ইভিএম নিয়ে এগিয়ে যাওয়া কেন

Published : 24 July 2011, 03:52 PM
Updated : 24 July 2011, 03:52 PM
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত। এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং কেবলমাত্র সংবিধান ও সংশ্লিষ্ট আইনের অধীনে তা পালন করতে হবে। সাংবিধানিক এই গুরুদায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নির্বাচন ব্যবস্হাপনার প্রতিটি অনুষঙ্গের কার্যকারিতা প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করে চিহ্নিত বাঁধাসমূহ অপসারণ কমিশনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। উন্নততর পদ্ধতি ও প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও ব্যবহার তাই কমিশনের কর্মকৌশলের অন্যতম প্রধান উপাদান। এই প্রেক্ষিতেই কমিশন বিগত ২০০৯ সাল থেকে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিষয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে আসছে।

সার্কভুক্ত দেশসমূহের মধ্যে শুধু বাংলাদেশ ও পাকিস্তান বাদে আর সব দেশেই নির্বাচনে কাগজের ব্যালট ব্যবহারের পরিবর্তে ইভিএম–এর মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ব্যালট ব্যবহার শুরু হয়েছে। পাকিস্তানও তাদের আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে চায় এবং সে লক্ষ্যে তারা কিছু কাল পূর্বে ঐ মেশিন সংগ্রহের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্রও আহ্বান করেছে।

ভারতসহ সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশ যে ইলেকট্রনিক ভোট গ্রহণ পদ্ধতির প্রবর্তন করেছে তা আদৌ ই-ভোটিং নয়। ই-ভোটিং ব্যবস্হা তখনই প্রবর্তিত হয় যখন মেশিনগুলো একটি কম্পিউটার নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত হয়। এগুলো ইভিএম–এর চাইতে প্রযুক্তিগত দিক থেকে আরও উন্নত, বহুবিস্তৃত ও জটিল। বাংলাদেশে আমরা যেটা করার চেষ্টা করছি তা হোল ব্যবহারবান্ধব একটি কম্পিউটার পদ্ধতি উদ্ভাবন যা সহজেই পরিচালনা করা সম্ভব এবং যেটি ভোটকেন্দ্রের স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটারদের ভোট গ্রহণ, সংরক্ষণ ও গণনায় শতভাগ সন্তোষজনক সেবা প্রদানে সক্ষম।

ইভিএম–এর প্রোটোটাইপ উদ্ভাবনের জন্য ২০০৯ সালে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনষ্টিটিউট অফ ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজির পরিচালক অধ্যাপক এস এম লুৎফুল কবিরকে অনুরোধ করে। কিছুদিন পর তিনি একটি মডেল কমিশনের সামনে উপস্হাপন করেন এবং এটির পরিচালনা সংক্রান্ত খুঁটিনাটি মেশিনটি চালিয়ে দেখান। কমিশন ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত গ্রহণ করে এটিকে আরও উন্নত করা হয় এবং এই সংস্করণে ১০০টি মেশিন তৈরি করে কমিশন ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একটি ওয়ার্ডে এটি সাফল্যের সাথে ব্যবহার করে। ভোট শেষ হওয়ার আধা ঘন্টার মধ্যে ওয়ার্ডের ফলাফল ঘোষণা করা সম্ভব হয়।

বর্তমানে পরীক্ষাধীন ইভিএম দুইটি ইউনিট সমন্বয়ে গঠিত একটি কন্ট্রোল ইউনিট ও অপরটি ব্যালট ইউনিট। কন্ট্রোল ইউনিটটি ব্যালট প্রদান ও প্রদত্ত ব্যালট সংরক্ষণের কাজ করে। মূলতঃ এটিই মেশিনের মূল নিয়ন্ত্রক। প্রোগ্রাম সম্বলিত সফটওয়্যারটি কন্ট্রোল ইউনিটেই স্হাপিত আছে এবং এখানে OTP বা (one time programmable chip) ব্যবহার করা হয়েছে যাতে একবার প্রোগ্রাম তৈরির পর আর কেউ যেন অন্য কিছু এটির মধ্যে সঞ্চালন না করতে পারে। এই ইউনিটটি মূলতঃ কাগজের ব্যালট ও ব্যালট বাক্সকে প্রতিস্হাপিত করেছে। স্মার্ট কার্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এই ইউনিটটি সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং বিদ্যমান ক্ষেত্রে যেমন তিনি ব্যালট পেপার ইস্যু করে থাকেন, এক্ষেত্রেও তিনি ইলেকট্রনিক ব্যালট ইস্যু করবেন। কতজন ভোট দিচ্ছেন তা ভোট প্রদানের সাথে সাথে ব্যালট ইউনিটের সম্মুখভাগে স্থাপিত display–তে প্রদর্শিত হতে থাকবে যা ভোট চলাকালীন সময়ে সকল পোলিং এজেন্ট ও নির্বাচন কাজে নিয়োজিত ও বুথে অবস্হানকারী অনুমোদিত ব্যক্তিরা দেখতে পাবে।

ব্যালট ইউনিটটি কন্ট্রোল ইউনিটের একটি তারের মাধ্যমে সংযুক্ত। ব্যালট ইউনিটে প্রার্থীদের নাম ও প্রতীক সম্বলিত একটি কাগজ লাগানো থাকে আর প্রতিটি প্রতীকের পাশে একটি বোতাম থাকে। কন্ট্রোল ইউনিট থেকে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ব্যালট ইস্যু করলে একটি সবুজ সংকেত উভয় ইউনিটে জ্বলে উঠবে এবং ভোটার বোতাম টিপে তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন। ভোটার তার পছন্দের প্রার্থীর প্রতীকের পাশের বোতামটি টিপলে একটা প্রলম্বিত বীপ শোনা যাবে–সেটা শুনে আর প্রতীকের পাশের বাতিটি জ্বলা দেখে ভোটার বুঝতে পারবেন তার ভোট গৃহীত হয়েছে। একই সাথে বাইরের display–তে একটি সংখ্যা বেড়ে তখনকার ভোট সংখ্যা দেখা যাবে।

দেশের বিভাজিত ও সংঘর্ষপ্রবণ রাজনৈতিক অঙ্গনে নির্বাচন ব্যবস্হাপনায় নূতন কোন প্রযুক্তি কিংবা উদ্ভাবনী পদ্ধতি প্রবর্তন করতে গেলেই রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে সন্দেহের উদ্রেক হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বহু চড়াই উৎরাই ও বাঁধা পেরিয়ে বর্তমানে একটা স্থিতিশীল পর্যায়ে আছে। তবুও যে কোন নূতন উদ্যোগ সহসাই সবার সমর্থন পাবে সেটা আশা করা যায় না। ইভিএম–এর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। শুরু থেকেই অনেকে এটা সন্দেহের চোখে দেখছেন এবং যেহেতু এটা কম্পিউটারপ্রযুক্তি নির্ভর, তাই কম্পিউটারে যে সমস্ত অনাচার সম্ভব সেগুলো ভেবে ইভিএম সম্পর্কেও নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন ও বুয়েটের উদ্ভাবকরা এই সমালোচনা সম্পর্কে খুবই সচেতন। তাই এটি যেন সূক্ষ্ম কোন কারচুপির শিকার না হয়, সেজন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যেমনঃ

ক. এই মেশিনগুলো সম্পূর্ণভাবে ব্যাটারী চালিত এবং এগুলো দেশের যে কোন স্হানে ব্যবহার করা যাবে।

খ. এই মেশিনগুলো একেকটি একক ইউনিট (stand alone unit)। এগুলির একটির সাথে আরেকটির কোন আন্তঃযোগ থাকবে না। কেউ কোন অপকর্ম করতে সক্ষম হলেও তা ঐ দখলকৃত ইউনিটগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

গ. মেশিনগুলোর সফটওয়ারে OTP (one time programmable chip)ব্যবহার করা হয়েছে যেখানে কেউ চাইলেও অন্য কোন প্রোগ্রাম সঞ্চালন করতে পারবে না।

ঘ. কন্ট্রোল ইউনিট চালু করার জন্য দুটি স্মার্ট কার্ডের প্রবর্তন করা হয়েছে। একটি থাকবে প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে আর অন্যটি থাকবে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে। পোলিং বুথ দখল হওয়ার সময় এরা কার্ডগুলি নিয়ে সরে পড়লে দুর্বৃত্তরা কোন ভোট প্রদান করতে সক্ষম হবে না।

ঙ. কন্ট্রোল ইউনিটের সম্মুখভাবে স্থাপিত display–টি মেশিন চালু অবস্হায় ও ভোট চলাকালে অব্যাহতভাবে ভোট প্রদানের অবস্হা প্রদর্শন করতে থাকবে। display–তে কোন হেরফের দেখতে পেলে তদারককারী কর্মকর্তা কিংবা পোলিং এজেন্ট ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকগণ তড়িৎ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্হা গ্রহণ করতে সক্ষম হবে।

একথা অনস্বীকার্য যে বিদ্যমান ভোট প্রদান পদ্ধতিতে কমিশন যে সমস্ত অসুবিধাসমূহের সম্মুখীন হয়, সেগুলোর সবই যে ইভিএম ব্যবহারে সীমিত কিংবা দূরীভূত হবে তা নয়। বিদ্যমান ব্যবস্থায় কৃত অনেক দুষ্কর্মই ইভিএম–এর ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে। যেমন ভোটকেন্দ্র যদি দখল হয়ে যায় কিংবা কেন্দ্রের পোলিং ষ্টাফ এবং শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী যদি একজোট হয়ে ভোট কারচুপি করতে চায়, তবে ইভিএম–এর মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করা যাবে না। এটা নির্বাচন সংস্কৃতির সাথে জড়িত। এ ধরনের অপকর্ম ভোটার ও নাগরিক সচেতনতা এবং সামাজিক প্রতিরোধই দূর করতে সক্ষম।

তবে এই সমস্ত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ইভিএম প্রচলনের মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্হাপনা বহুলাংশে সহজতর ও কম ব্যয়সাপেক্ষ হবে। নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই সুবিধাগুলি সত্যিই বিপ্লবাত্মক যা সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। এখানে এ ধরনের উল্লেখযোগ্য কিছু সুবিধাদির বিষয় উল্লেখ করা হোলঃ

ক. ইভিএম–এর আয়ু ১৫ বছর। ও সময়কালে জাতীয় সংসদ, সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদসমূহের প্রতিটির পাঁচ বছর মেয়াদ হিসাব করলে তিন দফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমাদের প্রাথমিক প্রাক্কলনে দেখা গেছে যে কাগজের ব্যালটে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়, ইভিএম–এর প্রচলন করলে তার চাইতে বেশি ব্যয় করতে হবে না।

খ. ব্যালট পেপার মুদ্রণ, ব্যালট বাক্সের সিল, অফিসিয়াল সিল, মার্কিং সিল, ষ্ট্যাম্প প্যাড, হেসিয়ান ব্যাগ, মোমবাতি, ম্যাচ, গালা, ব্রাস ইত্যাদি বহুবিধ খুচরা মালামাল সরবরাহের জন্য কোন প্রথিতযশা সরবরাহকারী নাই। অল্পবিত্তের ব্যবসায়ীরা সাধারণতঃ টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে। এদের অনেকেই সময়কালে মালামাল সরবরাহে ব্যর্থ হয়ে উধাও হয়ে যায়। তাৎক্ষনিকভাবে পুনঃ দরপত্র আহ্বান করে এগুলো সংগ্রহ করা তখন অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাড়ায়। ইভিএম ব্যবহার করলে এসব মালামাল সংগ্রহের ঝক্কি–ঝামেলা দূরীভূত হবে।

গ. ইভিএম ব্যবহার করলে বৈধ ভোট, বাতিল ভোট, নষ্ট ও হারিয়ে যাওয়া ব্যালটের জন্য অসংখ্য ফরম পূরণ ও প্যাকেট ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। প্রিজাইডিং ও সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারদের জন্য তাদের কাজটি করা অনেক সহজসাধ্য হবে।

ঘ. যেহেতু কাগজের কোন ব্যালট থাকবে না সেহেতু ব্যালট পেপার টেম্পারিং, হারানো কিংবা ছিনতাইয়ের কোন সুযোগ থাকবে না।

ঙ. দিবালোকের মধ্যেই ভোটগ্রহণ ও ভোট গণনা সম্পন্ন করা সম্ভব হবে যার ফলে নির্বাচন কেন্দ্রে গণনাকালীন ও তৎপরবর্তী সময়ে সংঘটিত সহিংসতা ন্যূনতম পর্যায়ে নেমে আসবে এবং ক্রমান্বয়ে তা সম্পূর্ণভাবে অপসারিত হবে।

চ. ভোট বাতিল হওয়ার কোন সুযোগ নাই বিধায় এতদসম্পর্কিত দ্বন্দ্ব ও রেষারেষি শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। সহিংসতা বহুলাংশে হ্রাস পাবে।

ছ. ভোটারগণ দ্রুততম সময়ে ভোট দিয়ে কেন্দ্র ত্যাগ করতে পারবেন এবং ভোটগ্রহণের এক ঘন্টার মধ্যেই কেন্দ্রের ভোটগণনা শেষ হবে।

জ. মধ্য রাতের পূর্বেই সব ফলাফল ঘোষণা করা সম্ভব হবে।

ইভিএম নিয়ে নির্বাচন কমিশন এগিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী। স্থানীয় নির্বাচনগুলো থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে ইভিএম ব্যবহার বিস্তৃত করা হবে। এর জন্য গনসচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ব্যাপাক প্রচারের কাজও হাতে নিবে নির্বাচন কমিশন। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে দেশে যেখানে পাঁচ কোটিরও অধিক লোক মোবাইল ফোনের মতো একটি জটিল যন্ত্র ব্যবহার করে অভ্যস্হ, সেখানে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে ইভিএম–র ব্যবহার গ্রহণযোগ্যতা পাবে বলে আমার বিশ্বাস।

জুলাই ২৪, ২০১১

এ টি এম শামসুল হুদা: প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)।