’৭২-এর সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অর্পিত (শত্রু) সম্পত্তি আইন: কিছু প্রস্তাবনা

অশোক কর্মকার
Published : 12 Jan 2011, 04:52 AM
Updated : 28 July 2011, 03:14 PM

সংবিধান একটা জীবন্ত দলিল। সমাজের অগ্রগতির সাথে এটাও এগিয়ে যাবে, পরিবর্তিত হবে–তাই স্বাভাবিক। সংশোধনের মাধ্যমেই সংবিধানে সমাজের এই পরিবর্তন প্রতিফলিত হয়ে থাকে। তাই সংবিধানের সংশোধন যেমন কোন নতুন বিষয় নয় তেমনি তাকে সাধারণভাবে খারাপ বলারও অবকাশ নেই। তবে কোন কোন সংশোধন করা হয়ে থাকে যাতে সমাজের অগ্রগতির প্রতিফলন হয় না, বরং তা কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকতে পারে। তাই '৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া কোন একগুয়েমির কারণে নয়, কোন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশে নয়, বরং আমাদের ভুলকে শুধরে নেবার স্বার্থে। আর তা রাজনৈতিক সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণের মাধ্যমেই করতে হবে। এটাকে অন্যভাবে বলা যেতে পারে, জাম্প করার আগে অনেকটা পেছনে যেতে হয়। সেই পেছনে যাওয়া মানে পেছনে পরে থাকার জন্য নয়, বরং সামনে এগিয়ে যাবার জন্য।

কি আছে '৭২-এর সংবিধানে এবং তার পরবর্তী সংশোধনীগুলোতে?

'৭২-এর সংবিধানের মূল নীতিগুলো ছিল–গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। যদিও এর মধ্যে একই সময় গনতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র কীভাবে পাশাপাশি একটা রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে থাকতে পারে তা আমার বোধগম্য নয়।

এ পর্যন্ত আমাদের সংবিধানের ১৪টি সংশোধন হয়েছে। ১ম এবং ১১ থেকে ১৩তম সংশোধনী বাদে প্রায় সবগুলো নিয়েই বিভিন্ন সময় বির্তক হয়েছে। পরবর্তী সময়ে সুপ্রীম কোর্ট ৫ম, ৭ম ও ৮ম সংশোধনীগুলো হয় পুরোপুরি বাদ দিয়েছেন নয়তো কাটছাঁট করেছেন।

সব সংশোধনীই যে অপ্রয়োজনীয় বা রিভার্ট করা যাবে তাও কিন্তু নয়। এবং অনেক সংশোধনী আমাদের আজকে এ পর্যায়ে আসতে সাহায্য করেছে, যেমন ১১তম সংশোধনী যার মাধ্যমে জাতি একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রমে সক্ষম হয়েছে ৯০ পরবর্তী রাজনৈতিক পট পরিবর্তনকে সামনে রেখে।

রাষ্ট্র ধর্ম ও বিছমিল্লাহ্ বাদ না দিয়ে কি '৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়?

আমার ধারণা সম্ভব। রাষ্ট্র ধর্ম ও বিছমিল্লাহ্ রেখেই '৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া সম্ভব এবং তা বর্তমানের সংবিধানের স্পিরিটকে অক্ষত রেখেই সম্ভব।

ইংরেজীর সেক্যুলারিজম এবং বাংলার "ধর্মনিরপেক্ষতা" ঠিক সমার্থক নয়। সত্যিকার অর্থে 'সেক্যুলারিজম' মানে হোল ইহজাগতিকতা, অন্য কথায় "pertaining to this world", এতে "after world"-এর কোন স্থান নেই। ধর্মনিরপেক্ষতা সে অর্থে খুবই মানানসই শব্দ, যা সঠিকভাবে সংবিধান প্রণেতাদের মনোভাব ও উদ্দেশ্য প্রকাশ করে। 'ধর্মনিরপেক্ষতা' সে অর্থে বলা যায় রাষ্ট্র কর্তৃক রাষ্ট্রে পালিত সকল ধর্ম ও ধর্মপালনকারীদের প্রতি সম আচরণ। অন্য কথায় বলা যায় রাষ্ট্র ব্যবহারের দিক থেকে কোন ধর্মের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না, রাষ্ট্র তার নিরপেক্ষতা বজায় রাখবে। আর তাই যদি হয় তবে কোন ধর্মের নাম সংবিধান থেকে বাদ দেয়ার দাবী না করে বরং রাষ্ট্রে যেসকল ধর্ম পালিত হয় সেসকল ধর্মের নাম উল্লেখ করলে তাতে কারও কোন ক্ষতি হয় না, বরং সকলেই আনন্দিত হতে পারে।

আমাদের বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫৩ অনুচ্ছেদে অন্যানের মধ্যে বলা আছে যে,
(২) বাংলায় এই সংবিধানের একটি নির্ভরযোগ্য পাঠ ও ইংরেজীতে অনূদিত একটি নির্ভরযোগ্য অনুমোদিত পাঠ থাকিবে এবং উভয় পাঠ নির্ভরযোগ্য বলিয়া গনপরিষদেও স্পীকার সার্টিফিকেট প্রদান করিবেন।
(৩) এই অনুচ্ছেদেও (২) দফা অনুযায়ী সার্টিফিকেটযুক্ত কোন পাঠ এই সংবিধানের বিধানবলীর চূড়ান্ত প্রমাণ বলিয়া গণ্য হইবে:
তবে শর্ত থাকে যে, বাংলা ও ইংরেজী পাঠের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাইবে।

'৭৫ পরবর্তীকালে সংবিধান থেকে "ধর্মনিরপেক্ষতা" বাদ দেয়া হয়েছে এবং সমাজতন্ত্রের একটা ব্যাখ্যা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আমার মনে হয় সমাজতন্ত্রের এই ব্যাখ্যা জুড়ে দেয়াটা ভালো কাজই হয়েছে-কেননা মৌলবাদ ও কম্যুনিজমের সাথে গনতন্ত্র একইভাবে চলতে পারে না। যাই হোক 'ধর্মনিরপেক্ষতা' বাদ দিয়ে সেখানে সংবিধানের ৮ম অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে বলা হয়েছে-'সর্ব শক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস'। দেশের অধিকাংশ মানুষের স্রষ্টা তথা আল্লাহ, ভগবান বা ঈশ্বরের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস যে আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। অবশ্যই সামান্য কিছু মানুষ যারা কিনা নাস্তিক তাদের মতামত তাতে প্রতিফলিত হবে না। তবে এই আমেরিকাতেও, যেখানে কি না প্রায় ১৭ ভাগ মানুষ স্রষ্টার অস্তিত্বে সন্দিহান, সেখানেও সরকারীভাবে বলা হয় "In God We Trust" , তো সেদিক থেকে চিন্তা করলে আমরা যদি "ধর্মনিরপেক্ষতা" শব্দটি না দিয়ে আল্লাহ্ শব্দের পাশাপাশি ভগবান, ঈশ্বর বা স্রষ্টা শব্দগুলো জুড়ে দেই তাহলে সকল ধর্মালম্বীদের অনুভূতিকেই সম্মান দেখানো হলো এবং প্রকৃত অর্থেই রাষ্ট্র কর্তৃক "ধর্মনিরপেক্ষতা" পালিত হতে পারে।

কাজেই সেক্যুলারিজমের শাব্দিক অর্থে কোন ধর্মের নামই সংবিধানে থাকতে পারে না, কিন্তু আমরা যদি সংবিধানের বাংলা সংকলনকেই মূল পাঠ হিসেবে নেই, এবং যা উচিতও বটে সংবিধান অনুসারে, তবে বিছমিল্লাহ রেখেই এবং তার পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের উচ্চারণকে সংযোজিত করা যেতে পারে। তেমনি রাষ্ট্র ধর্মের ক্ষেত্রে ইসলামকে রেখেই, তাকে বাদ না দিয়েই রাষ্ট্রে পালিত অন্যান্য ধর্মের নাম পাশাপাশি বসালে যেমন ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অনুভূতিকে সম্মান দেখানো যাবে, তেমনি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সাথে নিজেদেরকে ভাবতে পারবে। সবচেয়ে বড় কথা, এখনও পর্যন্ত কেউ বলেননি যে অন্যদের অনুভূতিকে সম্মান দেখানো যাবে না, তাদের দাবী বিছমিল্লাহ বা রাষ্ট্র ধর্ম বাদ দেয়া যাবে না। তাদের মতামত ও অনুভূতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে এবং সংবিধানে প্রদর্শিত পথেই দেশে সকল ধর্মের মানুষই আনন্দিত হতে পারে। আরও এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারে মডারেট দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম।

অর্পিত সম্পত্তি আইন: সমস্যা সবার, শুধু সংখ্যালঘুদের নয়

Evacuee Properties আইন যা কিনা ১৯৬৫ সালে Defence of Pakistan Ordinance –এর মাধ্যমে Enemy Properties হিসেবে পরিচিত হয়। পৃথিবীতে Enemy Properties-এর ধারণা নতুন কিছু নয়, তবে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী এটা করেছিল বিশেষ উদ্দেশ্যে, আমাদের সমাজকে ভাগ করে শাসন করার জন্য। পাকিস্তানের যারা তখন ভারতে চলে যায় তখন তারা ইচ্ছে করে যায়নি, তাদের তাড়ানো হয়েছিল। আর Enemy Properties আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে যারা কিনা সেই দেশের সাথে যুদ্ধরত অন্যদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে তাদের মালিকানাধীন সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়ে থাকে যাতে করে ঐ সম্পত্তি কোনভাবে সেই প্রথম দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত না হয়।

কিন্তু সে যাই হোক পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কিন্তু তাদের কূট কৌশলে সফল হয়েছে। আমাদের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস কিছুটা হলেও সৃষ্টি করতে পেরেছে। কিন্তু সেই ঐতিহাসিক ভুলকে শোধরানো আজ প্রয়োজন শুধুমাত্র সংখ্যালঘুদের জন্য নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠদের তথা সবার জন্য, দেশের জন্য।

আমার ব্যক্তিগত বিচারিক জীবনে আমি দেখেছি দেশের সিভিল মোকদ্দমার বেশিরভাগ সম্পত্তিতে একাধিক ব্যক্তি মালিকানা দাবী করে থাকে। দু'পক্ষই বলতে চায় যে তারা এই জমি কিনেছে একজনের কাছ থেকে যিনি পাকিস্তান ছেড়েছিলেন ঐ নির্দিষ্ট সময়ে। কেন এমনটি হয়? পাশাপাশি বাস করা প্রতিবেশিরা জানে কে আসলে কিনেছে আর কে সঠিক কথা বলেনি। তাই একজন ঐ সম্পত্তি নিয়ে গেলে অন্যজন ভাবে সে কেনো একা নেবে। শুরু হয়ে গেলো দু'পক্ষের রেশারেশি, মামলা। প্রথমে সিভিল পরে ক্রিমিনাল মামলা। এভাবে দেশের ক্রিমিনাল মামলারও একটা বিরাট অংশের উৎপত্তি হয় এই সিভিল মামলা থেকে। তাই আজ যদি ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে হলেও সমস্যার সমাধান করা যায় তাহলে পুরো সমাজ পাকিস্তানিদের কৃত অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারে। এখানে আর একটি বিষয় না বললে নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে পাকিস্তানিদের অনেকেই বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায় তাদের সম্পত্তি পেছনে ফেলে। এরা সবাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপক্ষে ছিল, আমাদের বিপক্ষে আমাদের শত্রু পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছে এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের বিপরীতে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেছে। তাই তাদের সম্পত্তি যদি Abandoned Properties না বলে Enemy Properties ভূক্ত করা হোত তা হলে তা অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত হতো।

সবশেষে আমাদের মনে রাখতে হবে রাজনীতিতে প্রতিহিংসার কোন স্থান নেই, আপোষের কোন বিকল্প নেই। সংবিধান বা আইন সকলের জন্য। তাই সবার শ্রদ্ধা যাতে এর প্রতি বজায় থাকে সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। আজকে যারা ক্ষমতায় নেই তাদের মতামতকেও জানতে হবে, শ্রদ্ধা জানাতে হবে। তারা ক্ষমতায় নেই বলে তাদের অস্তিত্বতো বিলুপ্ত হয়নি, বা হবার কথাও নয়। ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, চিরস্থায়ী মানুষ।

অশোক কর্মকার: এটর্নী এট ল।