রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে প্রতিবন্ধী মানুষ

সাবরিনা সুলতানাসাবরিনা সুলতানা
Published : 3 Dec 2015, 04:07 AM
Updated : 3 Dec 2015, 04:07 AM

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবসের শুভেচ্ছা সকলকে। এবারের প্রতিপাদ্য, Inclusion matters: access and empowerment for people of all abilities– "একীভূতকরণ: সামর্থ্য নির্বিশেষে প্রতিবন্ধী মানুষসহ সকলের প্রবেশাধিকার ও ক্ষমতায়ন"– বেশ কটি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠন বাংলা করেছে এভাবেই।

এক সময় সারা বিশ্বে প্রতিবন্ধী মানুষের মর্যাদা সমুন্নত রাখতেই এবং সিআরপিডি বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন করে 'ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর ডিজঅ্যাবিলিটি' (আইডিডি) এই নামকরণ পরিবর্তিত হয়ে 'ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর পারসনস উইদ ডিজঅ্যাবিলিটিজ' (আইডিপিডি) করা হয়েছিল। কিন্তু আজ অবধি আমাদের দেশে সেই পুরনো 'আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস' নামেই পালিত হচ্ছে দিবসটি। বিষয়টি ভাবায় বটে, আমরা কি তবে নতুনত্বে ভয় পাই, পরিবর্তনে অস্বস্তিবোধ করি? প্রশ্ন এসেই যায়, যারা প্রতিবন্ধী মানুষের মর্যাদার প্রশ্নে অটল, তারা আসলে প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার বা মর্যাদা বাস্তবায়নে কে সত্যিই উদ্যোগী?

প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার ও মর্যাদার সুরক্ষায় কল্যাণ আইন, ২০০১ এর পালা সাঙ্গ করে সিআরপিডিএর আলোকে গঠিত হল 'প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩'। দীর্ঘ দুবছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে এই আইনের বিধিমালা প্রকাশিত হল গেজেট আকারে। আইনসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সর্বস্তরের কমিটিতে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিনিধিত্বের জোরালো দাবি উঠছে গত দুবছর ধরে। ইতোমধ্যে সকল জেলা কমিটিতে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের জন্য পরিপত্র জারি করা হয়েছে দেশের সবগুলো জেলায়।

বর্তমান সরকার বৈষম্যপীড়িত মানুষের জন্য অতুলনীয় বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার বাস্তবায়নও দেখা যাচ্ছে। সরকারের বড় সাফল্য নারীর ক্ষমতায়ন। কিন্তু 'রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে প্রতিবন্ধী মানুষ'– এভাবে কি আমরা কি ভাবতে শিখেছি? আজ যদি সরকারের কাছে প্রতিবন্ধী মানুষেরা জানতে চেয়ে বসেন, নারীর ক্ষমতায়নে সরকারের যতটা সাফল্য, সিআরপিডি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধী মানুষের ক্ষমতায়নে তা কতটুকু? সরকারের নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী মানুষের সেবা, অধিকার আইন, তাদের জন্য অনেক কিছু করার চেষ্টা দেখা যায়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে প্রতিবন্ধী মানুষের ক্ষমতায়নের বিষয়টি নিয়ে সরকারের ভূমিকা কী?

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সরকার যে দারুণভাবে প্রস্তুত তা কি আমরা ভেবেছি কখনও!

সুপ্রিয় পাঠক, আপনি মোটেও এমন ভাবতে পারবেন না যে, কিছু কর্মসংস্থান ছাড়া আর কোনোভাবেই সরকার প্রতিবন্ধী মানুষকে ক্ষমতায়িত করেনি। প্রতিবন্ধী কোটা, নিয়োগ বা বিভিন্ন ভাতা বৃদ্ধি ছাড়া কিছুই তো নেই কোথাও, এমনটি বলারও সুযোাগ নেই আপনার। বরং প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার বিষয়ে সরকার যতটা ভাবাতে পেরেছে সমাজকে, তাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নিজেরা ক্ষমতায়িত হয়ে নীতিনির্ধারণী জায়গায় বসে নিজেদের অধিকার সুরক্ষায় কাজ করতে পারবেন, এমনই এক ধরনের ভাবনা পাচ্ছি প্রণীত নতুন আইনে। এতে দেখা যাচ্ছে, সরকার প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে একীভূত সমাজ গঠনে বদ্ধপরিকর। তবে এ কথাও বলতে চাই, যদি সত্যিই এর বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনযাত্রায় অকল্পনীয় পরিবর্তন আসবে। তবে প্রতিবন্ধী মানুষদেরও জানতে হবে, ভাবতে হবে এবং ভাবাতে হবে এই আইনে আসলে কী রয়েছে।

আমরা প্রতিবন্ধী মানুষেরা নিজেরা কি ভাবতে শিখেছি এভাবে যে আমরাও প্রতিনিধিত্ব করতে পারি? নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই দিয়ে নেতৃত্ব-চর্চা শুরু করতে পারি? এই আইনে সকল মৌলিক অধিকারের বাস্তবায়নে কঠোর পদক্ষেপ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে এই সমাজের সকল স্তরে, সকল ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী মানুষের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিষয়টিও। এই আইনের সকল কমিটিতে প্রতিবন্ধী মানুষের অংশগ্রহণ সংরক্ষণ অর্থাৎ তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে।

আমরা সরকারের আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে সিআরপিডি মনিটরিং কমিটিতে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা তাদের সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব পাওয়ার প্রত্যাশা রাখতেই পারি। এমনকি জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের আওতায় বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত স্টিয়ারিং কমিটিতেও বেসরকারি প্রতিনিধির মধ্যে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিনিধিত্ব দেখিনি। কিন্তু এই আইনের ৬৪টি জেলায় ৬৪টি কমিটি প্রতি একজন নারী ও একজন পুরুষ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে। এখানেই শেষ নয়, সারা দেশের ৪৮৭টি উপজেলার প্রতিটি কমিটি এবং অন্যান্য শহর কমিটিগুলো মিলিয়ে দেশে অন্তত প্রায় ৬০০এর মতো কমিটি গঠন হবার কথা যাতে অবশ্যই প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হওয়া জরুরি।

আমরা কি ভাবতে পারি, আমরা প্রতিবন্ধী মানুষেরা সরকারি প্রতিনিধিত্বে এসে নিজেদের উন্নয়নে যুগান্তকারী এক পরিবর্তন ঘটাতে পারি?

সাবরিনা সুলতানা: সভাপতি, বি-স্ক্যান।