রাশিয়া বনাম তুরস্ক: কে আগুন নিয়ে খেলছে

বিজন সরকার
Published : 21 Dec 2015, 11:39 AM
Updated : 21 Dec 2015, 11:39 AM

সিরিয়ার লাতাকিয়ার আকাশে চক্কর দেওয়া রাশিয়ার সু-২৪ বিমানটি ভুল করে তুরস্কের আকাশে প্রবেশ করেছিল। সেখানে সেটি ছিল মাত্র ১৭ সেকেন্ড। এ সময়ের মধ্যেই আমেরিকার তৈরি তুরস্কের এফ-১৬ মিগ রুশ বিমানটি ভূপাতিত করে। ঘটনাটি ২৪ নভেম্বরেরে। এর পর থেকে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বিশ্ব রাজনীতি। যার রেশ এখনও কাটেনি। দুতরফেই চলছে অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ প্রদান। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি ছিল, "তুরস্ক পরিকল্পনা করেই বিমানটি ভূপাতিত করেছে।''

জবাবে তাইপ এরদোগানের হুঁশিয়ারি ছিল এ রকম: "রাশিয়া আগুন নিয়ে খেলছে। সেই খেলা বন্ধ করুক।"

তবে এরদোগানের গলার স্বর নিম্নমুখী ছিল। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের বিষযটিতে তুরস্ক যে খুব গুরুত্ব দেয়, তা-ও তাদের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বারবার বলা হচ্ছে। তুরস্ক যদি জানত যে বিমানটি রাশিয়ার, তবে ঘটনা ভিন্ন হতে পারত বলেও জানান এরদোগান।

তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক দেশটির জন্য কেবল গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাদের অর্থনীতি সচল রাখার অন্যতম অনুষঙ্গও বটে। সে দেশের জ্বালানির ৬০ শতাংশ রাশিয়া-নির্ভর। প্রতি বছর ৩০ থেকে ৩৫ লাখ রাশিয়ান পর্যটক তুরস্ক ভ্রমণ করে। রাশিয়ার বিভিন্ন সেক্টরে প্রায় আড়াই লাখ তুর্কি কর্মরত। তাদের পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পে রাশিয়ার রয়েছে বিশাল বিনিয়োগ। অপরপক্ষে, রাশিয়া তাদের কৃষিজাত পণ্য-আমদানির মাত্র চার শতাংশ করে তুরস্ক থেকে, যা ইচ্ছা করলে তারা অন্যান্য প্রতিবেশি দেশের কাছ থেকে করতে পারে। এমন বাস্তবতায় তুরস্কের দ্বারা রাশিয়ার বিমান ভূপাতিত করার আচরণটি বিস্ময়কর।

ঘটনাটি যে পূর্ব-পরিকল্পিত, তা তুরস্কের নানাবিধ আচরণ থেকে সহজেই বোধগম্য। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই তুরস্ক চলে যায় জাতিসংঘে। জরুরি ভিত্তিতে ন্যাটোর সভা আহ্বান করা হল। সংগঠনের ৫ অধ্যাদেশের আলোকে ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্র তুরস্কের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে। তবে নিজেদের আকাশে মাত্র ১৭ সেকেন্ডের জন্য দৃশ্যমান রুশ বিমানটি গুলি করে নামানো কতটা যৌক্তিক, সে প্রশ্নও সামনে চলে এসেছে। তুরস্ক যে পরিকল্পনা করেই এটি করেছে, তার স্বপক্ষে দুটি বড় প্রমাণ রয়েছে।

প্রথমত, ভিন্ন দেশের আকাশে বিনা অনুমতিতে প্রবেশের বহু অভিযোগ তুরস্কের বিমানগুলোর বিরুদ্ধেই রয়েছে। ২০১৪ সালেই প্রায় আড়াই হাজার বার গ্রিসের আকাশে তুর্কি বিমান প্রবেশ করে।

দ্বিতীয়ত, প্রায় প্রতিদিনই সিরিয়ায় হামলা চালাতে ইসরাইলের বিমানগুলো তুরস্কের আকাশে প্রবেশ করছে। এ নিয়ে তুরস্কে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। তাহলে রাশিয়ার বিমান মাত্র ১৭ সেকেন্ডের জন্য প্রবেশের অপরাধেই ভূপাতিত করার প্রয়োজন পড়ল কেন?

রাশিয়ার সু-২৪ বিমানটি ভূপাতিত করার পর তুরস্ক এখানে ন্যাটোকে জড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। সদস্য রাষ্ট্র হওয়ার কারণে ন্যাটো তুরস্কের পক্ষে সংহতি প্রকাশ করলেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে শক্ত কোনো অবস্থান সামরিক নেয়নি। বরং বহু ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রের সচেতন সমাজ তুরস্ককে দায়ী করেছেন। খোদ আমেরিকার রিপাবলিকানপন্থী সামরিক বিশেষজ্ঞরা ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করার অভিযোগ আনেন আইএস-বান্ধব তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তাইপ এরদোগানের বিরুদ্ধে। পশ্চিমের সচেতন সমাজ সে দেশের রাজনীতিবিদদেরকে তাইপের লুকায়িত এজেন্ডা সম্পর্কে সচেতন করে দেন। তাদের বিশ্বাস, তিনি চতুরতার সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটোকে যুদ্ধে লিপ্ত করতে কাজ করছেন। তবে তার ন্যাটো-ভিত্তিক কৌশল কাজে আসেনি।

সিরিয়ার বৈধ সরকারপ্রধান বাশার আল আসাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাশিয়া দেশটির ভিতরে আইএস, আল-কায়দাসহ বহু জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হামলা পরিচালনা করছে। অন্যদিকে, কথিত আন্তর্জাতিক জোট আন্তর্জাতিক কোনো আইনের তোয়াক্কা না করেই যখন খুশি তখন সিরিয়ায় বিমান হামলা পরিচালনা করছে। কেবল ইসরাইল নয়, সিরিয়ায় হামলা করতে গিয়ে বহু দেশের সামরিক বিমান তুরস্কের আকাশে প্রবেশ করছে। তা সত্বেও কেবল রাশিয়ার বিমান প্রবেশ করার পরই তুরস্ক এমন প্রতিক্রিয়া দেখাল। শ্ন হল, বহুলাংশে রাশিয়া-নির্ভর হওয়ার পরও কেন তাদের এমন আচরণ? এর প্রেক্ষিত চারটি বড় পরিসরে পর্যালোচনা করা যাক।

প্রথমেই আমাদেরকে মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মীয় গোত্রভিত্তিক শত বছরের সংঘাত এবং এই সংঘাতের সঙ্গে গত শতাব্দীর সত্তর দশক থেকে চলমান পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের ক্রিয়াশীলতা বিবেচনায় নিতে হবে। সিরিয়া ও ইরাকে আইএসকে তৈরি করার পিছনে একমাত্র কারণ ছিল মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের আধিপত্য সুসংহত করা। দুর্ভাগ্যবশত, আইএস বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্ব এবং এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলির জন্য 'ব্যাকল্যাস' হয়ে উঠেছে। বিষয়টি আইএসএর নির্মাতাদের দ্বারা নির্ধারিত সম্ভাব্য পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার তালিকায় ছিল না।

রাশিয়া সিরিয়াতে হামলা করার পরপরই চ্যানেল ফোরকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবায়ের রাশিয়াকে হুমকি দিয়েছিলেন। তার বক্তব্য ছিল, রাশিয়াকে বুঝতে হবে, মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাত মৌলিক অর্থে রাজনৈতিক নয়, এটি মধ্যপ্রাচ্যের দুটি গোত্রের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। ফলে এই গোত্রভিত্তিক সংঘাতে রাশিয়ার না জড়ানোই উচিত ছিল।

ভূরাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় নিলে সিরিয়ায় আমেরিকার সরাসরি স্বার্থ নেই। ইউরোপের রাষ্ট্রগুলি, বিশেষ করে জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি এবং যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রেও তাই। আরব বসন্ত প্রকল্পে সিরিয়ার অভ্যন্তরীন বিষয়গুলিতে সৌদির নেতৃত্বে সুন্নি রাষ্ট্রগুলির পরামর্শেই পশ্চিমা বিশ্ব উস্কানি দেয়। উল্লেখ্য, আরব বসন্ত আর বসন্ত থাকেনি। সিরিয়ার বৈধ আসাদ সরকারও সেই ফাঁদে পা দেয়। তাঁর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনার ক্ষেত্র নির্মাণ করা হয়। সুন্নি রাষ্ট্রগুলির স্বার্থে কৌশল করে গোত্রভিত্তিক বিভাজনকে গৃহযুদ্ধে রূপদান করা হয়। এই প্রকল্পে অদৃশ্য পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন মার্কিন সিনেটর ম্যাককেইন, যাকে সৌদি প্রশাসন বারাক ওবামার চেয়েও বেশি বিশ্বাস করে।

পশ্চিমা বিশ্ব ইরাক আগ্রাসনের সময় থেকেই শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বে ঘি ঢালতে থাকে। তখন সাদ্দাম হোসেন সুন্নি গোত্রের হলেও সৌদি আরব ইরাকে হামলার জন্য আমেরিকাকে ডেকে আনে। সাদ্দাম হোসেনকে হঠানোর জন্য শিয়া গোত্রের নেতা নূরে আল মালিকির দল ইসলামিক দাওয়া পার্টি ইরান ও সিরিয়া সরকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে। শিয়া অনুসারী মালিকি ২০০৬ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ইরাকের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সে সময় মালিকির প্রশাসনিক সমর্থনে সুন্নি ধর্মাবলম্বীদের বাগদাদসহ ইরাকের বহু এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে সাদ্দাম হোসেনের প্রশাসন ও সেনাবাহিনীতে যে সকল সুন্নিপন্থী কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিল তাদের বেশিরভাগই আইএসে যোগদান করে। এক সময় সাদ্দামের প্রতি সৌদি আরবসহ অন্যান্য সুন্নিপ্রধান রাষ্ট্রগুলির বিরাগপূর্ণ মানসিকতা ছিল। তবে সুন্নি গোষ্ঠীর প্রতি নূরে আল-মালিকির অন্যায় আচরণের ফলে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলি সুন্নি-গোষ্ঠীর বিভিন্ন গ্রুপকে মালিকি সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন দিতে শুরু করে। এ সমর্থনই আজ আইএসের জন্মের অন্যতম নিয়ামক।

এখানেই রয়েছে তুরস্কের লুকায়িত অবস্থান। পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য সুন্নিপ্রধান রাষ্ট্রগুলির দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক এবং মধ্যপ্রাচ্যে সুন্নি রাষ্ট্রগুলির শক্তিশালী রাজনৈতিক অবস্থানের কাছে সুন্নিপ্রধান তুরস্ক মাথা নত করতে ইচ্ছুক। রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের চেয়ে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য সুন্নিপ্রধান রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করা তুরস্কের কাছে গোত্র ও ভূরাজনীতির নব-মেরুকরণ সাপেক্ষে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্ব বাজারে তেলের মূল্য অর্ধেকে নেমে এসেছে। উপসাগরীয় দেশগুলির বার্ষিক আয় ২৯৬ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে। বিশ্বের তেলের বাজারে ইরান প্রবেশ করছে। পশ্চিমা দেশগুলির সঙ্গে চুক্তির আওতায় ইরানের উপর থেকে বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা সরে যাওয়ায় তারা তাদের পাওনা ১৫০ বিলিয়ন ডলার বিশ্ব বাজার থেকে তুলে নিচ্ছে। ইরানের প্রবেশের ফলে তেলের দাম বৃদ্ধির সুযোগ সে অর্থে আর নেই। তাদের উপর বহু বছর ধরে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও সামাজিক ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন অনুষঙ্গে সেখানে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ফলে ইরান সকল ক্ষেত্রেই মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্বে চলে যাবে এমনটিই সম্ভাবনা।

এখানেই হল আসল খেলা। ইরানের সম্ভাব্য নেতৃত্বের আশঙ্কা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য সুন্নিপ্রধান রাষ্ট্রগুলির মতো তুরস্ককেও পেয়ে বসেছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সঙ্গে তেহরানের গভীর সম্পর্কও আঙ্কারার পছন্দ নয়। তারা জানে, আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরানো মানে ইরানের একটি হাত ছেঁটে ফেলা। ওদিকে আমেরিকাসহ ইউরোপের দেশগুলি মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলির প্রতি আগের মতো নমনীয় আচরণ করছে না। এ ক্ষেত্রে যদি কোনো জঙ্গি সংগঠন আমেরিকা ও ইউরোপের জন্য হুমকি না হয়– তা যতই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির জন্য ভয়ঙ্কর হোক– এ নিয়ে মাথা ঘামানো পশ্চিমা বিশ্বের দায় নয়।

তুরস্কের ভিতরেও রয়েছে সেই জঙ্গিবাদের প্রসার। তাইপ এরদোগানের প্রতি পশ্চিমা গোষ্ঠীর আগের মতো আস্থা নেই। তাদের এলিট সমাজ তাইপকে ইসলামি উগ্রবাদের প্রসারক বলে ভাবতে শুরু করেছে। সে ক্ষেত্রে তুরস্কের জন্য রুশবিরোধী মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে জোটে থাকা ছাড়া বিকল্প নেই। এমনকি রাশিয়া যদি তাদের জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তাহলেও উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলির কাছে থেকে সহযোগিতা প্রাপ্তির পথ উন্মুক্ত থাকবে।

দ্বিতিয়ত, সিরিয়ার সীমান্তে তুর্কমেন প্রদেশে সিরিয়ান আল কায়দা, আল নুসরাসহ বহু জঙ্গি সংগঠন কর্মতৎপর রয়েছে। আবার আসাদবিরোধী সিরীয়-তুর্কমেন বিদ্রোহীরাও সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। রাশিয়ার সিরিয়াতে বিমান হামলা শুরুর পরপরই তুরস্ক দাবি করে আসছে যে, ওরা তুর্কমেন প্রদেশে জঙ্গি দমনের নামে সাধারণ মানুষ মারছে। এমনকি তারা রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠিয়ে অভিযান বন্ধের দাবি জানিয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে তুর্কমেন প্রদেশে রুশ সেনা-অভিযানের প্রসঙ্গ তুলেছিল তুরস্ক। মূলত তুর্কমেনরা সিরিয়ার নাগরিক হলেও এদের শিকড় তুরস্কে। ফলে তুরস্কের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে তাইপ এরদোগানের প্রতি চাপ বাড়তে থাকে। অনেকেই আবার সম্ভাব্য খণ্ডিত সিরিয়ার তুর্কমেন প্রদেশকে তুরস্কের নতুন অংশ বানানোর জন্য এরদোগানের দুরভিসন্ধির কথাও উল্লেখ করেন।

তৃতীয়ত, তুরস্কের অভ্যন্তরীন রাজনীতিও তাইপ এরদোগানের মাথাব্যথার কারণ। তার জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির অবস্থান সুদৃঢ়। বিশেষ করে গত নভেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে দলটির অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে। তবে বিরোধী দলের সঙ্গে দলটির নীতিগত পার্থক্য কেবল অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইস্যুতে নয়, আন্তর্জাতিক বহু ইস্যুতেই।কয়েকটি বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে, তারা তুরস্ক ভেঙে ফেলার কথিত ষড়যন্ত্র করছে। বিশেষ করে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার পার্টি (পিকেকে হিসেবে পরিচিত) এবং পিকেকে-পন্থী সমাজতন্ত্রী পার্টি "পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি"র প্রতি দেশটির সরকারের কল্পিত দেশ ভাঙ্গার সন্দেহের রাজনীতি তুরস্কের রাজনীতির বাজারে চালু রয়েছে।

তুরস্ক কথিত আন্তর্জাতিক জোটের সদস্য হয়ে সিরিয়ার উত্তরাংশ এবং ইরাকের উত্তর-পশ্চিমাংশে হামলা শুরু করে। কারণ এই এলাকাটি কুর্দি-প্রধান, যারা আইএসের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। তুরস্কের বিরুদ্ধে বহু প্রমাণসহ অভিযোগ রয়েছে যে তুরস্ক আইএস দমনের নামে উল্লেখিত অঞ্চলে আইএসের সঙ্গে মিলে কুর্দিদেরকে হত্যার মিশনে লিপ্ত। দেশটির ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টিও কুর্দিদের উপর হামলার সরাসরি অভিযোগ আনেন।

তুরস্কের মোট জনসংখ্যার ২০-২৫ শতাংশ হল কুর্দি। কুর্দি সম্প্রদায়ের বড় একটি অংশ ১৯৮৪ সাল থেকেই তুরস্কের দক্ষিণ–পূর্বাংশে কুর্দিদের জন্য স্বায়ত্তশাসন দাবি করে আসছে। তুরস্কের সরকার বিশ্বাস করে, দেশটির ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টি স্বায়ত্তশাসনকামী পিকেকে বিভিন্নভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে এবং তুরস্কের কুর্দি ও সিরিয়ান কুর্দিরা মিলে নতুন একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য যুদ্ধ করছে।

কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসনের জন্য রাশিয়া সমর্থন দিয়েছে, তেমনটি শোনা যায়নি। তবে রাশিয়ার বিমানটি তুরস্ক ভূপাতিত করার পর রাশিয়ার নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কুর্দি নেতাদের মধ্যে একটি নিবিড় যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে বলে অনেক আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি রাশিয়া উল্লেখিত এলাকায় নিয়োজিত ফ্রি-সিরিয়ান আর্মির সঙ্গেও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। সু-২৪ বিমান ভূপাতিত করার রাশিয়ার জবাব কেবল যে তুরস্কের প্রতি রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবরোধ নয়, তা ভালোভাবেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তুরস্কও সম্ভাব্য সমস্যার প্রখরতা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।

সর্বশেষ, আইএসের সঙ্গে তুরস্কের অবৈধ বাণিজ্যিক সম্পর্কটি। আইএস সংগঠনের অর্থনীতির ৪৩ শতাংশ আয় করে ইরাক ও সিরিয়ায় দখলকৃত তেলের খনি থেকে। এর পরিমাণ প্রতি মাসে ৫০ মিলিয়ন ইউএস ডলার। আইএস জঙ্গিরা আহরিত তেল শত শত ট্রাকে করে বর্তমান বাজার দরের অর্ধেক দামে তুরস্কের সীমান্তে বিক্রি করে। ক্রেতা তুরস্ক। স্যাটেলাইট থেকে তোলা বিভিন্ন ইমেজে বিষয়টি স্পটতই প্রমাণিত হয়েছে। রাশিয়ার অভিযোগ, তুরস্কের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতাদের পরিবার এই অবৈধ ব্যবসা থেকে সুবিধা নিচ্ছে। একই অভিযোগ করেছে ইরান ও ইরাক। রাশিয়ার বিমান হামলার ফলে আইএসের তেল বহনকারী শত শত ট্রাক ধ্বংস হয়। কার্যত, তুরস্কে আইএসের তেলের ব্যবসার চ্যানেলটি ক্রমশ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এ কারণেও রাশিয়ার প্রতি তুরস্কের সীমাহীন গোস্বা।

প্রসঙ্গত, চেক প্রেসিডেন্ট মিলশ জামান তুরস্কের অবস্থান নিয়ে কড়া মন্তব্য করেছেন। তিনি বললেন, তুরস্ক আইএসের ঘনিষ্ঠ মিত্র। সংগঠনটির সঙ্গে দেশটির সামরিক, বাণিজ্যিক এবং রাজনৈতিক যোগাযোগ রয়েছে। তিনি কুর্দিদের উপর তুরস্কের পরিকল্পিত হামলারও সমালোচনা করেন। একই সঙ্গে তুরস্কে সিরিয়ার ২২ লাখ শরণার্থীর জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রস্তাবিত ৩.২৮ বিলিয়ন অনুদানের বিপক্ষে অবস্থান নেন।

এমতাবস্থায়, প্রশ্নটি খুব যথার্থ। কে আগুন নিয়ে খেলছে? রাশিয়া নাকি তুরস্ক?

বিজন সরকার: ভাষা গবেষক; রাজনৈতিক বিশ্লেষক।