অ্যামনেস্টির ধৃষ্টতা

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 29 Oct 2015, 10:18 AM
Updated : 29 Oct 2015, 10:18 AM

পশ্চিমবঙ্গের সাবেক অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র এক প্রবন্ধে লিখেছেন:

''ছোটবেলায় একটি দেশজ বাক্য প্রয়োগে চমকিত হয়েছিলাম, সেই সঙ্গে খানিকটা বিচলিত; তোর কথাগুলো শুনলে বুঝলি শ্রীমন্ত, পা থেকে চটিটা নিজের থেকেই খসে আসে।''

আমাদের সমাজে শ্রীমন্তদের সংখ্যা কিন্তু একেবারে কম নয়। এমন সব গা-জ্বলুনি কথা এদিক-সেদিক থেকে কানে আসে যে, রিপু দমনের চিন্তা কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু শ্রীমন্তদের আধিক্য বা পয়মন্ত হওয়া সত্ত্বেও আমরা শেষ পর্যন্ত জুতা পায়েই রাখি। এটা আমাদের বিশেষ গুণই বলতে হবে। শ্রীমন্ত-অধ্যুষিত সমাজে মাথা ঠাণ্ডা রেখে এই গুণ আয়ত্ত করতে পারা মোটেও সহজ সহজ কথা নয়।

তবে সম্প্রতি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বক্তব্য শুনে সেটা কঠিন হয়ে পড়ছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে বিচারপ্রক্রিয়া থেকে মুক্তি দিয়ে একাত্তরের স্বাধীনতাকামীদের বিচার চাইল এই তথাকথিত মানবাধিকার সংগঠন। তাদের বক্তব্য, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতা হওয়াতেই সাকা চৌধুরী ও আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদসহ অন্যদের মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। তাদের বিচার হলে 'একই রকম অপরাধে' কেন মুক্তিযোদ্ধাদের বিচারের আওতায় আনা হবে না সে প্রশ্নও তুলেছে সংগঠনটি। ফাঁসির রায় নিশ্চিত হওয়ার পরও তারা রিভিউ আবেদনের যে সুযোগ পেয়েছেন। ২ নভেম্বর সেটির শুনানির দিন চারেক আগে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে এ দাবি তোলা হয়।

এর আগেও সংগঠনটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে নানা কথা বলেছিল। কিন্তু এবার 'মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার' চেয়ে সংগঠনটি সব রকম শালীনতা, ভব্যতা ও নিরপেক্ষতার সীমা লঙ্ঘন করেছে। তাদের এই ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য নিঃসন্দেহে ক্ষমার অযোগ্য। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উচিত সংগঠনটির এই আপত্তিকর বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করা। আমাদের ব্যাপারে তারা যেন ভবিষ্যতে কখনও নাক না গলায়, তা নিশ্চিত করাও জরুরি। 'ভগবানের' ভূমিকা পালন করতে গিয়ে যারা 'শয়তান' হিসেবে আবির্ভূত হয়, তাদের সহজভাবে নেওয়া ঠিক নয়।

মনে রাখতে হবে, যুদ্ধাপরাধের বিচার আমাদের মানবিক দায়বদ্ধতার বিষয়। এটা কোনো প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য নয়– বরং ৩০ লাখ শহীদের রক্তের ঋণ শোধ, তাদের পরিবারবর্গের দুঃসহ যাতনা লাঘব, সভ্যতার বোধ প্রতিষ্ঠা এবং সর্বোপরি যুদ্ধ নামক অভিশাপ থেকে মানবজাতিকে মুক্ত করার জন্য। তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও বিচারের রায় কার্যকর করা জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী ক্ষুদ্র একটি অংশ ছাড়া সবাই চায় এ বিচার হোক ও রায় কার্যকর হোক।

কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে যখন থেকে এই বিচার ও রায় বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বাস্তব রূপ পেতে শুরু করে, তখন থেকে তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের নানামুখী কুটচালের শিকার হচ্ছে। আমরা দেখেছি, জামায়াতি টাকার কাছে (তাদের নিযুক্ত লবিস্টদের কাছে) পশ্চিমা মিডিয়া, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন কীভাবে বিক্রি হয়ে গেছে। জামায়াতি টাকা দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমাদের মুখে কথা বলছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে জামায়াতের সঙ্গী হয়েছে বিএনপি। জামায়াত-বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা বিদেশে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়েছে। তারা বিপুল অংকের অর্থের বিনিময়ে কিছু ব্যক্তি ও সংগঠন ভাড়া করেছে এই বিচার বিভিন্নভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য।

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার প্রণীত 'আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন'এ। আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল, টোকিও ট্রায়াল ও ম্যানিলা ট্রায়ালের মডেলে। তুলনা করলে দেখা যাবে, সে সব বিচারের ক্ষেত্রে যে আইন, নীতি ও বিধান অনুসরণ করা হয়েছিল, বাংলাদেশের আইন তার চেয়ে অনেক বেশি মানসম্পন্ন। তারপরও বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এই আইন সম্পর্কে বলা হচ্ছে যে, এতে যুদ্ধাপরাধীদের মানবাধিকারের বিষয়ে কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। আমাদের এ আইনে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে অভিযুক্তদের সুপ্রিম কোর্টে আপিলের যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তা ন্যুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রায়ালে ছিল না।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এতদিন 'মানবাধিকার রক্ষায়' মৃত্যুদণ্ড নিয়ে আপত্তি তুললেও এখন আর সে অবস্থানে নেই। এবারের বিবৃতিতে ওই প্রসঙ্গের পাশাপাশি বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেওয়ার সুপারিশ করেছে তারা। আলবদর ও রাজাকাররা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মিলে শুধু যুদ্ধরত মানুষদেরই হত্যা করেনি, হত্যা ও ধর্ষণ করেছে দেশের সাধারণ নিরপরাধ নাগরিকদের। এ রকম অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। অথচ অ্যামনেস্টি ওই অপরাধীদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মিলিয়ে ফেলেছে!

একাত্তরে আমাদের দেশের জনগণের ওপর চালানো নৃশংসতা মানবসভ্যতার ইতিহাসে একটি বিভীষিকাময় অধ্যায়। এ জন্য বিচার পাওয়া ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায্য অধিকার। কিন্তু শুরু থেকেই অ্যামনেস্টি বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। বাংলাদেশে একাত্তরের গণহত্যার দায়ে অভিযুক্তদের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলছে তারা। ওদিকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে রোজ ঘটে যাওয়া অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়ে কোনো ভূমিকা রাখতে তাদর দেখা যায় না। খুবই বিভ্রান্তিকর বিষয়!

আমরা বলব, ধৃষ্টতামূলক বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে অ্যামনেস্টিকে। বাংলাদেশের ওয়ার ক্রাইম ট্রায়াল ও একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে পক্ষপাতমূলক বক্তব্য রাখা বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশের জনগণ যখন তাদের হৃদয়ের দীর্ঘ ক্ষত সারাতে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আজ ঐক্যবদ্ধ, তখন যুদ্ধাপরাধীদের মানবাধিকারের নামে অ্যামনেস্টির মতো কিছু সংগঠনের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা জনপ্রত্যাশার বিরুদ্ধে।

বিশ্বের অন্যান্য স্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সরবতা না দেখিয়ে শুধুমাত্র একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের মানবাধিকার রক্ষায় অ্যামনেস্টি কেন এত সরব সে প্রশ্ন তোলাও জরুরি। প্রতিটি দেশের একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা আছে। আমরা যেমন মৃত্যুদণ্ড বিরোধীদের অবস্থান শ্রদ্ধার চোখে দেখি, ঠিক তেমনি তাদেরও আমাদের দেশের নিজস্ব বিচার ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত।

আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ এবং সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিচার এখনও শেষ হয়নি৷ তাদের রিভিউ শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে৷ এ সময় ফাঁসি কার্যকর হবার আশঙ্কা প্রকাশ করে অ্যামনেস্টি বাংলাদেশের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ও সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ করছে৷

প্রশ্ন হল, আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত ইরাকের নেতা সাদ্দাম হোসেনের বিচারে কত সময় নেওয়া হয়েছে? ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালেই-বা কী করা হয়েছে? গণহত্যার শিকার যারা হয়েছেন অ্যামনেস্টি তাদের জন্য বিচারের দাবি করছে না; কথা বলছে না বীরাঙ্গনাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে৷ যাদের বিরুদ্ধে সংগঠিতভাবে গণহত্যা ও ধর্ষণ চালানোর অভিযোগ, তাদের মানবাধিকারের কথা বলা কি প্রহসন নয়?

এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রত্যেক মানুষকে রুখে দাঁড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার লড়াই একই সঙ্গে পশ্চিমা দুনিয়ার এস্টাবলিস্টমেন্টের বিরুদ্ধে লড়াইও বটে।

হার্ভার্ডে পড়াশুনা করে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন গ্যারি বাস। তিনি একটি বই লিখেছেন, ব্লাড টেলিগ্রাম: নিক্সন, কিসিঞ্জার এবং একটি বিস্মৃত গণহত্যা । বাংলাদেশে একাত্তরে চালানো গণহত্যার ঐতিহাসিক সত্য এই বইতে উঠে এসেছে। বইটি ব্যাপক প্রশংসিত ও আলোচিত হয়েছে; পেয়েছে পুরস্কারও। পশ্চিমা দুনিয়ায় ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস গণহত্যার সম্পর্কে নীরবতার বিরুদ্ধে এ বই একটি উপযুক্ত দালিলিক প্রমাণ। পশ্চিমা এস্টাবলিস্টমেন্টের রক্ষক অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো সংগঠনগুলোর হর্তাকর্তারা কবে এসব বই পড়ে দেখবেন!

তবে পড়লেও কি ওরা সত্যটা মেনে নেবেন? নাকি মানবাধিকারের নামে চোখ বুজে অন্যায়ের সাফাই গেয়ে যাবেন? বরাবরের মতো?