বড়দিনে দূর হোক সব বিভাজন

পি আর প্ল্যাসিড
Published : 25 Dec 2015, 02:42 PM
Updated : 25 Dec 2015, 02:42 PM

বড়দিন সময়ের দিক দিয়ে মোটেও বড় দিন নয় তা আমরা এখন জানি। সারা পৃথিবীর খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় বিশ্বাসের গুরুত্বের কারণেই ২৫ ডিসেম্বর বড় দিন। এটি সত্য যে, এ দিন যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন নয়, তাঁর জন্মোৎসব। পৃথিবীতে অনেক ধর্ম আছে। একেক ধর্ম-স্রষ্টার জন্ম ও কর্ম ভিন্ন। তাই প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী তাদের স্রষ্টাদের জন্মোৎসব পালন করে ভিন্নভাবে। এরই ধারাবাহিকতায় খ্রিস্টানদের জন্য বড়দিনের উৎসবটি তাৎপর্যপূর্ণ।

আমরা যে ক্যালেন্ডার দেখে কাজ করি প্রতিনিয়ত, সেটি খ্রিস্টের জন্মের সঙ্গে মিল রেখে করা হয়েছে বলেই একে বলা হয় খ্রিস্টিয় ক্যালেন্ডার। আজ থেকে ২০১৫ বছর আগ থেকে এর হিসাব করা হলেও বাস্তবে ঠিক কোন দিন যিশুর জন্ম হয়েছিল সে ইতিহাস কোথাও নেই। রোমান ক্যথলিক ও তাদের কাছাকাছি কিছু ধর্ম-বিশ্বাসী গ্রুপ এই দিন ধার্য করে যিশুর জন্মোৎসব পালন করে। আবার অনেকে খ্রিস্টান হয়েও বড়দিন পালন করে জানুয়ারি মাসের শুরুতে বা অন্য কোনো সময়ে।

খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসীদের বিশ্বাস, যিশুর (যাকে ইসলাম ধর্মে বলা হয় হযরত ইসা আলাইহি ওয়া সালাম) জন্ম হয়েছে মরিয়মের গর্ভে। এই জন্ম-ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এটি স্বাভাবিক জন্ম ছিল না। কারও সঙ্গে মিলন ছাড়াই যেহেতু মরিয়ম গর্ভবতী হয়েছিলেন, সুতরাং একে স্বীকৃত অলৌকিক ঘটনা বলা হয়। এটাই সারা পৃথিবীর খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস।

ঈশ্বরের সৃষ্ট এই মানবজাতি যখন পৃথিবীতে বিভিন্ন পাপ আর অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তখন ঈশ্বর তাদের পরিত্রাণ বা মুক্তির জন্য যিশুকে মানুষরূপে পাঠান– তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে নয়, পুত্র হিসেবেই। মানবজাতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে মানুষের এই পৃথিবীতে পাপকাজ থেকে মানুষের পরিত্রাণের জন্য মানুষ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছিলেন যিশু। তাই অনেকে সে সময় তাঁকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বাস করতে পারেননি। যে কারণে তাঁকে এবং তাঁর বিভিন্ন অলৌকিক কাজ সহজে মেনে নিতে না পেরে তাঁর বিরোধিতাই করেছে অনেক ক্ষমতাধর রাজা। সর্বশেষ তাঁকে ক্রুশে বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে, ঈশ্বরের ইচ্ছায় যিশু তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার মাধ্যমে কবর থেকে সরাসরি স্বর্গে গমন করেন।

যিশুর জন্ম ও মৃত্যু দুটো দিবসকেই খ্রিস্ট-ভক্তরা অতি গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে। যিশুকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিল শান্তির বারতা বহনের জন্য। তিনি মানবজাতির সুখ ও শান্তির জন্যই কাজ করেছেন। তার মানে, খ্রিস্ট-জন্মের শুরুতে মানুষ ছিল অশান্তি, অপকর্ম আর পাপকাজের সঙ্গে জড়িত। যিশুর জন্মের পর পৃথিবী থেকে কি সেই পাপ ও অশান্তি দূর হয়েছে? হয়েছে কি ইশ্বরের ইচ্ছা পূরণ? উত্তর যদি হয় 'না', তাহলে প্রায় সোয়া দু হাজার বছর আগে যিশুর জন্ম বা আগমনের স্বার্থকতা কোথায়?

পৃথিবীতে এখনও মানুষে মানুষে দ্বন্দ্বসহ যাবতীয় পাপ টিকে রয়েছে। চলছে শক্তির বাহাদুরি, বুদ্ধির অপব্যবহার। রয়েছে ধর্মে ধর্মে অনভিপ্রেত সমস্যা। এসবের সমাধান করতে এখন আর নতুন কোনো যিশুর জন্ম হবে না। আমাদের, মানুষদেরই করতে হবে এর সমাধান। তবে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী মানুষের বিশ্বাস, শেষ বিচারের দিন যিশু আবার আসবেন বিচার করতে। এই বিচারের ভয়ে আর পরজগতে স্বর্গবাসী হবার আশা নিয়েই মানুষ ভালো বা পূণ্যের কিছু কাজ করছে। যিশুর দেখিয়ে যাওয়া পথে চললেই আমরা পাব পরিত্রাণ বা মুক্তি।

পৃথিবীতে প্রায় সব ধর্ম কেন্দ্র করে দেখা যায় বছরের একটি সময় বেশ বড় বাণিজ্য গড়ে ওঠে। বড়দিন ঘিরেও তাই হয়। নভেম্বর মাস এলেই দোকানপাট বা বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিভিন্নভাবে সাজানো শুরু হয়ে যায়। এর মধ্যে ক্রিসমাস ট্রি, ঘণ্টা, তুষারের উপস্থিতি থাকে। বড়দিন উদযাপন উপলক্ষে ক্রিসমাস কার্ডের আদান-প্রদান শুরু হয়েছিল। এই আদান-প্রদান থেকেই মানুষের মধ্যে জন্মদিনের কার্ড ব্যবহারেরও প্রচলন। যদিও বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে অনেক কিছুর ব্যবহার কমে গেছে। তবুও বড়দিন যেখানে পালিত হয় সেখানে এর ভাবমূর্তি ও তাৎপর্য ধরে রাখার বিষয়টি বাদ যায় না।

বড়দিনের আগের দিনকে বলা হয় ক্রিসমাস ইভ। এ দিনই হয় যত আনন্দ। বাড়ি বাড়ি ঘুরে যিশুর জন্মের উপর লেখা গান দিয়ে কীর্তন গাওয়া, পিঠা পুলি তৈরি করে খাওয়া, বিভিন্ন ধরনের পানীয় পানও হয় আগের সন্ধায়। গির্জাগুলোতে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন চলে।

এ বছর বড়দিন প্রসঙ্গে আমি বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলেছি। তাতে মনে হল, দেশে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের একটা বড় অংশ অনিশ্চিয়তা ও আতংকের মধ্যে রয়েছেন। ভয়-ভীতি মানুষের মনে বিরাজ করছে। সরকারের এ বিষয়ে আরও বেশি সাবধানতা অবলম্বন করে পূর্ণভাবে সবাইকে ধর্ম পালনে সুযোগ করে দেওয়া উচিত। তা না হলে মানুষ এক সময় তাদের বিবেক-বুদ্ধি হারাবে। হারাবে দেশে কোনো কাজ করার ভরসাও। সম্প্রতি মিডিয়ায় আসা কিছু সংবাদই তার প্রমাণ।

আমি যেহেতু জাপানে থাকি সুতরাং সেখানকার প্রেক্ষাপটই বলি। সেদেশে যে কটি গির্জা রয়েছে সে কয়টি কিন্তু বলা চলে রবিবার দিন পুরো খালিই থাকে। ধর্মের প্রতি তারা বেশ উদাসীন। অন্যান্য দিনেও একই চিত্র দেখা যায়। কিন্তু বড়দিন এলে গির্জায় ঢুকে দাঁড়ানোর জায়গাটুকু পর্যন্ত থাকে না। একদিনের জন্য যেন সকলেই হয়ে যান খ্রিস্টান। ছেলেমেয়েদের বড়দিনের উপহার দেওয়া হয় কখনও প্রকাশ্যে, কখনও গোপনেও। গোপনে যে উপহার দেওয়া হয় সেটির কথা এভাবে বলা হয় যে, ক্রিসমাস ইভে সানতা ক্লজ এসে দিয়ে গেছে তাদের এই উপহার। বিষয়টি শিশুরা বিশ্বাস করলেও আসলে এক ধরনের মিথ্যাকেই তুলে ধরা হয়। আমার মনে হয়, এতে আনন্দ করা হলেও মিথ্যা এক বিশ্বাসের লালন করা হচ্ছে।

আগে জাপানে বড়দিনে একে অপরকে উপহার দেওয়ার চল ছিল। সেই সংস্কৃতি ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন কারণে। ২০১২ সালের এক জরিপে দেখা গেছে যে, জাপানি মেয়েরা বড়দিনের উপহার বেশি কিনে। মজার ও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, উপহার কিনে এরা অন্য কাউকে এখন দেয় না, নিজেরা নিজেদের দেয়। এমন উপহারের অংক ৪৬ হাজার জাপানি ইয়েন।

বাংলাদেশে বড়দিন উদযাপনের রেওয়াজের বিস্তার ঘটেছিল বেশ। এ উপলক্ষে বিভিন্ন ভবন সাজানো এবং মিডিয়াতে অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িকতার উদাহরণ সৃষ্টি করা হত। অতিসম্প্রতি জীবননাশের নানা হুমকির কারণে এর ব্যাপ্তি আর দীর্ঘ হবার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

পৃথিবীর সব ধর্মই শান্তির কথা বলে। বলে খ্রিস্ট ধর্মও। আমরা যদি সবাই এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী হয়ে থাকি, তাহলে এত বিভাজন কেন বুঝি না। আজকের বড়দিনের এটাই প্রত্যাশা যে, সব ধর্মের বিশ্বাসীদের মাঝে বিরাজ করুক সহমর্মিতা ও শান্তি।

রেভারেন্ড পি আর প্ল্যাসিড: জাপান-প্রবাসী লেখক-সাংবাদিক।