প্যারিসে জঙ্গি হামলা ও বাংলাদেশে জঙ্গি প্রশ্ন

হাসান মামুনহাসান মামুন
Published : 17 Nov 2015, 01:19 PM
Updated : 17 Nov 2015, 01:19 PM

আইএস যা করার করছে। সিরিয়া ও ইরাকের অধিকৃত অঞ্চলে যারা অচিন্ত্যনীয় সব নৃশংসতা ঘটিয়েছে, প্যারিসে এমনটি করতেই পারে তারা। এর আগে বৈরুতেও ভয়াবহ বোমা হামলায় একসঙ্গে অনেককে তারা খুন করে। সে ঘটনা স্বভাবতই গুরুত্ব পায়নি পশ্চিমা মিডিয়ায়, এমনকি ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কাছেও।

নিজ প্রোফাইল পিকচার যারা ফ্রান্সের পতাকায় মুড়ে বেদনা বা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, তাদের আবেগের বিষয়টি হেলা করা যাবে না। প্যারিসে আইএসের হামলার অবশ্যই বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। হামলাটা যদি হত দেশটির সামরিক অবস্থান বা এমনকি সরকারি কার্যালয়ের ওপর, তাহলেও মানুষ একে হয়তো কিছুটা ভিন্ন চোখে দেখত।

তা তো নয়। তারা হামলা চালিয়েছে যে যার মতো আনন্দে মেতে থাকা নিরীহ মানুষের ওপর। এদের মধ্যে মুসলিমও থাকতে পারত বা পারে। সেটি তাদের দেখবার বিষয় নয়। সিরিয়া ও ইরাকের অধিকৃত অঞ্চলে তারা তো বেছে বেছে ভিন্ন ধারার মুসলিমদেরও হত্যা করেছে। গোষ্ঠী ধরে ধরে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। অমুসলিম যুগের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন ধ্বংস করেছে।

আইএসকে বলে লাভ নেই যে, এগুলো মানুষের ইতিহাসের অংশ। বলে লাভ নেই, ইসলামের আবির্ভাবের আগেও মানুষ এবং তার কর্মতৎপরতা ছিল। তারা এসব শুনবে না বলেই স্থির করেছে। নৃশংসতায় আল কায়দা বা তালেবান কিংবা বোকো হারামকেও ছাড়িয়ে গেছে তারা।

মিসরের সিনাই উপত্যকায় যাত্রীবাহী রুশ বিমান দুর্ঘটনায়ও তাদের বোমাবাজদের হাত ছিল বলে মনে করা হচ্ছে। সে ঘটনায় কিন্তু প্যারিসের চেয়েও বেশি মানুষ হয়েছে নিহত। এদের সিংহভাগ ছিল শিশু ও নারী। তারা একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্পট থেকে ফিরছিল। ঘটনাটি এখনও স্পষ্ট নয়, কিন্তু ঘটতে পারে। এটি হতে পারে রাশিয়ার আইএসবিরোধী অভিযানের একটি নির্বিকার প্রত্যুত্তর।

প্যারিসে নিরীহ মানুষের ওপর হামলাও তারা নির্বিকারভাবে চালিয়েছে। আটজন হামলাকারীর একজন নাকি সক্ষম হয়েছে পালিয়ে যেতে। তাকে পাকড়াওয়ের আপ্রাণ চেষ্টা স্বভাবতই করবে তদন্তকারীরা। গোটা ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র, এমনকি রাশিয়া এ ব্যাপারে বাড়িয়ে দেবে সহযোগিতার হাত। কেননা ভবিষ্যতে এদের যে কেউ হতে পারে আইএসের পরবর্তী হামলার শিকার। তেমন হুমকি তারা দিয়েই রেখেছে।

সিরিয়ার যুদ্ধে রাশিয়া গিয়ে সরাসরি জড়িয়ে পড়ায় এবং আইএসের বিরুদ্ধে বড় সাফল্য লাভ করায় ফেসবুকে দেখেছিলাম অনেককে খুশি হয়ে পুতিন সাহেবকে বাহবা দিতে। তারা কিন্তু ভেবে দেখেননি, উৎসভূমিতে আক্রান্ত হলে আইএস যোদ্ধারা ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এবং তারা প্রতিশোধমূলক হামলা চালাতে মরিয়া হয়ে উঠবে।

এখন তো এমনটিও বলা হচ্ছে, প্যারিসে হামলাকারীদের অন্তত দুয়েকজন শরণার্থী হিসেবে এসে উঠেছিল ইউরোপে। অনেকে ঢালাওভাবে বলছিলাম যে, এরা সবাই আইএসের দ্বারা উৎপীড়িত বা যুদ্ধের শিকার। ইউরোপের শরণার্থী-বিরোধী দল ও গোষ্ঠীগুলো কিন্তু বলছিল, এদের মধ্যে আইএস জঙ্গি থাকতে পারে। সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হয়ে তাদের মধ্যে কারও কারও জঙ্গি রূপান্তর ঘটাও তো বিচিত্র নয়।

অনেকে বলেন, কত শতাংশ লোক জঙ্গি? প্যারিসের মতো নগরীর তিনটি স্পটে পাঁচশ'র বেশি মানুষকে হতাহত করতে কিন্তু আটজন অস্ত্রধারী আর বোমাবাজই যথেষ্ট। নিরীহ মানুষ হত্যায় এদের হাত কাঁপবে না; নিজেদের উড়িয়ে দিতেও তারা প্রস্তুত। এমন একটা আদর্শে তাদের দীক্ষিতও করে তোলা হয়। বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষ জঙ্গিও ছিল, এমনকি ভারতবর্ষে। লক্ষ্য হাসিলে তারাও নিরীহ মানুষ মারতে দ্বিধা করেনি।

আইএস জঙ্গিরা নিঃসন্দেহে ভয়াবহতম। আজকের যুগেও এ ধরনের জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান দেখে অনেকে অবাক হন। এটা শুনে বা জেনে আরও অবাক হতে হয় যে, কোনো কোনো পশ্চিমা অপশক্তি রয়েছে এদের উত্থানের নেপথ্যে। মধ্যপ্রাচ্যের সম্পদ ও ব্যবসার লোভে এবং আরও কিছু দূরবর্তী লক্ষ্য অর্জনে তারা নাকি এ সুন্নি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উত্থানে ভূমিকা রেখেছে।

কেউ কেউ অবশ্য বলতে চান, তারা জানতেন না এটি বুমেরাং হবে। আল কায়দার উত্থানেও পশ্চিমা গোষ্ঠী, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের হাত ছিল। প্রধান শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে বারবারই তারা যদি একই ভুল করে থাকে তো বলতে হবে, এরাও বিশ্ব তথা মানবজাতির জন্য বিপজ্জনক। প্রকৃত নেতৃত্বের গুণ তাদের মধ্যে নেই, রয়েছে কেবল ব্যবসায়িক লিপ্সা। এ থেকে মিথ্যাচার করে অন্যায় যুদ্ধও চাপিয়ে দিচ্ছে তারা, যা আবার জঙ্গিবাদের জন্ম দিচ্ছে।

কোনো জনগোষ্ঠীর মধ্যে জঙ্গি উপাদান থাকলে বাইরের উস্কানি ছাড়াও কিন্তু জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটতে পারে। সীমিত পর্যায়ে হলেও বাংলাদেশে এর যে উত্থান হয়েছে, সেটিকে এ দৃষ্টিতে দেখা যেতে পারে। জঙ্গি গোষ্ঠী জেএমবির উত্থান কীভাবে ঘটেছিল, সেটি আমরা জানি। আফগান যুদ্ধের একটা প্রভাব ছিল এরক্ষেত্রে। দেশের ভেতর থেকেও ছিল রাজনৈতিক সহায়তা।

বাংলাদেশে নতুন করে জঙ্গি তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিভিন্ন ঘটনায়। এর মধ্যে নতুন কিছু উপাদানও রয়েছে। একাধিক ঘটনায় উঠে আসছে আইএসের নামও। এ জঙ্গি গোষ্ঠীর সহযোগী সন্দেহে লোকজন গ্রেপ্তারও হচ্ছে। প্যারিসে আইএসের হামলার প্রেক্ষিতে এসব কথার অবতারণা তাই অপ্রাসঙ্গিক নয়।

প্যারিসে হামলার ঘটনায় আমাদের দেশেও তাই দুশ্চিন্তা বাড়বে। এটা বাড়বে এমনকি সরকারি নীতিনির্ধারক পর্যায়ে। আইএস কোনো কারণে বাংলাদেশকে টার্গেট করে থাকলে সেটা হাসিল করা সহজতর বলেই মনে হয়। ফ্রান্সের গোয়েন্দা ব্যর্থতা এদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের চিন্তার কারণ হয়ে উঠবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য অভয় দিয়েছেন। কিন্তু লোকে এতে আশ্বস্ত নাও হতে পারে।

বাংলাদেশের অবশ্য আইএসের প্রতিশোধমূলক হামলার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা কম। সে সম্ভাবনা বা ঝুঁকি যাদের বেশি, প্যারিসের ঘটনায় তারা শেষ পর্যন্ত কী অবস্থান নেয়, সেটি অবশ্য আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আইএসের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে নেমে এটিকে গুঁড়িয়ে দেওয়া কঠিন নয়। আইএস হয়তো সর্বাত্মক যুদ্ধই চাইছে। এভাবে এরা হয়তো চাইছে সহানুভূতি অর্জন করতে, বিশেষত মুসলিম সংখ্যাগুরু দেশগুলোয়।

কেউ ভেবে অবাক হতে পারেন যে, আইএসের মতো নৃশংস জঙ্গি গোষ্ঠী কেন সহানুভূতি অর্জন করবে? মানবিক অনুভূতিসম্পন্ন যে কারও কাছে এটি প্রশ্ন বটে। তবে জঙ্গি আদর্শে বিশ্বাসীদের কাছে প্রশ্নটা ভিন্নভাবে উপস্থিত হতে পারে। প্রতিশোধে বিশ্বাসীদের কাছে নৃশংসতা ভিন্ন তাৎপর্য নিয়ে হাজির হলে অবাক হওয়া যাবে না। প্রশ্ন হল, দেশে তেমন মন-মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ কত শতাংশ রয়েছে?

একেবারে নেই, তা বলা ঠিক হবে না। ১৫-১৬ কোটি মানুষের দেশে ১ শতাংশও জঙ্গি মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠলে তাদের সামলানো কঠিন হতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠের মনোভাব বা ইচ্ছা অগ্রাহ্য করে এখানেও তারা আইএসের আদর্শ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হতে উঠলে অবাক হওয়া যাবে না। অন্য নামেও তারা সংগঠিত হতে পারে।

সরকারকেই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে সবার আগে। কোনো বিষয়ে তার ঢিলেঢালা অবস্থানে জঙ্গিরা যেন উৎসাহিত না হয়, সেদিকে কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, এ বিষয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোয় মতৈক্য নেই। কোনো রকম ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণের প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে না।

প্যারিসে নারকীয় হামলার ঘটনায় হতবিহ্বলতার কারণ থাকতেই পারে। কিন্তু সেটা যেন আমাদেরকে নিজ কর্তব্যকর্মের বিষয়ে উদাসীন করে না ফেলে। বাংলাদেশের মতো মুসলিম অধ্যুষিত দেশে গণতন্ত্রচর্চায় ব্যর্থতাও জায়গা করে দিতে পারে জঙ্গিদের। তারা হয়তো শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা দখলে ব্যর্থ হবে এবং হবে পরাস্ত। কিন্তু তার আগে দেশটির সর্বনাশ হয়ে যাবে।

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট।