এক সন্তান নীতির চীন বনাম বাংলাদেশের সাফল্য

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 24 Nov 2015, 11:18 AM
Updated : 24 Nov 2015, 11:18 AM

একজোড়া সক্ষম দম্পতি কত জন সন্তান ধারণ করতে পারবেন, এ সর্ম্পকে গণচীন সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় নীতির পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ১৯৮০এর দশকে গৃহীত কঠোর 'এক সন্তান গ্রহণ' নীতি থেকে তারা সরে এসেছে এখন। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পর ২২ অক্টোবর, ২০১৫ বেইজিংএ কম্যুনিস্ট পার্টির চারদিনের সন্মেলন শেষে স্থির হয় যে, গণচীন প্রগতির ধারা অব্যাহত রাখার স্বার্থে এবং প্রবীণ জনসংখ্যার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে প্রয়োজনে সক্ষম দম্পতিদের জন্য দুই সন্তান গ্রহণেরর সুযোগ দেবে। প্রধানত ভারসাম্যপূর্ণ জনসংখ্যা উন্নয়ন এবং প্রবীণ জীবনের বিড়ম্বনার কথা ভেবেই তারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।

[The change of the policy is intended to balance population development and address the challenge of an ageing population.]

তা সত্ত্বেও মানবাধিকারের প্রবক্তাদের অভিমত হচ্ছে, ব্যক্তির প্রজনন অধিকারের উপর গণচীনের সরকারের অনভিপ্রেত খবরদারি এখনও বহাল রইল। তাদের কমিউনিস্ট নেতারা এ যাবত অহঙ্কার করে বলে এসেছেন যে, এ নীতি গ্রহণ করে তারা প্রায় ৪০০ মিলিয়ন নতুন জন্ম প্রতিরোধ করতে পেরেছেন এবং এর ফলে সেদেশে নাটকীয় অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে।

জনমিতি বিশারদগণ অবশ্য ভিন্ন কথা বলছেন। তাদের মতে, এক সন্তান নীতি গ্রহণের ফলে গণচীনে অসংখ্য কন্যাশিশুকে জন্মলগ্নেই হত্যা করা হয়েছে। আর এতে সমাজে বিশাল লিঙ্গ-বৈষ্যমের সৃষ্টি হয়েছে। সেদেশে প্রায় ৩০ মিলিয়ন পুরুষ এখন বিয়ে করার কনে খুঁজে পাবে না। সরকারের এক সন্তান নীতি জনমিতিতে এতটাই বৈষম্য সৃষ্টি করেছে যে এর প্রভাব চলবে আরও কয়েক দশক।

এতদসত্বেও, গণচীনের জনসংখ্যা বর্তমান ১৩০ কোটি থেকে আগামী কয়েক দশকে ১৫০ কোটিতে উপনীত হবে, যার প্রায় ৪৪ কোটির বয়স হবে ৬০ বছরের বেশি। প্রধানত প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যাবৃদ্ধি এবং ভবিষ্যৎ দুর্বল প্রজন্মের কথা ভেবেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। বর্তমানে গণচীনে মোট প্রজননহার ১.২ যা নিম্নহার হিসেবে ধরা হয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশে মোট প্রজনন হার নারী প্রতি ২.৩।

লক্ষ্যণীয় যে, বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি শুরু থেকেই পরিচালিত হয়ে আসছে সক্ষম দম্পতিদের প্রজনন-স্বাস্থ্য অধিকারের প্রতি সম্মান প্রর্দশন করে এবং পদ্ধতি গ্রহণে তাদের স্বতঃপ্রবৃত্ত বা ঐচ্ছিক ভাবনায় প্রাধান্যদানের মাধ্যমে। এখানে বলপ্রয়োগ বা কাউকে প্রভাবিত করার সুযোগ নেই। পক্ষান্তরে, গণচীনে পরিবার পরিকল্পনায় রাষ্ট্রীয় নীতিমালা প্রতিপালনে বলপ্রয়োগ করা হয়েছে। অথচ সাফল্যের হিসেবে বাংলাদেশ খুব একটা পিছিয়ে নেই।

এ কথাই আমাকে বলতে হয়েছিল ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সাংহাই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রদত্ত ভাষণে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের আমন্ত্রণে সেবার আমি গণচীনের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি নিয়ে বক্তব্য রাখার সুযোগ পেয়েছিলাম। সাংহাই বিশ্ববিদ্যালয় আমার ভাষণের জন্যে এক বিশাল আয়োজন করেছিল। হলঘরে কমপক্ষে ৫০০ অংশগ্রহণকারীর সমাবেশ ঘটে আমার বক্তব্য শোনার জন্যে।

পাওয়ার পয়েন্টে প্রায় এক ঘণ্টা আমার উপস্থাপনার পর মডারেটর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জনমিতি বিভাগের প্রধান, আলোচনা ও প্রশ্নোত্তরের জন্য প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় রাখেন। অবশ্য মাঝে মাঝে ইংরেজি থেকে চীনা ভাষায় অনুবাদও অনেক সময় নিয়েছিল। যারা রাষ্ট্রীয় জনসংখ্যা বিভাগে কর্মরত এবং অর্থনীতির ছাত্রছাত্রী তারাই বেশি প্রশ্ন উত্থাপন করেন। সক্ষম দম্পতিদেরকে কীভাবে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা হয় তাদের ইচ্ছায় প্রাধিকার দিয়ে, একজোড়া সক্ষম দম্পতি কতটি সন্তান গ্রহণ করতে পারেন, কাফেটেরিয়া অ্যাপ্রোচ কী এবং গ্রহীতার কাছ থেকে স্থায়ী পদ্ধতি বা বন্ধ্যাকরণের পূর্বে কীভাবে সম্মতিপত্র গ্রহণ করা হয়, এসব নিয়েই তাদের প্রশ্নের আধিক্য ছিল।

আমাদের কর্মসূচির ভলানটারি প্রকৃতি এবং উদ্বুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া এবং দম্পতিদের সন্তান গ্রহণের সংখ্যার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার, এমনসব কথা তাদের কাছে অভিনব ও ব্যতিক্রমধর্মী বলে মনে হচ্ছিল। আমাদের স্লোগান, 'ছেলে হোক মেয়ে হোক, দুটি সন্তানই যথেষ্ট' এবং 'ছোট পরিবার সুখি পরিবার' তাদের খুব ভালো লেগেছে।

আলোচনা এমনই প্রাণবন্ত হল যে, মডারেটর একসঙ্গে ৫০ থেকে ৬০ টি হাত দেখে বিভ্রাটে পড়ে গেছিলেন। একটি গণতান্ত্রিক দেশের জনসংখ্যা কর্মসূচির মতো স্পর্শকাতর কর্মকাণ্ড সর্ম্পকে তাদের আগ্রহ দেখে মনে হয়েছিল, তারা গণচীনের নীতিতে পরিবর্তন চায়। সম্ভবত বর্তমানে কঠোর এক সন্তান নীতি থেকে বেরিয়ে আসা তারই ফলশ্রুতি।

সেবারের সফরে ঝিংঝিয়াং প্রদেশে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানেও বক্তব্য রেখেছিলাম। সেখানকার অংশগ্রহণকারীদের মৌলিক প্রশ্নের ধারা ছিল ভিন্ন। তাদের উৎকণ্ঠা ছিল উচ্চহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি অর্থনীতির উপর কীরূপ প্রভাব বিস্তার করছে এবং প্রগতির ধারা মন্থর করে দিচ্ছে কিনা তা নিয়ে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পরিকল্পনা ও জনসংখ্যা নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান হচ্ছে কীভাবে, তাও জানতে চাইল তারা। বাল্য-বিবাহ প্রতিরোধ, নারীর ক্ষমতায়ন এবং খাবার বড়ি-নির্ভর একটি কর্মসূচির সাফল্য নিয়ে তাদের সন্দেহ ছিল ব্যাপক। তবে সর্বত্র মনে হয়েছে, নিজেদের দেশের জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনা এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত বিধি-নিষেধ নিয়ে তাদের উৎকণ্ঠার শেষ নেই।

বাংলাদেশে যে জাতীয় জনসংখ্যা নীতি গ্রহণ করা হয়েছে এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে তা অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববাসীকে চমক দিয়েছে। সংক্ষেপে বলা হয়, প্রতিকূল পরিবেশে এক বিশাল সাফল্য (success under a challenging environment) এটি। বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির সঙ্গে উন্নয়নের ভাবনা সম্পৃক্ত করা হয়েছে। দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে গুরুত্ব দিয়ে, তথ্য ও জ্ঞানসমৃদ্ধ জনগণের উত্থানের চেতনায় প্রাধিকার দিয়ে এবং তার সঙ্গে সরকার ও সর্বস্তরের জনগণের সহযোগিতার মাধ্যমে বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩২ শতাংশে উপনীত হয়েছে, মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লক্ষে ১৯৪ তে হ্রাস পেয়েছে, মোট প্রজনন হার (নারী প্রতি) ২.৩ হয়েছে, শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৩৮এ নেমে এসেছে এবং পরিবার পরিকল্পনা গ্রহীতার হার ৬২.৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এছাড়াও, প্রতি হাজারে নবজাত শিশুমৃত্যুর হার ২৮ এখন। বড় কথা হচ্ছে, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে ৭০ বছরের অধিক হয়েছে, যেখানে গণচীনে গড় আয়ু ৮০ বছর।

একই সঙ্গে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা নেমে এসেছে ২৩.৫০ শতাংশে। নারীর ক্ষমতায়ন দৃশ্যমান হয়েছে এবং বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। এ সকল সাফল্যের অন্যতম কারণ সঠিক জনসংখ্যা ও মানবসম্পদ নীতি গ্রহণ, সরকারি খাতের সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি খাতের অবদান রাখার সুযোগ প্রদান ও সকল স্তরের মানুষের ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ।

গণচীন জনগণের জীবন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এবং প্রজনন-স্বাস্থ্য অধিকার উপেক্ষা করে যে অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছে তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রেখে, রাজনৈতিক অধিকার ও গণমানুষের বাকস্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রেখে জনগণের সহযোগিতায় ও উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে যে সাফল্য অর্জন করেছে তা অবশ্যই বিশ্বে একটি উদাহরণ, ব্যতিক্রমধর্মী সাফল্য।

বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. কৌশিক বসু ১৭ অক্টোবর, ২০১৫ পেরুর রাজধানী লিমায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের এক সভায় 'শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিস্ময়কর' বলে উল্লেখ করেন। এ সাফল্য ধরে রাখতে হবে এবং উন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটাতে হবে যে কোনো মূল্যে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যেন আমরা গর্ব করে বলতে পারি, স্বার্থক জনম মাগো জন্মেছি এই দেশে, স্বার্থক জনম আমার তোমায় ভালোবেসে।

ধীরাজ কুমার নাথ: সাবেক সচিব।