এ মানা যায় না, কিছুতেই না

আবেদ খান
Published : 5 Nov 2015, 06:10 PM
Updated : 5 Nov 2015, 06:10 PM

আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই পছন্দ করি– তা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা তাঁর ওপর যত ক্ষুব্ধই হোন না কেন, কিংবা তাঁর পদত্যাগ দাবি করুন না কেন। তিনি অতিশয় সজ্জন মানুষ। ফোন করলে ফোন ধরেন। কখনও ফোন ধরতে না পারলে পরে নিজেই ফোন করেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা; মানুষটাও চমৎকার; জনপ্রিয় নিজের এলাকায়; সংগঠক হিসেবে সুপরিচিতি।

কিন্তু কী করবেন তিনি? কী করার আছে তাঁর? এভাবে যদি ক্রমাগত একের পর এক 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা' ঘটতেই থাকে? এভাবে দিনে-দুপুরে লালমাটিয়ার প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের অফিসে ঢুকে পিস্তল ঠেকিয়ে ভয় দেখাল; তারপর তিন জনকে চাপাতি দিয়ে কোপাল; একজনকে গুলি ছুঁড়েও জখম করল। ওরা এ কথা বলেই ঢুকল যে, ওরা টুটুলকে মারতেই এসেছে। তারপর তিন জনকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়ে ওরা সদর্পে বেরিয়ে গেল, কিন্তু যাবার সময় শুদ্ধস্বরের অফিস বাইরে থেকে তালা মেরে দিয়ে গেল যেন কেউ সহজে ঢুকতে না পারে এবং আহতরা রক্তক্ষরণের কারণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

ঠাণ্ডা মাথায় কী নির্লিপ্ত হত্যাযজ্ঞ সাধনের প্রয়াস! বন্ধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একে 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা' বলে ভাবলেন।

ওই দিনই কাছাকাছি সময়ে আজিজ সুপার মার্কেটের তিন তলায় 'জাগৃতি' প্রকাশনীর স্বত্ত্বাধিকারী দীপনকে ঠিক একই কায়দায় কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যাই করা হল এবং ঘাতকরা একইভাবে 'জাগৃতি'র অফিসটায়ও বাইরে থেকে তালা ঝুলিয়ে চলে গেল। এটাও আরেকটা 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা'!

আরও দুটি 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা'র কথাও আমাদের বেশ খানিকটা বিচলিত করে ফেলল। দুর্গা পুজার সময়, সম্ভবত অক্টোবরের বাইশ তারিখে গাবতলীর পুলিশ চেকপোস্টে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে জঙ্গিবাদী ঘাতকরা এক নিরীহ পুলিশের প্রাণসংহার করল চাপাতি আর আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। আর এই নভেম্বরের চার তারিখে সকালবেলায় ওই হিংস্র ঘাতকরা আশুলিয়ার পুলিশ চেকপোস্টে পাঁচ পুলিশকর্মীর ওপর হামলা করল; একজনকে হত্যা করল; একজনকে গুরুতরভাবে আহত করল আর তিন জনকে চাপাতি দিয়ে তাড়া করল। তারপর মোটর সাইকেলে চেপে নিরাপদে-নির্বিঘ্নে চলেও গেল।

এই 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা'র ব্যাপারে মিতভাষী মিষ্টভাষী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, এই অতর্কিত হামলায় পুলিশ কিছু বুঝে ওঠারও ফুরসৎ পায়নি। তিনি আরও বললেন যে, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য ধারাবাহিকভাবে এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে।

হামলার ঘটনা যদি 'বিচ্ছিন্ন'ই হয়, তাহলে তা সুপরিকল্পিত হবে কীভাবে? আর যদি 'সুপরিকল্পিত'ই হয়, তাহলে তা 'বিচ্ছিন্ন' হল কী করে? এই সমন্বয়হীন পূর্বাপর অসঙ্গতিসম্পন্ন বক্তব্য প্রদান কিন্তু অস্থিরচিত্ততা ও বিচলিত হয়ে পড়ার লক্ষণ, মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অনুগ্রহ করে একবার কি ভাববেন, চেকপোস্ট কাকে বলে? কেন চেকপোস্ট বসানো হয়েছে? জঙ্গিদের কিংবা সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের অথবা সমাজবিরোধীদের শনাক্ত করা কিংবা পাকড়াও করে স্বাভাবিক জনজীবন নিরাপদ ও নিশ্চিত করার জন্যই তো?

পাহারাদারই যদি চাপাতি দেখে ভয়ে পালাতে গিয়ে নর্দমায় পড়ে যায়, কিংবা আহত রক্তাক্ত সঙ্গীকে ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ায়, তাহলে কী বার্তা পাবে সাধারণ মানুষ? কতখানি উল্লসিত হবে ঘাতকরা? চেকপোস্টে কি কারও কোনো অবস্থাতেই অসতর্ক হওয়ার সুযোগ রয়েছে? দুর্বৃত্তদের কেউ কেউ যদি আশেপাশে আগে থেকে ঘাপটি মেরে বসেই থাকে, তাহলে কী চেক করে চেকপোস্টের পাহারাদাররা?

প্রিয়ভাজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ধর্মান্ধ বিকৃত মানসিকতাগ্রস্ত খুনিরা চাপাতি হাতে মুক্তবুদ্ধির মানুষদের হত্যা করে যাবে একনাগাড়ে, আর আমাদের দেশের রাজনীতিকরা ব্লেইম-গেইমের সর্বনাশা খেলায় মেতে উঠবেন, তা কি হতে পারে? আপনিই বলুন। আপনি তো একজন আইনজীবী, একজন মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধুর একজন নিঃস্বার্থ সৈনিক এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো একটি দায়িত্বশীল মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী– আপনিই বলুন এ ধরনের দোষ-চাপানোর সংস্কৃতি থাকলে কীভাবে তদন্ত করা সম্ভব? ঘাতকদের খুঁজে বের করা সম্ভব? এর ফলে কি ঘাতকেরা পার পেয়ে যায় না? নতুন খুনের নেশায় কি উন্মত্ত হয়ে ওঠে না?

প্রিয় বন্ধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আপনিই বলুন কোনো ঘটনার এফআইআর করার পরমুহূর্তেই যদি ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে দেওয়া হয়, সেখানে কি তদন্ত বলে কিছু থাকে?

আমি তো বুঝি না, পুলিশের কি আত্মরক্ষা করার অধিকার নেই? তার কাছে অস্ত্র নেই? চাপাতি কিংবা অস্ত্রধারী জঙ্গিদের ঘায়েল করার অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি নেই? জঙ্গিরা খুন করেই যাবে আর পুলিশ ভয়ে পালাবে– এ কেমন রীতি?

কথায় আছে, 'বীরভোগ্যা এ বসুধা'। এ পৃথিবী বীর এবং সাহসীদের জন্যই তো নিরাপদ হবে, সাধারণ মানুষের বাসযোগ্য হবে! ধর্মান্ধ আর বিকারগ্রস্তদের হাতে কি দেশটাকে সমর্পণ করে দিতে হবে? ওরা মুক্তবুদ্ধির মানুষদের হত্যা করতে থাকবে আর আমরা 'মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আর একবার' স্লোগান দিয়ে মেদিনী কাঁপাব, রাজপথ দাপাব– এর কোনো মানে হয়?

আমরা তো দেখেছি বিগত নির্বাচনের সময় এবং তারপরে, একাত্তরের ঘাতকদের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে বারবার কীভাবে মানবতার বহ্ন্যুৎসব হয়েছে– পনের-বিশ জন পুলিশ, দশ-বার জন আনসার, জনাদশেক বিজিবি এবং সেনাবাহিনীর সদস্যকে প্রাণ দিতে হয়েছে। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হতোদ্যম না হয়, তাহলে এখন কেন জঙ্গিবাদের আস্ফালন নিশ্চিহ্ন করা যাবে না? এই মুক্তমনা মানুষদের ওপর হামলার বিরুদ্ধে– প্রকাশকদের ওপর– স্বাধীন সাহিত্যসেবীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে অনেক দিন পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির মোর্চা যখন গড়ে উঠেছে, তখন ভয় পেতে হবে কেন? পিছু হটতে হবে কেন?

আর কদিন পর আমাদের বিজয় দিবস। যে জাতির স্বাধীনতা দিবসের পাশাপাশি একটা বিজয় দিবসও থাকে, সে জাতি কি কখনও পরাজয়ের কলঙ্কতিলক ললাটে বহন করতে পারে?

আবেদ খান: সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ।