ব্রিটেনে লুটতরাজ ও পুঁজিতন্ত্রের সংকট

আলমগীর হক
Published : 24 Jan 2011, 07:48 AM
Updated : 13 August 2011, 05:55 PM

অস্ত্রধারী সন্দেহে পুলিশের গুলিতে হত্যা আমাদের দেশেও অরহর ঘটে থাকে। যেমন গুলিতে আহত ধরাশায়ী লিমন বিছানায় শুয়ে আছে। পুলিশী নির্যাতন ও হত্যা এখন উন্নত বিশ্বেও অভিন্নরূপ ধারণ করছে। একটা হত্যার প্রতিবাদে  সারা ব্রিটেন জ্বলে উঠেছে ৮ আগস্টে এবং তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ব্রিটেনের বৃহত্তর শহরগুলোয়।

অর্থনৈতিকভাবে নিষ্পেষিত কালো মানুষেরা ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনের এলিফেন্ট ক্যাসেল, পেকহ্যাম, নটিংহ্যাম, টটেনহ্যাম এবং নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। কৃষ্ণ অধ্যুষিত উত্তর লন্ডনের টটেনহ্যামের হেইল এলাকায় স্পেশিয়ালিষ্ট ফায়ার আর্মস স্কোয়াড (মেট্রপলিটন পুলিশ) ৪ আগস্টে গুলিতে হত্যা করে মার্ক ডাগেন(২৯ বছর বয়সী একজন কৃষ্ণকায় মানুষ, ব্রিটিশ নাগরিক)কে । পুলিশ বলছে মার্কের সাথে পুলিশের বন্দুক যুদ্ধে এই নিমর্ম ঘটনার সূত্রপাত। এবং এতে পুলিশের একজন অফিসারও আহত হয় বলে তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে। তারা আরো বলেছে ঘটনাস্থল থেকে অবৈধ একটা অস্ত্রও হস্তগত করেছে। পুলিশের এই দাবির প্রেক্ষিতে তখন ইন্ডিপেন্ডেন্ট পুলিশ কম্প্লেইন্টস কমিশনকে বলা হয় এই ঘটনার একটা নিরপেক্ষ তদন্ত করতে। এতে দেখা গেল কেঁচো খুড়তে সাপ! এ সূত্রে পুলিশের বয়ান হলো, গোলাগুলির সময় এক পুলিশ প্রাণে বেঁচে যায় যখন তার বুকের রেডিওতে গুলি এসে আঘাত করে। পুলিশ অফিসারকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়।

পুলিশের মতে মার্ক ডাগেন এই গোলাগুলির সময় মারা যায়। কিন্তু বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে দেখা গেল যে রেডিওতে আঘাত প্রাপ্ত যে বুলেট, তা পুলিশের বন্দুক থেকে আসা।

তাহলে ব্যাপার হচ্ছে মার্ক ডাগেনের অবৈধ বন্দুকের নল থেকে গুলি আসে নি। অতএব পুলিশের আহত বা হত হওয়ার কোন সম্ভবনা নেই। পুলিশের হাতে পাওয়া বন্দুকটি সত্যি মার্ক ডাগেনের ছিল কি?

কিন্তু এরই মধ্যে মার্ক ডাগেনের চরিত্র হনন শুরু করে দিয়েছে সেখানকার মিডিয়া। সে নাকি কালো এলাকার দলীয় মাস্তান ইতাদি।

ম্যানচেস্টর, বার্মিংহ্যাম, ব্রিস্টল, এমনকি সালফোর্ডেও সর্বত্র ছড়িয়ে গেল বিশাল প্রতিবাদ, যা সচরাচর দেখা যায় না। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে গ্রীসেও অতিসম্প্রতি দেখা যাচ্ছে এমনি বড় ধরনের পুঞ্জিভুত ক্ষোভের প্রকাশ।

ধনতন্ত্রের দেশসমূহেও পুলিশী নির্মমতা বা অত্যাচার গণমাধ্যমগুলো কীভাবে চাপা দিয়ে রাখে তা ক্রমশ: স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বৃটেনে তা হচ্ছে নানা সংকট ও আন্দোলনের প্রেক্ষিতে। এখানে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে মার্ক ডাগেনের হত্যার আগেও এরকম ঘটনা বহুবার ঘটেছে।

যেমন ১৯৯৯ সালের হ্যাকনী এলাকার হারি স্টেনলির মৃত্যু এবং একই সালে টটেনহ্যামের রজার সিলভেস্টারকে হত্যা করা। ২০০৫ সালে জঁ শার্ল ডি মেনডেসকে গুলি করে হত্যা করা হয় লন্ডনের স্কটওয়েলের টিউব স্টেশনে। ২০০৯ সালে গ্রুপজি সামিট-এর প্রতিবাদী ইয়ান টমলিনশনকে হত্যা করা।

এই রকম আরও অনেক নিহত আন্দোলন কর্মীদের নাম স্মরণ করা যেতে পারে। এদের সবাইকে পুলিশ দুষ্কুতিকারী সাব্যস্ত করে এবং সর্বশেষে চরিত্র হননের মাধ্যমে তাদের দৌরাত্ম্ বজায় রেখেছে।

আজকের ব্রিটেন, তথা য়ুরোপ, আমেরিকার সর্বত্র পুঁজির পিঞ্জরে যে নিমর্ম আঘাত লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা একটু খতিয়ে দেখার আছে। এটা পশ্চিমের তৈরি একটা সংকট। কূটাভাস এই যে নিজেদের নানাবিধ সংকট সত্ত্বেও অন্য দেশে বিভিন্ন মুহূর্তে নানামুখী সংকটে আক্রান্ত। বহু মানুষের কর্মসংস্থান নেই, যুবক শ্রেণীর বেকারত্ব বাড়ছে, মা ও শিশুদের নিরাপত্তামূলক ভাতার ঘাটতি বাড়ছে। নেই গৃহায়নের ভাতা। পুলিশের চাকরির খাতে বাজেট সংকোচনের ঘোষণা।

প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন তার গ্রীষ্মাবকাশ থেকে দ্রুত বাড়ি ফিরেছেন সংকট বিমোচনের লক্ষে। তিনি ফিরলেও ঘরের সমস্যা একই জায়গায় আছে।

ব্রিটেনবাসীরা টরি পার্টি এবং লিবারাল ডেমোক্রেট পার্টির কোয়ালিশনের এই সরকারী পেষণনীতির যাতাকলে পরেছে বছরের গোড়াতেই। সরকারের গৃহীত নীতিমালা গণমানুষের পক্ষে মোটেই কোন ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে না।

সমাজ বিজ্ঞানী ও সাংবাদিকরা নিজেদের প্রশ্ন করে আসছিলেন য়ুরোপে গণমানুষ যেভাবে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ছে সে তুলনায় ব্রিটেনের জনগণ কেন এতো নিস্পৃহ ছিলো।

কিন্তু আজ যুবশ্রেণীর এই বিরাট অংশ রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে লুটতরাজে, অথচ এই সংখ্যক তরুণযুবাদের, যুদ্ধবিরোধী মিছিল সভায়ও কখনো দেখা যায়নি। এই লুটতরাজের অন্য কোন ব্যাখ্যা নিশ্চয় আছে।

অমানবিক নীতি এবং  বাজেট সংকোচন নীতিও   দোকান পাটে আগুন নিক্ষেপ ও লুটতরাজের এই সামাজিক সহিংসতার পিছনে কাজ করছে বলে মনে করেন অনেকে।

নিজের দেশে সংকট সত্ত্বেও  বাইরের সংকটের সাথে নিজেকে যুক্ত করার প্রবণতা, একালে, ব্লেয়ারের সময় থেকে শুরু হয়েছিল। কিন্তু ব্লেয়ার, ক্যামেরন উভয় সরকারই অর্থনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাইরের দেশের রিসোর্স এর দিকে   নজর দেন। বলাই বাহুল্য, ইরাক, আফগানিস্তান এবং পরে লিবিয়ার দিকে। কিন্তু অর্থনৈতকি সংকটের নিরসন তাতে হয়নি।

মার্ক্সিস্ট তাত্ত্বিক আর্নেস্ট মেনডেল এই ধরনের অর্থনৈতিক সংকটকে শনাক্ত করেছিলেন 'লেইট ক্যাপিটালিজম' বলে। এই স্তরে ক্যাপিটালিজম কতগুলো অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়। ক্যাপিটালিজম নিজের এই নানামুখী সংকট কীভাবে কাটিয়ে উঠবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

সংকট বিমোচনে মি: ক্যামেরুন সামরিক খাতে বাজেট কমিয়ে ঘরের ছেলেদের ঘরে তুলে আনাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ঘরের মানুষকে দুষ্কৃতিকারী অভিধায় গ্রেফতার ও শাসানো যেতে পারে, লুটতরাজও সাময়ীকভাবে বন্ধ করা যেতে পারে, কিন্তু তা স্থায়ী সমাধান নিয়ে আসবে না।

আলমগীর হক:  সাংস্কৃতিক ও উন্নয়নকর্মী। বর্তমানে লন্ডন-প্রবাসী।