হাতিটি কিন্তু দেখা যাচ্ছে

ওমর শেহাব
Published : 5 Nov 2015, 04:14 AM
Updated : 5 Nov 2015, 04:14 AM

ইংরেজিতে একটি কথা আছে, 'দ্য এলিফেন্ট ইন দ্য রুম'। ব্যাপারটি এ রকম, কিছু মানুষ একটি ঘরে বসে আছে। সে ঘরের বেশিরভাগ জায়গাজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিশাল হাতি। সে শুড় নাড়াচ্ছে, কান নাড়াচ্ছে। কিন্তু ঘরের মানুষদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে, ঘরে তারা ছাড়া আর কিছু নেই। তারা সেই বিশাল জন্তুটিকে নিয়ে কথা বলছে না।

শুরুতে পাঠকদের জন্য একটি ছোট্ট কুইজ। আমাদের প্রথম সংবিধান, যেটি জনপ্রতিনিধিদের একটি সর্বদলীয় কমিটির সবাই মিলে তৈরি করেছিলেন, যেটিতে সাধারণ মানুষের মতামত নেবার জন্য কয়েক দিন ধরে ভাগ ভাগ করে পত্রিকায় ছাপানো হয়েছিল, সেখানে মূলনীতিগুলো কী ছিল?

জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।

কেন এগুলো? মুক্তিযুদ্ধের পরে দেশে খাবার নেই, টাকা নেই, রাস্তাঘাট ভাঙা, ত্রিশ লক্ষ সদ্য-খোঁড়া কবর– এত সব ব্যাপার থাকতে এই বায়বীয় ব্যাপারগুলো কেন মূলনীতিতে?

এর কারণ হল, যারা সংবিধান লিখেছিলেন, তাঁরা আসলে আমাদের কাছ থেকে ভবিষ্যতের বাংলাদেশটি ধার করেছিলেন। তারপর তারা এমন একটি ব্যবস্থা করেছিলেন যাতে আমরা তেতাল্লিশ বছর পরও তাদের জ্বালানো আলোতে পথ খুঁজে পাই। দেশে খাবার ছিল না, পরে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। টাকা ছিল না, এখন আমাদের রিজার্ভ উপচে পড়ছে। রাস্তাঘাট ভাঙা ছিল, এখন আমরা ঋণ ছাড়াই পদ্মাসেতু বানাচ্ছি। ত্রিশ লক্ষ শহীদের হত্যাকারীদের বিচারও চলছে। আমাদের শুরুর সমস্যার অনেকগুলো এখন আর নেই।

তার মানে এই নয় যে, নতুন সমস্যা তৈরি হবে না। নতুন সমস্যায় ভবিষ্যতের বাংলাদেশ যেন পথ হারিয়ে না ফেলে তার জন্যই আমাদের স্বাধীনতা প্রজন্মের মানুষেরা সেই মূলনীতিগুলো সংবিধানে রেখে গিয়েছিলেন।

যে প্রজন্ম আমাদের একটি স্বাধীন দেশ দিয়েছিল তাদের রেখে যাওয়া মূলনীতিগুলোর প্রতি কি আমরা সব সময় বিশ্বস্ত ছিলাম? যদিও ভীষণ লজ্জার ব্যাপার, কিন্তু এটি সত্যি যে, আমরা সব সময় বিশ্বস্ত ছিলাম না। তারা গণতন্ত্র দিয়ে গিয়েছিলেন আর জাতির পিতাকে হত্যার পর যখন সামরিক শাসক এল, তখন পত্রিকাগুলো সমস্বরে তোষামোদ করে সম্পাদকীয় ছাপিয়েছে। জাতীয়তাবাদ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আদিবাসী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংসদে মতপার্থক্য হলেও সেটি কোনো দিন বিদ্বেষে রূপ নেয়নি। আর আমরা পাহাড়িদের সংখ্যালঘু বানানোর জন্য সেখানে বাঙালিদের পুর্নবাসন করেছি! তারা সমাজতন্ত্র চেয়েছিলেন। আমরা কালো টাকা সাদা করা আইনসম্মত করেছি। তারা ধর্মনিরপেক্ষতা চেয়েছিলেন। আমরা বঙ্গবন্ধুের লাশের উপর দিয়ে এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব-ভিত্তিক রাজনীতি আবার বৈধ করেছি।

আজকে কোনো এক জাদুবলে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, সাত বীরশ্রেষ্ঠ আর অজস্র শহীদের আত্মার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে যায়, আর তাঁরা যদি আমাদের জিজ্ঞেস করেন, এই বাংলাদেশের জন্যই কি আমরা প্রাণ দিয়েছি, তখন আমরা কী বলব?

কী হবে তারা যদি আমাদের জিজ্ঞেস করেন, পাহাড়িদের অত্যাচার করার জন্যই কি আমরা পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়েছিলাম? তাদের কল্পনার বাংলাদেশে কি কালো টাকা সাদা করে রেহাই পাওয়ার কথা ছিল? রাষ্ট্রপরিচালনায় ধর্মবিশ্বাস থাকা বা না-থাকার কোনো ভূমিকা থাকার কথা ছিল? তাঁরা কি এমন রাষ্ট্র চেয়েছিলেন যেখানে মিলিটারি শাসক জেলের বাইরে জোটের অংশ হয়ে থাকবেন?

কী জবাব দিতাম আমরা তাদের?

আমরা বিভিন্ন সময়ে এই ভুলগুলো করেছি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুধরানোর চেষ্টাও করেছি। এ কারণে এখনও দেশটি মগের মুল্লুক হয়ে যায়নি। কিন্তু সব ক্ষেত্রে শুধরায়নি। আমাদের প্রথম প্রজন্ম স্বপ্ন দেখেছিলেন এই দেশের রাজনীতি হবে এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব-ভিত্তিক রাজনীতি থেকে মুক্ত। এখানে এমন কোনো রাজনৈতিক দল থাকবে না যেটি অন্য সব বিশ্বাসের উপর একটিমাত্র ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে। এতে তাদের এতটাই আপত্তি ছিল যে, এটি তারা আইন করে বন্ধ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, এর উপর সাধারণ মানুষের আস্থাও ছিল। এ কারণে ব্যাপারটি কোনো জনপ্রিয় আন্দোলনের মাধ্যমে বন্ধ হয়নি। বরং একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মিলিটারি শাসক এনে এই আইন বাতিল করে এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব-ভিত্তিক রাজনীতি আবার চালু করতে হয়েছে।

আজকের বাংলাদেশে 'এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম' হল এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব-ভিত্তিক রাজনীতির উত্থান। এটি সাধারণ মানুষ কখনও গ্রহণ করতে পারেনি। এ কারণে আমাদের নির্বাচনে ভোটাররা কখনও ভোটের সিদ্ধান্ত নেবার সময় ধর্মের বিষয়টি বিবেচনায় আনেন না। প্রত্যেক নির্বাচনেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায় যে ক্ষমতায় ছিল তার উপর মানুষের বিরক্তি কতটুকু। ইংরেজিতে একে বলে 'এন্টাই-ইনকামবেন্সি সেন্টিমেন্ট'। কিন্তু সমস্যা হল, আমাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এমন নয় যে, সব সময় ভালো মানুষরাই নেতৃত্বে উঠে আসবেন। খারাপ মানুষেরা প্রায়ই নেতৃত্বের বিভিন্ন পর্যায়ে চলে আসে।

ভালো রাজনীতিবিদরা অনেক পরিশ্রম করেন, মানুষের দরজায় ঘুরে ঘুরে জনসমর্থন নিয়ে আস্তে আস্তে নেতৃত্বের শীর্ষে উঠে আসেন। খারাপ রাজনীতিবিদরা এত কষ্ট করতে চান না। তারা চান শর্টকাট! সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশে ধর্মের চেয়ে শর্টকাট আর কী হতে পারে? ঘটনাচক্রে আমাদের দেশে এটি ইসলাম ধর্ম। একটু পশ্চিমে সীমান্তের ওপারে গেলে এই শর্টকাট হিন্দু ধর্ম আর পূর্বে বৌদ্ধ ধর্ম।

এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব-ভিত্তিক রাজনীতির মূল বিষয় খুব সহজ– আমি যে ধর্ম অনুসরণ করি সে ধর্ম অনুসরণকারীদের মর্যাদা বেশি হবে আর বাকিরা হবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। যারা একটু 'চাল্লু', তারা এত সরাসরি বলেন না– তারা বলেন, এ দেশে সবার সব ধর্ম পালন করার অধিকার আছে, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়া যাবে না (ধর্মানুভূতির সংজ্ঞা আর আঘাতের শর্ত সুবিধামতো নির্ধারণ করা হবে)। যারা একটু বেশি 'চাল্লু' তারা আরও ঘুরিয়ে বলে, এ দেশে সবার 'মিলেমিশে' থাকতে হবে, অর্থাৎ যারা সব ধর্ম পালন করার বা না-করার অধিকারে সমান সম্মান করে তারা এবং যারা অন্য সব ধর্মের চেয়ে একটি ধর্মের বেশি মর্যাদা দিতে চায়, তারা এই দুদল 'মিলেমিশে' থাকবে।

এই অতিবুদ্ধিমান শ্রেণি আবার এর একটি গালভরা নামও দিয়েছে– 'জাতীয় ঐকমত্য'। তাদের ভাব দেখে মনে হয়, ১৯৭১ সালের প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার, যেখানে সব দলের সদস্য ছিল, ১৯৭২ সালের সর্বদলীয় সংবিধান প্রণয়ন কমিটি এসবও জাতীয় ঐক্যমতের জন্য যথেষ্ট ছিল না। এখনকার এই অতিবুদ্ধিমান মানুষেরা যদি একাত্তরে থাকতেন তাহলে ১৬ ডিসেম্বরে বলতেন, 'যুদ্ধ শেষ হল, চল, এবার আবার পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তান মিলে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করি'! এসব সুশীল বুদ্ধিসমাজ চৌদ্দ ডিসেম্বরে কোনো সমস্যাতেই পড়তেন না।

আমাদের পূর্বপুরুষেরা কেন ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের জন্য জীবন দিয়ে গেছেন? কারণ এটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র আর ন্যায়ভিত্তিক সমাজের পূর্বশর্ত। সেটি কী? এ দেশের যে কোনো মানুষ তার ধর্মবিশ্বাস থাকুক বা না-থাকুক, সেটি কখনও নাগরিক হিসেবে তার অধিকার বা মর্যাদা নির্ধারণ করবে না। যে ধর্মের যে উপশাখার যতটুকু বিশ্বাসই তার থাকুক, রাষ্ট্র তাকে চিনবে শুধু একজন মানুষ হিসেবে। এটি কিন্তু খুব জটিল কিছু নয়। যে কোনো শিশুকেই যদি এটি জিজ্ঞেস করা হয়, সে বলব এটাই তো হওয়া উচিত। শিশুরা তো আর মিথ্যে কথা বলে না!

আমরা ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা সেই হাতিটি চিনতে পেরেছি। কিন্তু কারা ঘরের সেই মানুষ যারা এমন ভান করছেন যে, হাতিটি নেই? অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমার বলতে হচ্ছে, এটি হল আমাদের গণমাধ্যম যারা কিনা রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। এটি ঢালাও অভিযোগ নয়। আমি জানি, অসংখ্য মেধাবী সাংবাদিক আছে যারা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো তাদের সম্পাদকীয় নীতি কি কখনও প্রকাশ করেছে? তারা যদি সম্পাদকীয় নীতি প্রকাশ না করে তাহলে আমরা কীভাবে জানব সেই গণমাধ্যমের সম্পাদকমণ্ডলী কোন কোন আদর্শে বিশ্বাস করেন?

গণমাধ্যম হল মানুষের মতামতের প্রতিফলক আর বিনিময়-মাধ্যম। সেই প্রতিফলন আর বিনিময় কিন্তু অবাধে ঘটে না। গণমাধ্যমের সম্পাদকমণ্ডলী সিদ্ধান্ত নেন কোন মত (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সম্পাদকীয় বা উপসম্পাদকীয় হিসেবে) তারা প্রচার করবেন আর কোনটি করবেন না। যেহেতু তারা দাবি করেন তারা জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ, কাজেই কোন মত তারা প্রচার করেন আর কোনটি করেন না সেটি ঠিক হয় যে নীতিতে, সেই নীতিটুকু তাদের স্বচ্ছভাবে প্রকাশ করা উচিত।

আমরা কি জানি আমাদের কোনো কোনো সম্পাদক এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব-ভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন? আমরা কি জানি কোন কোন গণমাধ্যম ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করেন? আমরা যদি আমাদের সম্পাদকদের না চিনি, আমরা যদি না জানি গণমাধ্যমগুলোতে কীসের ভিত্তিতে মতামত প্রচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে আমরা কীভাবে বিশ্বাস করব যে, তারা দেশের জন্য যেটি ভালো সেটি করছে?

ঘটনাচক্রে যেখানে আমি এই লেখাটি দিচ্ছি সেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি তাদের আস্থা প্রকাশ করেছে অধ্যাপক আলী আনোয়ার সম্পাদিত বিস্মৃতপ্রায় গ্রন্থ 'ধর্মনিরপেক্ষতা'র নতুন সংস্করণ প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এজন্য আমরা সবাই তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু বাকিদের খবর কি আমরা জানি? যে সম্পাদকের কাছে তার পছন্দের ধর্মের পাঠকেরা অন্য ধর্মের পাঠকদের চেয়ে বেশি প্রিয় (এই ভালোবাসা সব সময় ধর্মবিশ্বাস থেকে আসে না, অনেক সময় শুধুমাত্র ব্যবসার জন্যও হতে পারে) তার ছাপানো উপসম্পাদকীয়গুলোর কাছে কি ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নিরাপদ?

যে প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্র ও সমাজের সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের সেতু তৈরি করে তাদের যদি আমরা বিশ্বাস করতে না পারি তাহলে কেমন করে চলবে? আর তারা যদি প্রকাশ্যে বৈষম্যমূলক যে কোনো রাজনীতির প্রতি অনাস্থা ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ না করে, তাহলে আমরা কী করে তাদের বিশ্বাস করব?

কিছুদিন পর পর মুক্তবুদ্ধির লেখকদের মেরে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু যে আদর্শ হত্যাকারীদের এসব কাজে অনুপ্রাণিত করছে সেই এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব-ভিত্তিক রাজনীতির অসারতা নিয়ে একটা উপসম্পাদকীয় কোনো পত্রিকার পাতায় নেই। ক্ষমতাসীন দলের একটি অঙ্গ সংগঠন হিন্দু ধর্মাবলম্বী বলে প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ চায়, ধর্মের অজুহাত দিয়ে শিশুকন্যাদের বিয়ে করার অধিকার দাবি করে কর্মসূচি দেয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যখন বিদেশ থেকে ফিরে আসেন তখন সিনিয়র সাংবাদিকরা সম্মেলনে এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন না। যেসব রাজনৈতিক দল তাদের গঠনতন্ত্রে সদম্ভে বাকিসব ধর্মের তুলনায় একটি ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে রেখেছে, সাংবাদিকরা কখনও তাদের নেতাদের জিজ্ঞেস করেন না এই ঘোষণার নৈতিক ভিত্তি নিয়ে।

এ অবস্থায় আমরা তো এই প্রশ্ন তুলতেই পারি, আমাদের গণমাধ্যমগুলো কি মুক্তিযুদ্ধের ফসল আমাদের প্রথম সংবিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি বিশ্বস্ত? কারা তারা যারা বিশ্বস্ত নয়? আমরা যখন কোনো পত্রিকা পড়ি আমরা যাদের চশমা দিয়ে পৃথিবীটাকে দেখি, সেই চশমার কাঁচ কতটুকু ঘোলা?

বাংলাদেশ হল সেই ঘর– এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব-ভিত্তিক রাজনীতির উত্থান হল সেই হাতি– আর গণমাধ্যম হল সেই মানুষেরা যারা ভান করছে হাতিটি ঘরে নেই।

লেখা এখানেই শেষ। আমার শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবালের মুক্তিযুদ্ধ ফিল্টারের জনপ্রিয়তা দেখে ভাবছি আমিও বোনাস হিসেবে পাঠকদের দুটি ফিল্টার দিয়ে যাই।

মুক্তচিন্তক লেখকদের যে হত্যা করা হচ্ছে তার পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার দুটি দিক আছে: প্রতিরোধ আর প্রতিকার। প্রতিরোধ মানে হল, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ করা। এসব ঘটনা ঘটছে। কারণ কিছু মানুষ এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব-ভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। ঘটনাচক্রে বাংলাদেশে সেটি হল ইসলাম ধর্ম। তারা আক্রমণগুলো করছে এমন সব মানুষদের উপর যারা কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব-ভিত্তিক রাজনীতির ভয়াবহ দিকগুলো সম্পর্কে অবহিত করে যাচ্ছিল। কারা এই ধরনের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে? বিএনপি, জামায়াত, আওয়ামী ওলামা লীগ, জাতীয় পার্টি এসব সংগঠন (কারও বিশ্বাস না হলে এসব দলের গঠনতন্ত্র পড়ে দেখে নিতে পারেন)। তাহলে আনসারুল্লাহ বাংলা, জেএমবি এরা কারা? এরা হল এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্- ভিত্তিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠার যে প্রচেষ্টা তার নিচের স্তরের শ্রমিক। এদের মাথা হল স্বীকৃত রাজনৈতিক সংগঠন, যাদের নাম একটু আগে বললাম।

প্রতিকার মানে হল ইতোমধ্যে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার জন্য দায়ীদের ধরা আর যারা ঝুঁকিতে আছেন তাদের নিরাপত্তা বিধান করা। প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল জিডি করে জানানোর পরও তাঁর কাজের জায়গায় এসে তাকে খুব আরাম করে আক্রমণ করে বেরিয়ে গেল। এর মানে, সরকার তাদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য যতটুকু দরকার ততটুকু করেনি। এ দায় পুরোপুরি সরকারের।

বেশিরভাগ মানুষ খুব আন্তরিকভাবে এসবের প্রতিবাদ করছেন। তারা প্রতিরোধ আর প্রতিকার দুটোই চান। কিন্তু অল্প কিছু দুনম্বর মানুষ আছেন যারা দুধরনের। এক দল, যারা সরকারের ব্যর্থতার ব্যাপারে সোচ্চার, কিন্তু এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব-ভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের ব্যাপারে (স্বাধীনতার পর পর যেমন ছিল) 'লা-জওয়াব'। এদের মূল উদ্দেশ্য সরকারবিরোধী আবেগ থেকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি। আরেক দল, যারা এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব-ভিত্তিক রাজনীতির ব্যাপারে সোচ্চার, কিন্তু সরকারের যে অবহেলা সেটির ব্যাপারে একদম 'লাজওয়াব'। সরকারের একজন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যখন রয়টার্সে নিজের মেরুদণ্ডহীনতার দায় তথাকথিত ধর্মভীরু সাধারণ মানুষের আবেগের উপর চাপিয়ে দেন, তখন তারা তার প্রতিবাদ করেন না। এরা প্রতিরোধে বিশ্বাসী, কিন্তু প্রতিকারে ব্যর্থতার দায় স্বীকারের সৎসাহস দেখান না।

যখন আমরা কারও প্রতিক্রিয়া দেখব, আমাদের এই দুটি ফিল্টার ব্যবহার করতে হবে। যে আটকে যাবে, তার কথা দ্বিতীয়বার পড়ে দেখতে হবে এটা জানতে যে, তার কোনো দুরভিসন্ধি আছে কিনা!

ওমর শেহাব: ডক্টরাল ক্যান্ডিডেট, ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড, বাল্টিমোর কাউন্টি; সদস্য, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটিজি ফোরাম (আইসিএসএফ)।