জাতীয় নিরাপত্তা কি ঝুঁকির মুখে

আমানুল্লাহ কবীর
Published : 12 Nov 2015, 04:02 PM
Updated : 12 Nov 2015, 04:02 PM

'আমি কোনো বিচার চাই না'– পুত্রহত্যায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া পিতার। পুত্র নিহত প্রকাশক ফয়সাল সালেহীন দীপন, পিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও বিশিষ্ট লেখক আবুল কাসেম ফজলুল হক। নিরপরাধ পুত্রের নিমর্ম পরিণতির জন্য হতাশ পিতা দায়ী করলেন দোষারোপের রাজনীতিকে। বললেন, যারা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছেন, উভয় পক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হোক, এটাই তাঁর প্রত্যাশা।

পিতা পুত্রহত্যার বিচার চান না (সরকারের কাছে), এতে অপমানিত বোধ থেকে চটে গেলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুবু-উল আলম হানিফ। জবাবে বললেন, ''হত্যাকারীদের আদর্শে বিশ্বাসী বলেই পুত্র দীপন হত্যার বিচার চাননি আবুল কাসেম ফজলুল হক।… এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত উনার দলের লোকজনকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চান না বলেই তিনি এ ধরনের কথা বলেছেন।''

যে দোষারোপের রাজনীতির অভিশাপের কথা বললেন অধ্যাপক, জবাবের নামে আবার সেই দোষারোপের রাজনীতিই করলেন সরকারি দলের নেতা। কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন বিচারপ্রার্থীকেই।

৩১ অক্টোবর, শনিবার। কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্যে রাজধানীতে উজ্জ্বল দিবালোক। কিন্তু কোনো কিছুই ঠেকাতে পারল না আততায়ীর উদ্ধত অস্ত্র। ঘটে গেল দুটি মর্মান্তিক ঘটনা। একটি শাহবাগে আজিজ কোঅপারেটিভ মার্কেটে, আরেকটি লালমাটিয়ায়। দুটি ঘটনাতেই হামলা চালানো হয় দুটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে– টার্গেট দুই প্রকাশক। লালমাটিয়ার 'শুদ্ধস্বর' অফিসে হামলা নিয়ে যখন দুপুরবেলায় টেলিভিশন ও অনলাইন মিডিয়াতে চলছিল তোলপাড়, তার মধ্যেই আবিস্কৃত হল আজিজ মার্কেটের ঘটনা। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান 'জাগৃতি'র অফিসে পুত্রের রক্তাক্ত লাশ আবিস্কার করলেন পিতা। দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে অফিসের দরজায় তালা ঝুলিয়ে উধাও হয়েছে খুনিরা। নীরবে ঘটে গেছে নির্মম ঘটনা, মার্কেটের কেউ টের পায়নি এতটুকু।

'শুদ্ধস্বরে' হামলায় কেউ নিহত হননি, কিন্তু গুরুতর আহত হয়েছেন প্রকাশক আহমেদুর রশিদ চৌধুরী (টুটুল) ও আরও দুজন কবি ও ব্লগার, তারেক রহমান ও রণদীপম বসু। দীপন ও টুটুলের অপরাধ– তারা দুজনই নিহত ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক।

এ দুটি ঘটনা এত স্পর্শকাতর হওয়ার কারণ কিছু দিন আগেই ঘটে গেছে তিনটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক ও ভয়াবহ ঘটনা, যা আন্তর্জাতিক মহলেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। গত মাসের প্রথম সপ্তাহে ও তার আগের মাসের শেষ সপ্তাহে মাত্র ছয় দিনের ব্যবধানে নিহত হয়েছেন দুই বিদেশি নাগরিক, ইতালির সিজার তাবেলা এবং জাপানের কুনিও হোশি।

পরিস্থিতি যখন এমনি উত্তপ্ত তখন ২৫ অক্টোবর রাতে শিয়া মুসলমানরা আশুরার মিছিল করার জন্য সমবেত হয়েছিলেন হোসেনি দালানে। কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থাও ছিল। কিন্তু নিরাপত্তার ফাঁক গলে তাদের উপর হল গ্রেনেড হামলা। ওই দিনই একজন নিহত হন, পরে আহত আরেক জনের মৃত্যু ঘটে হাসপাতালে। হামলায় আহতের সংখ্যা দেড়শরও বেশি।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিচারে এই তিনটি ঘটনা আলাদা বৈশিষ্ট্যের দাবি রাখে। প্রথমত, পর পর দুই বিদেশি নাগরিক হত্যা, যা ইতোপূর্বে বাংলাদেশে আর কখনও ঘটেনি। দ্বিতীয়ত, হত্যাকাণ্ডের পরপরই আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসএর দায় স্বীকার। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বাংলাদেশে কয়েকটি পাশ্চাত্য দেশের এলার্ট জারি। এশিয়ার একমাত্র দেশ জাপান এলার্ট জারি করে, যেহেতু তার নাগরিক নিহত হয়েছেন। হোসেনি দালানে গ্রেনেড হামলার দায়ও গ্রহণ করে আইএস।

আইএসএর সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও পশ্চিমা দেশগুলোর অবস্থান আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নাজুক করে তুলেছে। পাশ্চাত্য বিশ্বকে আইএস শত্রু মনে করে, আবার পাশ্চাত্য বিশ্বও তেমনি আইএসকে শত্রু মনে করে। বলা যায়, পরস্পর পরস্পরের এক নম্বর শত্রু, যারা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বজুড়েই লড়ছে।

হোসেনি দালানের ঘটনার বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। বাংলাদেশে শিয়া-সুন্নীদের মধ্যে কখনও রক্তাক্ত সংঘাত ঘটেনি। আশুরার মিছিলে সুন্নীরাও অংশগ্রহণ করে। গ্রেনেড হামলায় নিহত দুজনের একজন এবং আহতদের অধিকাংশই সুন্নী। আইএস সুন্নীদের জঙ্গি সংগঠন। সিরিয়া, ইরাকসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে তারা যুদ্ধ করছে শিয়াদের বিরুদ্ধে। সুতরাং যখন তারা হোসেনি দালানে হামলার দায় স্বীকার করে, তখন তা বাংলাদেশে শিয়া-সুন্নীর গোষ্ঠীগত সংঘাত উস্কে দেওয়ার কৌশল বলে চিহ্নিত করা যায়। এতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন উপাদান যোগ হওয়ার আশংকা দেখা দিতে পারে।

অবস্থানগত কারণে পশ্চিমা দেশগুলির উদ্বেগ ও আইএসএর দায় স্বীকার– এ দুটি বিষয় এখন বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা এর সঙ্গে বাংলাদেশের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য আদৌ চ্যালেঞ্জ কিনা কিংবা বাংলাদেশের নিরাপত্তা আদৌ হুমকির মুখে পড়ার আশংকা আছে কিনা, তা নিয়েও বিতর্ক থাকতে পারে। বিতর্ক যা-ই থাক, সতর্ক থাকার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ হবে, এমন যুক্তি দাঁড় করালেই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে না।

বর্তমান আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে বস্তুত বিতর্ক হতে হবে বাংলাদেশের geopolitical ও geo-religious ভিত্তি কেন্দ্র করে। তাহলে বর্তমান নিরাপত্তা-বলয়ে আমাদের দেশের নিরাপত্তা সংকট কী তা অনুধাবন করা যাবে।

বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে বাক-বিতণ্ডা সৃষ্টি হয়েছে গত সেপ্টেম্বরে, যখন নিরাপত্তার অজুহাত তুলে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট টিম বাংলাদেশ সফর বাতিল করে। এর কিছুদিন পরই কূটনীতিক পাড়ায় নিহত হন ইতালির নাগরিক তাবেলা। ঘটনার পরপরই আইএসএর দায় স্বীকারের খবরটি প্রচার করে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন SITE Intelligence Group, আর রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি নিহত হলেও SITE একইভাবে দ্রুত খবরটি ছড়িয়ে দেয়। SITE তেমনি দ্রুত প্রচার করে হোসেনি দালানের গ্রেনেড হামলার ঘটনা।

আইএস বা আল-কায়েদার হাত বাংলাদেশ পর্যন্ত সম্প্রসারিত কিনা, হলেও কতটুকু শক্তিশালী, তা কেউ নিশ্চিত নয়। বাংলাদেশ সরকার ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা আইএস বা আল-কায়েদার প্রাতিষ্ঠানিক সংগঠন আছে বলে মনে করেন না। সংগঠন না থাকলেও আইএসএর যে বেশ শক্তিশালী যোগাযোগ রয়েছে, তা SITE এর তৎপরতা থেকেই বোঝা যায়। SITE কে যারা দ্রুত এসব ঘটনার তথ্য সরবরাহ করেছে, তারাই আইএসএর যোগাযোগের মাধ্যম।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল সৈয়দ আতা হাসনাইন সম্প্রতি ঢাকায় বলেছেন, মুসলমানপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আইএসএর একটা গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট। তবে বাংলাদেশ বা এই অঞ্চলে আইএসএর বড় ধরনের উপস্থিতি নেই। কিন্তু তারা ভাড়াটে শক্তির (Surrogates) সন্ধানে আছে। তাহলে বাংলাদেশে আইএসএর ভাড়াটে শক্তি হিসেবে কারা ভূমিকা পালন করতে পারে?

জেএমবি, হুজি, আনসারউল্লাহর মতো অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জঙ্গি গ্রুপ ইতোমধ্যেই এখানে তৎপর। এসব গ্রুপ ব্লগার হত্যাসহ বেশকিছু হত্যাকাণ্ডের দায়ও স্বীকার করেছে। তাহলে তারাই কি আইএসএর কাঙ্ক্ষিত ভাড়াটে শক্তি হিসেবে কাজ করছে? রীটা কাটজ বলে একজন ইহুদি মহিলা SITE পরিচালনা করেন। জেএমবি, হুজি, আনসারউল্লাহর মতো সংগঠনগুলিই কি SITE এর কাছে এসব তথ্য সরবরাহ করছে?

এরই মধ্যে পুলিশের দুই সদস্য নিহত হয়েছেন। আশুলিয়ায় যে পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন, তার দায়ও স্বীকার করেছে আইএস। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে কুপিয়ে আহত করা হয়েছে একজন মিলিটারি পুলিশকে। এসব ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়, দেশে সরাসরি আইএস ও আল-কায়েদার উপস্থিতি না থাকলেও তাদের পরোক্ষ উপস্থিতি রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তারা সময় বুঝে তাদের পরোক্ষ উপস্থিতিকে প্রত্যক্ষ করার চেষ্টা করবে, আর সে জন্য প্রয়োজনীয় মাঠ তৈরি করছে। উপযুক্ত মাঠ তৈরির জন্য হত্যাকাণ্ড একমাত্র কৌশল নয়, একই সঙ্গে তারা সমাজকেও নানাভাবে জঙ্গিয়ায়ন করছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ বা BIIS এর আলোচনায় বক্তব্য প্রদানকালে জেনারেল হাসনাইন ভারত ও পাকিস্তানের জঙ্গিবাদ প্রসঙ্গও উল্লেখ করেন। তিনি তিন দেশের ধর্মীয় অবস্থান ও ধর্মগতভাবে বসবাসের একটা তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেন। ভারতে মুসলমানের সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি হলেও তাদের বসবাস বিশেষ এলাকায় কেন্দ্রীভূত নয়– সারা ভারতে নানা পকেটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান ও বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ক্ষুদ্র জনসংখ্যা বাদ দিলে বাংলাদেশ জুড়েই মুসলমানদের বসবাস।

তারপরও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। পাকিস্তান একটা অসমসত্ব বা অসমজাতীয় সমাজ এবং বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীতে বিভক্ত। তাছাড়া পাকিস্তানের রাষ্ট্রচরিত্র ধর্মকেন্দ্রিক (Islamic Republic) এবং শিয়া-সুন্নীর বিরোধ প্রায়ই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। কিন্তু বাংলাদেশ একটা সমসত্ব বা সমজাতীয় সমাজ (Homogeneous) এবং সুন্নীপ্রধান, যদিও শিয়া সম্প্রদায়ের একটা ক্ষুদ্রাংশের বসবাস বিদ্যমান।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের রাষ্ট্রচরিত্র ধর্মনিরপেক্ষ। সুতরাং যে কারণে পাকিস্তান ইসলামি জঙ্গিবাদের উর্বর ভূমিতে পরিণত হয়েছে, বৈশিষ্ট্যগত কারণেই বাংলাদেশে তা হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া বাংলাদেশের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, দেশটি বিচ্ছিন্ন একটি মুসলমানপ্রধান দেশ, এর চারদিকে আর কোনো মুসলমানপ্রধান দেশ নেই।

ইসলামি জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশের এই ভৌগলিক অবস্থান তার জন্য সহায়ক। কেননা, নিজেদের স্বার্থে হলেও প্রতিবেশি ভারত, মিয়ানমার, এমনকি চীনও বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিবাদ উত্থানের বিরুদ্ধে সহযোগিতা করবে, যেহেতু ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের শিকার হলে তা তাদের নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে পাশ্চাত্য দেশগুলির মতো এসব দেশ উদ্বিগ্ন নয় কেন? তার কারণ, বাংলাদেশে পাশ্চাত্য দেশগুলি ও এসব দেশের স্বার্থ এক নয়। নিজেদের নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য জাপান ছাড়া এশিয়ার আর কোনো দেশ এলার্ট জারি করেনি, যদিও বাংলাদেশে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলংকা ও ভারতের বহু লোক এমনকি গ্রামগঞ্জেও কর্মরত। এসব দেশ কি তাদের নাগরিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারে কম স্পর্শকাতর?

যুক্তরাষ্ট্র ও তার পাশ্চাত্য মিত্ররা নিজেদের নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য যে অতিস্পর্শকাতরতা দেখিয়েছে, তা বাংলাদেশের উপর এক ধরনের চাপ প্রয়োগের কৌশল। মনে হয়েছে, বাংলাদেশে আইএসএর প্রত্যক্ষ অস্তিত্ব আছে, এটা মেনে নিলেই তারা খুশি। প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের চাপের কথা স্বীকারও করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ তার কোনো কোনো মিত্রদেশ বাংলাদেশে সন্ত্রাস মোকাবিলার জন্য যৌথ অভিযানের আগাম প্রস্তাবও দিয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট একাধিকবার তার দেশের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ যেন আইএসএর হুমকি এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সহযোগিতার অতিআগ্রহের মাঝখানে ক্রসফায়ারে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কোনো কোনো নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলার চেষ্টা করছেন যে, আইএসকে তাড়া করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে, তাহলে এ অঞ্চলে তাদের খবরদারি পাকাপোক্ত করা যাবে, যা তাদের চীনকে ঘিরে ফেলানোর কৌশলেরই অংশ। বাংলাদেশে আইএসএর অজুহাতে একবার যুক্তরাষ্ট্র ঢুকে পড়লে কেবল বাংলাদেশ নয়, এই অঞ্চলের পুরো দৃশ্যপট পরিবর্তিত হয়ে যাবে, যার উদাহরণ হতে পারে বর্তমান সিরিয়া ও ইরাক। ভারত ও চীন– এই দুই দেশ তাদের মাঝখানে এমন একটি ঝুঁকিপূর্ণ সম্ভাবনা অবশ্যই মেনে নিতে পারে না।

ইসলামি জঙ্গি প্রুপগুলির উত্থান বাংলাদেশে একটা নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এ পরিস্থিতি এদেশের জনগণের কাছে নজিরবিহীন। বর্তমান অভ্যন্তরীণ রাজনীতিই তাদের উত্থানে উৎসাহিত করেছে বা সুযোগ করে দিয়েছে, যে উৎসাহ আইএসএর মতো আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনকেও উৎসাহিত করেছে। আমাদের দেশ অর্থনীতিতে কিছুটা এগিয়ে গেলেও গণতান্ত্রিক চর্চায় পিছিয়ে পড়েছে। Participatory democracy ও participatory governance বলতে যা বোঝায় তার সুযোগ এখন উদ্বেগজনকভাবে সীমিত। রাজনীতি সমাজের চালিকাশক্তি। রাজনীতি সঠিক না হলে এককভাবে অর্থনীতির অগ্রগতি সম্ভব নয়। দু-একটি ব্যতিক্রম থাকলেও তা সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে প্রযোজ্য নয়।

উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশকেই ধরা যায়। বর্তমানে যে ধারায় রাজনীতি চলছে তা যদি অব্যাহত থাকে, অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা বিঘ্নিত হবেই এবং সে লক্ষণ ইতোমধ্যেই কিছু কিছু দেখা দিয়েছে। অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত হলে সমাজের সর্বক্ষেত্রে অচলায়তন সৃষ্টি হবে এবং অস্থিরতা আরও বৃদ্ধি পাবে।

অবাধ গণতন্ত্র চর্চা অব্যাহত থাকলে প্রশাসনে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় এবং সমাজের সর্বস্তরে গতিশীলতা সৃষ্টি হয়। স্বৈরশাসন পাঁকের মতো আবর্জনা সৃষ্টি করে, গণতন্ত্র স্রোতের মতো আবর্জনা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এ জন্য গণতান্ত্রিক অধিকারের অবাধ চর্চা চিন্তার পঙ্কিলতা দূর করে, প্রগতিশীলতার দুয়ার অর্গল মুক্ত করে দেয়। প্রাপ্তিযোগের জন্য অথবা প্রাপ্তযোগের আশায় যে যে-যুক্তিই দাঁড় করান না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে, সমাজের একাংশ বর্তমানে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেলেও আরেক অংশ বঞ্চিত।

বিরাজমান পরিস্থিতিতে সরকারের ভূমিকা অস্পষ্ট ও অপরিচ্ছন্ন। আগে যারা আইএসএর সম্পৃক্ততা ও হুমকির কথা প্রায়শ উচ্চারণ করেছেন তারাই এখন তা জোর গলায় অস্বীকার করছেন। লক্ষ্য করা গেছে, সরকারের কর্তাব্যক্তিরা যখন আইএসএর অস্তিত্ব অস্বীকার করছেন তখন সরকারেরই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আইএসএর সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে বিভিন্ন জনকে গ্রেপ্তার করছে। খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও এ স্ববিরোধী আচরণ করছেন। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, কোনটি সত্য?

দেশে একাধিক জঙ্গি গ্রুপ রয়েছে, এটা সত্য, কিন্তু দমনের চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত প্রচার করে সরকার যে নিজের কৌশলেই ফেঁসে গেছে, আজ তা আর অপরিস্কার নয়। জঙ্গিবিরোধী প্রচারণার মাধ্যমে সরকার দুটি বিষয় অর্জনের চেষ্টা করছে: প্রথমত, পাশ্চাত্য দেশগুলির সহানুভূতি ও সমর্থন আদায়; দ্বিতীয়ত, জঙ্গি দমনের নামে প্রতিপক্ষ বিশেষত বিএনপি-জামায়াতকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে শাসন করা। সরকারের কর্তাব্যক্তিদের ভাষায় জেএমবি, হুজি, আনসারউল্লাহ ইত্যাদি জঙ্গি গ্রুপ আর বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তারা এক সূতায় গাঁথা। ঢালাওভাবে বিএনপিকে জামায়াত ও জঙ্গি গ্রুপগুলির সঙ্গে ব্র্যাকেট করায় কি প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে?

ব্লেইম গেইম বা দোষারোপের রাজনীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন কিছু নয়, বরং বলা যায় এটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দোষারোপের রাজনীতির মাধ্যমে রাজনীতিকরা নির্দ্বিধায় পরস্পরের চরিত্র হনন করে থাকেন। যে থুতু তারা উপরে ফেলেন, সে থুতু যে তাদের গায়েই পড়ে তা তারা লক্ষ্য করেন না। ফলে কলুষিত রাজনীতি থেকে নবপ্রজন্মের স্বচ্ছ ও মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিরা দূরে থাকছেন এবং রাজনীতিতে মেধাশক্তির পরিবর্তে পেশীশক্তি প্রাধান্য পাচ্ছে।

ইতালির নাগরিক যেদিন নিহত হন, ওই দিনই প্রধানমন্ত্রী নিউ ইয়র্ক থেকে বিএনপির এক সিনিয়র নেতার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলেন, তাকে গ্রেফতার করলেই পুরো ঘটনা উদ্ঘাটিত হবে। বেগম খালেদা জিয়া দেশে না থাকলেও বলা হচ্ছে, তিনিই ষড়যন্ত্রের মূল পরিকল্পনাকারী এবং তাঁর নির্দেশেই সকল হত্যাকাণ্ড ঘটছে। ক্ষমতাসীন নেতা-মন্ত্রীদের কেউ কেউ তাঁকে নির্মূল করার হুমকিও দিয়েছেন। দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার জন্য কয়েকজন বিএনপি নেতা-কর্মীকে গ্রেফতারও করা হয়েছে, আরও দুজন নেতাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হচ্ছে।

এমন অবস্থায় তদন্তের গতি কোন দিকে যাচ্ছে তা নিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের মধ্যেও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। ইতালির রাষ্ট্রদূতসহ কয়েকজন পশ্চিমা রাষ্ট্রদূত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর এমন সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

এদিকে খালেদা জিয়া লন্ডনে বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য এককভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই দায়ী। কারণ প্রশাসনের সব কিছুই চলে তাঁর নির্দেশে। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীদের অভিযোগ, মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামী, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী (যিনি বিএনপির সিনিয়র নেতা) ও আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের (যিনি জামায়াতের সেক্রেটারী জেনারেল) মতো স্বাধীনতাবিরোধীদের রক্ষা করার জন্যই দেশে এই অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। বিষয়টির এমন সরলীকরণ যুক্তিসঙ্গত মনে হয় না।

মানবতাবিরোধীদের বিচার ও শাস্তি এবং গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার সুযোগ সংকোচন– এ দুটি বিষয় মিলে বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে। কিন্তু সরকারপক্ষ দ্বিতীয় বিষয়টি উপেক্ষা করে এককভাবে প্রথম বিষয়টি কেন্দ্র করে তার রাজনীতি পরিচালনা করছে। জঙ্গি গ্রুপগুলি ও সন্ত্রাসীরা এ পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করছে। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এই তিন অবস্থার মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছে। এই ত্রিমুখী অবস্থা থেকে কীভাবে উত্তরণ সম্ভব, সেটাই এখন ক্ষমতাসীনদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

এ চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের জন্যও। সব কটি ইস্যু একত্রিতভাবে জিইয়ে রেখে সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যাবে কিনা, সরকারকে অবশ্যই সে সম্পর্কে ভাবতে হবে। ইস্যুগুলি চিহ্নিত করতে হবে জাতীয় নিরাপত্তার অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। যেসব ইস্যু জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি, তা মোকাবিলা করতে হবে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে।

খালেদা জিয়া দেশের বর্তমান সংকট মোকাবিলা করতে জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। 'খুনির সঙ্গে সংলাপ করবেন না' বলে প্রধানমন্ত্রী সে প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। কেউ স্বীকার করুন, আর না করুন, জাতি আজ দ্বিধাবিভক্ত। জাতি দ্বিধাবিভক্ত থাকলে বর্তমান সংকট গভীর থেকে গভীরতরই হবে। হয়তো কোনো এক সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক 'পুত্রহত্যার বিচার চাই না' বলে সরকার ও সমাজব্যবস্থার উপর তাঁর অনাস্থাই প্রকাশ করেছেন। বর্তমান সংকট মোকাবিলা করতে হলে তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, কেবল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে তা মোকাবিলা করা যাবে না।

আমানুল্লাহ কবীর: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সিনিয়র এডিটর।