নতুন ‘ইসলামিক’ সামরিক জোট ও রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র

শওগাত আলী সাগর
Published : 20 Dec 2015, 10:57 AM
Updated : 20 Dec 2015, 10:57 AM

''বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার কি নিজেদের আর 'ধর্মনিরপেক্ষ' সরকার মনে করে না?''

বন্ধু জয়ন্ত বণিকের প্রশ্ন খানিকটা দ্বিধায় ফেলে দেয়। তিনি নিজেই অবশ্য প্রশ্নটার ব্যাখ্যা দেন।

''এই যে বাংলাদেশ, সৌদি আরবের নেতৃত্বে গঠিত 'ইসলামিক সামরিক জোটে' অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিল, তা দেখে আমার মনে এই প্রশ্ন জেগেছে।''

মুসলিম চরমপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট তথা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সৌদি আরবের নেতৃত্বে সম্প্রতি ৩৪টি মুসলিম দেশের সমন্বয়ে যে নতুন সামরিক জোটে গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশও সেটিতে যোগ দিচ্ছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে আমাদের জানিয়েছে। মন্ত্রণালয় যখন আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বিষয় প্রচার করে, সেটি আসলে সরকারি ঘোষণা হিসেবেই বিবেচিত হয়। নতুন এই সামরিক জোটে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার আসলে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি ঘোষণাই দিয়েছে।

জয়ন্ত বণিক জানতে চান, নতুন জোট মুসলিম দেশসমূহের জোট এবং এর নামের সঙ্গে 'ইসলামি' শব্দবন্ধ রয়েছে। সঙ্গত কারণেই ধারণা করা যেতে পারে যে, ইসলামি রাষ্ট্র হওয়া এই জোটে যোগ দেওয়ার পূর্বশর্ত ও যোগ্যতা। বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকা সত্বেও বর্তমান সরকার নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের বলেই দাবি করে থাকেন। তাহলে ধর্মনিরপেক্ষ একটি সরকার 'ইসলামি' জোটে অংশ নেয় কীভাবে?

এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। নতুন এই সামরিক জোট গঠনের ঘোষণার পর জোটের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা এবং কর্মপরিধি নিয়ে যেমন মানুষের মনে কৌতূহল ও জিজ্ঞাসা রয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নিয়েও নানা প্রশ্ন। যে কোনো সামরিক জোটে যোগ দেওয়া আসলে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার মতো বিষয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিবৃতির মাধ্যমে একটি দেশ কোনো আন্তর্জাতিক সামরিক জোট বা যুদ্ধ-প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে কি না, এর জন্য সরকারের কোনো পর্যায়ে আলোচনার দরকার কিংবা অনুমোদনের প্রয়োজন আছে কি না, তা নিয়ে কিছু কিছু প্রশ্ন উঠলেও সরকারের পক্ষ থেকে পরিষ্কারভাবে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।

ন্যাটোর নেতৃত্বে একটি সামরিক জোট আইএসএর বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করছে। সেটিতে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক দেশ নিজ দেশের মন্ত্রিসভা ও সংসদ থেকে অনুমোদন নিয়েছে। কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ সরকার আইএসবিরোধী সামরিক অভিযানে অংশ নেওয়ার আগে প্রস্তাবটি হাউজ অব কমন্সে তুলেছিলেন। সেখানে এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক হয়েছে। কনজারভেটিভ পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে হাউজ অব কমন্স এক বছরের জন্য জোটে অংশগ্রহণের অনুমোদন দেয়। সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন ইসলামিক সামরিক জোটে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে কোনো আলোচনা হয়নি। এমনকি মন্ত্রিরিষদে আলোচনা হয়েছে বলেও খবর পাওয়া যায়নি। সরকার তার নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছেন, এ মর্মে কোনো খবরও কি চোখে পড়েছে? তাহলে?

ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিডিয়ায় প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে জানিয়েছে, সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দেশটির রাজধানী রিয়াদে 'ইসলামি সামরিক জোট কেন্দ্র' প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদেল বিন আহমেদ আল জুবায়ের এই কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হিসেবে যোগ দিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে অনুরোধ জানিয়েছেন। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের 'জিরো টলারেন্স' নীতির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এই কেন্দ্রে অন্যান্য মুসলিমপ্রধান দেশের সঙ্গে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। অপরদিকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানিয়েছেন যে, সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে এই জোটে যোগ দিতে অনুরোধ করেছিলেন। সে প্রেক্ষিতে সামরিক জোটে যোগদানে বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে সম্মত হয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক বিবৃতি এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বক্তব্যের মধ্যে খানিকটা ভিন্নতা আছে। মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে জানাচ্ছে, সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদেল বিন আহমেদ আল জুবায়ের বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে টেলিফোন করে অনুরোধ জানিয়েছেন। আর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানাচ্ছেন, সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে এই জোটে যোগ দিতে অনুরোধ করেছিলেন। দুটো বক্তব্যে একটি বিষয় পরিষ্কার– সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর টেলিফোনে জানানো অনুরোধে বাংলাদেশ এই জোটে অংশ নিয়েছে। আর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ভাষ্যমতে, সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেছিলেন। তাহলে কি শেখ হাসিনা এককভাবেই জোটে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য কিন্তু তাই ইঙ্গিত করে। পাকিস্তানের মতো একটি ব্যর্থ এবং অকার্যকর রাষ্ট্রও যখন এই জোটে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তিন দিন পর, সেখানে বাংলাদেশকে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হল কেন? এ ব্যাপারে কি কোনো ধরনের বাধ্যবাধ্যকতা ছিল? বা কোনো ধরনের চাপ? নাকি পুরো ব্যাপারটাই রাষ্ট্রযন্ত্রের এককেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার দৃষ্টান্ত? আন্তর্জাতিক সামরিক জোটে যোগ দেওয়ার মতো স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত যদি এভাবে চূড়ান্ত করে ফেলা হয়, তাহলে সে সরকারের চরিত্র সম্পর্কে নানা প্রশ্নও কিন্তু ওঠে।

নতুন ইসলামিক সামরিক জোট কীভাবে কাজ করবে সে ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা না হলেও নানা ধরনের কথাবার্তা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে হচ্ছে। ইসলামি চরমপন্থীদের দমনে সাফল্যের চেয়েও এই জোট দমন-পীড়নের নতুন উপসর্গ হিসেবে দেখা দিতে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশংকা প্রকাশ করছেন। এ সব আশঙ্কার পেছনে অবশ্য যুক্তিও রয়েছে। আইএস দমনের অঙ্গীকার নিয়ে নতুন জোট আত্মপ্রকাশ করেছে, অথচ আইএসএর চারণভূমি সিরিয়া এই জোটে নেই। সিরিয়ার সরকারকে সঙ্গে না নিয়ে সেই দেশের অভ্যন্তরে গিয়ে ইসলামিক জোট আইএস দমন কীভাবে করবে? সিরিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত ইরান বা ইরাকও এই জোটে নেই। ফলে আইএস দমনের নামে জোট সিরিয়ায় কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে সিরিয়ার মিত্র হিসেবে ইরান-ইরাক তার পাশে দাঁড়াতে পারে। সে ক্ষেত্রে ওয়াহাবি মতবাদের সৌদির সঙ্গে শিয়া মতাবলম্বী ইরানের দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী। তখন কিন্তু শিয়া-সুন্নি জাতিগত বিরোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আশঙ্কাও থেকে যায়।

ইসলামিক সামরিক জোটের শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনেকে অবশ্য নতুন এই জোটকে ন্যাটোর 'ইসলামিক আরব সংস্করণ' হিসেবে দেখতে চাইছেন। তাদের ধারণা, পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তান এবং তেলসম্পদের মালিক দেশগুলোর সমন্বয়ে এই জোট বিশ্বরাজনীতিতে বিকল্প একটি শক্তি হিসেবেও গড়ে উঠতে পারে। সে ক্ষেত্রে আরব বিশ্বকে একত্রিত করার একটি প্লাটফরম হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে এই জোট। আর তা সম্ভব হলে এই জোটই 'বৈধ খেলাফত' প্রতিষ্ঠার নিয়ামক শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখবে। বর্তমানের আইএসসহ চরমপন্থী মুসলিম সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোও আসলে 'ইসলামি খেলাফত' প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে।

সৌদি আরব সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কতটা সক্রিয় ভূমিকা রাখবে তা নিয়েও বিশ্লেষকদের মধ্যে সংশয় আছে। আইএস সন্ত্রাসীদের দমনের নামে সৌদি আরব যে অভ্যন্তরীন 'অ্যাকটিভিস্টদের' দমনে এই প্লাটফরম ব্যবহার করবে না সে বিষয়ে বিশ্লেষকরা নিশ্চিত হতে পারছেন না। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তো আশঙ্কাই প্রকাশ করে ফেলেছে যে, সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন নতুন সামরিক জোট দেশটিতে মানবাধিকার সীমিত করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে পারে। কারণ, সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি নিয়ে সৌদি দর্শনের সঙ্গে বহির্বিশ্বের ভিন্নমত রয়েছে। বিবিসির নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিনিধি ফ্রাঙ্ক গার্ডনার বলেছেন, সশস্ত্র সহিংস কর্মকাণ্ডই সন্ত্রাসবাদ, এই সংজ্ঞার মধ্যেই সীমিত থাকতে চায় না সৌদি সরকার। সম্প্রতি তারা আইন করে যে কোনো ধরনের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, সংস্কার নিয়ে প্রচারণা নিষিদ্ধ করেছে এবং রাস্তায় বা অনলাইনে যে কোনো ধরনের প্রতিবাদ রাষ্ট্রের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে এগুলো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। কাজেই 'সন্ত্রাসবাদ' শব্দটি সৌদি সরকারের কাছে ভিন্ন অর্থ বহন করে।

এসবই অবশ্য আশঙ্কার কথা। অভ্যন্তরীন ভিন্নমত নির্মমভাবে দমন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে সৌদি সরকারের ন্যাক্কারজনক অতীত ইতিহাসের জন্য এ ধরনের কথা আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু নতুন সামরিক জোটের লক্ষ্য ও আদর্শ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ছাড়াই এ ধরনের একটি জোটে যোগ দেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা কতটা সুবিবেচনাপ্রসূত তা বোধহয় ভাবা দরকার। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বাদ দিলেও এ ধরনের স্পর্শকাতর সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নানা পর্যায়ের মতামত এবং আলোচনা জরুরি বলেই আমরা মনে করি।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমরা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের পরিবর্তে 'ইসলামি' রাষ্ট্র হিসেবেই পরিচিত করতে চাই কি না সে প্রশ্ন তো থাকলই।