স্মৃতির পাতায় ৭ নভেম্বর

মাহজাবিন খালেদ
Published : 7 Nov 2015, 11:33 AM
Updated : 7 Nov 2015, 11:33 AM

শহীদ মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম এবং ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সম্পর্কে কিছু লিখতে বসেছি। চার দশক আগের এ দিনে আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী আমার স্মৃতিতে যেভাবে গেঁথে আছে তা-ই বলতে চাই। তখন আমি ৮ কী ৯ বছরের শিশু মাত্র। তবু সে দুঃসময়ের অনেক ঘটনা আমার মনে থেকে যাওয়াই স্বাভাবিক। কারণ দুর্দিনের কথা ভোলা যায় না। তখন বাবাকে কাছ থেকে দেখে এবং পরে মা ও অন্যান্যদের কাছ থেকে ইতিহাসের অনেক কথা জেনেছি। অনেক লেখক তাদের গ্রন্থে সে সব ইতিহাসের উল্লেখ করছেন।

তবে আজকে আমার কলম ধরার কারণ এটাই যে, ইতিহাস লেখকদের কেউ কেউ সত্য তুলে ধরলেও, মিথ্যা ও বানোয়াট ইতিহাস বলছেন অনেকে। তারা এভাবে দেশ ও জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। তাই আমি মনে করি, খালেদ মোশাররফের সন্তান হিসেবে সেদিনের যতটুকু স্মৃতি আমার মানসপটে আঁকা রয়েছে তা সবার সামনে প্রকাশ করা উচিত।

খালেদ মোশাররফ ও ৭ নভেম্বর সম্পর্কে বলতে হলে একটু পিছনের ঘটনা, অর্থাৎ ১৫ আগস্টের ভয়াবহ নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করতে হবে। কারণ খালেদ মোশাররফকে হত্যা ও ৭ নভেম্বরের ভয়াবহতার সঙ্গে ১৫ আগস্টের ঘটনাবলীর যোগসূত্র রয়েছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে বিশ্বাসঘাতক খুনি মোশতাক-চক্র। এ দিন খুব ভোরে রেড ফোনে একটি কল আসে। আমরা সবাই তখন ঘুমিয়ে। ফোনটি ধরেন বাবা। শুনলাম, ওপাশ থেকে সেনাবাহিনী প্রধান কে এম সফিউল্লাহ কথা বলছেন বাবার সঙ্গে। আরও জানলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে আক্রমণ করেছে আমাদেরই সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক অফিসার। তাই তখনই তাড়াতাড়ি বাবাকে তাঁর বাসায় যেতে বললেন শফিউল্লাহ।

ফোনটি রেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন বাবা। অস্থির হয়ে ঘরজুড়ে পায়চারি করতে লাগলেন। আর বারবার বলতে থাকলেন, 'সর্বনাশ হয়ে গেল… দেশের এখন কী হবে? না, এটা মেনে নেওয়া যায় না।'

কথা বলতে বলতেই তিনি আবার তৈরি হয়ে নিজে গাড়ি চালিয়ে চলে গেলেন সেনাপ্রধানের বাড়ি। সারাদিন আর ফিরলেন না বাসায়। এলেন সেই অনেক রাতে। দেখলাম মহাচিন্তিত শুধু নন তিনি, ছটফট করছেন বলা চলে। শুধু বললেন, ''এটা মেনে নেওয়া যায় না যে, যিনি আমাদের একটা স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করে দিলেন তাঁকে এভাবে হত্যা করা হল। এটা মেনে নেওয়া উচিতও নয়। এর প্রতিকার করতে হবে। তা না হলে আমাদের দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে, জাতি শেষ হয়ে যাবে। দেশ ও জাতিকে রক্ষার জন্য আমাদের খুব তাড়াতাড়ি বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরদের প্রতিহত করতে হবে। এদের চরম শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার।''

বাবা যখন অস্থির চিত্তে এভাবে কথা বলছেন, তখন আমরা বোনেরা বাবার সামনে যাওয়ার সাহস পেলাম না। তাই ওই সময়গুলোতে তাঁর সঙ্গে তেমন একটা কথা বলারও সুযোগ হয়নি আমার।

বেশ কিছুদিন পর বাবাকে বলতে শুনলাম, ''কী ভয়াবহ ব্যাপার! খুনিরা আইন করেছে যে, মুজিব হত্যার বিচার করা যাবে না, দেশটা কি মগের মুল্লুক হয়ে গেল? এটা হতে দেওয়া যাবে না। এর অবশ্যই একটা বিহিত করতে হবে। একটি দেশের প্রতিষ্ঠাতাকে হত্যা করা হয়েছে, তার বিচার হবে না, এটা কোনো সভ্য জাতি মেনে নিতে পারে না। কাজেই জাতির মুখ উজ্জল করার জন্য আমাদের দেশপ্রেমিক প্রত্যেক সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধার উচিত খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এগিয়ে আসা। স্বাধীনতার আদর্শে বিশ্বাসী প্রত্যেক নাগরিককে আজ সোচ্চার হতে হবে।''

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কদিন পরই সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহকে সরিয়ে উপপ্রধান জেনারেল জিয়াকে সেনাপ্রধান করা হয়। তাঁর কাছেও বাবা সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। কিন্তু জিয়া বাবার কথায় কর্ণপাত করেননি। তিনি খুনি মোশতাক ও মেজরদের পরামর্শ বা নির্দেশে চলতে থাকেন। এমনকি খুনি-চক্রকে সাহায্য-সহযোগিতা করেন।

বাবা কিন্তু এসব মেনে নিতে পারেননি। তাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ সময় রক্ষীবাহিনীর প্রধান নুরুজ্জামান, ৪৬ বিগ্রেডের প্রধান শাফায়াত জামিল ও মেজর হাফিজ উদ্দিনসহ অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন বাবা। এঁরাও সবাই বাবার সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করে দ্রুত খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার পরামর্শ দেন। এঁদের সবাইকে তখন আমাদের বাসায় এসে বাবার সঙ্গে আলোচনা করতে দেখেছি।

সবার সঙ্গে আলোচনা ও মতবিনিময়ের পর বাবা এ উদ্যোগে নেতৃত্ব দেবার সিদ্ধান্ত নেন। সে মোতাবেক ৩ নভেম্বর ঘাতকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের তারিখ নির্ধারিত হয়। বাবার সঙ্গে তখন অন্যদের আলোচনা ও সেনাবাহিনীর লোকজনের আসা-যাওয়া ও কথাবার্তায় বুঝতে পারতাম, বড় কিছু করতে যাচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু আমরা তো তখন নিতান্তই শিশু। সেটি বোঝার ক্ষমতা আমাদের ছিল না।

এদিকে ২ নভেম্বর মাসহ আমাদেরকে গুলশানে নানির বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হল। ৩ নভেম্বর ভোরে হেলিকপ্টার ও মিগ ফাইটারের প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভাঙল আমাদের। তখন লোকজন বলাবলি করছিল, 'দেশে সামরিক অভ্যুত্থান হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ক্ষমতা থেকে সরানো হবে।' এ সময় আমাদের বাসায় লোকজনের আনাগোনাও বেড়ে গেল। সবাইকে দেখতাম খুব হাসিখুশি উৎফুল্ল।

লোকজনের কথাবার্তায় আমরা এটা জানতে পারলাম যে, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দি করে বাবাকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করে সেনাপ্রধান করা হয়েছে। পরদিন বেশ কয়েকটি পত্রিকায় বাবার ছবি দেখলাম– তাঁকে ব্যাজ পরিয়ে দিচ্ছেন নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর প্রধান দুজন। আমরা, তাঁর সন্তানরা তখন পদোন্নতি কী জিনিস বা সেনাপ্রধান হওয়ার কী মর্ম তা বুঝতাম না। কেবল দেখতাম, বাসায় বেড়াতে আসা সেনাবাহিনীর লোকেরা খুব উৎফুল্লতার সঙ্গে বলছিলেন, খালেদ মোশাররফের প্রমোশন হয়েছে, তাঁকে দেশের সেনাপ্রধান করা হয়েছে।

লোকের কাছ থেকেই এমনতর স্বস্তির কথাও শুনতাম যে, এখন দেশ রক্ষা পেল, জাতি মুক্তির স্বাদ পেল আবার। মানুষকে এ বিষয়ে আশাবাদী দেখতাম যে, এবার মুজিব-হত্যার বিচার হবে, এবার খুনিদের রক্ষা নেই।

এমন সময় এল ভয়াবহ এক দুঃসংবাদ: জেলখানায় আটক চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। সংবাদটি প্রচার হওয়ার পরপর সেনাবাহিনীর লোকজনের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। সবাইকে এ নিয়ে মাতম করতে দেখেছি। এ দিনই আরেকটি খবর প্রচারিত হল, বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে গিয়েছে একটি শোক মিছিল। মিছিলটির অগ্রভাগে ছিলেন আমার দাদি জামিলা আক্তার ও আমার চাচা আওয়ামী লীগ নেতা রাশেদ মোশাররফ। এ সময় কেউ কেউ বলতে থাকেন, মিছিলটি খালেদ মোশাররফের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে।

সত্যি, খুব অস্থির সময়। ওদিকে প্রচার হতে থাকে যে, নভেম্বরেই সেনাবাহিনীতে আরেকটি অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালাতে পারে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোকজন। এ ধরনের কোনো সংস্থার নাম আগে কখনও শোনা যায়নি। হঠাৎ গজিয়ে ওঠা সংস্থাটি বিভিন্ন ধরনের অপতৎপরতা শুরু করেছে দেশে। শহরে তারা কিছু লিফলেট ছেড়েছে যাতে সাধারণ সৈনিকদের উস্কানি দেওয়া হয়েছে। এভাবেই ডালপালা মেলছিল নানা গুজব, যার একটি ও ভয়াবহতমটি হল, বাবা ও শাফায়াত জামিলকে হত্যা করা হতে পারে।

আমরা তিন বোন তো তখনও মায়ের সঙ্গে নানির বাসায়। কদিন ধরে আমাদের সঙ্গে বাবার দেখা-সাক্ষাৎ বা কথাবার্তা কিছুই হয়নি। তাই ৬ নভেম্বর সকালে মা আমাদের নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের বাসায় যান বাবার সঙ্গে দেখা করতে। সন্ধ্যা ৭টার দিকে বাবা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে পারলেন। তখন বহু লোক ভিড় করলেন সেখানে। বাবার সঙ্গে দেখা করতে চান তারা। বাবাকে দেখলাম খুব হাসিখুশি, উৎফুল্ল। গত কদিনের অনেক ঘটনাই বাবার কাছ থেকে মা শুনে নিলেন। রাতে একসঙ্গে খাবার খেলেন ওঁরা। তখনও কি জানতাম, ওটাই হবে মা-বাবার একসঙ্গে বসে শেষবারের মতো খাওয়া!

রাতের খাবারের পর নানা কথাবার্তা শেষে বাবা মাকে বললেন, 'খুবই ব্যস্ত আছি, এখনই বঙ্গভবনে যেতে হবে।' কথাটা বলেই বাবা একটি গাড়িতে এ টি এম হায়দারকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গভবনের দিকে চলে গেলেন। মাসহ আমাদেরকেও আরেক গাড়িতে করে গুলশানে নানির বাসার দিকে রওনা করিয়ে দেন।

বাবা যখন গাড়িতে উঠতে যান তখন আমার ছোট বোন তাইরিন মায়ের কোলে। গাড়ির শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে সে কেঁদে ওঠে। ওর কান্নার শব্দ শুনে বাবা তাঁর গাড়ি থেকে নেমে এসে তাইরিনকে কোলে তুলে নিলেন। তারপর বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন অনেকক্ষণ। পরে মা স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, তাইরিনের সে কান্নার উৎস তখন তিনি খুঁজে পাননি। আমার অবুঝ বোনটি কি তখনই জেনেছিল যে, বাবার আদর আর কোনো দিনই পাবে না সে!

সে রাতে বিদায়ের সময় বাবা মাকে বলেছিলেন, 'তোমরা যাও, আমি আগামীকাল আসব'। বাবা কথা রেখেছিলেন। কদিন পর এসেছিলেন বাসায়। তবে জীবিত অবস্থায় নয়, লাশ হয়ে।

বাসায় ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা সবাই ঘুমোতে যাই। মধ্যরাতে ঘুম ভাঙে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে। ওগুলো আসছিল ক্যান্টনমেন্টের দিক থেকে। ভয়ে মা, নানা, নানি স্তব্ধ হয়ে ছিলেন। নানা-নানির বেশ বয়স হয়েছে তখন। তাঁরা আতঙ্কে কাঁপছিলেন। আমাদের তিন বোনের অবস্থাও একই।

এ সময় আমার এক মামা বললেন, এ বাড়ি আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। কাজেই তাড়াতাড়ি এখান থেকে আমাদের সরে যেতে হবে। তখন আমরা ও বাড়ি ছেড়ে মায়ের খালার বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। এরপর মা বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলার চেষ্টা করলেন। তখন বঙ্গভবনে মিটিং চলছিল। মা বাবাকে বললেন, 'আমার মনে হয় অরাজক পরিস্থিতি শুরু হয়েছে। প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। তাই বাবার বাসা ছেড়ে আমরা সবাই এখন খালার বাড়িতে চলে এসেছি।'

বাবা মাকে বললেন, 'তোমরা ওখানেই থাক, আমি এদিকে দেখছি।' এটাই বাবার সঙ্গে মায়ের শেষ কথা।

রাতে ওভাবে ঘুম ভাঙার পর আর ঘুমাতে পারিনি আমি। ৭ তারিখ সকাল থেকেই বাসার সবাইকে চিন্তিত, অস্থির দেখছিলাম। মাকে তাই জিজ্ঞেস করলাম, 'মা, কী হয়েছে?' মা শুধু বললেন, 'না, কিছুই হয়নি। তোমরা আল্লাহকে ডাক, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বল, তোমার বাবাকে আর আমাদের সবাইকে যেন ভালো রাখে।'

মার কথা শুনে মনে হল, আমাদের কোনো বিপদ হচ্ছে।

এদিকে সকালের নাশতার সময় হয়ে এসেছে, কিন্তু বাসায় তার কোনো আয়োজন দেখছি না। আমার দেড় বছরের ছোট বোনটি খাওয়ার জন্য কান্না শুরু করে দিয়েছে। ওর দুধের বোতল, খাবার ও কাপড়-চোপড় আনতে নানি নিজেদের বাসায় যান সকাল ১০টার দিকে। রাতে ও বাসা ছেড়ে আসার সময় কিছুই নিয়ে আসতে পারিনি আমরা। নানি সে বাসায় পৌঁছুনোর সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে কিছু সেনা গাড়ি নিয়ে এসে হাজির হয়। তারা গাড়ি থেকে নেমে নানিকে জিজ্ঞেস করে, 'খালেদ মোশাররফের স্ত্রী কোথায়?'

মাকে না পেয়ে ওরা তখন নানিকে ধরে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। তিনি বহু কষ্টে পাশের বাসায় গিয়ে আত্মরক্ষা করেন। সেনারা তখন একদিকে মাকে খুঁজতে শুরু করে, আরেক দিকে বাসার ভেতরে গিয়ে লুটপাট করতে থাকে। আলমারি ভেঙে মা ও নানির গয়নাসহ সব লুটে নেয়।

সেদিন যদি ঘাতকরা আমাদের ও বাড়িতে পেত, তবে আজ হয়তো আমরা বেঁচেও থাকতাম না। নানি কোনো মতে ওখান থেকে ফিরে সব কথা জানান। তখন আতঙ্ক আরও বেড়ে গেল সবার। মা বারবার বলতে থাকেন, 'হে আল্লাহ, এখন আমাদের কী হবে। আল্লাহ, তুমি আমাদের রক্ষা কর। আমার স্বামীকে রক্ষা কর।'

দুপুরের দিকে এল সেই ভয়াবহ দুঃসংবাদ। মায়ের চাচা খবরটা নিয়ে এলেন। বাবাসহ হুদা ও হায়দারকে হত্যা করা হয়েছে। খবরটা শুনে মা যেভাবে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলেন, তাতে আমার শিশুমনের অবস্থা ভয়ানক হয়ে উঠল। আমিও চিৎকার করে কাঁদতে থাকি। আমাদের সান্তনা দেওয়ার মতো কেউ ছিল না তখন। আমাদের সামনে আসতে কেউ সাহস পাচ্ছিলেন না। তাই সব কিছু অন্ধকার লাগছিল।

৪ দিন পর বাবার লাশ আনা হল। মায়ের মুখে তখন যেন কোনো ভাষা নেই। আমি বাবার লাশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাগলের মতো কাঁদছি। বাবাকে গোসল করানো হল। তারপর কবর দিতে নিয়ে যাবার সময় আমার ছোট বোন বলল, 'মা, বাবাকে কোথায় নিয়ে যায়? বাবাকে ওভাবে নিয়ে যাচ্ছে কেন?' ওর কথায় কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।

আমার ছোট বোনটির তো তখনও বোঝার বয়স হয়নি যে, মৃত্যু কী জিনিস। ও অনেক দিন পর্যন্ত জিজ্ঞেস করত, 'মা, বাবা কোথায় আছে? বাবা কি আর কোনো দিন আসবে না?'

মা আমাদের তিন বোনকে নিয়ে খুবই অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। খড়কুটোর সন্ধানে এদিকে সেদিকে দৌড়েছেন। পালিয়ে বেড়িয়েছেন প্রাণভয়ে। কোথাও আমাদের থাকার একটু জায়গা ছিল না। কীভাবে সেসব দিন আমাদের কেটেছে তা ভাবলে আজও গা কাঁটা দিয়ে ওঠে।

মৃত্যুর সময় বাবা কিছ্ইু রেখে যাননি। বরং ১৪ হাজার টাকা ঋণ ছিল তাঁর। সে টাকা তাঁর বেতন থেকে কেটে নেওয়া হয়েছে। গুলশানে মায়ের নামে একটা অ্যালটমেন্ট ছিল, যেটি নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকার ষড়যন্ত্র করেছে। এসব ষড়যন্ত্রের মূল হোতা ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। শুধু বাবার পেনশনের সামান্য কটি টাকা এবং আত্মীয়-স্বজনদের সাহায্য-সহযোগিতায় আমাদের তিন বোনকে নিয়ে মা বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে পেরেছেন।

আমার পিতা, শহীদ মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ আজ নেই। তাঁকে আর কোনো দিন আমরা পাব না। আমাদের সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হলেও পিতৃস্নেহ দেওয়া যাবে না। তা বলে কি আমরা পিতার হত্যার বিচার থেকেও বঞ্চিত হব? প্রায় ৪ দশক ধরে পিতৃহত্যার বিচারের অপেক্ষায় রয়েছি আমরা তিন বোন। একটা সময় ছিল যখন বিচারের দাবিও করতে পারিনি আমরা। কারণ খালেদ মোশাররফের হত্যাকারী বা তাদের সহযোগীরাই এদেশের শাসন-ক্ষমতায় ছিল অনেক অনেক দিন। আজ এত দিন পরে হলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। তাই বাবার হত্যার বিচারের দাবি করার সুযোগ এসেছে আমাদের সামনে।

চল্লিশ বছর আগের ৭ নভেম্বরে হত্যা করা হয়েছিল ২ নং সেক্টরের কমান্ডার, কে ফোর্সের অধিনায়ক, সমরবিশারদ ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফকে। তাঁর সঙ্গে শহীদ হন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল নাজমুল হুদা বীর বিক্রম এবং ২ নং সেক্টরের কমান্ডার লেফটেনেন্ট কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তমসহ অসংখ্য সেনা কর্মকর্তা ও জোয়ানকে। এঁদের সবার হত্যার বিচার চাইব আজ।

সে সঙ্গে দাবি করছি সেদিনের ঘটনা নিয়ে সকল বিতর্কের অবসানের জন্য ইতিহাসের সঠিক লিখন ও পঠন-পাঠন। বিশেষ করে খালেদ মোশাররফকে 'ভারতীয় দালাল' বলে যে অপপ্রচার চালানো হয়েছিল, তাতে আমাদের সেনাবাহিনী ও জাতি তখন বিভ্রান্ত হয়েছে। আজও এসব অপপ্রচার চলছে, চালানোর চেষ্টা করছে কেউ কেউ। যদিও এখন এটা প্রমাণিত যে, ষড়যন্ত্রকারীরাই এসব মিথ্যা বলেছে বাবাকে নিয়ে, তবু বলব, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির এই সরকার তদন্ত করে দেখুক কোন যড়ষন্ত্রকারীরা এসবের সঙ্গে জড়িত। তারপর তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে।

দাবি জানাব সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরের আর্মি অ্যাওয়ার্ড বোর্ডের সেনাপ্রধানের তালিকায় বাবার নামটি যুক্ত করার। এ দাবি শুধু খালেদ মোশাররফের কন্যা হিসেবে একা আমার নয়, ২ নং সেক্টর এবং কে ফোর্সের সকল মুক্তিযোদ্ধার। এ দাবি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রত্যেক দেশপ্রেমিকের।

আশা করছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও হত্যার রাজনীতি বন্ধের লক্ষ্যে উত্থাপিত দাবিগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। তিনি ইতোমধ্যে ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় এনেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের দণ্ড দেওয়া হচ্ছে। বিচার-কার্যক্রম হয়েছে জেলহত্যার।

তাই ৭ নভেম্বরের খুনিদের বিচারের ব্যবস্থাও তিনিই করবেন বলে আ্স্থা রাখছি।