খালেদা জিয়ার ‘লন্ডন পাঠ’ এবং বিএনপির রাজনীতি

শওগাত আলী সাগর
Published : 10 Nov 2015, 04:31 AM
Updated : 10 Nov 2015, 04:31 AM

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দেড় মাস ধরে লন্ডনে একমাত্র ছেলে তারেক রহমানের কাছে রয়েছেন। দেশের অন্যতম প্রধান একটি রাজনৈতিক দলের নেত্রীর কোনো ধরনের ব্যাখ্যা বা সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া ভিনদেশে এতদিন পড়ে থাকা কোনো বিবেচনায় মানানসই নয়। পশ্চিমের রাজনীতিকরা বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় অবকাশযাপনে যান। বেগম জিয়া অবকাশে গেছেন, তেমন ঘোষণাও দেননি।

অবশ্য তাঁর দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, তিনি চিকিৎসার জন্য লন্ডনে রয়েছেন। ছেলে তারেক রহমানও চিকিৎসার কথা বলেই লন্ডনে গিয়েছিলেন। তারপর আর দেশে ফিরেননি। তার লন্ডনে অবস্থান নিয়ে নানা ধরনের কথাবার্তা রয়েছে। কিন্তু পরিবার বা দলের পক্ষ থেকে খোলামেলাভাবে তার অবস্থান নিয়ে কোনো বক্তব্য কখনও পাওয়া যায়নি। খালেদা জিয়ার চিকিৎসাও ছেলের মতোই দীর্ঘমেয়াদের কিনা তা নিয়ে নানা গুঞ্জন। তবে মা-ছেলে দুজনেই লন্ডনে বসে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন।

খালেদা জিয়ার লন্ডনের জনসভা নিয়ে আমাদের বেশ কৌতূহল ছিলো। জনশ্রুতি আছে, তিনি তারকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন। ছেলের সঙ্গে একান্ত কথাবার্তা বলার সুযোগের পর ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর প্রথম জনসভা ঘিরে কৌতূহলী মানুষদের তিনি হতাশ করেননি।

জনসভায় দেওয়া ভাষণে তিনি ইউরোপের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রশংসা করেছেন। সেটি তিনি করেছেন দেড় মাস লন্ডনে অবস্থানের সুবাদে অভিজ্ঞতালব্ধ উপলব্ধি থেকে। তিনি জানিয়েছেন, এ কদিনে অনেক কিছু দেখে তাঁর ভালো লেগেছে। তাদের আইন-শৃঙ্খলা ও সুন্দর সুন্দর আইনগুলো থেকে অনেক ভালো কিছু শেখার আছে বলেও মত দিয়েছেন। লন্ডনে তিনি আর কী দেখেছেন বা শিখেছেন?

লন্ডনের রাজনীতিকদের বক্তৃতা-বিবৃতি নিশ্চয়ই তিনি পড়েছেন; টেলিভিশনেও দেখে থাকবেন। সেখান থেকে কি তাঁর কোনো অভিজ্ঞতা হয়েছে? কোনো উপলব্ধি? ইউরোপের রাজনীতিকরা কি বিদেশে গিয়ে দেশের অভ্যন্তরীন বিষয় নিয়ে বক্তৃতাবাজি করেন? খালেদা জিয়া ইউরোপের রাজনীতিকদের শালীনতাবোধ, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধার অনুভব, দেশাত্মবোধ– এসব দেখার কি সুযোগ পেয়েছেন?

সম্ভবত তিনি পাননি। তাহলে হয়তো লন্ডনের জনসভায় তাঁর বক্তৃতাটি অন্য রকম হত।

বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া অবশ্যই দেশের অরাজকতা নিয়ে কথা বলবেন; শাসক দলের নিপীড়ন-নির্যাতন নিয়ে তাঁর কিছু অসন্তোষ থাকবে। তিনি এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও করবেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক ব্যর্থতা রয়েছে। সেগুলোসহ সরকারের নানা অন্যায্য পদক্ষেপের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পদক্ষেপ ও কর্মসূচি নেওয়া নিয়মতান্ত্রিক একটি রাজনৈতিক দলের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।

দুঃখের বিষয়, বিএনপি সে কর্তব্য পালনে বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। জন-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার দিকেও দলটি যায়নি। বিএনপির কাছে একমাত্র বিষয় হচ্ছে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে এ মুহূর্তে সরিয়ে দেওয়া। বিএনপির সে দাবির সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন আছে কিনা, সেটাও তারা বিবেচনায় নিতে চায় না।

যে কথা বলছিলাম, বিদেশে বসে দেশের রাজনীতি নিয়ে, সরকার নিয়ে অভিযোগ তোলা শোভন কিনা, সেটা খালেদা জিয়ার 'লন্ডন পাঠ'এ অন্তর্ভূক্ত ছিল কিনা সেটা আমরা জানতে পারিনি।

জানি, অনেকেই বলবেন, শেখ হাসিনাও তো বিদেশে গিয়ে বিএনপি এবং বিএনপি নেত্রীর বিরুদ্ধে বক্তৃতা করেছেন। আমি সেটিরও বিরুদ্ধে। যে কোনো রাজনীতিকের জন্য, খোলাসা করে বলি, দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের জন্য বিদেশে গিয়ে দেশের সরকার কিংবা কোনো রাজনীতিকের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা আমি অশোভন, রুচিহীন বিবেচনা করি। আমাদের রাজনীতিকদের কেউ নির্বাসিত নন; খালেদা জিয়া তো ননই। নির্বাসিত রাজনীতিকরা দেশে ফিরতে পারেন না। তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন।

আরও একটা কথা পরিস্কার করি। কেবল বিদেশেই নয়, দেশের ভেতরেও রাজনীতিকদের শালীনতা চর্চার পক্ষে আমি।

'লন্ডন পাঠে'র বাইরে খালেদা জিয়া অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য দিয়েছেন। সেটি তাঁর দেশে ফিরে আসা সম্পর্কিত। খালেদা জিয়া লন্ডনে যাওয়ার পর থেকেই তাঁর এই সফর নিয়ে নানা গুঞ্জন তৈরি হয়েছে। একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নেত্রী বিদেশেই যান আর দেশেই থাকেন, তার সব কিছুই থাকবে খোলামেলো। দলের কাছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকবে, যে কেউ চাইলেই সেটি পেয়ে যাবে। কিন্তু খালেদা জিয়া কবে নাগাদ দেশে ফিরবেন, দলের কেউ সেটা জানাতে পারেননি। লন্ডনের জনসভায় তিনি বলেছেন, "আমার যাওয়াটা অত্যন্ত প্রয়োজন। গিয়ে আমাকে বাকি কাজগুলো করতে হবে। এরা (পরিবার) আমাকে যেতে দিতে দেয় না। কিন্তু আমাকে যেতে হবে।"

দেশে ফেরাটা যে প্রয়োজন, সেটা তিনি অনুধাবন করছেন। কিন্তু কবে ফিরবেন, সেটা নিজেও জানাতে পারেননি। কেননা তাঁর ফিরে আসাটা তাঁর ইচ্ছার উপর যে নির্ভরশীল নয়, সে তথ্যটুকু তিনি আমাদের দিয়ে দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, 'এরা (পরিবার) আমাকে যেতে দিতে দেয় না।' মানে সেটা নির্ভর করছে ছেলের অনুমোদনের উপর। আওয়ামী লীগের বাক্যবাগীশ নেতা হাছান মাহমুদ কয়েক দিন আগে বলেছিলেন, বেগম খালেদা জিয়াকে লন্ডনে তাঁর ছেলে বন্দি করে রেখেছে। খালেদা জিয়ার বক্তব্য কিন্তু হাছান মাহমুদের 'আশঙ্কাই' সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়।

এই বক্তব্যে আরও একটি বিষয়ে আশঙ্কা জাগে। খালেদা জিয়ার শাসনকাল তারেক রহমানের বদান্যতায় দুঃশাসনে পরিণত হয়েছিল। বিএনপি শাসনের পতনের জন্য তাকেই দায়ী করা হয়। ক্ষমতাবলয় থেকে ছিটকে পড়া বিএনপির আজকের দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতির জন্যও তার দায় অনেক। দল, দলের নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া খালেদা-পুত্রের একক সিদ্ধান্তে পরিচালিত হয় বলে এতদিন গুঞ্জন ছিল। খালেদা জিয়া এবার জানিয়ে দিলেন, তিনি নিজেও পুত্রের একক সিদ্ধান্তেই পরিচালিত হন।

অবশ্য দলের নানা পর্যায়ের নেতারা মাঝে মধ্যে খালেদা জিয়ার ফেরা নিয়ে নানা রকম তথ্যও দিয়েছেন। বলা হয়েছিল, খালেদা জিয়া ১০ নভেম্বর দেশে ফিরবেন। পরে বলা হয়েছে, তিনি ১৭ নভেম্বর ফ্লাইট বুকিং দিয়েছেন। একই সঙ্গে জানানো হয়েছে, চিকিৎসকের অনুমতি সাপেক্ষে তিনি দেশে ফিরবেন। এসবের কোনোটাই দলের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নয়। তারেক রহমানের লন্ডনবাস নিয়ে যেমন দলের আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য নেই, খালেদা জিয়ার ব্যাপারেও একই পরিস্থিতির উদ্ভব হল। আমরা অনেক বার শুনেছি, 'চিকিৎসকের ছাড়পত্র' পেলেই তারেক দেশে ফিরবেন। এখন শুনছি, 'চিকিৎসকের অনুমোদন' পেলে তবে বিএনপি নেত্রী দেশে ফিরবেন।

পরিবারের (আসলে পুত্রের) সিদ্ধান্তের কারণে যদি খালেদা জিয়াকে লন্ডনেই অবস্থান করতে হয়, সেটা দোষের কিছু নয়। তিনি সেটা করতে পারেন। বাংলাদেশ-ভিত্তিক একটি রাজনৈতিক দল পশ্চিমের একটি দেশ থেকে পরিচালিত হবে, সেটি শোভন বা নৈতিক নয়। যে রাজনীতিকরা প্রয়োজনের সময় জনগণের পাশে থাকতে পারেন না, তাদের আসলে রাজনীতিতে থাকা দরকার কিনা, সে বিষয়েও ভাবনা-চিন্তার প্রয়োজন রয়েছে বৈকি।