়ের কাটতি বাড়ানোর জন্য লেখেননি। এটা লিখেছেন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান, Diaries of Field Marshal Mohammad Ayub Khan বইতে। তার বইটার ৪৯৮ ও ৪৯৯ নং পৃষ্ঠা খুললেই এ অংশটুকু খুঁজে পাবেন।

তথ্যসূত্র:

১.

'মুক্তির সোপানতলে', রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম

২.

'Diaries of Field Marshal Mohammad Ayub Khan', ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান

৩.

মুক্তিযুদ্ধ-ই-আর্কাইভ

৪.

'পাকিস্তানি জেনারেলদের মন', মুনতাসীর মামুন

সময় প্রকাশনী।